X
বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
৫ আষাঢ় ১৪৩২

সৌন্দর্য সৃষ্টি করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকি

নীলাঞ্জন বিদ্যুৎ, আবু ওবায়েদ বিপ্লব, মাহমুদ সিমান
২৮ এপ্রিল ২০২২, ১৩:০০আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২২, ১৯:১০

হুমায়ুন আজাদের জন্ম ২৮ এপ্রিল ১৯৪৭, মৃত্যু ১২ আগস্ট ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, রাজনীতিক ভাষ্যকার, কিশোরসাহিত্যিক, গবেষক, এবং অধ্যাপক। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক লেখক যিনি ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারবিরোধিতা, যৌনতা, নারীবাদ ও রাজনীতি বিষয়ে তার বক্তব্যের জন্য ১৯৮০-এর দশক থেকে পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদের ৭টি কাব্যগ্রন্থ, ১২টি উপন্যাস ও ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৭টি ভাষাবিজ্ঞানবিষয়ক, ৮টি কিশোরসাহিত্য ও অন্যান্য প্রবন্ধসংকলন মিলিয়ে ৬০টিরও অধিক গ্রন্থ জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুপরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়। বলা যায়, বাঙলা ভাষায় তিনি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অপরিহার্য এবং ব্যতিক্রমধর্মী গ্রন্থিত বৈভবের যোগান দিয়েছেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নীলাঞ্জন বিদ্যুৎ, আবু ওবায়েদ বিপ্লব এবং মাহমুদ সিমান।

অর্কেস্ট্রা : আপনি এ পর্যন্ত প্রচুর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেগুলো থেকে নির্বাচিত অংশ নিয়ে ‘আততায়ীদের সঙ্গে কথোপকথন’ নামে একটি বইও বেরিয়েছে। এত সাক্ষাৎকার দেওয়ার পরও আবার আমাদের সাথে রাজি হলেন যে?
হু. আ. : (কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেসে) একসময় যখন আমার বয়স কম ছিল, তখন আমি প্রচুর নিম্নমানের সাক্ষাৎকার পড়েছি। তখন আমার সাক্ষাৎকার নিতে কেউ আসত না। কিন্তু একদিন আমারও সময় আসে, এবং প্রচুর সাক্ষাৎকার আমাকে দিতে হয়। সাক্ষাৎকারকে আমি কতটা পছন্দ করি তা ঐ ‘আততায়ীদের সঙ্গে কথোপকথন’ এ রয়েছে। (হেসে) বোধ হয়, বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে সাক্ষাৎকার আমিই সবচেয়ে বেশি দিয়েছি, সাহিত্যসমাজ ইত্যাদি সম্পর্কে। ইদানীং আমি অনেককেই নিষেধ করে দেই এবং রাজি হই না, এটা রাজি হয়েছি কারণ টেলিফোনে বলছ যে চট্টগ্রাম থেকে এসেছ, চট্টগ্রাম বা ঢাকার বাইরে থেকে যারা যোগাযোগ করে তাদেরকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করাটা খুব স্বস্তিকর বলে মনে হয় না। (হেসে) এখন মনে হচ্ছে রাজি না হলেই ভালো ছিল।

অর্কেস্ট্রা : আপনার নেওয়া সাক্ষাৎকার এবং দেওয়া সাক্ষাৎকার নিয়ে দুটো বই বেরিয়েছে, সাক্ষাৎকার সম্পর্কে আপনি কি ধারণা পোষণ করেন?
হু. আ. : পশ্চিমে যেসমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারের বই বেরিয়েছে সেখানে দেখা যায় যে, সাক্ষাৎকার নেওয়ার উপযুক্ত লোক হচ্ছেন তিনি, সাক্ষাৎকার যার নেওয়া হচ্ছে তাঁর সম্পর্কে সবকিছু ভালো জানেন। আমাদের এখানে প্রস্তুতি না নিয়েই সাক্ষাৎকার নিতে আসা হয়। ফলে এমন প্রশ্ন করে যেগুলো অনেক সময় খুবই হাস্যকর। আমিও কিন্তু কিছু সাক্ষাৎকার নিয়েছি যেগুলো সংকলিত হয়েছে ঐ সাক্ষাৎকার বইয়ে, সেগুলো দেখলে বোঝা যাবে যে আমি আগে কতটা প্রস্তুতি নিয়ে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছি। এত দীর্ঘ এবং বিচিত্র ধরনের সাক্ষাৎকার বাংলাদেশে এর আগে নেওয়া হয়নি। এটা শুধু আপনি কি পছন্দ করেন, কি খান ধরনের সাক্ষাৎকার নয়।

অর্কেস্ট্রা : সামগ্রিক বাঙলা কবিতায় মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এবং শক্তি এ চারজনকে মুখ্য স্থপতি হিসেবে বিবেচনা করা যায়?
হু. আ. : না, চারজনকে ধরে বলা যাক―খুবই ভুল মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে। সমগ্র বাঙলা কবিতায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম অন্তত পঞ্চাশ কি আশি জনের পরে আসবে। আমি সমগ্র বাঙলা কবিতার কথা যখন ভাবি তখন জন-বিশেকের কথা প্রথমেই মনে পড়ে। সম্ভবত ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’ বইটির ভূমিকায় আমি তাঁদের নামও উল্লেখ করেছি। আমাদের সেই প্রাচীনকাল থেকেই যদি ধরি তাহলে প্রথমেই আমাদের বড়ু চণ্ডীদাশের কথা ধরা উচিত, তারপর মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বৈষ্ণব পদাবলীর কয়েকজন কবি বিশেষ করে চণ্ডীদাশ, জ্ঞানদাশ, মুকুন্দ দাশ, বিদ্যাপতি আর আমাদের মনসামঙ্গলের দ্বিজ বংশীদাশকে ধরা যেতে পারে। তারপরে আঠারো শতকে ভারতচন্দ্রকে ধরা যেতে পারে। উনিশশতকে এসে কবি পাচ্ছি আমরা মধুসূদন দত্ত, বিহারী লাল চক্রবর্তী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরই বিশশতকে এসে নজরুলকে ধরা যেতে পারে। তারপর আধুনিক যে প্রধান পাঁচ যুবরাজ তাঁদের। এর পরই গুরুত্বপূর্ণ শামসুর রাহমান। শক্তি সম্পর্কে তরুণদের এক ধরনের ব্যাকুলতা রয়েছে, অনুরাগ রয়েছে, কিন্তু শক্তি আসলে খুবই গৌনকবি, যেমন আমার সংকলনে শক্তির কবিতা নিয়েছি বেশ কম এবং অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পড়েই নিয়েছি। শক্তি হচ্ছে মোটামুটি উন্মাদধারার কবি। যখন যা মনে আসে তা সে লিখতে পারে এবং তাঁর কাব্যের অর্থ-গভীরতা বিশেষ নেই। ছন্দের কিছুটা কারুকাজ রয়েছে এবং হঠাৎ কিছু চমকপ্রদ আকর্ষণীয় পঙক্তি তিনি লিখেছেন। আমার কাছে একে অত্যন্ত অব্যবস্থিত, অত্যন্ত উন্মত্ত মনে হয় এবং প্রধান কবি হওয়ার জন্য যে গভীরতা থাকা দরকার তা তাঁর কবিতার মধ্যে নেই।

অর্কেস্ট্রা : তাহলে মূল্যায়নের নামে তাঁর সম্পর্কে হইচই-ই বেশি হয়েছে?
হু. আ. : হইচই কত গৌণ শিল্পী, কবি, ঔপন্যাসিক নিয়ে সব সময়ই হয়েছে। এতে কিছু যায় আসে না। এক সময় সুকান্তকে নিয়ে প্রচণ্ড হইচই হয়েছে। নজরুলকে নিয়ে হইচই হয়েছে এবং এখনও মুসলমানেরা হইচই করেই চলেছে। জীবনানন্দকে একসময় স্বীকারই করা হয়নি আর শক্তি সম্ভবত সে-সময়ের, বাঙালি তরুণরা যখন মেধা থেকে অর্থাৎ গভীর উপলব্ধি থেকে দূরে সরে এসেছে, লঘু, হালকা কিছুটা চমকপ্রদ, উদ্ধত জিনিসকে পছন্দ করেছে সেই সময়ের জনপ্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কবিতার মধ্যে মাঝে মাঝে প্রবল পাগলামি এবং মাঝে মাঝে বানানো পাগলামিও লক্ষ করা যায়।

অর্কেস্ট্রা : দেশভাগের সময় বেশ কয়েকজন লেখক আবহমান শিল্পগত ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্যকে দ্বিখণ্ডিত করার কৌশল নিয়েছিল। এই অপকৌশলের পেছনে তাদের সুবিধা আদায় না মেধা দৌর্বল্য কাজ করেছিল?
হু. আ. : আমি বাঙলার মুসলিম সাহিত্যের ইতিহাস যতটা বুঝি, এমনকি বাঙালি মুসলমানের অবস্থা যতটা বুঝি, তাতে আমার মনে হয় সেই মধ্যযুগ থেকেই বাঙালি মুসলমানের দুটি ধারার উৎপত্তি ঘটেছে। একটি হচ্ছে মৌলবাদী মুসলমান ধারা আরেকটি মুক্তচিন্তার বাঙালি মুসলমান ধারা। এটা কিন্তু সেই মধ্যযুগ থেকেই চলে এসেছে, বলা যায় পরিমাণে কম ছিল। ক্রমশ রাজনৈতিক কারণে তা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে। এজন্য দেখা যাবে যে আমাদের কবিরা, মুসলমানদের কথাই বলছি তারা যে কবিতা লিখেছে তার মধ্যে একটা মুসলমানিত্বের ব্যাপার রয়েছে। এমনকি নজরুলের কবিতাও আমার কাছে প্রধানত মুসলমানের কবিতা মনে হয়। নজরুলের কবিতায় দেখা যাবে তিনি মুসলমানের ঐতিহ্য, মুসলমানের শব্দ এগুলো প্রবলভাবে নিয়েছেন, এমনকি তিনি যদি আরও কিছুকাল সুস্থ থাকতেন পাকিস্তান-আন্দোলনের সাথেও যুক্ত হতেন এবং হয়তো পাকিস্তানবাদী হয়ে যেতেন। তাঁর মধ্যে সেই প্রবণতা ছিল। তারপরে যখন পাকিস্তান-আন্দোলন খুব তীব্র হয়ে ওঠে, চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই দেখা যায় একদল প্রচণ্ড পাকিস্তানবাদী লেখক দেখা দিয়েছে যাদের অধিকাংশেরই কোনো প্রতিভা ছিল না। কিন্তু তারা পাকিস্তান, ইসলাম, মুসলমান ইত্যাদি নিয়ে প্রচণ্ড হইচই করেছে। এবং একটি পাকিস্তানবাদী কবিতার ধারা, সাহিত্যের ধারা জন্ম দিয়েছে, যে ধারা এখন পর্যন্ত মৌলবাদীরা বহন করে চলেছে। এই ধারার বিশেষ কোনো সাহিত্যমূল্য নেই। আমি এ ব্যাপারটি খুব বিস্তৃতভাবেই ব্যাখ্যা করেছি আমার ‘ভাষা আন্দোলন সাহিত্যিক পটভূমি’ বইটিতে। আমি দেখিয়েছি আমাদের যে সাহিত্য ষাটের দশকেই ব্যাপকভাবে শিল্পগুণ সম্পন্ন হয়ে ওঠে এবং আধুনিক হয়ে ওঠে, সেটা বাঙালি আধুনিক-আন্তর্জাতিক মানসিকতা সম্পন্ন লেখকেরা সৃষ্টি করেছেন। পাকিস্থানবাদী সাহিত্যের বিশেষ কোনো মূল্যই নেই। পাকিস্তানবাদীদের বলা যায় এরা গোঁড়া, মৌলবাদী, যেমন ফররুখ আহমদকে নিয়ে খুব মাতামাতি, ফররুখ আহমদ একজন অনাধুনিক, মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল কবি। আমি বোধ হয় কোনো একটি লেখায় তাকে বলেছিলাম ‘রাজাকারদের জাতীয় কবি’। তার রচনার বিশেষ কাব্যমূল্য নেই, কিন্তু পাকিস্তানবাদীদের কাছে এ-সমস্ত লেখাকেই খুব অসাধারণ বলে মনে হয়।

অর্কেস্ট্রা : আপনি বলেছেন, এদেশের প্রধান কবিরা পশ্চিম থেকে চুরি করে, ছোটরা নকল করে এবং মাঝারিরা আবর্তিত হয় নিজেদের মৌলিক মূর্খতার মধ্যে। আপনি নিজেকে কোন পর্যায়ে মনে করেন?
হু. আ. : (হেসে) আচ্ছা, আমাকে কি মনে হয় এটা স্পষ্ট করে বলা বোধ হয় ঠিক হবে না। তবে এটা উনিশশতক থেকে খুব স্পষ্ট। আমাদের প্রধান লেখক যারা তাঁরা পশ্চিম থেকে বিপুল পরিমাণে ধার করেছেন, সেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আধুনিককালের জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমান, এমনকি ষাটের দশকে যাঁরা ভালো কবিতা লিখেছেন তাঁরা অনেকেই। এঁরাই কিন্তু আধুনিক উনিশশতকের, বিশশতকের প্রধান পুরুষ এবং তাঁরা বাঙলা সাহিত্যকে শুধু একটি সংকীর্ণ সাহিত্যের মধ্যে রাখতে চাননি। লক্ষ করতে হবে যে বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস আমরা বলি হাজার বছরের কিন্তু উনিশশতকের আগে বাঙলা সাহিত্য ছিল অসম্পূর্ণ, এ ‘কথাটা আমাদের সব সময় মনে পড়ে না। অসম্পূর্ণ এই জন্য যে, উনিশশতকের আগে অর্থাৎ আট ‘শ বছরের সাহিত্য ছিল শুধু পদ্য, পদ্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সেখানে উপন্যাস লেখা হতো না। সেখানে নাটক লেখা হতো না। সেখানে মহাকাব্য লেখা হয়নি। সেখানে প্রবন্ধ এবং গদ্যসাহিত্যের উৎপত্তি হয়নি। ফলে উনিশশতকে বাঙলা সাহিত্য একটি সম্পূর্ণ সাহিত্য হয়ে উঠল যার সমস্ত শাখা-প্রশাখা রয়েছে। যে’টি প্রাচীন মধ্যযুগীয় সাহিত্যে ছিল না। এই যে বাঙলা সাহিত্য একটি সম্পূর্ণ সাহিত্য হয়ে উঠল, তার সমস্ত শাখা-প্রশাখা দেখা দিলো, এটা কিন্তু ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগের পর। আমরা ইউরোপীয় উপন্যাস পড়েছি, উপন্যাস লিখেছি, ইউরোপীয় ছোটোগল্প পড়েছি, ছোটোগল্প লিখেছে, Romanticism ইউরোপে যখন প্রবলভাবে বিকশিত হয়ে চলে গেছে আমাদের কবিদের মধ্যে দেখা গেছে ঐ আবেগ, যার প্রধান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার পরে আধুনিককালেও দেখা যাবে যে আমাদের ঔপন্যাসিকেরা ঐ ইউরোপীয় বা আন্তর্জাতিক চেতনার সঙ্গে খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হননি বলে বাঙলা উপন্যাস অনেকটা পিছিয়ে আছে কবিতা থেকে। জীবনানন্দ বা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বা বিষ্ণু দে যতটা আন্তর্জাতিক হয়েছেন, পাশ্চাত্যের সঙ্গে যতটা যুক্ত হয়েছেন, আমাদের তারাশঙ্কররা ততটা যুক্ত ছিলেন না। তাঁরা নিজেদের সমাজের সঙ্গে এবং নিজেদের সমাজের প্রচলিত সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত অনেকটা। ফলে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তাঁদের বিশেষ ঘনিষ্ঠ পরিচয়ও ছিল না এবং ঐ সংবেদনশীলতা তাঁরা বাঙলা সাহিত্যে প্রকাশও করতে চাননি। আবার নিম্নমানের অনেক লেখক কিন্তু পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে সরাসরি বহু কিছু নিয়েছেন, কিন্তু তারা কিছু সৃষ্টি করতে পারেননি প্রতিভাহীনতার জন্য। আর এই যে বিশাল লেখকশ্রেণি রয়েছে যারা আন্তর্জাতিক নন, যারা পাশ্চাত্য এবং বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই রাখেন না, তারা হয়তো বাঙলা সাহিত্যও ভালো পড়েন না এবং তারা তাদের মতো করে লেখেন। ঐ লেখার বিশেষ কোনো মূল্য নেই। বিশেষ করে চিন্তার ক্ষেত্রে, আমরা যখন আবেগ প্রকাশ করি তখন আবেগ একান্ত ব্যক্তিগত হলেও মূল্যবান হতে পারে। কিন্তু চিন্তার জন্য সারা পৃথিবীতে কোনো চিন্তাধারা চলছে, কী-কী চিন্তাধারার উদ্ভব ও বিলয় ঘটেছে এগুলোর সঙ্গে কিছু পরিচয় থাকা দরকার। এ-জন্য দেখা যাবে যে বাঙলা সাহিত্যে মননশীলতার শোচনীয় অভাব রয়েছে আর আমাদের বিশেষ করে চিন্তামূলক রচনা, প্রবন্ধ গবেষণা বা তাত্ত্বিক রচনা―এগুলো তীব্র শোচনীয়। কারণ আমরা নিজেরা মৌলিক চিন্তার জনক নই এবং পশ্চিমে যে বিচিত্র ধরনের চিন্তার উদ্ভব ঘটেছে, বিকাশ ঘটেছে, সেগুলোর সঙ্গে পরিচিত নই। যেমন রবীন্দ্রনাথের কবিতা কেন, প্রবন্ধের কথা ধরি―রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলো পড়ার সময় আমি বারবার বোধ করি পাশ্চাত্যের কোনো লেখকের ভাবনা তিনি কোনো প্রবন্ধে প্রকাশ করেছেন। এই যে ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ বলে উচ্চমাধ্যমিকে পাঠ্য একটি প্রবন্ধ রয়েছে যে’টি রবীন্দ্রনাথের একটি জনপ্রিয় এবং প্রধান প্রবন্ধ বলে গণ্য হয়, ঐটির মূল বক্তব্যও রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের নয়। এটিও রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে ইংরেজি ভাষার একজন প্রাবন্ধিকের বক্তব্য।

অর্কেস্ট্রা : আপনি এক প্রবন্ধে বলেছেন, সৈয়দ আলী আহসান ঈভান গলের কবিতা মেরে দিয়েছেন।
হু. আ. : এটা বলেছি নাকি? না, ‘মেরে দিয়েছেন’ এই ভাষা ব্যবহার করেছি কি না আমার সন্দেহ রয়েছে। আলী আহসান ইউরোপীয় অনেক কবির কবিতাই বাঙলায় নিজের নামে চালিয়েছেন এবং ঈভান গলের কবিতা বলে যে বইটি রয়েছে, ঈভান গল এবং ক্লারাগল এই বইটির অনেক কবিতাই প্রথমে আলী আহসান নিজের নামে ছেপেছিলেন, পরে আপত্তি ওঠায় তিনি স্বীকার করেন যে এগুলো অনুবাদ। তার অনেক রচনা যেমন ‘বাঙলা সাহিত্যের ইতহাস’-এ তিনি যে আধুনিক যুগের বিবরণ লিখেছেন এ’টি জে.সি. দত্তের Bengali Literature বইয়ের উনিশশত Chapter এর সরাসরি অনুবাদ। ফলে তাঁর লেখা অনেকাংশই মৌলিক নয়।

অর্কেস্ট্রা : আপনার সমসাময়িক যারা আছেন রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা পাঠকদের কাছে এঁদের অবস্থান কবি হিসেবে আপনার চেয়ে বেশি। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
হু. আ. : এর একটা বড় কারণ হচ্ছে আমাদের দেশে পাঠকরা কেন, সমালোচকরাও বহুমাত্রিক লেখকদের সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন। একজন লেখক যখন সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিকে চর্চা করে তখন তাকে ঠিকমতো শনাক্ত করা বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। যেমন আমি যদি শুধুই কবিতা লিখতাম, যে-ক’টি কবিতা আমি লিখেছি শুধু সে ক’টিই লিখতাম তাহলেও কিন্তু আমি কবি হিসেবে পরিচিত থাকতাম। আর যদি আমি শুধু কবিতা লিখতাম তাহলে আমার কবিতার পরিমাণ এখন যা আছে তার থেকে অন্তত তিন-চার গুণ বেশি হতো। আমি যেহেতু প্রচুর সমালোচনা লিখেছি, গবেষণা করেছি, উপন্যাস লিখেছি, শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছি এবং দুরূহ ভাষাতত্ত্বের চর্চা করেছি ফলে আমার অন্যদিকগুলো অনেকের চোখে বেশি পড়েছে এবং কবিতা নিয়ে আমি তাঁদের মতো শোরগোলও করিনি। কবি হওয়ার জন্য শুধু কবিতা যে কাজ করেছে এঁদের ক্ষেত্রে তা নয়। তাঁরা নানা রকম যোগাযোগ রেখেছেন এবং বিভিন্ন অঞ্চলে গেছেন―চট্টগ্রাম, বগুড়া বা খুলনা, এখানে বা সেখানে এবং তাঁদের নামের সঙ্গে সব সময় কবি ব্যবহার করা হয়। আমাকে নিয়ে অসুবিধা, আমি অধ্যাপক না ডক্টর না ভাষাবিজ্ঞানী না সমালোচক―কি লিখবে ভেবে কিছুই লেখে না। এঁদের নামের আগে কাগজের মধ্যে কবিই ছাপা হয় এবং এঁদের কবিতা আমার কবিতা থেকে এক অর্থে সরল কবিতাও বটে। যে কবিতা হয়তো পাঠকদের মনে সহজ সরলভাবে প্রবেশ করে। আমার কবিতা অধিকাংশ পাঠকদের কাছে সৌন্দর্য বোধের জন্য দুরূহই। ফলে এই বহুমাত্রিকদের নিয়ে সমস্যা হয় এবং বহুমাত্রিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন, সেই ক্ষতির শিকার আমিও।

অর্কেস্ট্রা : শামসুর রাহমান সম্পর্কে আপনি বলেছেন তাঁর প্রথম চারটি কাব্যগ্রন্থের পর আর না লিখলেও তিনি শামসুর রাহমান থাকতেন, আপনার ক্ষেত্রে এ ধরনের বলা যাবে কি?
হু. আ. : আমার কাব্যগ্রন্থ পাঁচটি। এই পাঁচটির পর আর যদি কবিতা লিখি জানি না আমার কি ধরনের বিকাশ ঘটবে, আমি এই পাঁচটিকে ছাড়িয়ে কতদূর যেতে পারব। তবে আমার অন্য লেখার মধ্যে আমার যে বিচিত্র রকম প্রকাশ ঘটেছে তাতে দেখা যায় সম্ভবত নির্দিষ্ট কোনো বইতে আমি সীমাবদ্ধ নই। আমার লেখা এখনো বিকশিত হচ্ছে এবং আমি উপন্যাস লেখা শুরুই করেছি অল্প কয়েক বছর আগে। আমার মনে হয় ভবিষ্যতে আমি আরো উৎকৃষ্ট উপন্যাস লিখতে পারব। তবে আমার এখন যেগুলো প্রকাশিত বই সেগুলোর কোনোটাই আমি বর্জন করার পক্ষপাতি নই। ভবিষ্যতে যেগুলো লিখব সেগুলোর কথাও আমি ভাবছি―যে সেগুলোও হয়তো আমার অন্য রকম বিকাশ ঘটবে। কবি শামসুর রাহমান একান্তভাবেই কবি। তিনি গদ্য লিখেছেন, উপন্যাসও লিখেছেন কিন্তু সেগুলোর কোনো মূল্য নেই। তিনি বিশেষভাবেই কবি এবং কবিদের সাধারণত দেখা যায় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থেই তাঁদের প্রতিষ্ঠা হয়। যেমন জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ মূল্যহীন, শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ একেবারে মূল্যহীন নয়, কিন্তু দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে তিনি প্রতিষ্ঠিত। আসলে শামসুর রাহমানের যে বৈশিষ্ট্য, সেটা কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। শামসুর রাহমানের যে মূল চরিত্র সেটা কিন্তু আর বদলায়নি। তাঁর ঐ দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, ‘রৌদ্র করোটিতে’ তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। যদিও এ’টি এখন আর বোধ হয় পড়া হয় না। আজকালকার পাঠক, যারা শামসুর রাহমানের নামে পাগল, তারা ‘রৌদ্র করোটিতে’ পড়ে বুঝবেও না এমনকি ভালোও লাগবে না। তারপর ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, ‘নিরালোকের দিব্যরথ’ এবং যদি আমরা ‘নিজ বাসভূমের’ কথা ধরি, এগুলোর মধ্যে শামসুর রাহমানের কিন্তু সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটে গেছে। এরপর হচ্ছে বিস্তৃতি। সেই একই আবেগ, উপলব্ধি বা কামনা-বাসনা এগুলোর বিচিত্রভাবে বিস্তৃতি লাভ ঘটেছে। মূল ব্যাপারটি কিন্তু ঐ কাব্যগ্রন্থগুলোয় ঘটে গেছে। তবে ঐ পাঁচটির পরে যদি তিনি আর না লেখতেন তাহলে তাঁকে সংকীর্ণ মনে করা হতো, কারণ এগুলোর মধ্যে তিনি বিস্তৃতি লাভ করেননি। এর পরে তাঁর আরো ৪৫টি কাব্যগ্রন্থ বোধ হয় বেরিয়েছে। ফলে বিচিত্র রূপেই তিনি আত্মপ্রকাশ করেছেন। মূল সংবেদনশীলতা কিন্তু রয়ে গেছে ঐ পাঁচটির মধ্যে।

অর্কেস্ট্রা : তাহলে কি এটাই দাঁড়াচ্ছে না যে সাহিত্যের ক্ষেত্রে কোয়ানটিটি নয় কোয়ালিটি মুখ্য―
হু. আ. : সেটা এক বাক্যে বলে দেওয়া সম্ভব নয়, যেমন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা খুব বেশি নয় এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মৌলিক কবিতার সংখ্যা বোধ হয় ১৪০ এর মতো। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এর পর আর লেখেননি। তিনি মনে করেছেন যে তার পক্ষে আর উৎকৃষ্ট কিছু সম্ভব নয়। কিন্তু ওর মধ্যেই তিনি একজন অসাধারণ কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তার কবিতা জনপ্রিয় না হতে পারে, সাধারণ পাঠক তার নাম না জানতে পারে, তাতে কিছু যায় আসে না। তাঁর কবিতা অত্যন্ত কাব্যগুণসম্পন্ন এবং আমি মনে করি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে অনেক-অনেক উৎকৃষ্ট কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং জীবনানন্দের ক্ষেত্রেও কিন্তু তাই। জীবনানন্দ আর দশ-পনেরো বছর আগেও বিবেচিত হতেন শুধুই কবি হিসেবে। এখন আমরা জানতে পেরেছি তিনি অনেক উপন্যাস লিখেছেন এবং গোপন রেখে গেছেন। তাঁর গবেষকরা আরো প্রচুর কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু সংগ্রহ না করলে কিছু আসত-যেত না। কারণ যে কবিতাগুলো সংগ্রহ করেছেন আমি পড়ে দেখেছি, সেগুলো বিশেষ মূল্যবান কবিতা নয় বরং জীবনানন্দের জীবিতাবস্থায় যে সাতটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছিল সেগুলোই জীবনানন্দের প্রধান কবিতা―যেগুলোর জন্য তিনি কবি, তাও সবকটা প্রয়োজন করে না; যেমন ‘বনলতা সেন’, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘রূপসী বাংলা’, এই চারটি হচ্ছে প্রকৃত জীবনানন্দ দাশ। মৃত্যুর পর ‘রূপসী বাংলা’ ছাড়া যে কবিতাগুলো বেরিয়েছে সেগুলো আসলে খুব অসাধারণ কবিতা নয়, এবং জীবনানন্দ তার নিজস্ব জগৎ থেকে একটু বিশ্বলোকে বেরিয়েছিলেন―বিশ্ব, সমাজ, জাতি, সভ্যতা সম্পর্কে ভেবেছিলেন, এগুলো খুব অসাধারণ হয়ে ওঠেনি। ফলে কম হলেই কিন্তু ক্ষতিকর নয়, যেমন ফরাসি কবি মালার্মের কবিতাসংখ্যা অনেকে বলেন যে একষট্টিটি বা কারোর মতে আবার তেপান্ন’টি―এত কম কবিতা লিখে তিনি সারা পৃথিবীকে প্রভাবিত করেছেন। ইলিয়টের কবিতাসংখ্যাও খুব বেশি নয়। ইলিয়টের ‘কালেকটেড পয়েমস’ দেখলেই বোঝা যাবে, যে খুব বেশি কবিতা তিনি লেখেননি। কিছু কাব্যনাটক তিনি লিখেছেন; তার মধ্যে প্রচুর কবিতা রয়েছে, ফলে আমাদের এখানেও একটা রীতি তৈরি হয়ে গেছে যে কবিদের হাজার-হাজার কবিতা লিখতে হবে; তা যত বাজে কবিতাই হোক না কেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ প্রচুর কবিতা লিখেছেন, তাঁর একটি কবিতার সংগ্রহ আমি এ বছর সম্পাদনা করছি। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কবিতা আমি পড়েছি। দেখলাম পঁয়ষট্টি বছরের পর তিনি যা লিখেছেন ওগুলো বিশেষ মূল্যবান নয়। তিনি গদ্য-কবিতা লিখেছেন, কাহিনি বলেছেন কিছু বর্ণনা দিয়েছেন, কিছু চমকপ্রদ কথা বলতে চেয়েছেন, কিন্তু সেগুলো আর কবিতা হয়ে ওঠেনি। মাঝে মাঝে দু-একটি যে হয়নি আমি বলছি না, কিন্তু বিপুল পরিমাণ কবিতার লিখিত রচনা হচ্ছে নিতান্ত শব্দবিন্যাস―যেমন শামসুর রাহমানের এখন যা করেছেন। এগুলো পদ্য হচ্ছে। তিনি জানেন। শব্দ, ছন্দ ইত্যাদির ওপর তাঁর দখল আছে। তিনি নানারকমের পদ্য লিখেছেন কিন্তু আমরা বলছি যে এগুলো কোনো না কোনোভাবে তাঁর আগের কবিতায় প্রকাশিত হয়ে গেছে।

