X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

মহামারির নেক্রোপলিটিক্স : আশিল এমবেম্বে

অনুবাদ : আবদুল্লাহ আল মামুন
১৮ মে ২০২০, ১৩:০৫আপডেট : ১৮ মে ২০২০, ২০:৩৩

নেক্রোপলিটিক্স বা মারণ-রাজনীতির ধারণা এগিয়ে নিতেই আশিল এমবেম্বে সবার কাছে পরিচিত। ‘নেক্রোপলিটিক্স’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে তিনি বিশ্লেষণ করেন, কীভাবে সরকার কে-বাঁচবে আর কে-মরবে, আর মরলেও কীভাবে মরবে তা ঠিক করে দেয়।

এই ধারণার আলোকে বোঝা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি সবার জন্য সমান নয়। বৃদ্ধদের চাইতে তরুণদের সেবা-শুশ্রূষা দেয়ার ঝোঁক যেন একটু বেশি। আর আপনি জোয়ার বোলসোনারো (Jair Bolsonaro)’র মতো কিছু মানুষ দেখবেন যারা রীতিমতো জোর দিয়ে বলেন, উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য কিছু মানুষের মৃত্যুতে তো আর অর্থনীতির চাকা থেমে থাকতে পারে না। ‘তাই বলে মৃত্যু? হ্যাঁ, মৃত্যুই বটে’ সোজাসাপ্টা জবাব এমবেম্বের। তিনি বলেন, ‘আফসোসের ব্যাপার হলো এটাই জীবন।’ জীবন-মৃত্যুর এই অসমান সুযোগ বণ্টনই হলো পুঁজিবাদের খেলা। সত্যি বলতে কী, নয়া-উদারনীতিবাদ (neo-liberalism) দাঁড়িয়ে আছে মানুষকে বলি দেয়ার যুক্তির ওপর। এক দলের চাইতে আরেক দল যোগ্যতর, কিংবা মূল্য নেই যার, তার বেঁচে থেকে লাভ কী’, এসব ধারণাও নতুন কিছু নয়।

[আশিল এমবেম্বে বর্তমান ক্যামেরুনের বিখ্যাত দার্শনিক এবং বুদ্ধিজীবী। এমবেম্বে তার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘অন দ্য পোস্টকলোনি’-তে নেক্রোপলিটিক্স গভীরভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য রাজনৈতিক তাত্ত্বিক হিসেবেও বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন। এমবেম্বে ১৯৫৭ সালে ক্যামেরুনের ওথেলে শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একই সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার উইটওয়েটারস্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত।] মহামারির নেক্রোপলিটিক্স : আশিল এমবেম্বে

প্রশ্ন : মহামারির ব্যাপারে আপনার অনুভূতি কী?

আশিল : এই মুহূর্তে ঘটনার বিস্তারে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছি। এই দুর্যোগে আমরা হাজারও প্রশ্নের সম্মুখীন। এই ভাইরাস আমাদের শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

 

প্রশ্ন : সেই সঙ্গে সরকার হাসপাতালগুলোকেও সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে, ঠিক কারা শ্বাস নেয়া অব্যাহত রাখবে?

আশিল : হ্যাঁ, এমন একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে যাতে প্রতিটি ব্যক্তিরই শ্বাস নেয়ার নিশ্চয়তা থাকে। এটা মূলত রাজনৈতিক অধিকারের আওতাভুক্ত হওয়া উচিত। মনে হয়, আমাদের এই বিচ্ছিন্নতার ভয়, কোয়ারেন্টাইনের ভয়—সবই আমাদের নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই ভয়টি আবার যুক্ত নিজেদের মৃত্যু আরেকদিকে ঠেলে দিতে না পারার সঙ্গেও।

 

প্রশ্ন : সামাজিক দূরত্বায়ন কি আমাদের কোনোভাবে মৃত্যুর ওপর কর্তৃত্ব ফলানোর সুযোগ করে দেয়?

