সুখ-দুঃখের আবেগে স্পন্দিত হয় কবির হৃদয়। কবির সেই আবেগ সৃজনশীল প্রকাশের মাধ্যমে প্রভাবিত করেন পাঠককে। সাধারণ মানুষের মতো তার মনে দানা বাঁধতে পারে নৈরাশ্য, অবিশ্বাস। দূর থেকে মনে হতে পারে আত্মনিমগ্ন কবি প্রতিদিনের জীবন থেকে পালিয়ে থাকতে চান, যেন তার হৃদয়ে কোনো দৃঢ়তা নেই।
বেদনার তারকে স্পর্শ করলেই কি তা আনন্দময় হয়ে উঠতে পারে? বেদনাকে বেদনা দিয়েই অনুভব করতে হয়। কবি মুস্তাফিজ শফি নির্জনতা আর অবচেতনে মগ্ন থেকে লিখেছেন নিশ্চেতনার কথা। কবি প্রতিদিনের জীবন থেকে পালিয়ে থাকতে চাননি কখনো। তিনি বেদনা নিয়েই অনুভব করতে চেয়েছেন বেদনার রূপ।
মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে মুস্তাফিজ শফির ২৪৫টি কবিতার সংকলন ‘বিরহসমগ্র’। প্রায় প্রতিটি কবিতায় তিনি সংকুচিত, কুঁকড়ে যাওয়া জীবন থেকে আহরণ করতে চেয়েছেন বেদনাকে, নিরাশাকে, জীবনের ধূসরতাকে।
‘কবির বিষণ্ণ বান্ধবীরা’ কবিতাগ্রন্থের একটি কবিতায় কবি তার বেদনাকে এঁকেছেন গভীর উপলব্ধির মমতায়:
লতার বেদনার ভার কি বোঝে বাঁশের কঞ্চি
গোত্র বিতাড়িত কচুরিপানার দুঃখ বোঝে ঢেউ?
ভাবলে ভাবতেই পারো, আমিও হয়তো
কেউ নই, একগুচ্ছ বেদনার ভার ছাড়া
আমিও শূন্য ভীষণ, ভীষণ হতচ্ছাড়া।
সেই একই গ্রন্থে কবি লিখেছেন:
মিশে যায় আলো মৌনসন্ধ্যায় মুখোমুখি
আমি আর অন্ধকার।
দাও, পেতে রাখি হাত, একটু যদি
বিনিময় হয় হাহাকার।
‘নির্জনতার সঙ্গে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:
নির্জনতা তোমার আমার এগিয়ে চলা
অন্তহীন এই পথের বাঁকে,
নির্জনতার মায়ার ভেতর, ছায়ার ভেতর
নির্জনতা একলা আমায় একলা ডাকে।
‘নিঃসঙ্গতার কাছে দীর্ঘশ্বাস গচ্ছিত রেখে’ কবিতায় নিঃসঙ্গ কবি আরো নির্জনতা অনুভব করেন:
ধু ধু মাঠে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছটির মতো একা হতে হতে
আমিও যে দাঁড়িয়েছি আজ তোমার উঠানে। এইসব মায়াময় নির্জনতার
কাছে, নিঃসঙ্গতার কাছে গচ্ছিত রেখে আমার দীর্ঘশ্বাস।
নব্বই দশকের কবি মুস্তাফিজ শফি পেশায় সাংবাদিক। জাতীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতায় তার সময়ের সবচেয়ে মেধাবী তরুণদের একজন। ১৯৭১ সালের ২০ জানুয়ারি সিলেটের বিয়ানীবাজারে জন্ম। সেখান থেকেই তার কবিতাজীবন শুরু। লেখালেখিতে সক্রিয় থেকেও তিনি একজন সফল সাংবাদিক। তিনি মৌলিক লেখালেখিতে পাঠকের মাঝে তৈরি করেছেন ভালোবাসার আসন।
কবি মুস্তাফিজ শফির কবিতার প্রণোদনা তৃষ্ণার, বিস্ময়কর যাতনার, সকরুণ একাকীত্বের। তার কবিতায় রয়েছে শুদ্ধ সুন্দর নিঃসঙ্গতার আকুলতা, নিঝুম দ্বীপের নীরবতা। এই শক্তিমান কবির বড় গুণ তিনি দুর্বোধ্য কবিতা লেখেন না। তার সহজ সুন্দর সাবলীল ভাষাভঙ্গি পাঠকে সহজেই টেনে নিয়ে যায়। পাঠক তার কবিতার পঙক্তিতে নিজেকে খুঁজে পায় অনুভবের আলোড়নে। এখানে তিনি স্বকীয়তায় প্রাঞ্জল। তার উপমা, চিত্রকল্প এতটা হৃদয়গ্রাহী যে পাঠক ভুলে যান কখন সে নিজে কবিতার অতলে ডুবে গেছেন।
যেমন করে ‘এমন বৃষ্টির রাতে’ কবিতায় তিনি তার একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতার আকুলতা প্রকাশ করেছেন:
কান্নার জল আমাকে ভিজিয়ে দেবে, ভিজিয়ে দেবে
আর আমি শুধু তোমাদের কোলাহল থেকে দূরে,
বহুদুরে, কারো বুকের অতল গভীরে
ঝরাপাতা হয়ে কেবল ডুবে থাকবো, ডুবেই থাকবো।
পারোতো লিখে রেখো এপিটাফ—
জমা-খরচের খাতায় রেখে যেতে কিছু ঋণ,
ঝরাপাতা হবে বলে সেও এসেছিলো একদিন।
শফির কবিতা পড়তে গেলে এক মায়ার বেড়াজাল রচনা করা ঘোর প্রলম্বিত হয় পাঠকের হৃদয়ে। কিছুদূর যেতেই পাঠক ভালোবাসতে শুরু করেন ওই মায়াকে। সেখান থেকে তিনি আর বেরিয়ে আসতে চান না। এ বুঝি এক ধরনের ঘোর, যে ঘোর তিনি সঞ্চারণ করেন পাঠকের মনজুড়ে।
তার কবিতায় ধূসরতা আর নিরাশা যেনো এক বিবর্ণ কোলাজ। জীবনযাপনের নিত্যদিনে তার হৃদয়ের অন্ধকার কাটে না, নিরাশা মোছে না। ‘ঈশ্বর এবং অনিবার্য ঝড়’ কবিতায় উঠে আসা হাহাকারে পাঠক বিলীন হয়ে খুঁজে ফেরেন নিজের শূন্যতা:
কিছুক্ষণ আগেও দেখেছি আমার আর ঈশ্বরের মাঝ বরাবর বয়ে চলেছে
কিছু অনিবার্য শূন্যতা। আর আমি খুলে বসি আত্মার পবিত্র বৈঠকখানা।
হঠৎ দেখি সরস্বতীর মতো সাদা ভাষ্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই
মেয়েটি—যে কিনা কাঁধের ব্যাগে ভরে রাখতো মেঘ, প্যান্টের বাম
পকেটে রোদ্দুর আর ডান পকেটে সমুদ্রের ফেনিল জল। চারুকলার
বকুলতলা আর শূন্যতাভরা পুকুরের পাড় তার খুব প্রিয় ছিলো। শীত
বসন্ত বৈশাখ–আমি বারবার ছুঁয়ে আসি সেই হাহাকারগুলো।
‘জুয়াড়ি’ কবিতায় শফির বিরহ-দর্শন সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়ে আমাদের আচ্ছন্ন করে এক অদ্ভুত না-পাওয়ার যাতনায়। সব মানুষের জীবনেইতো বিরহ আছে, বিরহের যাতনাও আছে। কবিতায় তার সেই উচ্চারণ:
পূর্বজন্মে তুমি নদী ছিলে, আর আমি তরঙ্গে ভাসা কচুরিপানা। হাজার
বেদেনীর দাঁতে ঝিলিক দেওয়া হাসিতে রাতের নির্জনতা ভেঙে এখনো
তুমি দুলে দুলে ওঠো, আর আমি হাবুডুবু খেতে খেতে ভালোবাসার
নামে পাঠ করি কোনো আশ্চর্য আখ্যান।
অন্য আরেক জন্মে ধুধু হাওয়া হয়ে ভাটির বিলের বুক বরাবর ভেসে
বেড়িয়েছো তুমি, আর আমি দীর্ঘ তালগাছ হয়ে শূন্যতাকে আগলে রেখে
পান করেছি তোমার ঘ্রাণ।
অথচ দেখো এই জন্মে জুয়াড়ি হতে গিয়ে তোমাকে বানিয়ে ফেলেছি
স্মৃতির কলসে বন্দি সোনালি চড়ুই।
জীবনের নিষ্ঠুর ও অশুভ দিক সম্পর্কে তার সচেতন অভিব্যক্তি প্রায় তিক্ততার কাছ ঘেঁষে গেছে। তিনি জীবনকে তার ঔদাসিন্য, নির্মমতা ও অসম্পুর্ণতা নিয়েই গ্রহণ করেছেন। জীবনের না-পাওয়ার নির্মমতা কবির সাথে যেনো তার পাঠক আর প্রকৃতিকেও কাঁদায়। তোমার সেই চিঠি পেয়ে আমিও কেঁদেছি অনেক। আর একাকী নির্জন
রাতে হাওরের বুক বরাবর হাঁটতে হাঁটতে শুনেছি প্রকৃতির হাহাকার।
গ্রীষ্মের প্রবল দাহে রাত্রি যখন ঘেমে ওঠে, বেদনার বালিগুলোকে
পৃথিবীর বুক থেকে উড়িয়ে নিতে নিতে বাতাসও তখন কাঁদে।
আধুনিক সময়ে মৃত অনুভূতির বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে মুস্তাফিজ শফি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো উচ্চারণ করতে পারেননি, ‘এই লভিনু সংগ তব, সুন্দর হে সুন্দর।’ একি তার সীমাবদ্ধতা, না কালের? সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তিনি বরং জীবনানন্দের সুরে সুর বেধেছেন—পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন—এর তীব্র বাস্তব চেতনা। ব্যর্থতার নিয়তি নিয়ে মানুষের জীবনে নেমে আসছে ক্রমাগত অন্ধকার ও আয়ুর ক্ষয়। উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়, মানুষেরও আয়ু শেষ হয়।
কবি মুস্তাফিজ শফির জীবন থেকে নিরাশা কি সবকিছু নিয়ে যেতে পেরেছে? তিনিও জীবনের কাছে ফিরতে চেয়েছেন নতুন আশায়। ‘খুলে দিও দখিনের জানালা’য় কবি লিখেছেন:
সোনাইয়ের ক্লান্ত স্রোতগুলো যদি ফিরে আসে। শরতের আকাশে ধবল
সাদা মেঘগুলো যদি পায় বৃষ্টির দেখা। ধূসর শালিক যদি
ফিরে পায় তার ঝরে পড়া পালকের মর্মার্থ—আর বরুণের ডালে হারিয়ে
যাওয়া বাচ্চাদের কণ্ঠে জড়ানো গান।
তাহলে রাতের নির্জনতার কাছে কিছু হাহাকার গচ্ছিত রেখে ভোরের
ট্রেনে আমি ফিরব বাড়ি, তোমার পেছন পেছন। দরজাটা না হয়
বন্ধই থাক, দখিনের জানালাটা একটু খুলে দিও।
‘তোমার হাত পাখার শব্দের ভেতর’ তিনি লিখলেন:
তোমার নিবিড়তম স্পর্শের মায়ায়
শীতের রুক্ষ উঠোনেও অনায়াসে
নামিয়ে ফেলবো বৃষ্টির ছটা,
হাত ইশারায় থামিয়ে দেবো বর্ষার ট্রেন।
তোমার নিবিড় মৌনতা গ্রাস করে
টেনে আনবো পুষ্পের দিন,
এইতো আমার ছায়া—
টের পাও, তোমার হাত পাখার শব্দের ভেতর?
প্রেমিকার নিবিড় মৌনতা গ্রাস করে কবি টেনে আনতে চেয়েছেন পুষ্পের দিন। কৃত্রিম মগ্নতা আর ভুল অবগাহন শেষে তিনি খুঁজে পেতে চেয়েছেন জীবনের নতুন পথ। ‘শিউলি রায় বাড়ি আছো’ কবিতায় তার জীবনের নতুন পথ খোঁজা:
আজও মনে পড়ে সেই শ্যামল কিশোরী মুখ। স্মৃতির ধুলো হাতড়ে
আজও আমি তুলে আনি সেই সব উজ্জ্বল পাতাবাহার দিন। তার
আলতামাখা পায়ে নূপুরের ধ্বনিতে আজো আমি পথ খুঁজি, নতুন পথ।
সব কৃত্তিম মগ্নতা আর ভুল অবগাহন শেষে প্রতি পূর্ণিমায় আমি তার
উঠোনে গিয়ে ডেকে উঠি—শিউলি রায় বাড়ি আছো?
দৃশ্যের বর্ণনায়, চিত্রকল্পের বর্ণনায় মুনশিয়ানার সাথে কবি তার কবিতায় তৈরি করেছেন কাব্যের আখ্যান। ‘পড় তোমার প্রেমিকার নামে’ দিয়ে যে যাত্রা শুরু। তারপর তিনি থেমে থাকেননি। ‘দহনের রাত’, ‘মধ্যবিত্ত কবিতাগুচ্ছ’, ‘কবির বিষণ্ণ বান্ধবীরা’, ‘মায়া মেঘ নির্জনতা’ কিংবা ‘ব্যক্তিগত রোদ ও অন্যান্য’ কবিতাগ্রন্থে তিনি সৃষ্টি করেছেন এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিক মায়ার জাল, কী এক বেদনার ঘোর!
মুস্তাফিজ শফির মতো জন কিটসও গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন মানব জীবনের এই বেদনার কথা। তিনি আমাদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘তুমি কি দেখো না পৃথিবী-সমান কতটুকু বেদনা আর সমস্যার প্রয়োজন পড়ে বুদ্ধিমত্তাকে পরিশীলিত করতে এবং তৈরি হয় আত্মা।’ মুস্তাফিজ শফির আত্মা তার বুদ্ধিদীপ্ত কবিতা রচনায় পরিশীলিত হয়ে তাই বুঝি এমন ভারাক্রান্ত, নিঃসঙ্গ, নিবিড় মৌনতায় আচ্ছন্ন। শফির কবিতা পড়তে পড়তে তার গুণগ্রাহী পাঠক নিজের অজান্তে সেই প্রাচীন আইরিশ ত্রিপদীতে আবিষ্ঠ হয়ে পরতে পারেন:
‘কবিকে ভালোবাসা মরণ;
কবিকে বিদ্রূপ করা মরণ;
কবি হওয়া মরণ।’
(“Do you not see how necessary a world of pains and troubles is to school an intelligence and make it a soul?”– John Keats.