অর্কেস্ট্রা : অনেকে বলতে চাচ্ছেন ‘নারী’-তে ব্যবহৃত রেফারেনসগুলো বেশ পুরানো―
হু. আ. : আমাদের এখানে বহু অশিক্ষিত মানুষ আছেন যারা এ ধরনের কথা বলে থাকেন। ‘নারী’ বইটিকে বোঝা দরকার, যে এ’টি কি এবং বাঙলা ভাষায় এর অবস্থানটি কোথায়। আমি যখন এই বইটি লেখার কথা ভাবি তখন আমি কি লিখব তার একটা পরিকল্পনা আমাকে করতে হয়েছে―সেটা হচ্ছে যে নারীবাদের ব্যাপারটি বাঙলা ভাষায় অপরিচিত। নারী সম্পর্কে ইউরোপে যে নতুন মূল্যায়ন করা হচ্ছে, সে মূল্যায়ন বাঙলা ভাষায় কিছু করা হয়নি। ফলে আমার লক্ষ হচ্ছে একটি ঊণের মধ্যে সম্পূর্ণ ব্যাপরটিকে ধারণ করা। আমি যদি শুধু আধুনিক নারীবাদিদের কিছু কথা লিখতাম তাহলে এটা একটি পূর্ণাঙ্গ বই হতো না। এটা এমন নয় যে আমি ছোট্ট একটি এলাকা বেছে গবেষণা লিখেছি, যে’টা গবেষকরা লিখে থাকেন। যেহেতু বাংলা ভাষায় এর আগে নারী সম্পর্কে নতুন ভাবনা থেকে কোনো বই লেখা হয়নি, নারীদের ব্যাপারটি উপস্থিত হয়নি; নারীর অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা হয়নি, ফলে সম্পূর্ন ব্যাপারটিকে একটি বইয়ের মধ্যে নিয়ে এসেছি। যার ফলে আমাকে সেই প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিককাল পর্যন্ত নারীদের সম্পর্কে বিভিন্ন প্রধান ব্যক্তি, ধর্মগ্রন্থ, বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং নারীবাদীদের রচনার পরিচয় দিতে হয়েছে অর্থাৎ যাতে সামগ্রিকভাবে এই ব্যাপারটি উঠে আসে। আর অতি সাম্প্রতিক আমি যখন লিখছিলাম তখন (১৯৯০) পর্যন্ত বাংলাদেশে আধুনিক পাশ্চাত্য নারীবাদের যে-সমস্ত বইপত্র পাওয়া যেত আমি তা সবই ব্যবহার করেছি। মূল্যবান বই চিরকালই মূল্যবান, যেমন মেরি ওলস্টোনক্রাফট’র বই, ভিন্টিকেটস অফ দি রাইট অফ ওমেন। বাঙলা ভাষায় নারীবাদ সম্পর্কে একটি বই যা―প্রথম বিস্তৃতভাবে লেখা হয়েছে, তাতে ওই বইটির কথা থাকতেই হবে, পরিচয় দিতেই হবে। আমি শুধু কয়েকজন সাম্প্রতিক নারীবাদীর চিন্তা-ভাবনার পরিচয় দিতে চাইনি। আমি সামগ্রিকভাবে ব্যাপারটিকে তুলে আনতে চেয়েছি। আমার মনে হয়েছে এটি উপকারী বইও হয়েছে। আমি কিন্তু উপকারিতার কথাও মনে রেখেছি, শুধু মৌলিক গবেষণা করতে চাইনি। আমি সামগ্রিকভাবে ব্যাপারটিকে তুলে আনতে চেয়েছি। আমার মনে হয়েছে এটি উপকারী বইও হয়েছে। আমি কিন্তু উপকারিতার কথাও মনে রেখেছি, মৌলিক গবেষণা করতে চাইনি। পাঠক যাতে নারীর অবস্থা সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ ধারণা লাভ করে সে লক্ষ্যেই আমি কাজ করেছি। এটাই যে সম্পূর্ণ ধারণা তা নয়, এর বাইরেও আরো ধারণা রয়েছে, সেগুলো অন্যলেখকরা লিখবেন। আমাদের বাংলাদেশে একটি সমস্যা হচ্ছে যেহেতু এখানে জ্ঞানচর্চা হয় না, সেজন্য কোনো কোনো বিষয়ে একজন লেখককেই লিখতে হয়। যেমন আমি একটি বই লিখেছি ‘বাক্যতত্ত্ব।’ এটি বাঙলাভাষায় একমাত্র বই বাক্য সম্পর্কে। ইংরেজি ভাষায় এরকম বই কয়েক হাজার লেখা হয়েছে, ফরাসি ভাষায় কয়েক হাজার লেখা হয়েছে; এবং ঠিক নারী সম্পর্কে যে বইটি আমি লিখেছি এমন বই ইউরোপ, আমেরিকায় কয়েক হাজার লিখা হয়েছে কিন্তু বাঙলা ভাষায় রচিত হয়েছে একটি। সমস্যাটা আমার নয়, এটা হচ্ছে সমগ্র বাঙালি জাতির সমস্যা যে- বাঙালি জাতি জ্ঞানচর্চা করে না। বাঙালি জাতির উচিত ছিল এর মধ্যে নারী ও নারীবাদ সম্পর্কে কয়েকশ বই লেখা, তাহলে সমস্ত দিক উঠে আসত।

অর্কেস্ট্রা : আপনার উপন্যাস এবং ছোটগল্পগুলোতে কবিতার সূক্ষ্ম বা কোমল অনুভূতির বিস্তৃতি দেখা যায়...
হু. আ. : আসলে আমার লেখা তা ভাষাচর্চা হতে পারে, মূল ব্যাপার হচ্ছে আমি যখন লিখি তা কিন্তু এক ধরনের সৌন্দর্য সৃষ্টি। যদি আমার ‘বাক্যতত্ত্ব’ কেউ পড়ে তাহলে বুঝতে পারবে এটি ঐ প্রথাগত গবেষণার মতো লিখিনি। আমার সমাজ, রাজনীতি-বিষয়ক যে কলাম-প্রবন্ধ, এটা পড়ার সময় বুঝতে হবে যে, আমি সাংবাদিকের মতো লিখিনি। সৌন্দর্য সৃষ্টি করা, বিশেষ করে ভাষায় সৌন্দর্য সৃষ্টি করার ওপর আমি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আমি যখন উপন্যাস লিখেছি, আমি স্থূল বাস্তবতার উপাখ্যান লিখতে চাইনি―আমি নবম ও দশম শ্রেণির ছেলেমেয়েদেরকে তুষ্ট করার জন্য উপন্যাস লিখিনি। আমার উপন্যাসের মধ্যে স্থূল বাস্তবতা নাই। আমাদের দেশে এটা খুব প্রশংসিত ব্যাপার স্থূল বাস্তবতাবাদ। যেটা ইউরোপে অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে। আমাদের দেশে এখনও স্থূলভাবে গ্রামের গরিবদের নিয়ে টেনে-টেনে অপাঠ্য উপন্যাস লেখা হয়, যে কাজটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস করেন। আমি জানি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বই কেউ পড়ে উঠতে পারে না, কিন্তু এটাকে একটা ভালো বই বলে প্রশংসা করার রীতি দাঁড়িয়ে গেছে। আমার উপন্যাস সম্পর্কে কেউ কেউ যখন আপত্তি করে, আমি বলি এই বইটি প্রথম পড়বেন আপনি এইভাবে, যে এটা একটা শিল্পসৃষ্টি। আপনি যখন চিত্রকলার দিকে তাকান তখন আপনি ওইটার সৌন্দর্যটি দেখবেন। আমার উপন্যাসেও পড়তে হবে তার বিষয় প্রথমে বাদ দিয়ে, বিষয় তো থাকবেই। এই যে একটি রচনা লেখা হয়েছে এটি একটি শিল্পসৃষ্টি হয়েছে কি না, তার ভাষায়, তার প্রকাশ রীতিতে, তার সমস্ত কিছু মিলে, এটা কিন্তু আমি করে থাকি। এটা আমার স্বভাবের মধ্যে রয়েছে যেমন ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, অনেকে এটার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন, অনেকে এসে আবার নিন্দাও করেন। কিন্তু আমি বলি যে আপনি প্রথমে পড়ুন এটি একটি ভাষার সাহায্যে শিল্পসৃষ্টি হয়েছে কি না। তারপর বিষয় আছে, আমার প্রবণতা আছে। আমার ব্যাখ্যা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, নাও হতে পারে। উপন্যাসের এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্যতার ওপর বিশেষভাবে নির্ভর করে না, আবার অনেকটা নির্ভর করেও বটে। আর কবিত্বের ব্যাপারটি আমি যেহেতু আবেগ বা অনুভূতি বা উপলব্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি, সেই জন্য এর মধ্যে অবশ্যই কাব্যগুণসম্পন্ন পঙক্তি এবং স্তবকের বোধ হয় অভাব নাই। কিন্তু এগুলোকে আবার আমি ভাবালুতায় পর্যবসিত করতে চাইনি, আর এই বইগুলোর বড় বৈশিষ্ট্য অবশ্যই তার গদ্য। যা আমাদের দেশের উপন্যাসগুলোতে পাওয়া যাবে না। এর চূড়ান্ত রূপগুলো পাওয়া যাবে আমার দুটি কি তিনটি ছোটগল্পের মধ্যে। ‘জাদুকরের মৃত্যু’র মধ্যে। বিশেষ করে ‘মহান শয়তান’ এবং ‘জাদুকরের মৃত্যু’ এই দুটো গল্পের মধ্যে আমি গদ্য এবং কবিতার মিশ্রণ ঘটাতে চেষ্টা করেছি। আর আমার সমস্ত রচনাই আসলে এক ধরনের সৌন্দর্য সৃষ্টি, এটা মনে রাখা দরকার।

অর্কেস্ট্রা : আপনার সমালোচনাগ্রন্থ ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’কে আল মাহমুদ তাঁর একটি বইয়ে (কবির আত্মবিশ্বাস) ‘বাজে কথার জঞ্জাল’ বলেছেন। জবাবে কি বলবেন?
হু. আ. : আল মাহমুদ খুব অমার্জিত রুচির মানুষ এবং অশুভ মানুষও বটে। সে যেকোনো কিছু সম্পর্কে যেকোনো কিছু বলার অধিকার রাখেন। সে আর ও বলুক।

অর্কেস্ট্রা : আপনার মধ্যে কিছু স্ব-বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে, যেমন―নজরুলকে একদিকে প্রতিক্রিয়াশীল বলেছেন অন্যদিকে বাঙলা ভাষাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন―‘তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম’। নির্মলেন্দু গুণকে একদিকে বলেছেন মস্ত অকবি অন্যদিকে আপনারই সম্পাদিত ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’য় গুণের একাধিক কবিতা নিয়েছেন। এক লেখায় বলেছেন, ‘প্রভু-ট্রভু বিশ্বাস করি না’ অন্যদিকে একটি কবিতায় বলেছেন―যে সাধনায় মানুষেরা স্রষ্টাকে গাঢ় কাছে পায়।
হু. আ. : (হেসে) এগুলো আসলে যে স্ব-বিরোধিতা এমন নয়, এগুলোকে আমি ব্যাখ্যা করে দিতে পারি যে কেন এটা এসেছে।

প্রথম নজরুল প্রসঙ্গে আসা যাক...
আমার কবিতা উৎসবে পড়া প্রবন্ধে সম্ভবত এ’রকম একটি মন্তব্য ছিল যে নজরুল বিদ্রোহী। বাল্যকাল থেকেই তিনি যে জীবন-যাপন করেছেন এর জন্য বিদ্রোহের ব্যাপারটাকে তার আয়ত্ত করার দরকার করেনি। এটা তাঁর সহজাত। কিন্তু বোধ হয় এরকম একটি মন্তব্য ছিল যে, নজরুলের কবিতা প্রতিক্রিয়াশীলতার জয়গানে মুখরিত। এটা আমি নজরুলের কবিতা ঘেঁটে-ঘেঁটে দেখাতে পারি যে নজরুল কত প্রতিক্রিয়াশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। নজরুলের চিন্তাধারা আবেগের একটি বড় অংশ দখল করে আছে ধর্ম। নজরুল ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছেন, অবশ্য ‘ভগবান’ শব্দটি ব্যবহারে তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি সেখানে বলেননি ‘আল্লাহর বুকে’। তাহলে তাকে তখনই খুন করা হতো। তিনি আল্লাহ বলেননি এটা আবার বাঙালি মুসলমানদের আত্মরক্ষার একটি কৌশল। যখনই বিপদ দেখে তখন হিন্দু, ঈশ্বর বা ভগবান ব্যবহার করে, আল্লাহ বাদ দিয়ে দেয়। আমি কিন্তু যেখানে বোঝাতে চেয়েছি সেখানে আল্লাহই লিখে দিয়ে দিয়েছি আমি কিন্তু স্পষ্ট লিখে দিয়েছি। সেই নজরুল যখন গান লেখেন যে মসজিদের পাশে আমায় কবর দিও ভাই, আমাকে নিয়ে ভাই মদিনায়। তারপরে তিনি কুরআন অনুবাদ করেন। আমি আর বিস্তারিত যেতে চাই না। তাঁর রচনা ঘেঁটে-ঘেঁটে দেখানো যেতে পারে যে কত প্রতিক্রিয়াশীলতার মধ্যে নজরুল ছিলেন। এমনকি যেগুলো তাঁর প্রগতিশীলতার উদাহরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয় সেগুলোও কিন্তু প্রগতিশীল নয়। আমাদের ব্যাখ্যাকাররা খুবই নিম্নমানের ভিতরে ঢুকতে পারেন না। যেমন ধরা যাক―‘অর্ধেক তার করিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী’। এ কবিতাটিতে নারীর নাকি জয়গান গাওয়া হয়েছে। কিন্তু এ কবিতাটি ভালো করে পড়লে বোঝা যাবে এখানে নারীর কোনো জয়গান গাওয়া হয়নি। এখানে পুরুষের আধিপত্যকেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ওখানে পংক্তি আছে―‘রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন রাজারে শাসিছে নারী’। এটা একটা ভাওতা। রাজা রাজ্য শাসন করছে, নারী নাকি রাজাকে শাসন করে। কোথায় নারী শাসন করে? ক’জন নারী শাসন করতে পেরেছে? এবং রাণীর শাসনে রাজা কয় বছর থেকেছে? বার-বার রানি বদল হয়েছে। এমনকি দেখা গেছে ইতিহাসে রানি থেকে উপপত্নীরাই বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে এগুলো হচ্ছে ভাওতা। নজরুল যে খুব প্রগতিশীল কবি এমন নয়, কিন্তু নজরুলকে নিয়ে আমাদের একটি সমস্যা হচ্ছে নজরুলকে প্রশংসা না করলে আমাদের নানা রকম অসুবিধা হয়। সমাজ, রাষ্ট্র আমাদের নানা রকম অসুবিধায় ফেলে দেয়। ফলে নজরুলকে প্রশংসা করা একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্মরক্ষার জন্য। নজরুল যদি খুব বেশি প্রগতিশীল হতেন, তাহলে পাকিস্তান সরকারের দেওয়ার কথা নয়। তারপর আসে বিদ্রোহের কথা। তাঁর সেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এবং তার বহু কবিতার মধ্যে যে বিদ্রোহ রয়েছে এটা তো আমি জানি। বিশেষ করে বাল্যকালকে আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলো খুবই নিয়ন্ত্রণ করে। ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে আমরা যে কবিতাগুলি পড়েছি, যেগুলো ভালো লেগেছে, যে কবিদের ভালো লেগেছে, তাদের জন্য চিরকাল একটি অনুরাগ কিন্তু থাকে। এবং নজরুলের ঐ যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রয়েছে বলা যাক বাঙলা ভাষায় অনন্য একক কবিতা কোনো সন্দেহ নেই। ফলে আমি যখন বাঙলা ভাষা নিয়ে কবিতাটি লিখছিলাম তখন―‘তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম’ বা ‘তোমার অশ্রুবিন্দু জীবনানন্দ’ এগুলোকে আমি চিত্রকল্পের পর চিত্রকল্পে পরিণত করছিলাম। তখন বিদ্রোহের চিত্রকল্পরূপে কাকে আঁকব? নজরুলকেই আনতে হয়।

অর্কেস্ট্রা : সুকান্তকে আনা যেত না?
হু. আ. : সুকান্ত বিদ্রোহী, কিন্তু নজরুলের মতো আকাশচুম্বি নয়। সুকান্ত আবার নজরুলের মতো স্ব-বিরোধিতা গ্রন্থ নয়। সুকান্ত সম্পূর্ণরূপে সমাজতান্ত্রিক। কিন্তু সুকান্তের ভাবমূর্তি থেকে পাঠকদের কথাও আমি ভেবেছি যে পাঠকদের কাছে বিদ্রোহের রূপ হচ্ছে নজরুল। নজরুলকে কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে গোপনে পছন্দই করি। তাঁর কবিতাকে আমি খুব বেশি মূল্যায়ন করি না। কিন্তু সবকিছু মিলে আমি তো কোনো কিছুর অন্ধ নাবিক নই। এখানে যারা স্তাবকতা করে তারা ব্যাক্তিগত স্বার্থের জন্য করে। আমি শুধু সাহিত্যের জন্য বা কবিতার জন্য কবিতা ব্যাখ্যা করতে চাইনি।

এর পরে নির্মলেন্দু গুণ সম্পর্কে
হু. আ. : আমি যখন মন্তব্য করেছি তখন থেকে নির্মলেন্দুর রচনা আসলে মস্ত অকবির রচনা। তবে তাঁর প্রথম জীবনের মধ্যে কবিত্ব রয়েছে―আমি কিন্তু পরিমাপ করেই তাঁর কবিতা নিয়েছি, যে সংকলনে তাঁর ক‘টি কবিতা থাকা উচিত। শিল্প বিচারের সময় আমি কখনই ব্যাক্তিগত অনুরাগ বিদ্বেষ দ্বারা চালিত হই না। আমি যাদের কবিতা নেওয়া উচিত নিয়েছি এবং যাদের নেওয়া উচিত নয় তা নেইনি। এবং আমি ভূমিকায় বলে দিয়েছি।

স্রষ্টার সম্পর্কে
হু. আ. :
এই কবিতাটি লেখা ১৯৭২-এ, যখন দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। তখন আমার বয়স খুব বেশি নয়। চব্বিশ বা পঁচিশ হবে বোধ হয়। এই পঙক্তিটি কিন্তু আমার নিজের জন্য অস্বস্তিকর। কবিতাটির এ লাইনটি আমি যখন পড়ি তখন ভালোই লাগে, কিন্তু এটা আমার বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত নয়। এটা আমার বিশ্বাসবিরোধী পঙক্তি। কিন্তু অনেক সময় চিত্রকল্প বা সৌন্দর্য সৃষ্টি বা আবেগ বোঝানোর জন্য কিছু কিছু পঙক্তি হয়তো লিখতে হয়। এখন অবশ্য আমি আর লিখি না। এ রকম আমি আর লিখবই না। ঐ সময় লিখেছি হয়তো মনে হয়েছিল যে মহৎ কিছু লাভ করার চিত্রকল্পরূপে এটা আনা আনা যেতে পারে। এটা অনেকেরই ভালো লাগে ‘স্রষ্টাকে গাঢ় কাছে পায়’ যদিও বাজে কথা।

অর্কেস্ট্রা : হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ সম্পর্কে বলেছেন বই দুটির নাম সুন্দর, তবে নামগুলো অন্যের। আপনার একাধিক গ্রন্থের নামও অন্যের। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন নামকরণে লেখকের স্বাধীনতা থাকবে না কিংবা লেখক অন্যের সাহায্য নিতে পারবেন না?
হু. আ. : ‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এ দু’টো নাম কিন্তু বাঙলা সাহিত্যের কোনো অসাধারণ রচনা থেকে নেওয়া নয়। বন্ধুরা দিয়ে দিয়েছে। এ দু’টোর নাম সম্পর্কে পাঠকদের কোনো পূর্ব ধারণা ছিল না। কিন্তু আমার ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বললেই ‘বাগচীর’ সেই বিখ্যাত কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। হুমায়ূন আহমেদের নাম দু’টি বন্ধুর কাছ থেকে ধার করা, আর আমারটা হচ্ছে বাঙলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ আবেগঘন, বেদনাভারাতুর কবিতা থেকে নেওয়া। এই বই পড়তে গেলে সব সময়ই যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সেই ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ’ মনে রাখতে হবে। আর ঐ বই নিতান্ত নামের জন্য নাম, বন্ধুর কাছে শুনেছে, ভালো লেগেছে, নিয়ে নিয়েছে। এতে তাৎপর্য কিছু নেই। এরপরে আমিই আরও কিছু নিয়েছি, সেগুলো হচ্ছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কিছু নাম থেকে বা পঙক্তি থেকে―যেমন ‘মাতাল তরণী’ এটি র‌্যাবো’র ক্যাব্যগ্রন্থের নাম। এটি বিশ্ববিখ্যাত। আমারই আর একটি গ্রন্থের নাম ‘নরকে অনন্ত ঋতু’ আর ‘র‌্যাবো’রটি হচ্ছে ‘নরকে এক ঋতু’। এর পরে আমি অবশ্য আর নাম নিইনি এবং রবীন্দ্রনাথ থেকে আমি কখোনই নাম নেব না।

অর্কেস্ট্রা : বিগত সরকার ‘নারী’, ‘দেশ’, ‘লজ্জা’, ‘গ্লানি’ নিষিদ্ধ করেছিল―নতুন সরকার এসে ‘দেশ’ থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। আপনি কি মনে করেন বাকিগুলোও পাঠকের কাছে আসার সুযোগ পাবে?
হু. আ. : আমার মনে হয় না বাকিগুলো এ সরকার ছেড়ে দেবে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার অল্পদিনের মধ্যেই একটি বিদেশি পত্রিকাকে মুক্ত করে দিয়েছে। এতেই এই সরকারের চরিত্র বোঝা যাচ্ছে। ‘দেশ’ হচ্ছে একটি বিদেশি ধনী প্রতিষ্ঠানের পত্রিকা, যে পত্রিকাটি এদেশে প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। নতুন সরকার আসার কয়েক দিনের মধ্যেই তারা সরকারকে প্রভাবিত করে নিজেদের পত্রিকা মুক্ত করে নিয়েছে। অথচ দেশের কিছু মূল্যবান বই এখনও নিষিদ্ধ রয়ে গেছে। সরকারের এনিয়ে চিন্তাই নেই। আমার বা অন্য লেখকদের বই কিন্তু মুক্ত হয়নি, এবং আমার তো প্রভাব নেই; ফলে আমার বই মুক্ত হচ্ছে না।

অর্কেস্ট্রা : আপনার লেখায় সচেতনভাবে কারো প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয়?
হু. আ. : আমি যখন অল্পবয়স্ক ছিলাম, তখন গদ্যে সচেতনভাবেই বুদ্ধদেব বসু এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’র মিশ্রণ ঘটিয়েছি। কারণ তখনকার মুসলমান গদ্য এত অমার্জিত, এত মুসলমানি গদ্য যে তার থেকে আমাদের বেরনোর দরকার ছিল। আমার গদ্য লক্ষ করলে দেখা যাবে যে আমিই সবচেয়ে কম পরিমাণ বিদেশি শব্দ ব্যবহার করি। আমি কিন্তু ইংরেজি ব্যবহার করি না, আরবি-ফারসিও করি না। কথায় কথায় শওকত ওসমান যেমন আরবি-ফারসি আনেন, এমনকি শামসুর রাহমান যত আনেন, আমি সেগুলোও আনি না। গদ্যের ক্ষেত্রেও তাই। আর কবিতার ক্ষেত্রে বোদলেয়ার বা জীবনানন্দ আমার খুবই প্রিয়। কিন্তু যে কবিতাগুলো আমার বইতে অন্তর্ভুক্ত আছে সে কবিতায় কারো প্রভাব নেই। যদিও আমি ইউরোপিয় বহু কবির কবিতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি। এমনকি ইউরোপিয় কোনো-কোনো কবির কিছু-কিছু চিত্রকল্প আমি বাঙলায় রূপান্তরিত করেছি, একেবারেই নিজস্ব স্বকিয়তার সঙ্গে। আর চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে আমার যে বিপুল পরিমাণ চিন্তামূলক বই রয়েছে এগুলোতে মৌলিক যে চিন্তাগুলো যেমন―‘নারী’ গ্রন্থের মধ্যে মৌলিক যে প্রতিপাদ্য এটা তো আমার নয়। আমার হলে অবশ্যই আমি বিশ্ববিখ্যাত হতাম এতদিনে। নারীবাদের মূল প্রস্তাব ইউরোপীয়। আমার ‘ভাষাবিজ্ঞান’ বইয়ের মূল প্রস্তাবগুলোতে আমার নয়, সেগুলোয় ইউরোপীয় এবং আমেরিকান চিন্তা কাজ করেছে। আমি চিন্তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকবাদী। আমি সারাক্ষণ বাঙলা, ঐতিহ্য এগুলোতে নিমজ্জিত থাকতে চাই না। ঐতিহ্য আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। সারাক্ষণ ধরে কি আমি দ্বিজবংশী দাশকে নিয়ে থাকব? লালন ফকির নিয়ে থাকব? লালন ফকিরের কোনো কোনো গান আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়। সেটা আমার ভিতরে আছে কিন্তু আমি লালন ফকির হতে চাই না, আমি দ্বিজবংশী দাশ হতে চাই না।

অর্কেস্ট্রা : তাহলে ‘উত্তরআধুনিকতা’য় বিশ্বাসীরা বলছেন, যে নিজেদের ঐতিহ্যে ফিরে আসতে হবে―
হু. আ. : না, এটিই হচ্ছে একটি ভুল ব্যাপার―যে আমাদের এতে ফিরে আসতে হবে। কথা হচ্ছে আমরা শিল্পসৃষ্টি করব, আমরা কবিতা লিখব―তা আমি আমেরিকান বিষয় নিতে পারি বা লোক ঐতিহ্য থেকে নিতে পারি। আমার লেখায় বাঙলার গ্রাম, বাঙলার ঐতিহ্য কম আছে? খুবই রয়েছে এবং আমার মনে হয় অনেকের থেকে অনেক বেশি কাব্যিক এবং শিল্প সুন্দরভাবে রয়েছে। কিন্তু আমি কিছুতেই লালন ফকিরের মতো লিখব না এবং ঐগুলো নিয়ে মাতামাতি করব না। এগুলো কি, এগুলো কি হচ্ছে এক ধরনের ‘ফ্যাসিবাদ’। ‘উত্তর আধুনিক’দের লেখা আমি কিছু পড়ে দেখেছি, অত্যন্ত গ্রাম্যতাদুষ্ট-প্রতিভাহীন রচনা বলে মনে হয়। ওগুলো তো কবিতা হয়নি। কবিতা, কবিতা হবে। কবিতার মধ্যে এমন কোনো বিধান নেই যে ‘এই হতে হবে’। আমি যা দিয়ে পারি আমি তা দিয়েই কবিতা লিখব এবং যদি তা কবিতা হয় তাহলে মূল্যবান, কবিতা না হলে-আন্তর্জাতিকতাও কবিতাকে মূল্যবান করবে না আর লোক-ঐতিহ্যও মূল্যবান করবে না।

অর্কেস্ট্রা : বাঙলার সমালোচনা সাহিত্য দুর্বল। সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন―বাঙলাসমালোচনা পড়ি না। কারণ সমালোচনা পড়লে আমার তখন সমালোচনার স্কুল খুলতে হবে। আপনার বক্তব্য কি?
হু. আ. : সমালোচনা সাহিত্যের কথা না বলে আর একটু ব্যাপকভাবে বলা ভালো, সেটা হচ্ছে, বাঙালির মননশীলতার এলাকাটি অত্যন্ত দুর্বল। আমি তো বলি যে বাঙালির কোনো মৌলিক চিন্তাই নেই। আমার একটি বই রয়েছে, নাম ‘সীমাবদ্ধতার সূত্র’―সেখানে আমি দেখিয়েছি বাঙালি মৌলিক কোনো কিছু সৃষ্টি করেছে কি না। কেন বাঙালি সীমাবদ্ধ? আমাদের যে মননশীলতার এলাকা সে’টাই দরিদ্র এবং সংকীর্ণ। আমাদের কোনো মৌলিক চিন্তা নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধের মধ্যে কোনো মৌলিকত্ব নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে কোনো মৌলিকত্ব নেই। অর্থাৎ, আমরা কোনো মৌলিক চিন্তা উপহার দেইনি বিশ্বকে। আমার যে চিন্তা ভাবনা এগুলো বিশ্ব থেকে আহরণ করা, এগুলো কোনো অভিনব নতুন প্রস্তাব নয়। যে অর্থে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট নতুন চিন্তা দিয়েছেন, যে অর্থে বলা যাক ওয়ার্ডস ওয়ার্থ এবং কোলরিজ মিলে ‘লিরিক্যাল ব্যালার্ডস’ এর ভূমিকা লিখল যে রোমান্টিাসিজমের একটি ব্যাখ্যা; ব্যাখ্যা না―প্রস্তাব বলাই ভাল। ঐ রকম মৌলিক কোনো কিছু আমরা লিখিনি;