আশিল : বলতে পারেন এক ধরনের ক্ষমতা দেয় বৈকি। আমরা মৃত্যুর গ্রাস থেকে পালাতে পারি। তা না হলেও অন্তত মৃত্যু বিলম্বিত করতে পারি। মৃত্যুকে ঠেকা দেয়া হলো, ঐ রাজনীতির মূল গীত। এটাই ক্ষমতা, তবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা নয়, যেহেতু এটা অনেক মানুষের সঙ্গে জড়িত।

 

প্রশ্ন : এটা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করার উপরও তো নির্ভরশীল?

আশিল : হ্যাঁ, আরেকটা ব্যাপার হলো, এ পর্যন্ত যারা মারা গেছেন তাদের অধিকাংশকেই অসম্ভব সাদামাটাভাবে সৎকার করা হয়েছে। অনেককে এত দ্রুত পোড়ানো বা সৎকার করা হয়েছে যে, যেনো তারা এক আবর্জনার স্তূপ। যত দ্রুত মুক্তি পাওয়া যায়, ততই মঙ্গল। এই খালাস করার যুক্তি কখন মাথায় আসে জানেন? যখন নিজেদের জনগোষ্ঠীর স্বার্থ-চিন্তা বেশি করা হয়। তবে যে জনগোষ্ঠী মৃতদের সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানানোর ক্ষমতা রাখে না, তাদের জনগোষ্ঠী বলাটা ঠিক হবে না। আবারও প্রশ্ন আসতে পারে, ‘এই দুর্যোগের সময় জনগোষ্ঠী গঠিত হবে কীভাবে?

 

প্রশ্ন : সমাজের উপর মহামারির কেমন প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন?

আশিল : এই মহামারি আমাদের নিজেদের শরীরের সঙ্গে নিজেদের বোঝাপড়ার সুযোগ করে দেবে, আমাদের এই শরীরই কিন্তু আমাদের জন্য হুমকির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দ্বিতীয় ব্যাপারটা হলো, ভবিষ্যৎ ভাবনা আর সময় সচেতনতার হেরফের। হঠাৎ মনে হচ্ছে, ভবিষ্যৎ যে কী রূপ নিয়ে অপেক্ষা করছে তা জানা মুশকিল।

 

প্রশ্ন : বাসায় না থাকলেও তো আমাদের শরীরও আরেকজনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়?

আশিল : তা বলতে পারেন। সবাই-ই হত্যা করার ক্ষমতা পেয়ে গেলো। আরও আগ বাড়িয়ে বললে হত্যার ক্ষমতা এখন গণতান্ত্রিক রূপ পেলো। আমাদের বিচ্ছিন্নতাই কিন্তু এই ক্ষমতার পুষ্টি যোগালো।

 

প্রশ্ন : কথা হচ্ছে, নেক্রোপলিটিক্স তো আরেক বিতর্কিত প্রশ্নের জন্ম দিল—এই মুহূর্তে জনগণের অর্থনীতি রক্ষার্থে কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ জরুরি? ব্রাজিল সরকার তো অর্থনীতি উদ্ধারেই তৎপর।

আশিল : গলাকাটা নয়া-উদারনীতিবাদের যুক্তির সঙ্গে এই তৎপরতার মিল আছে। নয়া-উদারনীতিবাদ না বলে একে নয়া-মারণবাদ বলাই ভালো—হিসাব যন্ত্রের চালিকা হিসেবে এইসব কিছু আগে থেকেই সক্রিয়। মানে, একদল আরেক দলের চাইতে যোগ্যতর—এমন ধারণা আরকি। আবারও বলি, মূল্য নাই যার তাকে কোরবানি দেওয়া সহজ। প্রশ্ন হলো, মূল্যহীন ভাবছি যাদের, তাদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে? এই প্রশ্ন কিন্তু সমজাতি, সমশ্রেণি এবং সমলিঙ্গভুক্ত সকলের জন্য বিবেকের দংশনস্বরূপ।

 

প্রশ্ন : এইডসের সঙ্গে কি এই মহামারির তুলনা করা যায়? সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে সরকারের কেমন যেন গড়িমসি। এর কারণ হয়তো আক্রান্তদের অধিকাংশ উল্লেখযোগ্য কেউই নয়। মানে এইডসের আক্রান্তদের অধিকাংশ হয় কালো, না হয় সমকামী কিংবা মাদক ব্যবসায়ী।

আশিল : কাগজ কলমে বা তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করলে, করোনাভাইরাস কিন্তু যে কারো জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিতে পারে। হুমকির মুখে তো সবাই। যাই হোক, গ্রামের দিকে শহরতলীতে দ্বিতীয় বাসভূমিতে আবদ্ধ থাকা এক কথা, আর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সামনের সারিতে মাস্ক ছাড়া কাজ করা আরেক কথা। ঝুঁকি বণ্টনও যেন ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন।

 

প্রশ্ন : আনেক রাজনৈতিক নেতা তো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামকে যুদ্ধ বলে অভিহিত করতে চাচ্ছেন। শব্দ বাছাবাছি কি এই মুহূর্তে এতই জরুরি? আপনি বলেছিলেন, মারণ-রাজনীতি কীভাবে বাস্তবে কার্যকর হয় যুদ্ধের মারফত তা ভালোভাবে বোঝা যায়।

আশিল : এই মুহূর্তে বিশ্বে যা ঘটছে তার নামকরণ কঠিনই বটে। এটা তো শুধু ভাইরাস নয়। কী যে কপালে আছে, এটা বুঝতে না পেরে সব জায়গায় রাষ্ট্রগুলো ‘যুদ্ধ’ বা এই জাতের পুরনো শব্দ ব্যবহার করছে। এছাড়া, অনেক মানুষ জাতিরাষ্ট্র অভিমুখে যাত্রায় ইচ্ছুক।

 

প্রশ্ন : তাহলে এই মহামারির সময়ও কি বৃহত্তর জাতীয়তাবোধ বা এই ধরনের কোনো কিছু কাজ করছে?

আশিল : হ্যাঁ, করছে। মানুষজনের মাঝে ‘ফিরে চল মাটির টানে’ এমন একটা তাড়না কাজ করছে। এদের দেখলে মনে হয়, নিজভূম হতে দূরে কোথাও মৃত্যুবরণ করার মতো খারাপ আর কিছুই নাই। এর মধ্যে আবার সকল দেশের সীমানা বন্ধ। ভাববেন না যে, আমি আবার বলছি সীমানা খোলা রাখা উচিৎ। তবে অনেক সরকারই সীমানা, দেয়াল ইত্যাদির ধারণা মারফত জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে উসকে দিয়ে সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করছে।

 

প্রশ্ন : দুর্যোগের পর আগের জীবন কি ফিরে যাওয়া সম্ভব?

আশিল : পরেরবার আরও ভয়ঙ্কর কিছু দ্বারা হয়তো আক্রান্ত হবো। মানবতা আজ বিপর্যস্ত। মহামারি এসে বুঝিয়ে দিলো পৃথিবীতে আমাদের ইতিহাস খুব একটা সুরক্ষিত নয়। পৃথিবীতে যে চিরদিন থাকব এমন কোনো নিশ্চয়তাও নেই। এই মুহূর্তে, মানুষের অস্তিত্ব ব্যতিত জীবনের কোলাহল সম্ভব কিনা, এটাই শতাব্দীর অন্যতম জিজ্ঞাসা।

[গত ৩১শে মার্চ ব্রাজিলের বিখ্যাত পত্রিকা গাউসোজ (GaúchaZH)-এ সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয়]

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইনজুরিতে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচে খেলা হচ্ছে না মেসির  
ইনজুরিতে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচে খেলা হচ্ছে না মেসির  
এবার রাজশাহীর আম গাছে প্রচুর মুকুল, স্বপ্ন বুনছেন চাষিরা
এবার রাজশাহীর আম গাছে প্রচুর মুকুল, স্বপ্ন বুনছেন চাষিরা
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ মার্চ, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ মার্চ, ২০২৪)
চীনে ৯ বছরে প্রথমবারের মতো বিয়ের সংখ্যা বেড়েছে
চীনে ৯ বছরে প্রথমবারের মতো বিয়ের সংখ্যা বেড়েছে
সর্বাধিক পঠিত
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
শ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে ওয়ানডে সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ
তৃতীয় ওয়ানডেশ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে ওয়ানডে সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ
পদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
একীভূত হলো দুই ব্যাংকপদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার