X
সোমবার, ২০ মে ২০২৪
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

পাথর পথের মানুষ

নাহার ফেরদৌসি বেগম
২০ এপ্রিল ২০২০, ১৭:৩৪আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২০, ১৭:৩৮

করোনায় আমরা ভীত নই। বরং মোকাবেলা করছি গৃহে অন্তরীণ থেকে। এতে হয়ত কিছুটা বাড়তেও পারে মানসিক চাপ। তাই আসুন, খুলে দেই মনঘরের জানালা। নিজেকে চালিত করি সৃজনশীলতায়। আপনি নিয়মিত লিখছেন, বা এটাই হতে পারে আপনার প্রথম গল্প। লিখুন ফেসবুকে। চটজলদি ৫০০ শব্দের গল্প, বাংলা ট্রিবিউনের জন্য। একইসঙ্গে নমিনেট করুন আপনার পছন্দের আরও ১০ জন লেখককে। সেরা ১০ জন লেখক পাচ্ছেন কাগজ প্রকাশনের বই। আর অবশ্যই হ্যাশট্যাগ দিন #বাংলাট্রিবিউনসাহিত্য পাথর পথের মানুষ অক্টোবর মাস। প্রায় ভোর হয়ে আসা শীতের রাত। ১৯৬১ সাল। ছোট মফস্বল শহর বরিশাল। টিমটিমে হ্যারিকেনের আলো জ্বলা টিনের ঘরে প্রসব বেদনায় কাতর অষ্টাদশী এক তরুণী। দীর্ঘ রাতের প্রসব বেদনায় ক্লান্ত শরীর যেন জীবনের ভার আর বইতে পারছে না। সময়টাও স্তব্ধ হয়ে আছে। যন্ত্রণাকাতর তরুণীকে ঘিরে বসে আছে কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ রমণী আর অক্সফোর্ড মিশন থেকে আসা একজন চল্লিশোর্ধ্ব নার্স। মাঝেমধ্যেই ভেসে আসছে প্রসূতির যন্ত্রণাকাতর গোঙানি। সময়ের স্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ করেই ভেসে আসে আজানের শব্দ তার সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্ত তরুণীটি তার সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে চেপে ধরে পাশের রক্ষার হাত দুটিকে। অস্ফুট শব্দে কেঁদে ওঠে একটি সদ্যোজাত শিশু।

ছেলে? না মেয়ে? নার্সের ক্লান্ত কণ্ঠস্বর—মেয়ে। মনে হলো প্রত্যাশার দপদপে শিখাটি কে যেন হঠাৎ এক ফুৎকারে নিভিয়ে দিল। অনাহুত কন্যা জন্ম। হতাশ জন্মদাত্রী।

মেয়ে হওয়ার অপরাধে সকলে মুখ ফিরিয়ে নিলেও পিতা পরম আদরে কোলে তুলে নিল তার প্রথম জাতিকাকে। পিতার আদরে প্রশ্রয়ে বড় হওয়াটাও যেন ছিল পাড়া প্রতিবেশীর চক্ষুশূল। পিতার ‘না’ ছিল না কন্যার কোনো আবদারে। সীমিত সাধ্যের মধ্যে পিতার প্রচেষ্টা ছিল কন্যাকে উজাড় করে পৃথিবীর সকল আনন্দ দেবার।

পিতার প্রশ্রয়ে কন্যাটি হয়ে উঠল দুরন্ত, সকল বিষয়েই ছিল অসীম কৌতূহল। খাসিয়া পল্লির পাহাড়ের কোলঘেঁষে সারি সারি Fenchugonj Fertilizer Factory-এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়ার্টারগুলো এই দুরন্তপনাকে স্রোতের মতো ভাসিয়ে নিচ্ছিল। দিন শেষে খাসিয়া রমণীরা মাথায় লাকড়ির বোঝা আর পিঠে কাপড়ের ঝোলার মধ্যে সন্তানকে ভরে সুঠাম দেহের ছন্দায়িত দোলায় পাহাড়ে উঠে যেত। মেয়েটির সকল ভাবনা যেন এই খাসিয়া রমণীদের পেছনে পেছনে ধেয়ে চলত। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে হারিয়ে যাওয়া ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক। খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত পিতাটি দেখতে পেত পাহাড়ের বয়ে আসা ঝরনার স্রোতে পা ডুবিয়ে তার দুরন্ত কন্যাটি একমনে বসে বসে পাখি আর কাঠবিড়ালিদের দেখছে। তাই মেয়েটির নামও দিল ঝরনা।

পিতাপুত্রীর এই পৃথিবীতে মায়ের কি কোনো স্থান ছিল?

অষ্টাদশী তরুণীটির জীবনের জৈবিক প্রক্রিয়ায় সন্তানের জন্ম হলেও সত্তায় কিন্তু আদৌ মা হয়ে উঠতে পারেনি, এর ওপরে ছিল পুত্র প্রত্যাশার আশা ভঙ্গের বেদনা। সে যেন তার নিজের সঙ্গে নিজেই যুদ্ধ করে চলেছে নিরন্তর। অন্তর্মুখী এই যুদ্ধে কন্যাটি ছিল একান্তই উপেক্ষিত।

ইতোমধ্যে পিতাটি চাকরিসূত্রে স্থানান্তরিত হয়েছে করাচি শহরে। মেয়েটি পরম বিস্ময়ে দেখে বড় বড় রাস্তা, দালান, বাস-ট্রাক- ট্রাম-ট্যাক্সি। সবচেয়ে বড় বিস্ময় ছিল তার বয়সি শিশুরা লজেন্সের মতোকী যেন মুখে দিয়ে সেটা চিবিয়ে চিবিয়ে ফুলিয়ে বেলুন বানায়। প্রচণ্ড বিস্ময়ে দেখল ঝলমলে শিশুদের বিজাতীয় ভাষায় কথা বলা। চকোলেট দিয়ে বেলুন ফোলানো শিশুগুলোকে তার মনে হয় ঈশ্বরের দূত। এক সময় সেও শিখল এগুলোকে বলে চুইংগাম। সেও শিখে নিল নরম চকোলেটের মতো এই পদার্থটাকে চিবিয়ে চিবিয়ে মিষ্টিটা শুষে নিয়ে দাঁত, ঠোঁট এবং জিহ্বার সমন্বয়ে কীভাবে এটা দিয়ে বেলুন ফোলাতে হয়। নিজেকে তার মনে হলো আমিও পারি। শিখল কীভাবে গাছে উঠতে হয়। আরও শিখল বাবার মানিব্যাগ থেকে দুই আনা চার আনা চুরি করে ছোট ছোট সাইকেল ভাড়া করে ছেলেদের কাছ থেকে সাইকেল চালানো। বাবা সব বুঝেও উপভোগ করত প্রথম জাতিকার এই দুরন্তপনা।

একে একে সংসারে এল আরও তিনটি কন্যা। তরুণীটির আরও তিনবার আশাভঙ্গের যন্ত্রণা। জীবনের এই আশাভঙ্গের বেদনায় মাইগ্রেন হয়ে উঠল তরুণীটির দৈনন্দিন সঙ্গী। মাইগ্রেনের মাথাব্যথায় কাতর তরুণী দৈনন্দিন দায়িত্বের বিষয়েও হয়ে উঠল নিরাসক্ত, বিরক্ত। ওষুধ এবং বিছানা এই দুই হয়ে উঠল তার একান্ত আশ্রয়। ফলশ্রুতিতে দুরন্ত কিশোরীকে কৈশোর পেরোবার আগেই দায়িত্ব নিতে হলো ছোট ছোট দুটি শিশুর।

বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই মায়ের আদেশ এল ঘরের বাহিরে যাওয়া যাবে না।

১৯৭১-এর ডিসেম্বর পরবর্তী সময়। প্রচণ্ড অহংকারী পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর অহংকারকে পদাঘাত করে কৃষ্ণকায় গাত্রবর্ণের খর্বাকৃতির, হাত দিয়ে ভাত আর কাঁচা মাছ খাওয়া অসভ্য বাঙালিগুলো শেখ মুজিব নামের এক দুর্বিনীতের নেতৃত্বে পাকিস্তান নামের মানচিত্রকে দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান তার দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাসে আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিচয়ে। সেই বাঙালির উঠতি বয়সি কিশোরী মেয়ে কী করে নিরাপদ থাকে ঘরের বাহিরে? এক ঝটিকায় মেয়েটি যেন নিজের শরীরকে, অস্তিত্বকে নতুন করে চিনতে বাধ্য হলো। শুরু হলো গৃহবন্দি জীবন। জানালা দিয়ে আকাশ দেখে আর ভাবে আমার আকাশ কোথায় হারাল। খেলার মাঠ, সাইকেল চালানো, গাছে ওঠা, ফেরিওলার কাছ থেকে বাদাম বুট তেঁতুল কিনে খাওয়ার অবারিত আনন্দগুলো হঠাৎ করে কেনইবা বাবা-মার দৃষ্টিতে হয়ে গেল অনেক বড় অপরাধ। অবুঝ কৈশোরে এই বন্দিত্ব মেনে নিতে না পারার অসহায়ত্ব গুমড়ে কাঁদে কিশোরীর মনে।

১৯৭৩-এর নিজ ভূমে পুনরায়।

এ যেন নতুন দেশ। কিউবায় পাট রপ্তানির অপরাধে গমভর্তি জাহাজ ভারত মহাসাগর থেকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল আমেরিকা। আরম্ভ হলো দুর্ভিক্ষ। পথের দুধারে হাড় জিরজিরে ক্ষুধায় কাতর, চক্ষু কোঠরাগত, মানুষগুলোর একমুঠো খাবারের জন্য তীব্র হাহাকার। খাদ্যাভাবে মৃত মায়ের শুকনো স্তন চুষতে চুষতে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত শিশুটির কান্নার শক্তিও যেন অবশিষ্ট নেই। এর মধ্যে সংসারে এল আরও একটি সদস্য, এবার পুত্র। ১৯৬১-এর সেই সন্তান জন্মদানকারী অষ্টাদশী ১৯৭৪ যেন প্রথমবারের মতো‘মা’ হলো। পুত্রকে পেয়ে তরুণীর তার জীবন যেন পূর্ণ হয়ে উঠল চারদিকের এই দুর্ভিক্ষর মধ্যেও।

ঝরনা নামের কিশোরীটিও সময়ের ঘূর্ণিপাকে মনেপ্রাণে শরীরে হয়ে ওঠে তরুণী। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রচেষ্টায় সিভিল সার্ভিসে অংশগ্রহণ করে। ১৯৮৮ সালে যোগদান করে কর বিভাগে। চলতে থাকে বাস্তব জীবনের যাত্রা। ব্যক্তিগত জীবনে আসে জীবনসঙ্গী আর একমাত্র সন্তান অরিন। জীবনের এই চরাই-উৎরাই কেটে যাচ্ছিল হাসিকান্নার মাঝেই। অফিসার্স ক্লাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জয়ী হওয়ার পথে রোটারির তদানীন্তন গভর্নর স্যাম শওকতের আন্তরিক সহযোগিতা উৎসাহিত করে রোটারিতে যোগদানে। ২০১৪-তে হয়ে উঠল Rotary Club of Dhaka North West-এর একজন গর্বিত সদস্য।

চাকরি, ক্লাব, সংসার, সমাজ সবকিছুই চলছিল জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে। কিন্তু ঈশ্বরের কলমে তার জীবনের অন্তরা লেখা ছিল ভিন্ন ছন্দে। হঠাৎ জীবনসঙ্গীর ধরা পড়ল কর্কট রোগ Blood Cancer Leukemia। অসহায়ভাবে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। Chemothearaphy, ডাক্তার, হসপিটালের চক্রে প্রাণোচ্ছল একটি মানুষ কীভাবে হয়ে উঠল কঙ্কালসার। মৃতপ্রায় অথচ কোঠরাগত চোখ দুটিতে জীবনকে আঁকড়ে ধরা জীবনের জন্য কী প্রচণ্ড আকুতি। বিধাতার কাছে এই আকুতির কোনো মূল্যই নেই। নিয়ে গেলেন বিধাতা তাকে নিজের কাছে। মাত্র এগারো মাসের ডাক্তার-ওষুধ-হাসপাতাল-পরিবার সকল প্রচেষ্টার ইতি ঘটিয়ে।

আরম্ভ হলো মা-মেয়ের জীবন যাত্রা।

চাকরির শেষ প্রান্তে এসে যখন পেছন ফিরে জীবনকে দেখে খুব দার্শনিকভাবেই মনে হয় এই তো জীবন—এই আসা-যাওয়া—এই হাসি কান্না—এর মাঝেই ফুল ফোটানোই আনন্দ—হাসি ছড়াতে পারাটাই সার্থকতা।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘নিখোঁজ’ এমপি আনোয়ারুল আজিমের খোঁজে ভারতে গেলো পরিবার
‘নিখোঁজ’ এমপি আনোয়ারুল আজিমের খোঁজে ভারতে গেলো পরিবার
পশু আমদানিতে সম্মতি দেবে না প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়
পশু আমদানিতে সম্মতি দেবে না প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়
মদরিচের নেতৃত্বে ক্রোয়েশিয়ার ইউরো দল ঘোষণা
মদরিচের নেতৃত্বে ক্রোয়েশিয়ার ইউরো দল ঘোষণা
বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত হোসেনউদ্দীন হোসেন আর নেই
বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত হোসেনউদ্দীন হোসেন আর নেই
সর্বাধিক পঠিত
রাইসির হেলিকপ্টারের অবস্থান ‘শনাক্ত’, সুসংবাদের প্রত্যাশা
রাইসির হেলিকপ্টারের অবস্থান ‘শনাক্ত’, সুসংবাদের প্রত্যাশা
ঋণ খেলাপের দায়ে স্ত্রী-ছেলেসহ স্টিল মিল মালিকের কারাদণ্ড
ঋণ খেলাপের দায়ে স্ত্রী-ছেলেসহ স্টিল মিল মালিকের কারাদণ্ড
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত
রাইসির বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের ভিডিও প্রকাশ
রাইসির বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের ভিডিও প্রকাশ
ইরানের প্রেসিডেন্ট নিহতের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া
ইরানের প্রেসিডেন্ট নিহতের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া