জীবনানন্দের ‘সকলেই কবি নয় কেউ-কেউ কবি’ এই প্রবন্ধের যে বিষয় এটাও ইউরোপীয়। ১৯০৫ এর দিকে OXFORD এর কোন (?) একজন বিখ্যাত অধ্যাপক-দার্শনিক কাব্য সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেই প্রবন্ধটির বাঙলা রূপ। আর সমালোচনার ব্যাপারটি দুর্বল কারণ এটা তো মননশীল এলাকা। আমাদের সমালোচকরা সন, তারিখ, বিবরণ দিতে পারেন। তাঁরা বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়ন করেন না, এবং তাঁদের কোনো মৌলিক প্রতিপাদ্য বা তত্ত্ব নেই। পাশ্চাত্যের সমালোচকরা সবাই একটি মোটামুটি তত্ত্ব নিয়ে উপস্থিত হন। তাঁদের ব্যাখ্যারীতি, তাদের বিশ্লেষণের পদ্ধতি এবং মূল্যায়নের পদ্ধতিতে একটা উদ্যোগ থাকে মৌলিকত্ত্বের। সবাই যে মৌলিক প্রস্তাব তত্ত্ব নিয়ে আসেন এমন নয় এবং এখানে দশকের পর দশকে সমালোচনার নতুন রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙলায় সেটি নেই। আমরা এখনও সেই পুরনো কতগুলো তথ্য এবং বিবরণপূর্ণ সমালোচনা রীতির মধ্যেই রয়েছি।

আর সত্যজিৎ রায় কি বলেছেন ওটা আমি অবশ্য পড়িনি। সত্যজিৎ রায়কে আমি খুব মননশীল লোক বলে মনে করি না এবং খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণও মনে করি না। আমি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়কে মূল্য দেই, কিন্তু সত্যজিৎ রায়কে আমি অতটা মূল্য দেই না। এবং সত্যজিৎ রায় যখন মৌলিক তখন কি? তিনি হচ্ছেন ‘শঙ্কু’, ‘ফেলুদা’ ইত্যাদিও কাহিনি লেখক এবং বেশ নিম্নমানের লেখক। ‘খগম’ বলে একটি গল্প আমার কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর বলে মনে হয়েছে। আমার মনে হয়েছে এ’টি একটি প্রতিক্রিয়াশীল মানেুষের লেখা। ‘খগম’ এর কাহিনী সম্ভবত এই―তারা তিন বন্ধু এক ছুটিতে বেড়াতে গেছে কোনো একটি জঙ্গলে এবং তারা জঙ্গলের ভিতরে একটি বাঙলোতে থাকে। একদিন এক বন্ধু (কাহিনি খুব আকর্ষণীয়ভাবে বলা) একটি সাপে পরিণত হয়ে গেছে এবং গর্তের মধ্যে মাথা উঁচিয়ে আছে। অর্থাৎ কি হলে মানুষ সাপ হয়ে যায় এবং এই জাতীয় কুৎসিত গল্প আমি কখনও লিখব না।

অর্কেস্ট্রা : আপনি বিভূতিভূষণ বন্দোপধ্যায়কে ব্রাহ্মণ চেতনাসম্পন্ন বলেছেন―
হু. আ. : হ্যাঁ, সেটা আমি যখন বিভূতিভূষণের আলোচনায় আসব―বিভূতিভূষণের উপন্যাসের মধ্যে যে ব্যক্তিটিকে আমরা দেখি, অর্থাৎ যার দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে―(রচনাগুলোতে কিন্তু একজনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়) আমার উপন্যাসের মধ্যে আমার দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশ পাচ্ছে এবং সেখানেও দেখবে বিভূতিবূষণের উপন্যাসে, তাঁর গল্পে একটি গরিব ব্রাহ্মণ বালকের দৃষ্টিভঙ্গি নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে, নানাভাবে; আমি এখন আর এটা ব্যাখ্যা করতে চাই না।

অর্কেস্ট্রা : আপনার কাব্যগ্রন্থের সমালোচনায় একটি শব্দ (জঙ্ঘা) কে কেন্দ্র কার কেতকিকুশরী ডাইশনের সাথে দীর্ঘ পত্র-বিতর্ক হয়েছিল। ঐ সমালোচনা সম্পর্কে কিছু বলুন।
হু. আ. : বাঙালির অহমিকার রূপ কি হতে পারে, তা ঐ বিতর্কে ধরা পড়েছে। কেতকীকুশারী ডাইসন বহুদিন ধরে ইংলান্ডে থাকেন। তিনি ভালো সমালোচক, অনুবাদকও খুব ভালো―তিনি আমার একটি বই ‘জ্বলো চিতাবাঘ’ এর সমালোচনা করেন। তাঁর সমালোচনা খুব ভালো। আমার মনে হয় কেতকী কুশারীই আমার কবিতাগুলো সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝেছেন। কিন্তু শেষে এসে বাঙালি যেমন সব সময় নিজের একটা পাণ্ডিত্য দেখাতে চায়, সে’টা দেখাতে চেয়েছে। সেটা হলো ‘জঙ্ঘা’ শব্দটি। আমার ওই কাব্যের কয়েকটি কবিতাই ‘জঙ্ঘা’ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। এবং তাঁর মনে হয়েছে আমি ভুল ব্যবহার করেছি―‘জঙ্ঘার’ অর্থ হচ্ছে এই হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত, আর আমি বোধ হয় এটা জঘন অর্থে ব্যবহার করেছি। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আমি ‘জঙ্ঘা’ ব্যবহার করেছি এই অর্থেই। সেটা আমার কবিতা একটু ভালো করে পড়লেই বোঝা যাবে। যেমন একটি কবিতা আমার এখনও মনে আছে―ব্যাপারটা হচ্ছে বন্যা এসেছে সেটা পরিহাসমূলক কবিতা)―বলছে যে খুব চমৎকার সময় এসেছে বাঙলার গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা এখন দেখতে পাবে হেলিকপ্টার, বিদেশি কম্বল, হেসে) স্যুপের প্যাকেট। এগুলো আসবে তো এবং দেখতে পাবে অসংখ্য সুন্দর জঙ্ঘা, ব্যাপারটাতে বুঝতে হবে যে আমাদের সেবকেরা যাবেন, সেবিকারাও যাবেন। সেখানে পথে পানি হয়েছে এবং শাড়ি উঠালে সেই জঙ্ঘাই দেখবে, নাকি জঘন দেখতে পাবে? শাড়ি তো কিছুটা তুলে তাকে যেতে হবে। জঙ্ঘা দেখতে পাবে। জঘন তো দেখার উপায় নেই। একটি কবিতা যেটা সে উদ্ধৃত করেছে―কবিতাটির নাম বোধ হয়―ধর্ষণ। একটি মেয়ের কথাই ভাবো, যে রিকশা করে যাচ্ছে এবং আমি দেখলাম তার কি মারাত্মক জঙ্ঘা। এখন এটা বাংলাদেশে থাকলে বোঝা যায়, মেয়েরা যখন রিকশা করে যায় হঠাৎ বাতাসে শাড়ি উঠলে জঙ্ঘাই দেখা যায়, হেসে) জঘন দেখা যায় না। আমি একটি ছোট উত্তর দিয়েছিলাম এবং কেতকি তার উত্তরে তিন চার পাতা লিখেছে। এখানে অবশ্য একটা সুন্দর জিনিস ধরা পড়েছে যে, সংস্কৃতি কিভাবে কাজ করে। যেমন―আমরা যারা বাঙলাদেশে থাকি এবং তোমাদেও বয়স যেহেতু কম তোমাদের কাছে কি একটি মেয়ের জঙ্ঘা দেখতে পাওয়ায় একটা অসাধারণ যৌন অভিজ্ঞতা। ঐটিই তোমাকে আলোড়িত করবে, কিন্তু ইংল্যান্ডে ওরা প্রতিদিনই জঙ্ঘা দেখতে পাচ্ছে, কারণ তারা স্কার্ট পরছে বা অনেকে ছোট প্যান্ট পরছে। ফলে জঙ্ঘা ওদের জন্য খুব আলোড়ন জাগায় না। আবার জাগায় না একেবারে তাও না। ফলে কেতকি ঐটা না বুঝে পণ্ডিতি করতে গেছে। আর আমি তো ঠিক বাঙলার লোকজ অশিক্ষিত কবিধারার মধ্যে পড়ি না যে না বুঝে বা ভুল বুঝে শব্দ ব্যবহার করেছি।

অর্কেস্ট্রা : আপনার আড্ডার অভিজ্ঞতা বলুন―
হু. আ. : ঠিক আড্ডাবাজ আমি নই, তবু আড্ডার আসরে গেলে আমি বেশ অংশ নিয়ে থাকি। তর্ক-বিতর্কও শুরু হয়। তবে আড্ডা আমার ভালোই লাগে না, কারণ আড্ডা আমাদের দেশে খুব অনুপ্রেরণাদায়ক হয় না। কতগুলো বাজে বিষয় নিয়ে চিৎকার করা হয়। যেমন ধরো এক আড্ডায় গেলাম―সেখানে একজন যে বিশেষ কিছুই পড়েনি, সে আমাকে ‘নারীবাদ’ সম্পর্কে শেখায়। আমি মৌলবাদ সম্পর্কে বিপুল পড়াশুনা করেছি। আমার একটা বই লেখার ইচ্ছে আছে, লিখব কি না জানি না। যে কোনো বই-ই পড়েনি মৌলবাদ সম্পর্কে, সে আমাকে সে আমাকে মৌলবাদ বোঝায় যে―‘এ হচ্ছে মৌলবাদ’ বুঝতে পারছ আড্ডার কি অবস্থা এদেশে।

অর্কেস্ট্রা : আপনার কয়েকজন প্রিয়জনের নাম (লেখক, শিল্পীদের মধ্যে)
হু. আ. : ব্যক্তিগতভাবে আমার সবচেয়ে সম্পর্ক শামসুর রাহমানের সঙ্গে আর আমার প্রিয় লেখক তো পৃথিবীজুড়ে বিপুল। জীবিতদের নাম বলছি না। বাঙলা কবিতায় আমার প্রিয় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ। বিষ্ণু দেও আমার বেশ প্রিয়, বুদ্ধদেব এবং অমিয় চক্রবর্তী কিছুটা প্রিয়, যদিও বুদ্ধদেবের কবিতাকে আমি মনে করি―তিনি সবচেয়ে কম আধুনিক। তিনি কবিতা লিখতে গিয়ে বলা যায় শুধু কথা বলেছেন তারপরেও লেখক হিসেবেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আমার বেশ প্রিয়। বিশেষ করে তার কবিতা। আর একটি কবিতার জন্য আমার প্রিয় যতিন্দ্রমোহন বাগচী। তাঁর কবিতার পঙক্তি থেকে তো আমি বইয়ের নামই রেখেছি। বিদেশে আমার প্রিয়দের মধ্যে ইংরেজিতে কিটস, শেলি; এলিয়ট আমার অত প্রিয় নয় তবুও প্রিয়দের মধ্যেই পড়তে পারে। এজরা পাউন্ড আমার নানাভাবে প্রিয়। ই. কামিংসও প্রিয়। বোদলেয়ার এবং মালার্মে ফরাসি ও দুজন র‌্যাঁব্যো এত নয়। চিত্রকলার ক্ষেত্রে পিকাসোর থেকে দ্যালিই আমার বেশি পছন্দ। আরেকজন চিত্রকর আছেন ম্যাকগ্রিথ নামে এবং আরও অনেকে রয়েছেন। বাঙলাদেশে জয়নুলের কিছু-কিছু ছবি আমার প্রিয়। কামরুল হাসানের নারীর চিত্র, যামিনী রায়ের কিছু-কিছু ছবি; বিশেষ করে রেখার টান বেশ প্রিয়। অবনীন্দ্রের ছবি খুব বেশি দেখিনি কিন্তু প্রিয়দের মধ্যে তাকেও ফেলা যায়। আরো অজস্র-আরো বহু প্রিয় রয়েছে। সম্পূর্ণ না হোক খণ্ডিতভাবে আমার প্রিয় অনেকেই রয়েছে।

অর্কেস্ট্রা : আপনার লেখায় আছে–যদি মরে যাই কিছু থাকবে না। এই মাটি যতই বান্ধব হোক মনে রাখবে না। পঁচিশ বছরের গদ্য পদ্য যা কিছু রচনা, সকলই অর্থহিন, নির্বোধ অনুশোচনা।
হু. আ. : এটা পঁচিশ বছর বয়সেই লেখা। আমি অবশ্য মনে করি যে কিছুই থাকবে না। আমার বেশকিছু লেখার মধ্যে বা সাক্ষাৎকারের এর মধ্যে বলা আছে যে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। একটি কবিতা আছে আমার খুব পছন্দ―সেটা হচ্ছে ‘ব্যাধিকে রূপান্তরিত।’ ঝিনুকের ব্যাধি হচ্ছে মুক্তা, মুক্তাকে যত মূল্যবান মনে করা হোক ওটা কিন্তু অসুখ মাত্র। যে অসুখে ঝিনুক ক্রমশ মরে যায়। এখন আমি কি করতে পারি? এই যে আমি বিশ্বলোকে জন্ম নিয়েছি। আমি জানি আমার পরিসমাপ্তি হচ্ছে ধ্বংস। আমি যত মহৎ কাজই করি না কেন আমার মৃত্যু অবধারিত। সবার মৃত্যু অবধারিত। এবং এই সময়টা আমি কি করতে পারি। এই যে নিরর্থকতা, মৃত্যুর মতো নিরর্থকতা তো আর কিছু নেই। সবকিছু―এই কবিতা, এই শিল্প, এই সঙ্গীত, এই জীবন―সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। এর চেয়ে হাস্যকর, এর চেয়ে নিরর্থক আর কি হতে পারে? আমরা কি করছি নিরর্থকতাকে কিছুটা অর্থপূর্ণ করার জন্য? এই শিল্পসৃষ্টি, এই কবিতা, এই সঙ্গীত, এই নাটক, এই বিজ্ঞান, এটা হচ্ছে এই নিরর্থক সময়টাকে অর্থপূর্ণ করে তোলার একটা ব্যর্থ চেষ্টামাত্র। সবকিছু ধ্বংস হবে। এই সূর্য নেমে যাবে, এই ছোট্ট মাটির পৃথিবী থাকবে না, রবীন্দ্রসাহিত্যও থাকবে না, আপেক্ষিক তত্ত্বও থাকবে না। হয়তো চল্লিশ বছর লাগবে। এটা তো আমি এখন আরো বেশি বিশ্বাস করি, যে সবকিছু ধ্বংস হবে।

অর্কেস্ট্রা : আপনি বলতে গেলে জীবনের অর্ধেক (অর্ধশত বছর) অতিক্রম করেছেন। এই বয়সে আপনাকে কোনটি বেশি তাড়িত করে, স্বপ্ন না স্মৃতি?
হু. আ. : দুটোই, অতীতকে আমার খুবই মনে পড়ে, বিশেষ করে বাল্যকাল। মনে করা যাক পাঁচ থেকে পনেরো বছর পর্যন্ত যে বয়স, সেই কৈশোর আমার খুবই মনে পড়ে। তখন আমি গ্রামে ছিলাম। ওটা আমার জন্য খুবই সুখকর। এরপরে ঢাকার যে যৌবন―এটা আমাকে খুব আলোড়িত করে না। এখন আমার অবশ্য খুব বিস্ময়কর অনুভূতি হয়, যেমন এখন আমার সামনে কোনো বিশেষ ভবিষ্যৎ নেই বলে মনে হয়। তোমাদের এখন একটি বিশাল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। 3rd year -এ এখন তোমরা, কাজেই তোমাদের স্বপ্ন হচ্ছে Honours ভালোভাবে পাশ করবে এবং পাশ করে ভালো একটি চাকরি পাবে। একটি চমৎকার মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে বা এখনই হয়েছে ইত্যাদি। তোমাদের সবটাই হচ্ছে ভবিষ্যৎ বা স্বপ্ন। আর আমার ঠিক এই ধরনের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমি এইগুলি সব পেরিয়ে এসেছি। এখন আমার জন্য রয়েছে একটা বেশ বড় অতীত, এবং ভবিষ্যৎ হচ্ছে শুধু আমার লেখা―আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। জীবন যাকে বলে―জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করা, এগুলো আমার জন্য অতীত ব্যাপার। ফলে ঐ যে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের উত্তেজনা এবং স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন-ব্যাকুলতা এগুলোকে নিয়ে মাথাব্যথা আমার নেই। আমার এখন শুধু ভবিষ্যতের কথা হচ্ছে দুটো জিনিস―এক হচ্ছে আমি কতদিন বেঁচে থাকব, আমি অবশ্য আরো ৩০-৩৫ বছর বাঁচতে চাই। তাহলে হয়তো ৮০ পেরোনো হবে। আমার ভবিষ্যৎ হচ্ছে নিত্য বেঁচে থাকা। কারণ আমি তো আর দালালি করে অন্য চাকরিতে যেতে চাই না... এবং এই সময়ে কিছু উৎকৃষ্ট বই লেখা বা অসাধারণ বলাই ভালো―যদি পারি। আর অতীত তো পেরিয়ে এসেছি। আমার সবচেয়ে প্রিয় সময় হচ্ছে ঐ দশ বছর―মানে প্রথম থেকে বলা ভালো কিন্তু সেটা তো আমার মনে পড়ে না। তবে অনেকেই জিজ্ঞেস করে সুযোগ পেলে আবার অতীত জীবন শুরু করতে প্রস্তুত কিনা? আমি বলেছি তাতে আমি প্রস্তুত নই। ধরো আমাকে সুযোগ দেওয়া হলো―সেই এক বছর থেকে জীবন শুরু করার, কিন্তু আমি আর প্রস্তুত নই। কারণ আবার সেই স্কুলে যেতে হবে, আবার সেই বইপত্র মুখস্থ করতে হবে, আবার First হতে হবে; এই জাতীয় (প্রচণ্ড হাসি) ঝামেলায় আমি যেতে রাজি নই।

পূর্বপ্রকাশ : অর্কেস্ট্রা, প্রথম সংখ্যা, অ‌ক্টোবর ১৯৯৬, চট্টগ্রাম। সম্পাদক নীলাঞ্জন বিদ্যুৎ, আব‌ু ওবা‌য়েদ বিপ্লব, মাহমুদ সিমান।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সপ্তম দিনে গড়ালো ইরান-ইসরায়েল সংঘাত
সপ্তম দিনে গড়ালো ইরান-ইসরায়েল সংঘাত
তামাক চাষে মাটি হারাচ্ছে উর্বরতা, বিপন্ন টেকসই কৃষি
তামাক চাষে মাটি হারাচ্ছে উর্বরতা, বিপন্ন টেকসই কৃষি
যশোরে একদিনেই করোনা আক্রান্ত দুই জনের মৃত্যু
যশোরে একদিনেই করোনা আক্রান্ত দুই জনের মৃত্যু
মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ড. খলিলুর রহমানের সাক্ষাৎ
মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ড. খলিলুর রহমানের সাক্ষাৎ
সর্বাধিক পঠিত
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে হট্টগোল
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে হট্টগোল
আরও একমাসের ছুটিতে ২ বিচারপতি
আরও একমাসের ছুটিতে ২ বিচারপতি
স্ত্রীর মামলায় কারাগারে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
স্ত্রীর মামলায় কারাগারে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে রাশিয়ার লাভ-লোকসানের সমীকরণ
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে রাশিয়ার লাভ-লোকসানের সমীকরণ
আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে সশস্ত্র রোহিঙ্গারা: ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদন
আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে সশস্ত্র রোহিঙ্গারা: ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদন