বুকার প্রাইজ ২০২৪-এর সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছে রাচেল কুশনারের ‘ক্রিয়েশন লেক’ উপন্যাসটি। বুকার কর্তৃপক্ষকে দেওয়া রাচেল কুশনারের সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন তাসনিম ওয়াসীত্ব
প্রশ্ন : সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হওয়ার পেছনে অনুপ্রেরণা জানতে চাই।|
উত্তর : আমি অনেক আগে থেকেই এমন একটি গল্প বলতে চেয়েছিলাম, যে গল্পে একদল তরুণ প্যারিস থেকে ফ্রান্সের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে চলে গেছে এবং যেখানে প্রতিনিয়ত তারা ফরাসি রাষ্ট্রের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। একই সময়ে, আমি প্রাগৈতিহাসিক বিষয়াদি নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠি, প্রাচীন লোকদের সম্বন্ধে আমরা যা জানি, এবং যা জানতে চাই—এই অর্থে যে আমরা একটি ভুল পদক্ষেপ, ভুল মোড় নিয়েছি, আমাদের পূর্বপুরুষরা আমাদের জন্য যে দিকনির্দেশনা রেখে গিয়েছিলেন, আমরা তা পড়তে জানি না। আমরা কোথায় যাচ্ছি এবং কোথায় ছিলাম—এই বোঝাপড়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : একজন পাঠক হয়ে উঠতে কোন বইটি আপনাকে প্রণোদনা দিয়েছে?
উত্তর : মনে আছে আমার দাদি আমাকে অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড বইটি উপহার দিয়েছিলেন। আমরা তখন ওরেগনের ইউজিনে থাকি। বইটি মেইলে এসেছিল এবং এটা পাওয়ার পরপরই আমি আমার ঘরে গিয়ে বইটি পড়তে শুরু করি এবং শেষ না হওয়া পর্যন্ত পড়েছিলাম। তখন আমার বয়স ছয় কিংবা সাত হবে। আমি এখনো বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো, চিত্র বা এর জাদুময় পৃথিবীকে অনুভব করি। বই পড়া আমার কাছে একান্ত গোপন এক অনুভূতি মনে হয়৷
প্রশ্ন : আপনার লেখক হওয়ার পেছনে কোন বইটি অবদান রেখেছে?
উত্তর : আমার কিশোর বয়সে যখন ব্লাড মেরিডিয়ান পড়ি, তা আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। আমি ইতোমধ্যেই ঠিক করেছিলাম আমি একজন লেখক হব, কিন্তু সেই উপন্যাসটি জীবনের নিষ্ঠুরতা এবং ভাষার ব্যবহারকে অবর্ণনীয় অলীকত্বে উপস্থাপন করেছিল। মানুষ এবং ইতিহাস, উভয়ের রূঢ় সত্যকে একটি উপন্যাস কীভাবে উপস্থাপন করতে পারে তা আমি তখন নতুনভাবে বুঝতে পারি। আমি এখনো কর্ম্যাক ম্যাকার্থির একজন ভক্ত, কিন্তু আমি তার প্রথম দিকের কাজ বেশি পছন্দ করি, বিশেষ করে চাইল্ড অফ গড—যা আমি ‘ক্রিয়েশন লেক’ রচনা করার আগে পড়েছি। চাইল্ড অফ গড-এর শুরুটা এতো প্রাণবন্ত এবং প্রতিটি ছোট ছোট অধ্যায় যেন বসন্তের মতো বর্ণিল।
প্রশ্ন : কোন বইটির কাছে আপনি বারবার ফিরে যান?
উত্তর : আমি সম্প্রতি আবারো ম্যাডাম বোভারি পড়েছি এবং শুরুটা কতটা অদ্ভুত তা দেখে যারপরনাই মুগ্ধ। সেই কণ্ঠস্বরটি হলো একটি ‘সম্মিলিত সত্তা’, যারা চার্লসের দিকে তাকাচ্ছি, এবড়োখেবড়ো পথে তার জীবনের এগিয়ে যাওয়া দেখছি, স্কুলছাত্র হিসেবেও সে মোটামুটি ব্যর্থ। কৃষি অনুষ্ঠানে রডলফ যখন এমাকে প্রলোভিত করে, তখন আমরা তিক্ত হাস্যরসের মাধ্যমে ধর্ষণের পুরো ইতিহাস দেখি।
প্রশ্ন : কোন বইটি আপনার মাথা থেকে বের করতে পারছেন না?
উত্তর : জ্যঁ প্যাট্রিক মানসেতের ‘ফ্যাটালে’—যেখানে একজন নারী আততায়ী পৃথিবীর হয়ে বদলা নেয়, কোনোরকম অনুভূতি ছাড়াই—ঠিক যেন স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণে চলা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার।
এর সাথে আরো একটি বই হচ্ছে আলবার্তো মোরাভিয়ার ‘আগোস্টিনো’, যা একটি ছেলের শৈশব থেকে কৈশোরে রূপান্তরের আকর্ষণীয় আখ্যান। মোরাভিয়া নিখুঁতভাবে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা ফুটিয়ে তুলেছেন, কেন একটি শিশু মায়ের কোমল বক্ষের নিরাপত্তা ছেড়ে প্রাপ্তবয়স্কদের পৃথিবীর দিকে ধাবমান হবে, যা তাকে হঠাৎ দমিয়ে দেয়৷
প্রশ্ন : কোন বইটি বিশ্ব সম্পর্কে আপনার চিন্তার উপায়কে পরিবর্তন করেছে?
উত্তর : জন ডেলিলোর ‘গ্রেট জোন্স স্ট্রিট’ যেভাবে জীবনকে অযৌক্তিকতার মায়াজালে আবদ্ধ করেছিল, তা অনন্য। এই কাজটি করতে গিয়ে ডেলিলো এক ঝাঁক নতুন সামাজিক এবং ভাষাভিত্তিক নিয়ম আবিষ্কার করেছে, এবং আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমি একজন প্রকৃত শিল্পীর কাজ পড়ছি, এক মহান শিল্পী যিনি অনন্য কিছু আমাদের উপহার দিয়েছেন।
প্রশ্ন : কোন বইটি উপন্যাস সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করেছে?
উত্তর : মার্গুরাইট ডুরাসের ‘প্র্যাক্টিকালিটিস’, যা প্রথমে তার ছেলের বন্ধুকে বলেছিলেন, তারপরে তিনি নিজেই সংশোধন এবং সম্পাদনা করেন, এটি অন্য কোনো বইয়ের মতো নয়। এছাড়াও অ্যান কার্সনের ‘ডিক্রিয়েশন’ নিয়ে কথা বলতে পারি, যা উপন্যাসের চিরাচরিত প্রথা ভেঙে এক নতুন রাস্তায় হেঁটেছে, যেই রাস্তা আবার নতুন এক প্রথা বনে গেছে। এই উপন্যাসটিকে আমি এমনভাবে বিবেচনা করি যে একে যথাযথ উপায়ে কখনোই মূল্যায়ন করতে পারব না, এটি সর্বদাই আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে একটি উপন্যাস শুধু এর নিজের যুক্তি দ্বারাই নির্ধারিত হয়।
প্রশ্ন : কোন বইটি আপনাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে?
উত্তর : প্রুস্তের সাতটি খণ্ডের সবগুলোই। তার মাঝে জীবনকে অনুভব করার ক্ষমতা অতুলনীয়। তিনি আমাকে আমি যা চাইছি তা বলতে, একটি ভাবনাকে একটি বাক্যের ভেতর দিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রকাশ করতে ভরসা জোগান। আমি সম্প্রতি শেষ খণ্ডটি পুনরায় পড়ি এবং সেই বইটির কাঠামো আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকে, কীভাবে পুরো বইটি একজন শিল্পীর শিল্পী হয়ে ওঠাকে তুলে ধরে এবং বইটির শেষে, তিনি তার শিল্প দিয়ে পৃথিবীকে রাঙিয়ে তোলেন।
প্রশ্ন : এই মুহূর্তে আপনি কোন বইটি পড়ছেন?
উত্তর : আমি আমেরিকান সাহিত্য সমালোচক, ফ্রেডেরিক জেমসনের প্রবন্ধ সমগ্র পড়ছি। প্রথম প্রবন্ধেই, অবিশ্বাস্য অনুধাবনের সাথে তিনি ‘ম্যাচিসমো’-এর ঘটনাটি ব্যাখ্যা করেছেন এবং এর পরের প্রবন্ধতেই ‘গ্রিংগো’ উপন্যাসের সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ করেছেন, যেখানে তিনি রবার্ট স্টোনের মতো লেখকদের মনোজগতে প্রবেশ করতে চেয়েছেন। রবার্ট স্টোনের অনেক চরিত্রই প্রবাসী এবং সেই চরিত্রগুলো নিজ ভাষা বা নিজ দেশের চেনাজানা বিন্যাসে ফিরে যেতে পারে না৷ এটি এমন একটি প্রশ্ন যার উত্তর ব্যক্তিগতভাবে আমাকেও উদ্বিগ্ন করে।
প্রশ্ন : বুকার মনোনীত কোন বইটি সবার পড়া উচিত?
উত্তর : আমি সম্প্রতি প্রথমবারের মতো কাজুও ইশিগুরোর ‘নেভার লেট মি গো’ পড়েছি। এটি আমার ছেলের পাঠ্যক্রমে ছিল। এই বইটিকে আমি শুধু ভালো লাগার গণ্ডিতেই আবদ্ধ রাখতে চাই না, বইটি আমি যে ধরনের কাজ করি তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের কাজ, এবং এটি পড়তে শুরু করলে আপনি বুঝতেই পারবেন না আপনি একটি বই পড়ছেন, এর বর্ণনা এতই মসৃণ। এই দুঃখজনক এবং রহস্যময় বইটি পড়া আমার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল—বইটি মানুষের গঠনমূলক অভিজ্ঞতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, কেননা প্রায় প্রত্যেক আমেরিকান স্কুল শিক্ষার্থীই বইটি পড়েছে এবং জীবন, দয়া, নিষ্ঠুরতা, ভাগ্য বা পারস্পরিক নির্ভরতা সম্পর্কে তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতার একটি অংশ এই বইটি।