X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

দেবেশ রায়—একক ও নিঃসঙ্গ যোদ্ধা

গৌতম গুহ রায়
২০ মে ২০২০, ০৫:০০আপডেট : ২২ মে ২০২০, ১৪:৪৬

দেবেশ রায়—একক ও নিঃসঙ্গ যোদ্ধা

এক.

১৫ মে, কলকাতা শহরেও অতিমারি আতঙ্ক ও লকডাউন কবলিত। শ্মশানে দু’একজন নিকট আত্মীয়, দাহ হলেন বাংলা সাহিত্যের এক মহান স্রষ্টা, একক ও নিঃসঙ্গ। কিন্তু সময়টা ভিন্ন রকম হলে এই দৃশ্যটাও ভিন্ন হতো, হতোই, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আবার এ কথাও বলা যায়, মৃত্যুতেও তিনি একাকিই থেকে গেলেন, যেমন ছিলেন। রাজনৈতিক অবস্থানে, তাঁর সাহিত্যে, ব্যক্তি-জীবনেও শেষের গুটি কয়েক দিন, তিনি স্বতন্ত্র ও একা। তাঁর সত্তার অনেকটা জুড়েই ছিলো কৈশোরের যাপিত জনপদের মানুষ ও সমাজ এবং সমাজতান্ত্রিক দর্শন। স্বাতন্ত্র্য নিয়ে নিজের মতো ব্যাখ্যায় সেখানেও ক্রমশ একক হয়ে থাকা। যে দর্শন তার আত্মদর্শন ছিলো তার ভিত তৈরি হয়েছিলো তাঁর কৈশোরকালেই। ‘দেখতে দেখতে উত্তাল ছেচল্লিশ এলো। সেই দূর মফস্বলেও এসে আছড়ে পড়ল নৌ-বিদ্রোহের ঢেউ, এই.এন.এ মুক্তির দাবি, রসিদ আলি দিবসের শ্লোগান, ডাক-তার ধর্মঘট, আরও কত কী! সেই ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মধ্যে দম ফেলার মতো অবকাশ ছিলো না। আমি তখন বড়জোর ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ি। সেইসব সময়ে আমার বন্ধুরা মিলে আমাকে কমিউনিস্ট বানিয়ে দিল। ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ, ঠাট্টা-তামাশার লক্ষ্য হয়ে আমি একা একা কমিউনিস্ট হয়ে গেলাম। সেই একা একা কমিউনিস্ট আমাকে অনেক দিন থেকে যেতে হল।…আমারই মতো আরও কয়েকজন একলা কমিউনিস্ট শহরের রাস্তা দিয়ে চোঙা ফুঁকে চেঁচাতে চেঁচাতে গেলাম… আর হঠাৎ সেই বালক-মনে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হল, আমি আর একলা কমিউনিস্ট নই, আমি কখনই একলা ছিলাম না।’ কিন্তু বাস্তবিকই কি তিনি একলা ছিলেন না! মৃত্যুর পর নানা চর্চা ও গুঞ্জনের মধ্যেও সেই কথাটাই ভেসে আসছে, দেবেশ রায়—এক, একক ও নিঃসঙ্গ সাহিত্য-যোদ্ধা, ১৯৫৫ থেকে ২০২০ মে, আমৃত্যু কলম-যোদ্ধার অক্লান্ত লড়াইয়ের শেষে রণক্ষেত্রে একা একাই নিঃসঙ্গ দহনে পঞ্চভূতে লীন হয়ে গেলেন। কিন্তু গোটা বাংলাভাষা বিশ্বের যোদ্ধাদের জন্য যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে রেখে গেলেন, তার আখ্যান, তাঁর প্রবন্ধ, তাঁর সমাজভাষ্যের আয়ুধ।

