X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ওড়িশার দুইটি লোকগল্প

হিন্দি থেকে সংগ্রহ : ম্যাগডিলিনা মৃ
২৯ এপ্রিল ২০২০, ০০:০১আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২০, ০৭:৫১

[ওড়িশা ভারতের পূর্ব তটে, বাংলার উত্তরে এবং অন্ধ্র প্রদেশের দক্ষিণাংশে অবস্থিত একটি রাজ্য। এর সাংস্কৃতিক ইতিহাস খুব সমৃদ্ধ। প্রাচীন ভারতে ওড়িশা ছিল মগধ রাজ্যের নন্দ রাজাদের অধিনস্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। সংস্কৃত শব্দ ওড়া (বিশ্ব) বা দেশ থেকে ওড়িশা নামের উৎপত্তি। পালি ও সংস্কৃত উভয় সাহিত্যে ওড়ার জনগোষ্ঠীকে ‘ওড়াকা’ এবং ‘ওড়াহ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আধুনিক ওড়িশার কেন্দ্রীয় বলয়েই মূল আদিবাসী ‘ওড়া’দের বাস। তবকাত-ই-নাসিরী, তবকাত-ই-আকবরী, রিয়াজ-উস-সালাতীন, তারিক-ই-ফিরুজশাহী প্রভৃতি মধ্যযুগীয় মুসলিম ইতিহাস গ্রন্থসমূহে ওড়া ভূখণ্ডকে ‘জাজনগর’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। সামস-ই-সিরাজ আফিফ তার গ্রন্থে প্রথম ওড়িশাকে ‘জাজনগর-ওড়িশা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ওড়িশার ইতিহাসে কলিঙ্গ ও উৎকল আদি জনগোষ্ঠী সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচীন কলিঙ্গ রাজ্য সম্পর্কে বৈদিক ঘটনাপঞ্জিতে এর উল্লেখ রয়েছে। কলিঙ্গরা হিংস্র ও স্বাধীন জনগোষ্ঠী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। বর্তমানের ওড়িশা রাজ্য প্রাচীনকালে মহাভারতীয় যুগের কলিঙ্গ, কাঁটারা বা মহা-কাঁটারা এবং দক্ষিণ কোশালা-এ তিনটি ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। তখন কলিঙ্গ-এর অবস্থান ছিল বর্তমান ওড়িশার পূর্বাংশে, দক্ষিণ কোশালা উত্তর-পশ্চিমাংশে এবং কাঁটারা বা মহাকাঁটারা বর্তমান ওড়িশার দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত ছিল। কটক-ভূবনেশ্বর এবং কলিঙ্গনগর (উত্তর অন্ধ্র প্রদেশ) ছিল কলিঙ্গ রাজ্যের কেন্দ্রীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত।

ওড়িশার বর্তমান রাজধানী ভুবনেশ্বর অসংখ্য মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। এর পূর্ববর্তী রাজধানী ছিল ভুবনেশ্বর থেকে প্রায় বাইশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কটকে। বঙ্গোপসাগরের তীরে এবং ভুবনেশ্বর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরত্বে ঐতিহাসিক পুরি শহরটির অবস্থান। জগন্নাথ দেবতার বাসস্থান হিসেবে বিবেচিত পুরি একটি পূণ্য শহর হিসেবে খ্যাত। ‘সম্বলপুরের নিকটে হীরাকুণ্ডা বাধ’ ওড়িশার দীর্ঘতম বাধ হিসেবে পরিচিত। ওড়িশায় রয়েছে একাধিক জনপ্রিয় পর্যটন শহর। পুরি, কোনারক ও ভূবনেশ্বর-এ শহর তিনটি পূর্ব-ভারতীয় ‘গোল্ডেন ট্রায়েঙ্গেল’ নামে পরিচিত। পুরির জগন্নাথ মন্দির, কোনারকের সূর্য মন্দির, ভূবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির, খন্দগিরি, উদয়গিরি, ধউলিগিরি ছাড়াও বরহামপুর শহরের নিকটে ঝাউগড়ে অবস্থিত অশোকের বিখ্যাত প্রস্তর লিপি এবং কটকের বড়বাটি দুর্গ প্রভৃতি ওড়িশার প্রধান প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন] ওড়িশার দুইটি লোকগল্প

পরনিন্দার পাপ

এক রাজা তার প্রজাদের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে রাজদরবারে ব্রাহ্মণ ভোজের আয়োজন করেছিলেন। রাজমহলের ভেতর খোলা মাঠের নিচে ছাপ্পান্ন রকম ভোগের আয়োজন চলছিল। রান্নার সময় সবার অজান্তেই এক বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল। খোলা মাঠে চুলায় বসানো খাবারের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল এক মস্ত চিল। চিলের শিকার করে নিয়ে যাওয়া বিষাক্ত সাপের মুখ থেকে কয়েকফোটা বিষ পড়ে গেল খাবারের পাত্রে। রীতিমতো সেই খাবার খেয়ে রাজমহলে নিমন্ত্রিত সব ব্রাহ্মণদের মৃত্যু হলো।

এই ঘটনায় রাজা খুব দুঃখী হলেন। নিজেকে পাপী সাব্যস্ত করতে লাগলেন। এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল যমরাজ। যমরাজ অনুসন্ধান করতে লাগলো প্রকৃতপক্ষে কাকে এই পাপের জন্য শাস্তি দেওয়া যায়। পাপী আসলে কে? ব্রাহ্মণ হত্যার জন্য পাপের দণ্ড শেষমেষ কাকে দেওয়া যায় তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো।

অনুসন্ধানে যমরাজের তালিকায় সবার প্রথমে এসেছে রাজার নাম কারণ সে ব্রহ্মণদের ভোজের জন্য নিমন্ত্রণ করেছিল। দ্বিতীয় নাম এসেছে রাজমহলের বাবুর্চিদের কারণ তারা খোলা মাঠে রান্না করেছিলো। আর তৃতীয় নাম এসেছে সেই চিলের যে সাপটিকে শিকার করে খাবারের ওপর দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

দীর্ঘ সময় ধরে যমরাজ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলো। সবার শেষে যমরাজ পাপের জন্য সাপকেই নির্বাচন করলো। এই ঘটনার কিছুদিন পর একদল ব্রাহ্মণ রাজার সঙ্গে দেখা করার জন্য রাজমহলে যাচ্ছিল। তারা এক মহিলাকে রাজার মহলের রাস্তা জিজ্ঞেস করলে মহিলা রাজমহলের পথ দেখিয়ে ব্রাহ্মণদের হুশিয়ার করে বলল, ‘সাবধানে থাকবেন। রাজার আপ্যায়নে কিছুই খাবেন না। এমনকি, জল পর্যন্ত না। রাজা বিষ খাইয়ে ব্রাহ্মণদের মেরে ফেলে।’ যেই মহিলা এই কথা বললো, যমরাজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো—মৃত ব্রাহ্মণদের পাপের সকল শাস্তি এই মহিলাকেই দেওয়া হবে।

যমরাজকে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে দেখে কৌতুহল নিয়ে যমদূত জিজ্ঞেস করলো, ‘এরকম কেন প্রভু?’

যমরাজ জবাব দিল, ‘যখন কেউ পাপ করে তখন পাপ কাজে তার খুব আনন্দ হয়। ব্রাহ্মণদের মৃত্যুতে না রাজা আনন্দ পেল, না বাবুর্চি, চিল, সাপ কাউকেই আনন্দ করতে দেখিনি। তাদের অজান্তে ঘটে যাওয়া এই দূর্ঘটনায় তারা সকলেই খুব ব্যথিত হয়েছে। অথচ এই দুর্ঘটনায় মহিলা বেশ মজাই পাচ্ছে। ঘটনা সম্পর্কে ঠিকমতো না জেনেই রাজার সম্পর্কে অন্যান্য ব্রাহ্মণদের নিকট নিন্দা করে যাচ্ছে এবং ভুল তথ্য রটাচ্ছে। আমরা সবসময় এটা মনে করি, কোনো বড় ধরনের পাপ না করেও আমারা অনেক সময় দুর্দশাগ্রস্ত হই। আসলে এই দুর্দশা ভোগের জন্য যে বড় রকম পাপ করতে হয় তা কিন্তু নয়। মূলত পরনিন্দার ফলে বড় পাপ কাজ না করেও আমাদের দুর্দশাগ্রস্ত হতে হয়। তাই পরনিন্দা করা কখনো উচিৎ নয়।

 

ঠগরাজ

পুরির জগন্নাথ মন্দিরে রথযাত্রা উৎসব চলছে। পুরো দেশ থেকে ভক্তরা দলে দলে রথযাত্রা উৎসবে এসেছে। উৎসবে এক গ্রামের ঠগীর সঙ্গে এক শহরের ঠগীর বেশ ভাব হয়েছিল। দুই ঠগী মিলে প্রতিদিন নতুন নতুন জায়গায় যেত। এতে করে ধরা খেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকতো। রথযাত্রার উৎসবেও তারা অর্থ উপার্জনের ধান্দায় এসেছিল। প্রামের ঠগীর মাথায় শিমুল তুলা দিয়ে বানানো বড় একটা কাপড়ের পট্টি বাঁধা ছিল। আর শহরের ঠগীর কাঁধে ছিল ছোট একটি ঝোলা ব্যাগ। 

—তোমার কাছে কী আছে? শহরের ঠগী গ্রামের ঠগীকে জিজ্ঞেস করলো।

—আমার কাছে তাজা হাওয়া আছে। গ্রামের ঠগী জবাব দিল

এই আলাপে শহরের ঠগীর বেশ লোভ হলো। সে বললো, আমার ব্যাগে মূল্যবান কিছু পাথর আছে। যেকোনো জায়গায় ভাল দামে বিক্রি করা যাবে।

আচ্ছা তুমি হাওয়ার বদলে আমাকে তোমার কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা দেবে? শহরের ঠগী এটাই চাইছিলো মনে মনে। সে রাজি হয়ে গেল।

রাতের বেলা দুই ঠগী নিজ নিজ ঘরে চলে গেল। আনন্দে স্ত্রী বাচ্চাদের সামনে দুলে বেড়াচ্ছে। আর বলছে—আজকে তো এক লোককে বোকা বানালাম।

দেখ ছোট একটা কয়লার পুটলির বদলে শুদ্ধ হাওয়া নিয়ে এসেছি। যখনই, ঠগী তুলার বোনা কাপড়ের পট্টি খুললো চারপাশে তুলা উড়তে লাগলো।

গ্রামের ঠগীও যখন কালো ঝোলা খুললো, দেখলো সেখানে শুধু কয়লা। ঠগীর স্ত্রী তাকে বেশ গালাগাল আর বকতে শুরু করলো—যাক তোমার মতো ঠগীকেও আজ কেউ ঠকিয়েছে। তুমিতো কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারো না।

পরের দিন রাস্তায় আবারও দুই ঠগীর দেখা হলো। দুজন দুজনকে ঘুর ঘুর করে দেখতে লাগলো তারপর অট্টহাসি দিল। এটাও বেশ দারুণ হলো, ওস্তাদের সঙ্গে ওস্তাদী—এক ঠগী বলে উঠলো।

আরেকজন হাসতে হাসতে বলতে লাগলো, আমিতো কোনো সুন্দরীর চোখের কাজল পর্যন্ত চুরি করে ফেলতে পারব। দ্বিতীয় ঠগী বললো। 

প্রথম জন আবার বললো, আরে আমিতো ব্রাহ্মণের কপালের তিলক পর্যন্ত চুড়ি করে ফেলতে পারবো অথচ টের পাবে না।

এবার দুজনে মিলে একসঙ্গে চুরি করার পরিকল্পনা করলো। সেদিন দুজনই রাতে একসঙ্গে ছিলো। সন্ধ্যায় তারা হাঁটতে হাঁটতে এক গ্রামে গিয়ে পৌঁছালো। ঘুরতে ঘুরতে খোঁজখবর নিয়ে এক ধনী গৃহস্থের বাড়িতে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলো। দুজনে সেই বাড়িতে গিয়ে সেই বাড়ির ধনী বৃদ্ধা মহিলার পা স্পর্শ করে প্রণাম করে বললো, পিসিমা আমরা দু’জন তোমাদের ভাতিজা। তুমি তো আজ কতবছর হলো আমাদের এখানে যাও না। এবার আমাদের ছেলের বিয়েতে তোমাকে অবশ্যই আসতে হবে। আমরা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। 

বৃদ্ধা মহিলা তার ভাতিজাদের ছোটবেলায় দেখেছে। ফলে সে তাদেরকে দেখে ঠিক চিনতে পারেনি। মহিলা দুই ঠগীর সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলাপ করে তাদেও আন্তরিকতায় খুশি হলো। তারপর রাতের বেলা তাদের থাকার ব্যবস্থা করে ভাইপো ভেবে সোনার থালায় করে খাবার খেতে দিল। সোনার থালাগুলো বৃদ্ধা মহিলা তার নিজের বিয়েতে পেয়েছিলেন। কেবল বিশেষ অতিথিদের জন্যই তিনি সেগুলো ব্যবহার করতেন। সেই দুজন খাবার খেয়ে থালা পরিষ্কার করার জন্য কুয়ার পাড়ে গেল। তারপর বৃদ্ধা মহিলার নজর এড়িয়ে নিজেদের ব্যাগে থালা দুটো ঢুকিয়ে ফেললো। তাদের মধ্যে একজন চিৎকার করে বলতে লাগলো, আরে আরে কী করছিস, থালাতো কুয়ায় ডুবে যাচ্ছে? আওয়াজ শুনে বৃদ্ধ মহিলা দ্রুত কুয়ার পাড়ে আসতেই দুই ঠগী দুঃখ-ভারাক্রান্ত মুখে বলতে লাগলো, পিসি আমরা বুঝতে পারিনি, থালা দু’টো হাত ফসকে কুয়ার মধ্যে পড়ে গেল। ঠগীদের কথা শুনে বৃদ্ধা মহিলার খুব দুঃখ হলো। পরদিন সকালবেলা দুই ঠগী যখন বিদায় নেবে তখন তাদের দু’জনকে ডেকে বললো, শোন বাবারা আমি তো বুড়া হয়ে গেছি, আমি তোমাদের ছেলের বিয়েতে যেতে পারবো না। তবে আমার ছেলে, মানে তোমাদের ভাই অবশ্যই যাবে। বৃদ্ধার ছেলে তাদের দুজনকে থালা চুড়ি করতে দেখে ফেলেছিলো। সে তার মার সামনে কিছুই বলেনি। এবং নিজের ঘোড়ায় চড়ে সেই দুই ঠগীর সঙ্গে রওনা হলো।  

পথ চলতে চলতে দুপুরবেলা গাছতলার নিচে দাঁড়িয়ে দুই ঠগী বৃদ্ধার ছেলেকে বললো, আরে ভাই ঘোড়া থামাও, খুব ক্ষিধে পেয়েছে। আমাদের কাছে তো টাকা নেই। তুমিতো ধনীলোক, একটু পেট ভরে আমাদের খাবার খাওয়াও।

তোমরা চিন্তা করো না। আমি এখনই তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করছি। এই গ্রামে আমার ব্যাবসায়িক কাজ চলে। আমার পকেট থেকে খরচ করতে হবে না। বৃদ্ধার ছেলে বললো। সে বুদ্ধি করে এই দুজনকে পরিচিত করে দিতে চাইছিলো।

—তাহলে তো এটা বেশ হয়। দুই ঠগী জবাব দিল।

—তোমরা এখানে দাঁড়াও, আমি খাবারের আয়োজন করে আসছি। এই কথা বলে বৃদ্ধার ছেলে এক ব্যাপারীর কাছে গেল। কী যেন চুপি চুপি বলাবলি করলো। তারপর আবার ফিরে এসে দুই ঠগীকে সেই ব্যাপারির নিকট নিয়ে গেল। ব্যাপারী বৃদ্ধার ছেলেকে কিছু অর্থ দিল। সেটা নিয়ে বৃদ্ধার ছেলে দুই ঠগীকে রেখে আবার কোথাও যেন যাওয়ার কথা বললো, তখন ঠগীরা বলে বসলো,

—আরে ভাই আমাদের দুজনকে একা ফেলে তুমি কোথায় কোথায় যাও? আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে চল।

—না-না আমার কাজ আছে, একটু দাঁড়াও আমি এখনই আসছি। ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের খাবার-দাবার আর আপ্যায়ন তিনিই করবেন। বৃদ্ধার ছেলে সেই ব্যাপারীকে ইশারা দিয়ে চলে গেল।

ব্যাপারী তাড়াহুরা করে দুই ঠগীকে বললো, ‘আসো আমার সঙ্গে মাঠে মুজুরদের সঙ্গে কাজে লেগে পড়। দুই ঠগী ব্যাপারীকে খুব করে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে তারা মুজুর না। ততই ব্যাপারি চটে যাচ্ছিল আর রাগান্বিত ভঙ্গিতে বলল আমি তোমাদের দুজনকে টাকা দিয়ে কিনেছি। যদি পেটের ক্ষুদা মেটাতে চাও তো কাজে লেগে পড়।

—না-না তুমি কোথাও ভুল করছ আমরা যেন-তেন পরিবারের লোক না। সেই যুবক আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছ। আপনাকেও ধোঁকা দিয়েছে। আমরা তাকে খুঁজে বের করছি, আপনি একবার আমাদের যাওয়ার সুযোগ দিন। দুজনেই খুব অনুনয়-বিনয় করল। ব্যাপারীর খুব দয়া হলো, সে তার এক চাকরকে সঙ্গে দিয়ে সেই যুবককে খুঁজে বের করার সুযোগ দিল।

ততক্ষণে সেই যুবক আরেক গ্রামে পৌঁছে গেছে। সেখানে এক মিষ্টির দোকানে গিয়ে গপাগপ মিষ্টি খাচ্ছিল। দোকানে একটা ছোট্ট বাচ্চা বসা ছিল। সে বললো, মিষ্টি খাচ্ছ ভাল কথা টাকা বের কর।

দেখ বাবু, তোমার বাবা আমার বন্ধু। তাকে গিয়ে বলো মাছি মিষ্টি খেয়ে ফেলছে। দেখবে, কিছুই বলবে না। যুবক খুব করে বাচ্চাকে বোঝালো।

বাচ্চা গিয়ে তার বাবাকে বলল, তার বাবা জবাব দিল, আরে মাছি তো মিষ্টি খাবেই। চিন্তা করো না। এক মাছি আর কত মিষ্টি খাবে। এদিকে যুবক একের পর এক মিষ্টির থালা খালি করে খেয়ে ফেললো আর বাচ্চা থাম থাম বলে চিৎকার করতে লাগলো।

দোকানের সামনেই রাস্তা দিয়ে এক বৃদ্ধ মহিলাকে দেখল তার সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। যুবক সেই মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। সে ঘোড়ায় চরে পেস থেকে এসে আচমকা সেই যুবতী সুন্দরী মেয়েটিকে টেনে-হিঁচড়ে ঘোড়ায় তুলে সেখান থেকে পালিয়ে গেল। বৃদ্ধা মহিলা চিৎকার করতে লাগলো। আর ঘোড়ার পেছনে পেছনে দৌঁড়াতে লাগলো। এদিকে ঘোড়ায় চড়া সেই যুবক বলতে লাগলো, মা, আপনি কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়েকে খুব সুখে রাখবো। আমার নাম মনে রাখবেন। আমার নাম জামাই-রাজা।

বৃদ্ধ মহিলা সেই রাস্তায় বসে চিৎকার করে মেয়ের শোকে কান্না করতে লাগলো। চারপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গেল। সবাই জিজ্ঞেস করতে লাগলো ‘সে কেন কাঁদছে’। বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো ঘোড়ায় চড়া এক যুবক তার মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। সে এখন কী করবে?

আশেপাশে জড়ো হওয়া লোকজনের ভেতর থেকে একজন জানত চাইল, কে নিয়ে গেছে মা, তোমার মেয়েকে? তার নাম কী? কিছু জানো?

—বৃদ্ধ মহিলা বললো, তার নাম জামাই-রাজা। সেই নিয়ে গেছে আমার মেয়েকে।

এই কথা শুনে জড়ো হওয়া লোকজন হাসতে লাগলো। আর বলতে লাগলো আরে এটাতো খুশীর সংবাদ আপনার জামাই আপনার মেয়েকে নিয়ে গেছে। মেয়েকে তো একদিন জামাইয়ের বাড়িতে যেতে হবেই।

এইভাবে রাস্তায় সবাইকে বোকা বানিয়ে সেই যুবক যখন সুন্দরী মেয়েটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল তখন মাঝপথে এক জায়গায় ঘোড়া থামিয়ে সঙ্গে নিয়ে আসা কিছু মিষ্টি বের করে খেতে লাগলো। পাশেই রাজবাড়ীর এক ধোপা কাপড় শুকাচ্ছিল। যুবক সেই ধোপাকেও মিষ্টি বিতরণ করলো আর বললো এটা কোনো সাধারণ মিষ্টি না, দিব্য মিষ্টি। নদীর ওই পারে একটি গাছে ধরে। যত পার পেড়ে আনতে পার। ধোপা মিষ্টির লোভে নদী সাঁতরে অপর পারে যাওয়ার সময় যুবককে বলে গেল, ভাই দয়া করে আমার দামী কাপড়গুলোর খেয়াল রেখ, এগুলো সব রাজবাড়ির কাপড়। হারালে আমার চাকরি থাকবে না। আমি যাব আর আসবো। যুবকও বললো, ভাই তাড়াতাড়ি এসো, আমি বেশিক্ষণ এখানে থাকতে পারব না, কাজ আছে। ধোপা নদী সাঁতরে ওপারে যেতেই ধোপার শুকানো রাজবাড়ির দামী কাপড় চোপড় পুটলিতে বেঁধে ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে গেল।

এদিকে ব্যাপারীর চাকর আর সেই দুই ঠগী একসঙ্গে খুঁজতে খুঁজতে সেই মিষ্টির দোকানে পৌঁছুলো। তারপর দোকানীর কথাবার্তা শুনে তারা নিশ্চিত হলো এটাই সেই যুবক। এবার তারা চারজন মিলে যুবকের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো। পথে সেই বৃদ্ধা মহিলাকেও পেয়ে গেল যার মেয়েকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল সে। তারপর তারা পাঁচজন মিলে সামনে যেতে যেতে নদীর পাড়ে সেই ধোপাকেও পেল। মাথায় হাত দিয়ে বিমর্ষ অবস্থায় বসে থাকা সেই ধোপার বর্ণনা শুনে নিশ্চিত হল এই সেই যুবক যাদেরকে তারা সবাই মিলে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এবার ছয়জন মিলে পথে একসঙ্গে সেই যুবককে খোঁজার পণ করলো এবং একে অপরের গল্প শুনাতে লাগলো।

শেষে এক গ্রামের প্রবেশ পথে তাঁরা সবাই খুঁজতে খুঁজতে সেই যুবকের সন্ধান পেল। এবং সবাই গিয়ে তাকে ধরে ফেললো এবং মারার জন্য প্রস্তুত হলো। বাঁচার কোনো উপায় না পেয়ে সেই যুবক অবশেষে স্বীকার করলো সে যার যার কাছ থেকে যা কিছু নিয়েছে সব ফেরত দিয়ে দেবে। সে বললো, ‘দেখেন ভাইয়েরা আমি চোর না, আমি আপনাদের সকল মালামাল ফিরিয়ে দেবো। আমিতো শুধু এটা পরীক্ষা করে দেখলাম লোকজন আসলে কত সহজে বোকা হয়ে যায়। আপনারা সবাই ছোটখাট লাভের জন্য আমার কথায় রাজি হয়েছিলেন। আমি আপনাদের সবাইকে এই গ্রামে আজকের দিনটা থাকা-খাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি। এই গ্রামে আমার এক বন্ধু আছে। আজ রাতে ওর বাসায়ই আপনাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হবে। সকালে সবাইকে আমি যার যার মালপত্র অথবা সেগুলোর বিনিময়-অর্থ ফেরত দিয়ে দেবো।

সেই রাতে তারা ছয়জন যখন রাতের খাবার খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। তখন যুবকটি মহল্লার চৌকিদারকে ঘোষণা দিয়ে বললো, যেনো সে পুরো গ্রামে প্রচার করে বেড়ায়, গ্রামে কিছু নতুন লোকের আনাগোনা দেখা গেছে। সম্ভবত এরা পাশের গ্রামের কুখ্যাত চোর। এই গ্রামে বড় কোনো চুরির ধান্দায় ঘোরাঘুরি করছে। যারা তাদেরকে ধরিয়ে দেবে তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে।

এই ঘটনা রটে গেলে চারপাশে খুব হইচই শুরু হয়। লোকজন দলবেঁধে যুবকটির বন্ধুর বাড়ির দিকে আসতে শুরু করে। সেই সময় লোকজনের গলার আওয়াজ এবং কথাবার্তা শুনে দুই ঠগী সহ বাকিরা খুব ভয় পেয়ে গেল। এবং রাতেরবেলা তারা বাড়ির পেছনের জঙ্গল দিয়ে সেখান থেকে জীবন রক্ষায় পালিয়ে গেল। জীবনের ভয়ে যেতে নিজেদের সঙ্গে যা-কিছু মালপত্র, টাকা-পয়সা ছিল সেগুলোও ফেলে দিয়ে গেল। অনেক দূর পর্যন্ত পালাতে পালাতে তাদের মনে হচ্ছিলো তাদের পিছু পিছু কেউ যেন আসছে। তখন দুই ঠগী একটি ঝোপের নিচে বসে পড়লো। তারপর দুইজন বলতে লাগলো, ভাই আজকে জান বাঁচিয়ে পালিয়ে এলাম। তুমি শহরের ঠগী আর আমি গ্রামের ঠগী। আমরা তো চুনোপুঁটি, এদিক-সেদিক টুকটাক ঘুরে ফিরে হাত সাফাই করি। আরে আমরা তো কোনো ঠগীই না। আসল ঠগী তো সেই যুবক। আমাদের সবাইকে কীভাবে বোকা বানালো। এদিকে সেই যুবক তাদের পালিয়ে যাওয়ার কথা শুনে খুব হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে তার মায়ের সোনার থালা নিয়ে যুবতীর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে বাড়িতে চলে গেছে।

মায়ের আশীর্বাদে অপহরণ করা সেই যুবতীকে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার করতে লাগলো। একদিন স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা তুমি তাদেরকে কেন এত বোকা বানিয়েছিলে? যুবক তার স্ত্রীকে জবাব দিল, ‘শুধু ঘুরে ফিরে কী আর এমন মজা! চালাকি করে অন্যের ঘুম নষ্ট করাতেই আসল মজা।’

উৎস : একটি ভারতীয় অনলাইন আর্কাইভ থেকে।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!