আলপথের ওপর দিয়ে মায়ের কাছে এক্ষুনি ফিরলাম
ফেরার পথে মেরুন মেঘে
জ্বলতেছিল একখানি মোম
সুসংযত তারই আলোয়
পার হচ্ছিলাম যোজন যোজন
বাবার চলে যাবার পরে আমার আসা এবার এই প্রথম।
মা'র হাতে আর নোয়াটা নেই
চোখে পড়তেই মশাল জ্বালি
মশকরার, মাকে বললাম:
'তুমিই আমার নোয়াখালি।'
মায়ের খিন্ন শরীরটাকে
বুকে জড়িয়ে খেয়ায় তুলি
সমবেদনা ডুকরে ওঠে
ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলি
এখন আমার চোখের ওপর
আগের মোমের সলতে দু'টি
জ্বলতে থাকে, পার হয়ে যাই
সোনালি মাঝখানটা দিয়ে
আমায় এখন বৌদ্ধ ভেবে
মঠে তুলল ব্রহ্মচারী—
মাকে নিল না, যেহেতু তিনি
নিতান্তই একটি নারী
(সোনালি মাঝখানটা দিয়ে/ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত)
কতদিন আগে এভাবে মায়ের কাছের ফেরার কথা লিখেছিলেন কবি। কবিতাটি হির্শবার্গ থেকে ফ্যাক্স করে আমাকে পাঠিয়েছিলেন অলোকদা, কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। প্রকাশ পেয়েছিল ২০১৩ সালে, একটি বাণিজ্যিক পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায়। আমি তখন সেই পত্রিকার কবিতা অংশের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। অলোকদার কবিতা ছাড়া পুজো সংখ্যার কথা ভাবতেই পারতাম না।
তিনি তো ইমেল ফেসবুক হোয়াটসয়্যাপ ব্যবহার করতেন না। কথা হত আন্তর্জাতিক ফ্যাক্সে আর টেলিফোনেই। কলেজ স্ট্রিটে থাকতাম। শিয়ালদার ফ্লাইওভারের নিচে একটা দোকানে আন্তর্জাতিক ফ্যাক্স মেশিন ছিল। অলোকদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার উদ্দেশ্যেই দোকান-মালিকের সঙ্গে ভাব জমিয়েছিলাম বেশ! এতে যা হল : মাঝেমধ্যে মুক্তাক্ষরে লেখা অলোকদার চিঠি আর কবিতা পেতাম! আমিও তাঁকে চিঠি পাঠালে একটা কপি থেকে যেত আমার কাছেই। আজ সেইসব চিঠির ঝাঁপি একবার টেবিলে ছড়িয়ে বসলে কেমন হয়?
মনে ভিড় করে আসছে নানা স্মৃতি। প্রথম দেখা হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার একটা আর্ট গ্যালারিতে, কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে। আমার সম্পাদিত পত্রিকা 'উত্তর শিলালিপি'র নতুন সংখ্যা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। সেখানে কবিতা পড়তে গিয়েছিলেন, ঋতম মুখোপাধ্যায়, ছন্দম মুখোপাধ্যায়-সহ আরও কয়েক জন তরুণ কবি। তিনি বলেছিলেন : এভাবে তো কথা হয় না, একদিন বাড়িতে এসো'। কলেজ স্ট্রিট থেকেই এক শীতের সকালে বাসে চেপে অলোকদার যাদবপুরের বাড়িতে গেলাম। সময় দিয়েছিলেন সকাল ৭ টায়। দিনটাও মনে আছে ২০ ডিসেম্বর ২০১১। গিয়ে মুখোমুখি বসলাম আর কবিতা দেখালাম নিজের। আমার শরীরে তখন খেলা করছে রোমাঞ্চ! একটা কবিতায় লিখেছিলাম 'ছেড়ে দিই সব বিষণ্ণ আর্তনাদ'। আমার কবিতার লাইনটা একটু বদলে দিয়ে অলোকরঞ্জন লিখলেন: 'ছেড়ে দিই সব বিজন আর্তনাদ'। কেন তিনি 'বিজন' শব্দটি আমার কবিতায় লিখতে চাইলেন, আমাকে সারা জীবন ধরে তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে!
অলোকদার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আমার বাবা-মায়েরও। যখন 'দৃষ্টিকোণ'-এ যেতাম, ফোনে কথা বলিয়ে দিতাম। কথা বলতে গিয়ে জেনেছিলাম, তিনি কাটুমকুমুট পছন্দ করেন। তাঁর জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম আমার মায়ের কিনে দেওয়া ডুয়ার্সের কাটুমকুটুম। সেই উপহারে কি যে খুশি হয়েছিলেন তিনি! আমি নিজেও একবার হস্তশিল্প মেলা থেকে যৌবন বাউলের জন্য কিনেছিলান একটা একতারা। যেদিন সেটা বাড়িতে দিতে যাই, তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ একতারাটা বাজিয়েছিলেন। সেদিন তাঁর বাড়িতে এসেছিলেন 'পেন' সংগঠনের কয়েক জন কর্মকর্তা। তিনি নিজেই ৫০০ টাকা দিয়ে আমাকে ওই সংগঠনের সদস্য করে দেন এবং তাঁদের সঙ্গে আমাকে যোগাযোগ রাখতে বলেন।
তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্তিও কিছু কম হয়নি! 'স্বকাল' পত্রিকায় কবি অরুণকুমার সরকারকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ তিনি শুরু করেছিলেন অধমের প্রসঙ্গ দিয়ে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, আমি নাকি সারা দিনমান জীবনানন্দের লাইন আওড়াই! 'স্বকাল' পত্রিকায় তাঁর লেখাটা পড়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ! সাধারণত ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি তিন মাস কলকাতায় থাকতেন যৌবন বাউ'। তিন মাসে আমি অন্তত চল্লিশ বার তাঁর দীক্ষা নিতে যেতাম! আর তিনি কানের ভেতর দিয়ে মর্মে ঠেলে দিতেন বিশ্ব সাহিত্যের মন্ত্র! বাড়িতে যাওয়ার আগে ফোন করতাম। বলতেন: 'একটা ব্যাগ নিয়ে এসো। কিছু বই দেব'। বাড়িতে গেলে আমার ব্যাগ ভরে যেত একগুচ্ছ বইয়ে! বলতেন : 'এর মধ্যে তোমার কোনও বই ভাল লাগলে আমাকে আবার পড়তে দিয়ো কিন্তু!"
একবার কলেজ স্ট্রিট থেকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার সময় ফোনে বললেন, 'দে'জ থেকে দু'কপি কিনে আনবে শক্তি-মুকুলের অনুবাদে রিলকের 'দুইনো এলিজি'। ছোট আর কালো মলাটের বই। যদি অসুবিধে হয় কার্তিকদাকে বলবে। ও খুঁজে এনে দেবে। কার্তিক বুদ্ধদেব বসুর গৃহকর্মী ছিলেন।' ওই দু'কপি বইয়ের মধ্যে একটা নিজের কাছে রেখে, অন্যটা উপহার দিলেন আমাকে। সেই বই আমি এখনও পড়ি। এমন আরও নানা উদাহরণ আছে। অনেকে অলোকদাকে 'বিশ্বনাগরিক' বলেন। শব্দটা বোধ হয় পছন্দ ছিল না তাঁর। তাই একটা সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন : 'আমি বিশ্বগ্রামীণ হতে চেয়েছি।'
পরে তাঁর অনুবাদে গ্যুন্টার গ্রাসের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। 'নৈশ স্টেডিয়াম' কবিতাটি তিনি ভাষান্তর করেন এইভাবে:
আস্তে আস্তে আকাশে প্রকাশমান হল ফুটবল।
তখন দেখা গেল গ্যালারিতে তিলধারণের জায়গা নেই।
গোলপোস্টে একলা দাঁড়িয়ে কবি,
কিন্তু হুইসিলে রেফারি বাজিয়ে দিলেন : 'অফসাইড'।
নানা সময় তাঁর কাছে বিশ্বসাহিত্যের পাঠ পেয়েছি। কখনও যে মধুর বকুনি খাইনি এমনটা নয়, যারা তাঁর বকা খেয়েছেন তারা নিশ্চয়ই 'মধুর' শব্দটির ব্যঞ্জনা বুঝতে পারবেন! খুব মনে পড়ছে, আমার ডাকে ২০১৩ সালের বইমেলার মাঠে (তখন মিলন মেলায় হত) এসে অলোকদা উদ্বোধন করেছিলেন রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর 'কবিতাসমগ্র'। উদ্বোধনের সময় সেখানে ছিলেন কয়েক জন তরুণ কবিও। প্রবীর চক্রবর্তী, সায়ন, সুনির্মলদা, অনিমেষ আরও অনেকে। অনুষ্ঠান শেষ সারা বইমেলায়, অলোকঞ্জনের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি আমাদের আজীবন মনে থাকবে।
সেই সময় একটি পত্রিকায় ধারাবাহিক লিখছেন তিনি। প্রতি সংখ্যায় লেখা বেরলে আমিই তাঁকে ফ্যাক্স করে তাঁর লেখার পৃষ্ঠা দুটি পাঠাতাম আর আগ্রহে জিগ্যেস করতাম: পরের সংখ্যায় কী লিখবেন? মজার উত্তর আসত: 'আর বোলো না, সম্পাদকদ্বয় তো আমার লেখা পাওয়ার আগে তাড়া দেন না, পাওয়ার পরে সারা দেন না'! আলোকদার কথাগুলো আজ কানের কাছে বেজে উঠছে বারবার। ২০১৫ সালের বইমেলায় মমার্ত মঞ্চে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত উদ্বোধন করেছিলেন আমার দ্বিতীয় বই 'দিনান্তের ভাষা'। ঠিক এর পরের বই উৎসর্গ করেছি তাঁকে। বইটা হাতে নিয়ে বলেছিলেন : 'হির্শবার্গে নিয়ে যাব'।
কাজের সূত্রে যখনই কোনও পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়েছি, লেখা চেয়েছি আলোকদার আছে। তিনি লেখা দিয়েছেন, আর বারংবার পড়তে গিয়ে কবিতাটি হয়ে উঠেছে একান্ত আমার। তেমনই একটি কবিতা তুলে দিচ্ছি। কবিতাটি তিনি ফোনে বলেছিলেন হির্শবার্গ থেকে, আমি লিখেছিলাম কলকাতায় বসে। ২০১৯ সালে পুজোর আগে।
“মরুভূমির আকাশ জুড়ে
এক ঝলক চাঁদের কিরণ,
একি শান্তি, কোথাও কোনও
উদ্বেগের চিহ্ন নেই,
অতিথিরাও ঠিক সময়ে
পৌঁছে গেছে, মধুপর্ণা
শুধু আসেনি, আসবেও না;
সাহারা জুড়ে হলকা হাওয়ায়
বেজে উঠছে লোকমন্ত্র:
বধূ বরণে চন্দ্রকণা!”
(বধূ বরণ/ অগ্রন্থিত)
ভালো থেকো 'আড় ভাবুক'।