X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনকে প্রতিনিয়ত খোঁড়াখুঁড়ি আর আবিষ্কারের মোহ : জিনাত জাহান খান

.
৩০ আগস্ট ২০১৭, ১১:২৪আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০১৭, ১১:৩৩

জীবনকে প্রতিনিয়ত খোঁড়াখুঁড়ি আর আবিষ্কারের মোহ : জিনাত জাহান খান জিনাত জাহান খান। জন্ম : ১০ আগস্ট, বরিশালে। পেশা শিক্ষকতা। কাব্যগ্রন্থ : নীল কাছিমের দ্বীপ, [শুদ্ধস্বর ২০১৪], কথা বলা মাছ, [চৈতন্য ২০১৫]।

দ্বিতীয় দশকের কয়েকজন কবির কাব্য-ভাবনা ও লেখালেখি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন সাহিত্যের এই আয়োজন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একই সময়ের কবি রাসেল রায়হান।

 

প্রশ্ন : ‘...ট্রাংকের ঝাঁপ খুলতেই স্মৃতি-বিস্মৃতির গন্ধযুক্ত শাদা চাদর

আর কিছু গ্রুপফটো।

গ্রুপফটোতে যারা ছিল, সবাই হাসছে…’

পাঠক হিসেবে এই হাসির আড়ালে গোপন কান্না দেখতে পাই। এই লুকোনো কান্নাটা কি সচেতনভাবে এসেছে? নাকি এই কান্নাটা আসলে অবচেতনের কৃতিত্বে, হয়তো আপনিও জানতেন না?

উত্তর : জ্বি, অবশ্যই আমি জানতাম।এখন কথা হলো, কান্না কতটা কান্না কিংবা হাসি কতটাই হাসি। যা-ই হোক, সচেতনভাবেই আমি কান্না-হাসি নিয়ে আসি। অসচেতনভাবে নয় আসলে।

প্রশ্ন : সবটা কি সচেতনভাবেই আসে? সম্ভব? হয়তো কারও ‘কেমন আছ’র উত্তরে আমি বললাম, ভালো আছি। তার মধ্যেও আলগোছে কখনো কখনো কি একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে পারে না, আমার অলক্ষ্যে, অজ্ঞাতসারে?

উত্তর : এখানের দৃশ্যপট আলাদা। এখানের দর্শনও আলাদা।

প্রশ্ন : এটা উদাহরণ। ধরেন, এই কবিতাটায় হয়তো কান্নাটা সচেতনভাবে আসছে— কিন্তু সব কবিতায় কি এমন সচেতন থাকতে পারেন আপনি?

উত্তর : কবিকে সচেতন বা অসচেতন দুইভাবেই কখনো না কখনো দর্শনের কাছে যেতেই হয়।

প্রশ্ন : দর্শনের কাছে যাওয়ার ব্যাপারটা কি?

উত্তর : এই চলে যাওয়াটা নিজের অজান্তেই। জোর করছে না কেউ। ধরুন,  আপনি বললেন,  ‘জিরাফ, শরীরভর্তি এত এত মানচিত্র, কাঁটাতার কই?’ এই লাইনটাকে আমি বর্ণনা করতে চাই। জিরাফ শব্দটা আমার কাছে অসাধারণ, আমার ধারণা এখানে কবি জিরাফের স্বভাব, যেমন সে কথা বলতে পারে না—সেইভাবেই মানচিত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। একটা মানচিত্র নির্বাক অথচ নিষ্প্রাণ নয়।

প্রশ্ন : কবিতার ক্ষেত্রে সচেতনভাবে ঠিক কোথাও আলাদা মনোযোগ দেন কি না?

উত্তর : খুব ভালো প্রশ্ন, পূর্বের কথার একটু জের টানি, মানুষ থেকে মানুষের চিন্তা, কল্পনা আলাদা। মূল কারণ কিন্তু যাপনের টর্চার। হাজার বছর ধরে কবিতা লেখা হচ্ছে, প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে কবিতা, এখন আমি যা কিছু লিখছি তা যদি সচেতনভাবে চিন্তাকে প্রয়োগ না করতে পারি আমি তলিয়ে যাবো। সেক্ষেত্রে, চিত্রায়ন, বর্ণনাকৌশল এবং শেষভাগে আমার মনোযোগ থাকে যা আরোপিত নয়, অনিবার্যভাবেই তা উঠে আসে।

প্রশ্ন : কতটা নিজের জগত নির্মাণ জরুরি? জরুরি হলে আপনার ক্ষেত্রে সেই পদ্ধতিটা ঠিক কেমন?

উত্তর : আসলে নিজের জগত নিয়ে সংশয়ে আছি। কবিতা লেখার জন্য কোনো পদ্ধতি মেনে চলি না। বা এসব নিয়ে ভাবিও না।

প্রশ্ন : আচ্ছা, কবিতার ক্ষেত্রে আপনার প্রচলিত যাপনের সাথে অন্য একজনের প্রচলিত যাপনের খুব বেশি পার্থক্য নেই সম্ভবত। তবুও কবিতা কেন একজনের সাথে অন্যজনের পার্থক্য দুই মেরুর হয় কখনো কখনো? আপনার কী মনে হয়?

উত্তর : খুব বেশি পার্থক্য নেই—এখানে সামান্য আপত্তি—আসলে পার্থক্য আছে, প্রচলিত যাপনের পার্থক্যের কারণেই চিন্তা, চেতনা, পাঠ, রুচির ভিন্নতা দেখা যায়। জগতের প্রতিটি বস্তুই আলাদা। একটা থেকে অন্যটা ভিন্ন মেজাজ, রূপ, ওজন, উচ্চতা, শক্তি, পরিমাপের। যেহেতু কবি মাত্রই ভাষার কলাকৌশল প্রয়োগকারী। আর আমাদের ইচ্ছা, প্রেম, কল্পনা, চিন্তা কোনোকিছুই ভাষা থেকে আলাদা করতে পারি না। ভাষা মানুষের স্বাভাবিক গুণ। তেমনি কবিতার ক্ষেত্রেও, শুধুমাত্র পার্থক্য ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও প্রতিদিনকার দিনলিপিতে। একজন মানুষ তার বিপুল সম্ভাবনা দিয়ে যখন তার চিন্তাকে বর্ণনা করতে পারল, অন্যজন একই চিন্তাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করলো। সে একজন ইংরেজি কবিই হোক কিংবা বাংলা ভাষাভাষীর কবিই হোক। ফলে, যে কাব্যের প্রাচুর্যকে লুফে নেয় এবং ভাষার সঠিক প্রয়োগ ঘটায় তার কাব্যে সে কেন অন্যজন থেকে আলাদা মেরুর হবে না? তার নান্দনিকতা অন্য অনেকের থেকে ভিন্নতর হবেই।

প্রশ্ন : কবিতার পাঠক কমের একটা অভিযোগ পাওয়া যায়, এর ভিত্তি কী? উত্তরণ সম্ভব কি না? কীভাবে?

উত্তর : আসলে কবিতার পাঠক বলতে বরাবরই কম ছিল। কবিতার বিষয়বস্তুর দুর্বোধ্যতা, ইঙ্গিতে প্রকাশ করা, আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, মানুষের কমন বিষয় নিয়ে কথা কম হচ্ছে, নিজস্ব বেদনা, যন্ত্রণা নিয়েই প্রকাশিত হচ্ছে বলে পাঠক কম।

আর যেহেতু পাঠকই কম সেহেতু মনে করি এখানে উত্তরণের বিষয় নেই।

প্রশ্ন : সুবিধা পাবার জন্য জুনিয়র কবিরা জ্যেষ্ঠ্য কবিদের পেছনে ঘোরে, সম্পাদকের পেছনে ঘোরে। এই অভিযোগ কতটা সত্যি? সত্যি হলে, এই প্রক্রিয়ায় কতটা জাতে ওঠা যায়?

উত্তর : অভিযোগ আছে এবং অভিযোগ সত্য। তবে 'সুবিধা পাবার' কথাটা সম্পূর্ণ কবিতা বিরোধী। সাহিত্য এমন একটা মাধ্যম যেখানে যুগে যুগে জুনিয়র-সিনিয়র, কবি-সম্পাদকের সম্পর্ক ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু জাতে ওঠার ব্যাপারটা অসম্ভব।  কখনোই কাউকে কবি বানানো যায় না আর গেলেও সাময়িক। তাই জুনিয়র থাকুক সিনিয়রের পাশেপাশে, কবিও থাকুক সম্পাদকের কাছে, কিন্তু লাইন বা জাতে ওঠার জন্যে যেন না হয়, এমনই আশা থাকুক।

প্রশ্ন : বিভিন্ন দৈনিকে, অনলাইন নিউজপোর্টালে সাহিত্য বিভাগ থাকে। এই বিভাগটি সাহিত্যের কতটুকু উপকার করছে?

উত্তর : অবশ্যই উপকার করছে। শিল্প যেহেতু প্রকাশিত হতে চায় এবং তার জন্য একটা মাধ্যম প্রয়োজন। অবশ্য মানগত পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তা সাহিত্যের জন্য ভালো। এখনো মানুষ সাহিত্য পাতায় তার প্রিয় লেখা বা লেখকের নাম খোঁজেন, যেসব লেখক সাহিত্যকে বেছে নিতে চাচ্ছেন, শিল্প প্রকাশে তারা কিন্তু সাহিত্যপাতায়ই চোখ রাখেন। মূলকথা, এইসব সাহিত্য বিভাগ সাহিত্যের জন্যই।

প্রশ্ন : এখন ছোটকাগজের ভূমিকা কী?

উত্তর : ছোটকাগজ সবসময়ই প্রচলিত চিন্তার বিপরীতে অবস্থান করে। ছোটকাগজ সাহিত্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে অগ্রগামী। কিন্তু বর্তমানে এর ভূমিকা খুবই কম। কারণ, প্রকাশমাধ্যমের সহযোগীকরণ হয় বড় কাগজ অথবা ছোট কাগজ। আমার মনে হচ্ছে, যেটুকুও ভূমিকা আছে—তা এখন নয়, হয়তো আরও দশ-বিশ বছর পরে বোঝা যেতে পারে।

প্রশ্ন : ছোটকাগজের ম্রিয়মাণতা আর দৈনিকগুলোর উত্থান, এই দুইয়ের সুবাদে সাহিত্য একটি কর্পোরেট শ্রেণির কাছে বাঁধা পড়ছে কি না?

উত্তর : কিছুটা বাঁধা পড়েছে। আশি ও নব্বই দশকে ছোটকাগজের যে প্রতাপ তা এখন নেই।নব্বই এসে আবার দৈনিকের উত্থানে ঢাকা পড়ে যায়। আজ কিন্তু তাও নেই। এখানে অর্থনৈতিক কারণে, বহুজাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পুরস্কারের প্রলোভনের যে জোয়ার বইছে, সেইসব কারণে বলা যায় সাহিত্য আজ কর্পোরেট শাখায় ঝুলছে।

প্রশ্ন : নীল কাছিমের দ্বীপ, কথা বলা মাছ... শুধু পানির আশেপাশে ভ্রমণ কেন?

উত্তর : হা হা হা! কী প্রশ্নরে বাব্বা! পানি ভ্রমণ!

প্রশ্ন : শুরুর দিকেবড় কবির প্রভাব থাকে—ঠিক প্রভাব নাও হলে আচ্ছন্নতা থাকে। আপনার কারও প্রতি আছন্নতা ছিল?

উত্তর : অন্যদের থাকে কিনা জানা নেই, আমার বিষয়টা ছিল একটু আলাদা।আসলে কবিতাই কবিতায় টেনে আনে এমন।  আর প্রভাব বলতে মুগ্ধতাও বলা যায়। যখন বয়সে ছোট, গান ছিলো প্রাণ, গান ছাড়া বাঁচা যায়—এ চিন্তাও করতে পারিনি। এককথায় গানেই ডুবে থাকতাম, গাইতামও একটু আধটু। এটাকে আচ্ছন্নতাও বলা যায়। জীবনকে প্রতিনিয়ত খোঁড়াখুঁড়ি আর নিজস্ব জগতকে আবিষ্কারের মোহ ভীষণ কার্যকর এক্ষেত্রে। খুব কাছের একজন এক জন্মদিনে দুইটা কবিতার বই দেয়, জীবনানন্দ দাশ ও নির্মলেন্দু গুণের। আমাদের সেই বয়সে গুণ তখন প্রেমের কবিতায় খুব হিট। কিন্তু একটু সময় পেলেই জীবনানন্দ দাশ নিয়ে বসে পড়তাম।প্রথম প্রথম কিছু না বুঝে-না ভেবেই ভালো লাগায় পড়া।টান অনুভব করতাম। তখনকার সময়ে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় গুণের একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশ হয়, পড়লাম, দেখলাম বেশিরভাগ সময়েই কবি তার প্রিয়বন্ধু আবুল হাসান-এর কথা বললেন, এবং একটা কবিতার পঙক্তিও উল্লেখ করেন, ‘ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও,/ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও’। বেশ কয়েকবার পড়ে ভেতরে ভেতরে একটা অদ্ভুত ব্যাপার অনুভব করলাম।শুরু হলো কবিতা লেখার জার্নি। কবিতায় আচ্ছন্নতা আর তার জন্য এই তিন কবি ও গানের মুগ্ধতা অস্বীকার করতে চাই না।

স্মৃতি ঘেঁটে দেখলাম, গুণের বই যে বয়সে হাতে আসছে সে বয়সে প্রেমের ওইরূপ কবিতা আর টানছিল না।

প্রশ্ন : অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের সাথে কবিতার পার্থক্যটা কোথায়?

উত্তর : অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের সাথে কবিতার পার্থক্য বলতে অন্যান্য মাধ্যমে ছোঁয়া যায়, ধরা যায় কিংবা দেখাও যায়। কিন্তু কবিতা শুধুই অনুভবের বিষয়।

প্রশ্ন : কবিতা কতদিন লিখতে চান?

উত্তর : যতদিন সক্রিয় থাকবো।

ধন্যবাদ জিনাত।

আপনাকেও ধন্যবাদ।


 

আরো পড়ুন-

লিখি শান্তি পাবার জন্য। শূন্য হবার জন্য : বিধান সাহা 

 

 

জেড. এস.
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