X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

একজন অজিক চৌধুরী এবং বাংলাদেশি ডায়াস্পোরা সাহিত্য

মোজাফফর হোসেন
০৮ জানুয়ারি ২০১৮, ১৬:৪৮আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০১৮, ১৬:৫৫

বইয়ের প্রচ্ছদ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশি-ব্রিটিশ লেখক অজিক চৌধুরীর প্রথম উপন্যাস ‘অ্যা মুসলিম বয়’। ৩৫০ পৃষ্ঠার রয়েল সাইজের এই উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে আমাজন। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট সত্তর দশকের ব্রিটেন। কাহিনিতে দেখা যায়, ১১ বছর বয়সী বাংলাদেশি কিশোর শান্তির পরিবার আরো উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে চলে যায় লন্ডনে। ব্রিটিশ সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয় শান্তির। নানাভাবে বর্ণবৈষম্যের শিকার হয় সে। স্কুলে তার সঙ্গে পরিচিতি ও বন্ধুত্ব ঘটে তারই মতো চারজন ভিন্ন সংস্কৃতির ছেলের সঙ্গে। তারা কেউই স্কুলের কড়া নিয়ম-কানুন মানতে রাজি না। অন্যদিকে তাদের পরিবার শক্তভাবে চায় ছেলে স্কুলে ভালো ফল করে দ্রুত জায়গা করে নিক নতুন দেশে।
একদিকে ব্রিটিশ লাইফস্টাইল, অন্যদিকে নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়—দুয়ের মাঝখানে একজন বাংলাদেশি কিশোরের বেড়ে ওঠার গল্প নিয়ে এগিয়ে গেছে ‘অ্যা মুসলিম বয়’ উপন্যাসটি। খুব ঝরঝরে গদ্য। উইট এবং হিউমরের চমৎকার সমন্বয় ঘটেছে। অজিক চৌধুরী উপন্যাসটি নিজের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছেন। মা দেশের খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক সালেহা চৌধুরী, কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করার পর ১৯৭২ সালে স্বামী তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী সঙ্গে লন্ডনে চলে যান। তখন পুত্র অজিক চৌধুরীর বয়স ১১ বছর। শান্তির মতো তাঁকেও ব্রিটিশ সংস্কৃতির সঙ্গে অনেক কষ্ট করে মানিয়ে নিতে হয়েছে।
অজিক চৌধুরীর প্রতি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইল। প্রথম উপন্যাসেই তিনি বড় ক্যানভাস ধরে কাজ করেছেন। ভালো লাগছে এই ভেবে যে, তিনি বাংলাদেশি একজন কিশোরকে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র করে ব্রিটেনের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ও বহুজাতিক সংস্কৃতি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের নামকরণে তিনি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। কথাটা এইজন্যে বলছি, কদিন আগে ঢাকায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে আরেক বাংলাদেশি-ব্রিটিশ লেখকের সঙ্গে। তাঁর একটি সাইন্স ফিকশন উপন্যাস বের হয়েছে ‘দ্য সেভেনথ রিলেলিটি’ নামে। লেখক হিসেবে তিনি বাংলাদেশি নাম ব্যবহার না করে রেখেছেন সিডেরা জ্যাকস। লেখক পরিচিতি অংশেও বাংলাদেশি পরিচয়টা চেপে গেছেন। এর কারণ আমি জানতে চাইলে তিনি বললেন, সাইন্স ফিকশন লিখছেন বাংলাদেশি মুসলমান কোনো লেখক, এটা ইউরোপ-আমেরিকার পাঠক গ্রহণ করতে চাইবে না। মার্কেটিংয়ের কথা ভেবে তিনি অরিজিনাল নামে বইটি বের করেননি। কিন্তু অজিক তাঁর পরিচয়ের ব্যাপারে স্পষ্ট। আশা করি অজিক চৌধুরী তাঁর বাংলাদেশি পরিচয়কে সঙ্গে রেখেই অনেকদূর এগিয়ে যাবেন।

এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে। ঢাকাতে বড় পরিসরে লিটফেস্ট হয়। কদিন পর হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন। এসব সম্মেলনে বিদেশ থেকে বহু লেখক অংশগ্রহণ করেন। আমরা প্রত্যাশা করতে পারি, সম্মেলনগুলোতে বাংলাদেশের যাঁরা বিদেশে থেকে ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চা করছেন তাঁদের দাওয়াত করে আনা হবে। আমাদের মূলধারারা সাহিত্যের সঙ্গে তাঁদের বড়রকমের একটা গ্যাপ আছে। আমরা তাঁদের চিনি না, তাঁরা আমাদের চেনেন না। অথচ আমরা সকলে লিখছি বাংলাদেশকে নিয়ে। হয়ত ভাষার মাধ্যমটা আলাদা। [এমনকি বাংলাদেশে থেকেও যাঁরা ইংরেজিতে লিখছেন, তাঁদের সঙ্গেও দেশের মূলধারার সাহিত্যের বোঝাপড়ার ঘাটতি চোখে পড়ে।] দেখা যায়, অরুন্ধতী রায়, ঝুম্পা লাহিড়ীদের আমরা যেভাবে চিনি বা জানি বাংলাদেশি ডায়াস্পোরা লেখকদের আমরা সেভাবে চিনি না। দেশি প্রথম সারির মিডিয়াও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তাঁদের বইয়ের রিভিউ, অনুবাদ ও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। আমরা তাঁদের জানতে চাই, তাঁদের পড়তে চাই। এবং তাঁরা যেহেতু আধুনিক চলতি ইংরেজিটা ভালো জানেন, বাংলাটাও ভালো জানেন কেউ কেউ, তাঁরা নিজেদের লেখার পাশাপাশি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মানসম্মত সাহিত্যকর্ম অনুবাদেও হাত দেবেন, এটা আমাদের প্রত্যাশা। তবে এও ঠিক, বাংলাদেশি ভালো লেখার মানসম্মত অনুবাদ হলেই হবে না, বিদেশে বাংলাদেশি সাহিত্যের একটা মার্কেট তৈরি হতে হবে। সেই মার্কেটটা তৈরি হবে বাংলাদেশি ডায়াস্পোরা লেখকদের হাত ধরে। যেভাবে ভারতের ক্ষেত্রে ঘটছে।

‘তাহমিমা আনাম আমার চেয়ে দুর্বল লেখক, তাঁকে কেন বিশ্ব পড়বে, পুরস্কৃত করবে?’—এই ভাবনা থেকে আমাদের বের হতে হবে। তাঁরা বাংলায় লেখেন না। কাজেই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তাঁরা বাংলাদেশের লেখকদের প্রতিদ্বন্দ্বী নন। ইংরেজিতে আমাদের ভালো লেখকদের লেখা মানসম্মত অনুবাদ হয়ে আন্তর্জাতিক সাহিত্য-বাজারে যাচ্ছে না; এটা আমাদের জাতীয় আফসোস। কিন্তু পূর্বেই বলেছি, বাজার তৈরি করা না গেলে অনুবাদ হলেও লাভ নেই।

বাংলাদেশি ডায়াস্পোরা লেখকদের ক্ষেত্রে মোটা দাগে দুটি অভিযোগ ওঠে। এক. তাঁরা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ লেখক নন। কিন্তু তাঁরা বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। দুই. তাঁরা বাংলাদেশকে ভুলভাবে উপস্থাপন করছেন। 

অজিক চৌধুরী প্রথম অভিযোগ নিয়ে কথা হলো, বাংলাদেশের ভেতরেও কিন্তু শ্রেষ্ঠ লেখকদের জনপ্রিয়তা ও পঠনপাঠন কম। অনেক দুর্বল লেখক এখানেও জনপ্রিয় হচ্ছেন। তুলনামূলক বিচারে হাসান আজিজুল হকের চেয়ে হুমায়ূন আহমেদ বড় লেখক নন। কিন্তু দেখা যাবে, হুমায়ূন আহমেদের একটি বই যে পরিমাণ কপি বিক্রি হয়েছে, হাসান আজিজুল হকের সমগ্র বই মিলেও তত কপি বিক্রি হয়নি। ভারতের প্রসঙ্গ টেনেও আমরা বলতে পারি, বিশ্বে ভারতের প্রতিনিধিত্বশীল লেখকরা কিন্তু সেই দেশের শ্রেষ্ঠ লেখক নন। অরুন্ধতী-অমিতাভ-ঝুম্পার চেয়ে অনেক ভালো লেখক হয়ত সেখানে আছে। ইংরেজি বাদে ভারতীয় কোনো না কোনো ভাষায় লিখছেন। একইকথা অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে খাটে। তাই এই অভিযোগ করে লাভ নেই।

দ্বিতীয় অভিযোগ নিয়ে কথা হলো, বাংলাদেশে বসে আমরা যারা লিখছি, তারাও কি সবসময় বাংলাদেশকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছি। তাছাড়া এই সঠিক-বেঠিক নির্ণয় করা হবে কোন ভিত্তিকে? লেখক স্বাভাবিকভাবে তাঁর ভার্সনটা বেছে নেবেন, পাঠক সেটি মিলিয়ে নেবেন নিজের সঙ্গে। পাঠকের সত্য, লেখকের সত্য সবসময় একসত্য হয়ে উঠবে না। তাছাড়া ডায়াস্পোরা লেখকদের সবসময় এই বিতর্কে জড়াতে হয়েছে। সাহিত্যে সদ্য নোবেলজয়ী লেখক ইশিগুরো অজিক চৌধুরীর মতো অল্প বয়সে জাপান ছেড়ে লন্ডনে চলে যান। লন্ডনে বসে তিনি জাপানি প্রেক্ষাপটে উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর লেখার বস্তুনিষ্ঠটা নিয়ে তিনি নিজেই সন্দিহান। তিনি বলছেন, ‘স্মৃতি খুব অনির্ভরযোগ্য।’ অন্যত্র বলছেন, ‘আমি যেমনটি বলি, আমি নিশ্চিত এই অভিব্যক্তি যথার্থ নয়, কিন্তু এভাবেই গোধূলিটা স্মৃতিতে আমার আছে।’ ভারতীয় লেখকদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আরও তীব্রভাবে উঠেছে। ফলে রুশদিকে বলতে হয়েছে, ‘আমরা সশরীরে ভারতে এখন নেই, অনিবার্যভাবে এর অর্থ হলো, ঠিক যে-জিনিসটা আমরা হারিয়েছি সেটা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়; এককথায়, আমরা তৈরি করে বসব কাহিনি, সত্যিকারের শহর বা গ্রাম নয়, বরং এমন শহর বা গ্রাম যা কোথাও দেখা যায় না, কল্পনায় স্বদেশ, অনেকগুলো মনগড়া ভারত।’ [‘কল্পনায় স্বভূমি’, অনুবাদ : অভিজিৎ মুখার্জি]

এভাবেই বিশ্বসাহিত্যে স্বদেশ-বিদেশ ভেঙে যে অন্তর্বয়ান ও মহাবয়ানের মিশ্রণে নতুন এক বিশ্ববয়ানের সৃষ্টি হচ্ছে, তা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। আমরা যদি নাইপল-রুশদি-ইশিগুরোর মতো লেখকদের গ্রহণ করতে পারি, এটা যেনেও যে তাঁরা তাঁদের পিতৃমাতৃভূমির বিশ্বস্ত কথক নন, তাহলে স্বদেশি ডায়াস্পোরা লেখকদের গ্রহণ করতে সমস্যা কোথায়? তাঁর মানে এই নয় যে তাদের সমালোচনা হবে না। তাঁদের সাহিত্যমান ও অসঙ্গতি ধরে গঠনমূলক সমালোচনা হোক। কিন্তু সেটা করতে হলে তাঁদের আগে গ্রহণ করতে হবে। পড়তে হবে, পরস্পরকে জানতে হবে।  

 

 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী