অমৃতা প্রীতম (জন্ম: আগস্ট ৩১, ১৯১৯) পাঞ্জাবি কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক যিনি বিংশ শতাব্দীতে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের উভয় দিকের মানুষেরই প্রিয়পাত্র ছিলেন। ১৯৩৬ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অমৃত লেহরেঁ’ প্রকাশিত হয়। দেশভাগের পর তিনি লাহোর থেকে ভারতে চলে আসেন। তিনি ‘অজ্জ আখাঁ ওয়ারিস শাহ নূ’ নামে একটি বিষাদধর্মী কবিতা রচনা করেন, যেখানে ভারত ভাগের সময়কার বিপর্যয়ে তার রাগ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তিনি ‘পিঞ্জর’ উপন্যাসে ‘পারো’ নামে একটি স্মরণীয় চরিত্র সৃষ্টি করেন। ২০০৩ সালে এই উপন্যাসটির চলচ্চিত্ররূপ দেয়া হয়। তিনি সাহিত্য অকাদেমি অ্যাওয়ার্ড, জ্ঞানপীঠ অ্যাওয়ার্ড, পদ্মশ্রী সহ দেশি-বিদেশি আরও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
এক মুলাকাত
আমি নিশ্চুপ, শান্ত
এবং অটল দাঁড়িয়ে
পাশেই সমুদ্রে ঝড় উঠেছিলো
সমুদ্রের না জানি কী মনে হলো—
সে ঝড়ের একটা পুটলি বেঁধে
আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে
উধাও হয়ে গেল
হয়রান ছিলাম...
কিন্তু সমুদ্রের কেরামতি গ্রহণ করলাম
ভাবলাম এমন চমৎকার শতাব্দীতে
একবারই হয়ে থাকে
অসংখ্য এলোপাথাড়ি চিন্তা
মাথায় এসেছিলো তবুও অটল
দাঁড়িয়ে ভাবছি
ঝরের সেই পুটলি কাঁধে নিয়ে
কী করে নিজের শহরে ফিরবো?
যে শহরের প্রতিটি গলি সরু,
প্রতিটি ছাদ নিচু আর
প্রতিটি প্রাচীর প্রতারক!
ভাবছি যদি তোমাকে কোথাও
পেয়ে যাই; সমুদ্রের মতো
সেই ঝড় বুকে নিয়ে
দুই তীরের মতো হেসে উঠবো
আর সেই সরু গলি,
নিচু ছাদের শহরে ফিরে যাব
কিন্তু পুরো দুপুর তোমাকে
তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি আর
নিজের ভেতরের যন্ত্রণার আগুন
নিজেই পান করেছি
আমি এক শূন্য সমুদ্রতীর
নিজেকে লণ্ডভণ্ড করে যেই
শান্ত হলাম—সমুদ্রের ঝড়
সমুদ্রকে ফিরিয়ে দিয়েছি
এখন অবেলায়—এই
অন্ধকারে ফিরে এসে
তুমি উদাস, নিশ্চুপ
অটল দাঁড়িয়ে আছ
আমিও উদাস, নিশ্চুপ
অটল দাঁড়িয়ে আছি
কেবল দূরের সমুদ্রে
ঝড় দেখা যাচ্ছে।
পরিচয়
তোমাকে যদি পাই
কয়েকজন্ম আরও
বেঁচে থাকবো
আমার নিঃশ্বাস যেই
তোমার নিঃশ্বাস
পান করলো
কয়েক যুগ আরো
বদলে গেলো...
এক গুহা ছিলো
সেখানে এক যোগী
আমাকে জড়িয়ে ধরে
যেই আমার নিঃশ্বাস
ছুঁয়ে দিল
খোদার কসম!
ঠিক সেরকমই তৃপ্তি ছিলো
এ কেমন মায়া, এ কেমন লীলা
হয়তো তুমিই যোগী ছিলে
অথবা এই যোগী তোমার মতোই ছিলো
হয়তো তোমার বেশে
সে আমার কাছে এসেছিলো
কিন্তু আমিতো সেই ছিলাম...
এখনো দেখি তোমার নিঃশ্বাসে
সেই একইরকম তৃপ্তি...
স্মৃতির চাদর
তোমার সঙ্গে আবারও
দেখা হবে, কিন্তু কখন কিভাবে
কিছুই জানা নেই।
হয়তো তোমার কল্পনার
রঙে স্মৃতির ক্যানভাসে
রহস্যময়ী কোনো রেখা হয়ে
স্তব্দ তাকিয়ে থাকবো
তোমার সঙ্গে আবারও
দেখা হবে, কখন কিভাবে
কিছুই জানা নেই
হয়ত সূর্যের আলো হয়ে
তোমার রঙে মিশে যাব
সেই রঙ থেকে ভিজে
তোমার ক্যানভাসে এসে পড়বো
জানি না কখন কিভাবে
তবে তোমার সঙ্গে
দেখা হবে নিশ্চিত
অথবা যেভাবে ঝর্ণা থেকে
জল গড়িয়ে পরে
তেমনি কোনো ছোট্ট
জলের কণা হয়ে
তোমার শরীরে নেমে পড়বো
তোমার বুকের সঙ্গে
বুক মিলিয়ে নেব
আমি আর কিছুই জানি না
তবে এইটুকু জানি
সময় আমার সঙ্গে যা করবে—
যে জন্ম আমি পার করছি
সেখানে শরীর ধ্বংস হলে
সবকিছু শেষ হয়ে যায়
কিন্তু স্মৃতির চাদর
এত দীর্ঘ আর অসীম
আমি সেই চাদরে নিজেক
জড়িয়ে তোমার সঙ্গে
দেখা করবো
কিন্তু কখন, কিভাবে
কিছুই জানা নেই।
অবিশ্বাস
আজ আমি পুরো দুনিয়া বেঁচে দিয়ে
মাত্র একটি দিন কিনে নিয়েছি
আমি অবিশ্বাসের কথা বলেছি
স্বপ্নের এক দুনিয়া বুনেছি
এক টুকরো কাপড় ছিঁড়ে
জীবনের ঝোলা সেলাই করে নিয়েছি
আকাশের পাত্র হতে
মেঘের ঢাকনা সরিয়ে
এক পেয়ালা জোছনা পান করেছি
এই যে এক মুহূর্ত আমি
মৃত্যুর কাছ থেকে ধার নিয়েছি
গানের সাজিতে এর দাম মিটিয়ে দেব
আমার ঠিকানা
আজ আমি
নিজের ঘরের ঠিকানা মুছে দিয়েছি
আর গলির মাথায় ঝুলানো
গলির নামের সাইনবোর্ড ফেলে দিয়েছি
প্রতিটি সড়কের মাথায় লাগানো
নামগুলোও মুছে দিয়েছি
যদি তুমি আমার ঠিকানা পেতে চাও
তাহলে প্রতিটি দেশের, প্রতিটি শহরের
প্রতিট গলিতে আমাকে খোঁজ করো
এ এক অভিশাপ, আবার বরপ্রাপ্তিও!
আর যেদিকে তোমার মুক্ত হৃদয়ের
ঝলক পড়বে মনে রেখো সেটাই আমার ঘর।
আত্মমিলন
আমার বিছানা প্রস্তুত
জুতো আর জামার মতো
তুমি তোমার শরীরও খুলে ফেল
ওদিকটায় টেবিলের উপরে রাখো
বিশেষ কিছু না—
নিজ নিজ দেশের রীতি!
তোমার গান
আমার শহর যখন প্রথম
তোমার পা স্পর্শ করলো
তারার মুঠো ভরে
আকাশ নিচু হয়ে এলো
হৃদয়ের প্রান্তে মেলা শুরু হলো
রাতভর রেশমী পরীরা
পাখা বেঁধে এলো দলে দলে...
যখন আমি তোমার গান
লিখতে শুরু করি—কেশরের রেখায়
কাগজ ভরে গেল
সূর্য আজ মেহদির রঙে
হাত রাঙিয়ে লিখে দিয়ে গেল
আমাদের দুজনের ভাগ্য
নীরবতার চক্রান্ত
রাত বেড়ে চলছে...
কেউ যেন মানুষের বুকে
সিঁধ কাটছে চুরি করবে বলে
সকল চুরির চেয়েও ভয়ানক
কারো স্বপ্নকে চুরি করা
চুরির নিশানা
প্রতিটি দেশের, প্রতিটি শহরের
প্রতিটি রাস্তায় যেন লেগে আছে
কিন্তু কারো দৃষ্টি তা দেখতে পায় না
না চমকে উঠে।
শিকলে বাঁধা এক কুকুরের মতো
সময় যেনো কারো কবিতা হয়ে
ডেকে উঠে।