১৯৩৬ থেকে ২০২০, ৮৪ বছর সংখ্যার হিসাবে পূর্ণ যাপিত জীবন, কিন্তু কিছু কিছু জীবন থাকে যার শূন্যতা যাবতীয় পূর্ণতাকেই শূন্য করে দেয়। দেবেশ রায়, ভারতীয় সাহিত্য বা চিন্তন-বিশ্বে সেই শূন্যতা দিয়ে গেলেন, ১৪ মে। সীমান্তের কাঁটাতারের দুইপারের দুই মানুষ, একই দিনে চলে গেলেন। এপার থেকে ওপারে যাওয়া আনিসুজ্জামান, ওপার থেকে এপারে আসা দেবেশ রায়। পাবনার পিতৃপুরুষের ভিটা ছেড়ে দেবেশ রায়ের ঠাকুরদা উমেশচন্দ্র রায় চলে আসেন ১৯৪৩-এ। এই ‘ভিটা’র টান আত্মায় রেখে, শেকড়ের সন্ধানেই তাঁর সৃজন মননের যাবতীয় নির্মাণ, স্বপ্ন, কল্পনা। এই শেকড়ের অন্বেষণে অক্লান্ত ছুটে চলা মানুষটি থামলেন, কিন্তু সত্যিই কি থামলেন? নাকি, যাত্রার পথ বাতলে দিতে রেখে গেলেন তাঁর সাহিত্যের সম্ভারকে? আত্মকথায় যিনি লিখেছিলেন, ‘ঠাকুরদার নাম জানি না—মানুষটি জড়িয়ে আছেন। ঠাকুরদার বাবার নামটাও জানি, ঠিক কী জানি না। তবে জানাটা একেবারে অবিশ্বাস করি না। …ঠাকুরদা থেকে আমি পর্যন্ত যদি তিন প্রজন্ম ধরা যায় তাহলে বলা যেতে পারে এই তিন পুরুষের বেশিরভাগ সময়েই আমাদের বাড়ি ছিল না। অথচ আমরা, আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেকেই বাড়িমনা। আমাদের সেই বাড়ি, সব সময়ই স্মৃতির বাড়ি। যেন আমরা যে যেখানে আছি সেটা আমাদের বাড়ি নয়। অন্য কোথাও আমাদের একটা বাড়ি আছে। আমরা সেদিক দিয়ে স্মৃতিতাড়িত বংশ। সব সময়ই নিজেদের বাড়ি খুঁজে বেড়াই। ইহুদিদের মতো। কিংবা আফ্রো-আমেরিকানদের মতো। আমাদের বাড়িতে কোনোদিন না-জানা দেশ থেকে মানুষজন আসতেন, তাঁরা দু’একদিনের মধ্যেই আমাদের সেই আসল দেশটার আভাস দিয়েই চলে যেতেন, কিন্তু তাতে তো এটাই প্রমাণ হত নির্ভুল—আমাদের সত্যিকারের একটা দেশ আছে।’ (আত্মকথা, গায়ে গায়ে বাঁচা। আরম্ভ জুন ২০১৩)

১৯৫৫-কে প্রকাশকালের সূচনা-বিন্দু ধরলে প্রায় সাত দশক এক ‘কথোয়াল’ আত্মকথনের এক স্বতন্ত্র জগতে পৌঁছেছিলেন, আশি-ঊর্ধ্ব সাহিত্যিকের এ নিজেরই তৈরি নিজস্ব ভুবন। হিমালয় সন্নিহিত বাংলার তিস্তাপারের এই কথোয়ালের গল্পে মিশে থাকে তাঁর সবাক উপস্থিতি, অভিজ্ঞতার কথা, ক্রমশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবাক কথন আরও মুখরিত। যে বিকল্পহীন একান্ত-বর্তিতার কথা তার জীবনকথায় তুলে আনছেন সেখানেও থাকে তার সময়ের স্পন্দন, হাসি-কান্না, দ্বন্দ্ব, চলমান সময় তার বৈপরীত্যের সহ-অবস্থান এবং সংঘর্ষ। দেবেশ রায় তার আত্মকথা ‘জলের মিনার জাগাও’-তে লিখলেন যে পরিবারের সন্ধনের ভেতরেও সারপ্লাস লেবার আর সারপ্লাস ভ্যালুর তত্ত্বের উদাহরণ পান তিনি। আশঙ্কার সঙ্গে তিনি সেই সরলীকরণের উল্লেখ করেন যেখানে মানুষের সামাজিক বিকাশের ধারাকে কতগুলো অনড় স্তরে ভাগ করে ফেলা হয়। উল্লিখিত একান্ত-বর্তিতার সঙ্গে সরলরেখায় এনে ফেলেন সমাজবিকাশের বাঁক ও ঝোঁককেও; বেশ জটিল একতা বাঁচাতে যদি আদি সাম্যতন্ত্র, উপজাতীয়-জাতীয় এইসব লেবেল সাঁটা হয় তাহলে মানুষজনের নানারকম ঝোঁক, ভালোলাগা, ভালোবাসা, খারাপ-বাসা। অভ্যেস এইসব ক্যাটালগিং করে ফেলা হয়। ইট কাঠ পাথরের ক্যাটালগিং করা জীবন থেকে ফাঁক পেলেই ফিরে আসতে চান তিনি এই ডুয়ার্সের সবুজে। কৈশোরের শহর জলপাইগুড়িতে স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে বেরানো এই মানুষটার ভেতরে তার নিজস্ব যে ভুবন তা তার বেড়ে ওঠার জগত, নিজের কথায় যেমন লিখেছেন, ‘দেশ বিদেশের কোথাও আমার বাড়ির হদিস করলে আমি জলপাইগুড়িই বলি। ম্যাপে জলপাইগুড়ি বের করা মুশকিল। আমি তখন, পূর্ব হিমালয়ের নেপাল-সিকিম-ভূটানের উপর আঙুল চালাই।’

দেবেশ রায়ের দাদু ১৯১৭ সালে জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের অ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টার হিসেবে অবসর নেন। এই হিসেবে এই শহরের সঙ্গে তাঁদের তিন পুরুষের টান। দাদুর অবসরের পর প্রতি বছর ‘আয়াপিয়ার’ হতে আসা কঠিন হয়ে পড়ায় তাঁদের পাকাপাকিভাবে জলপাইগুড়ি চলে আসা। পরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এই ‘নাড়ীর টান’-এর শহর থেকে ২০০০-এর সূচনায় পাকাপাকিভাবে ‘শেকড় ছিঁড়ে’ চলে যান তাঁরা। কিন্তু শেকড় ছেঁড়ার অদ্ভুত যন্ত্রণা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, উত্তরের কথায় সেই যন্ত্রণা তাঁর চোখমুখে টের পাওয়া যায়। প্রতি বছরই তাই এসে ঘুরে যান তার নাড়ীর টানে, গত বর্ষাতেও তেমনি তিস্তা নদী এবং তার মানুষজনের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন, বুকভরে শ্বাস নিয়েছেন তাঁর শেকড়ের কাছে। ১৩-১৪ বছর আগে তাঁর আত্মজীবনীধর্মী গদ্যে দেবেশ রায় লিখেছিলেন—‘কলকাতার ফ্ল্যাটবাড়িতে আমাদের বিকেলটা, সন্ধেটা একটু নিঝুম। ...কাকলী বাড়িতে থাকলে গানের গুঞ্জন শোনা যায় একটু, না থাকলে তা নয়। সেই সময় বাইরের আকাশে সন্ধে হওয়া, রাতপোকাদের প্রথম আওয়াজ ও সকাল জুড়ে পাখিদের দলবাঁধা পারাপার শোনা যায়। ঘরের চেয়ারে বসে বসেই অনেকটা বেড়ানো যায়। শুনেছি মাত্র বিশধাপ ওপরে বিশাল ছাদ সারা আকাশময় ও ভ্রমণসম্পন্ন। ঐ বিশটি ধাপ পেরোতে পারি না।’ দেবেশ রায় তাঁর বিস্তারমগ্ন গদ্যের মধ্য দিয়ে আমাদের ভ্রমণসঙ্গী করেন, খুঁচিয়ে দেন পাঠকের ভ্রমণতৃষ্ণা। নিজেও এই ভ্রমণেই জুড়ে থাকতেন। জীবনসঙ্গী কাকলী রায়, অসাধারণ গাইতেন, তিনি জুড়ে রেখেছিলেন দেবেশ বাবুর নকশীকাঁথার সংসার, সেই কাকলী দিদি চলে যাওয়ার পর সম্পূর্ণ একা হয়ে যান। তাই হয়তো ফাঁকা ফ্ল্যাটবাড়িতে তার দম বন্ধ হয়ে আসতো। গত ফেব্রুয়ারিতে তার বাসায় যখন এই নিঃসঙ্গ মানুষটির সঙ্গে দেখা করতে যাই, তিনি বললেন, আমাকে জলপাইগুড়ি থাকতে দেবেন? আপনাদের কাছে, আমার নিজের জায়গায়? কিন্তু চিকিৎসার কারণে ছেলের অনুমতি মিলবে না, তাও জানালেন। কিছুদিন আগেই গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন। তবুও কথা হলো পূজার লেখালেখির চাপ সামলে নিয়ে তারপর জলপাইগুড়ি আসবেন। কিন্তু সেই শেকড়ের কাছে আসা আর হলো না তাঁর।  

বাংলা ভাষার পাঠক তাঁর স্পর্ধাকে কুর্ণিশ করে, যিনি লিখতে পারেন—‘লেখককে প্রত্যাখ্যান করার শক্তি ও অধিকার লেখকের না থাকলে, পাঠক আর পাঠক হয় না। আর পাঠককে প্রত্যাখ্যান করার শক্তি ও অধিকার লেখকের না থাকলে, লেখক, লেখক হতে পারে না। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রসঙ্গেও তিনি কোনো কৌশল আড়াল রাখেননি, ‘এই বিশ্বাসটুকু রাখার জন্য এই একটিমাত্র জীবনে কত অবিশ্বাসের সঙ্গে লড়ে যেতে হলো আর সে তো সব একটু-আধটু অবিশ্বাস নয়, দেব-দানবের মিলিত শক্তির সমান অবিশ্বাস। মার্কসবাদ এমনই এক নিখাদ বিজ্ঞান যে চাইলেও তার অন্ধ ভক্ত হওয়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় লক্ষণ নির্দিষ্টতা আর নির্দিষ্টতা যদি অনতিক্রম্য হয়, তাহলে সেখান থেকেই তৈরি হয় তার নিত্যসত্যতা।’ মনে পড়ে যায় গত বর্ষায় জলপাইগুড়িতে এক সান্ধ্য আড্ডায় বলা তাঁর কথাগুলো, ‘আমার উপন্যাস লিখবার একমাত্র কাজ যদি হয় ব্যক্তির ঐতিহাসিকতা তা হলে আমাকে আর একটা শক্তিতেও বিশ্বাস করতে হয়, যে শক্তির ইতিহাসটা তৈরি করতে পারে। ব্যক্তি, দেশ ও কালের সীমা অতিক্রম করেও সেই শক্তি সক্রিয় থাকতে পারে। সেই শক্তিটা কমিউনিস্ট পার্টির। ব্যক্তির একটা ইতিহাস আছে, এটা যদি বিশ্বাস করি, তাহলে সে ইতিহাস আরও বড় একটা ইতিহাসের অংশ এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হয়।’ শেষের দিকে সেই প্রাতিষ্ঠানিক কমিউনিস্ট পার্টির বুদ্ধিজীবীরাও তাকে আঘাত করতে ছাড়েনি। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক ও সাম্য সমাজের বিশ্বাসে তাঁর আস্থা ছিলো, এই জন্য লড়াইয়ে থেকেছেন আমৃত্যু। আমরা এই বিশ্বাসের অনুরণন শুনি তাঁর প্রতিটি বৃত্তান্তে, যেখানে আখ্যান হয়ে ওঠে সময়ের দলিল।

আমাদের নিঃস্ব করে চলে গেলেন এই আখ্যানকার ।

 

দুই.

দাদা দীনেশ রায় সম্পর্কে দেবেশ রায় বলতেন, বাংলা সাহিত্যের দুর্ভাগ্য যে তিনি স্বল্পকালীন জীবনে মাত্র তিন-চারটের বেশি উপন্যাস লিখে যেতে পারলেন না। ‘সোনাপদ্মা’ উপন্যাস সেই সময়ের সিরিয়াস পাঠকের কাছে আদৃত হয়েছিলো। ‘লিপ ইয়ারের মৃত্যু’ প্রভৃতি গল্প দীনেশ রায়ের ক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করছে।

এই বড় দাদার হাত ধরেই তার লেখালেখির জগতে পদার্পণ বলা যায়। ১৯৫৩-তে জলপাইগুড়ির পত্রিকা ‘জলার্ক’-এ প্রকাশিত ‘নিশিগন্ধা’ তার মুদ্রিত প্রথম লেখা, এরপর তিস্তাকে নিয়ে লেখেন ‘মৃতদংশন ও বিপজ্জনক ঘাট’। এভাবেই তাঁর রাজনীতির মানুষ থেকে সাহিত্যের অঙ্গনে চলে আসা। যিনি গোটা জীবন বহন করেছেন একটি নদীকে, এই নদীর জল হাওয়া মাটির মানুষের স্মৃতি।

স্মৃতিচারণে, আখ্যানে, বৃত্তান্তে যে দেবেশ রায়ের সঙ্গে পরিচয় হয় তিনি এই স্মৃতি-আক্রান্ত সদা-সক্রিয় ‘কথোয়াল’। আশি অতিক্রম করার পরেও যিনি দিনের অধিকাংশ সময় নিজেকে ব্যস্ত রাখেতেন, মগ্ন রাখতেন সৃজনে, প্রতিবাদের উচ্চারণে। এই তো কয়েক বছর আগেও এক সকালে তাঁর বাসায় গিয়ে দেখি ধর্মীয় সন্ত্রাসী রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি উপ-সম্পাদকীয় লেখার তাগিদে ডাইনিং টেবিলেই বসে লিখছেন। হাতে রুমাল, তাতে রক্ত, তখন শরীর কষে যাওয়ায় নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, বাসায় গুরুতর অসুস্থ স্ত্রী কাকলী দি, বৌদি পা ভেঙে বিছানায়। কিন্তু পারিবারিক প্রতিবন্ধকতায় থামার পাত্র তিনি ছিলেন না। এর কিছুদিন পরে সত্যিই তিনি এই প্রিয়জনদের হারিয়ে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে যান।

নিজেকে বলতেন ‘কথোয়াল’, এই দেবেশ কথোয়াল কলম ধরলেই মাথায় চেপে বসতো স্মৃতিতে গেঁথে থাকা মানুষজন, যে চোখ দিয়ে তিনি এই পরিব্যাপ্ত লোকজীবনকে দেখেছেন এবং যে সহৃদয় মনষ্কতা দিয়ে—তাকে হৃদয়ঙ্গম করেছেন তার প্রতি দায়বোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেন না। ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থবোধ সেখান থেকে তাঁকে বিচ্যুত করতে পারে না। যেখানে তিস্তা নদী বা আপেলচাঁদ ফরেস্ট নিছক জলস্রোত বা গভীর অরণ্য নয়, এ যেন সেই লোকজীবনের অংশ যা গ্রামে, বন্দরে, নগরে ব্যাপ্ত। যার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস দেবেশ রায় অনুভব করেন, পাঠককে সেই ধ্বনির কাছে নিয়ে যেতে চান। ‘ধরো, একজন রাজবংশী কৃষকের বাড়িতে বসে আছি। ...শহর থেকে গিয়েছি, পাঁচ ছয় দিন থাকব। বাইরের আঙিনায় দুয়েকটি গাছ-টাছ থাকে, তার নিচে বাঁশের মাচাটাচা থাকে। সেখানে একটু বসেছি, কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আমি একটা শব্দ সম্পর্কে সচেতন হলাম। যেটি আমারই হৃৎপিণ্ডের শব্দ। নীরবতা ও নৈঃশব্দ্য এমনই গভীর যে হৃৎপিণ্ডের শব্দ শোনা যায়।’

বারবার আস্তানা হারানো এই নিঃসঙ্গতার অভিজ্ঞতা দেবেশ রায়ের শেকড় সমাজের গভীরে প্রথিত। তাই তিনি লিখতে পারেন, ‘দেশ, গাঁ, জন্মভূমি যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টায় ঘণ্টায় নতুন নতুন বন্যায় ডোবে আর ডাঙ্গায় ভাসে, কেমন করি ঘাটা-আঘাটা চিনিবারে পাস?’ সময় বিষয় হয়ে ভিত তৈরি করে তাঁর কাহিনিতে, আখ্যানে, কথায়। এই ভিত ক্রমশ বিস্তৃত হতে হতে দিগন্তের রেখা মুছে দেয়। আর এই দেবেশহীন দিনে বাংলা ভাষার দিগন্ত জুড়ে সেই একক কথোয়ালের তুর্যধ্বনি শুনতে পাই।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
চুক্তিতে না থাকলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার আশা স্টয়নিসের
চুক্তিতে না থাকলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার আশা স্টয়নিসের
নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিতে এসে ১৭৩ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়ে গেলো মিয়ানমার
নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিতে এসে ১৭৩ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়ে গেলো মিয়ানমার
প্রার্থিতা নিয়ে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা দলীয় নির্দেশনা না মানলে ব্যবস্থা
উপজেলা নির্বাচনপ্রার্থিতা নিয়ে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা দলীয় নির্দেশনা না মানলে ব্যবস্থা
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা