করোনায় আমরা ভীত নই। বরং মোকাবেলা করছি গৃহে অন্তরীণ থেকে। এতে হয়ত কিছুটা বাড়তেও পারে মানসিক চাপ। তাই আসুন, খুলে দেই মনঘরের জানালা। নিজেকে চালিত করি সৃজনশীলতায়। আপনি নিয়মিত লিখছেন, বা এটাই হতে পারে আপনার প্রথম গল্প। লিখুন ফেসবুকে। চটজলদি ৫০০ শব্দের গল্প, বাংলা ট্রিবিউনের জন্য। একইসঙ্গে নমিনেট করুন আপনার পছন্দের আরও ১০ জন লেখককে। সেরা ১০ জন লেখক পাচ্ছেন কাগজ প্রকাশনের বই। আর অবশ্যই হ্যাশট্যাগ দিন #বাংলাট্রিবিউনসাহিত্য
—কেমন আছ?
—উমম?
—কেমন আছ?
—জানি না তো। কেমন আছি? সত্যিই তো! কেমন আছি!
—আহা। সে কী কথা! কেমন আছ তাও জানো না! এটা আবার হয় নাকি গো!
—হয় না আবার! কে বলেছে? আচ্ছা, এবার তুমিই বলো, কেমন আছ?
—এই তো আছি! দিব্যি আছি!
—দিব্যি কেমন? ঝেড়ে কাশো!
—কী সব কথা! দিব্যি মানে ভালো আছি, দিব্যি মানে সুখেই আছি, তাও বোঝো না?
—সুখেই আছ? হাহা! হাহা!
—হাসছ যে খুব! ভালো থাকা হাসির কিছু?
—হাহা! হাহা! নয় বলছ? আচ্ছা তবে হাসব না আর! কান মলছি! হাহা! হিহি!
—আহ! থামো তো! হাসিও এমন বিচ্ছিরি হয়! গা জ্বলে যায়!
—জ্বলুক! জ্বলুক! গাও না হয় জ্বলুক খানিক। একা শুধু মন জ্বলবে, পুড়বে হৃদয়, সেই বা কেমন!
—তোমার শুধু কাব্য করা! ছাড়ো তো সব!
—আচ্ছা যাও, ছেড়েই দিলাম! এবার খুশি?
—দারুণ খুশি! ভীষণ খুশি! ঠিক আমাদের খোকার মতো!
—খোকার মতো! কী যে বলো! খোকাটা কে?
—সে কী কথা! ভুলে গেলে? ভুলেই গেলে খোকার কথা!
—না না! না না! ভুলিনি তো! খোকার কথা ভুলব কেন! সেই যে খোকা! আমাদের সেই ছোট্ট সোনা! কোথায় গেল? কোথায় গেল? খোকা! খোকা!
—সিস্টার! রোগীকে কড়া ঘুমের ওষুধ দাও! অক্সিজেন লাগাও! কুইক!—মনিটরে চোখ রেখে দ্রুত কথাগুলো বলে ডা. জাহিদ। রোগী প্রলাপ বকছে। কোমায় চলে যাওয়ার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমশ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশের বেবিকটটায় চোখ রাখে জাহিদ। কী নিশ্চিন্ত, নিষ্পাপ একটা মুখ! ঘুমাচ্ছে। মিষ্টি, টুলটুলে মুখটায় এক টুকরো হাসি ঝুলে আছে। এক ফালি চাঁদ। অজান্তেই ভিজে ওঠে চোখ। প্রায় ভুলে যাওয়া মায়ের মুখটা মনে করতে চেষ্টা করে। অস্পষ্ট, ঝাপসা। চোখের সামনে মনিটরটাও ঘোলাটে হয়ে আসে। অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী নারীটির মুখের কাছে কান নিয়ে শুনতে চেষ্টা করে জাহিদ। ফিসফিসে, দুর্বল স্বর থেকে শব্দগুলো আলাদা করতে চায় প্রাণপণে। খোকা! আমার খোকা! সোনা! হাহা! আয়! দুধ খা বাবা! আমার সোনাবাবাটা!
সাবধানে সরে আসে জাহিদ। চোখ মনিটরে স্থির হয়। অসহায় লাগে। কোনো মানে হয়! মানে হয় কোনো! বিড়বিড় করে জাহিদ। এসির নিচে বসেও ঘামতে থাকে শরীর। মনিটরে ওঠানামা করা রেখাগুলো সরল হয়ে আসে ক্রমশ। থির, নীরব হয়ে যায় একসময়। অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য নামে রুমটায়। মৃত্যু তেমন আলোড়িত করে না আর। এমন মৃত্যু দেখে অভ্যস্ত সে। তবু আজ অস্থির লাগে। মা! মারা যাচ্ছে, সে নিয়ে ভাবনা নেই কোনো, সন্তানকে নিয়ে ভেবে সারা হচ্ছে তখনও! জাহিদকে রেখে মা যখন চলে যাচ্ছিল, অনন্ত যাত্রায় যখন মা পা বাড়িয়েছিল অমোঘ, অলঙ্ঘনীয় কারও নির্দেশে, তখন সেও কি এমন দোটানায় পড়েছিল? জাহিদকে ভেবে মাও কি এমনই দীর্ঘশ্বাসে, দুর্ভাবনায় ভুলে গেছিল নিজের মৃত্যুযন্ত্রণা? বেবিকটটায় চোখ পড়ে আবার। বেবিটা হাসছে ঘুমের ভেতর। সে জানে না, পৃথিবীতে যে বুকটাতে তার জন্য জমা ছিল অমৃতধারা, নিরাপত্তার উষ্ণ ওমে তাকে আগলে রাখার যে চাদরটা ছিল তার জন্য, তা নেই আর। হারিয়ে গেছে খানিক আগে। শিশুবেলার কথা মনে পড়ে জাহিদের। বেবিটার জন্য করুণায়, মায়ায় ভিজে আসে চোখ। ফোনটা হাতে নেয় আনমনে। চোখ মুছে সাবধানে ডায়াল করে চেনা নম্বরটায়।
—হ্যালো, জাহিদ? কী রে? এত রাতে? কী ব্যাপার?
—কেমন আছ, রুনু আপা?
—এই তো রে! যেমন থাকা যায় এসময়! এত রাতে ফোন করলি যে? কোনো সমস্যা?
—অনেকদিন েআগে একটা কথা বলেছিলে, মনে আছে?
—কী কথা বল তো? মনে পড়ছে না এখন।
—সেই যে, বেবি দত্তক নিতে চাও, বলেছিলে না?
—ও হ্যাঁ! হ্যাঁ! বলেছিলাম তো। পেয়েছিস?
—হুম। নেবে?
—বেবির বাবা-মা? রাজি হবে?
—কেউ নেই রুনু েআপা। একটু আগে মা মারা গেল। বাবা গতসপ্তায়।
—সে কী রে! কীভাবে?
—ভাইরাস।
—করোনা?
—হুম।
—তুই কি পাগল? এই বাচ্চা নেয়ার জন্য ফোন করেছিস? তোর তো কোনো আক্কেলজ্ঞান নাই দেখছি।
—ফোনটা নীরব হয়ে যায় ধুম করে।
বেবিটা জেগেছে। ইতিউতি তাকাচ্ছে অবাক চোখে। মুখে হাত দিয়ে চুষছে চপাচপ। ঝাপসা চোখে বেবিকটে শোয়া নিজের প্রতিবিম্ব দেখে জাহিদ। বাইরে জ্যোৎস্নার ঝুম বৃষ্টি তখন। বোবা, ফ্যাকাসে চোখে চাঁদটা গোঙায়। জাহিদের মতোই।