X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এবং যাদুবাস্তবতা || ডানা গিয়োইয়া

অনুবাদ : দুলাল আল মনসুর
২১ এপ্রিল ২০১৬, ১৭:৫৯আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০১৬, ১৮:৪৪

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এবং যাদুবাস্তবতা || ডানা গিয়োইয়া লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যে প্রাত্যহিকতার সঙ্গে কল্পনার মামুলি মিশেলকে বর্ণনা করার জন্য ‘যাদুবাস্তবতা’ পদযুগল ১৯৪৯ সালে প্রথম ব্যবহার করেন কিউবার ঔপন্যাসিক আলেহো কার্পেন্তিয়ের। প্রায় একই সময়ে ইউরোপের সাহিত্য সমালোচকগণ একই রকম প্রবণতা প্রকাশ করার জন্য যুদ্ধপরবর্তী জার্মান কথাসাহিত্যে এই পদযুগল ব্যবহার করেন। উদাহরণ দেখা যায় গুন্টার গ্রাসের দ্য টিন ড্রাম (১৯৫৯) উপন্যাসে। জার্মান শিল্প সমালোচক ফ্রানজ রোহ এই একই শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন ১৯২৫ সালে, তবে তিনি ব্যবহার করেন শুধু চিত্রকলার ক্ষেত্রে। সমসাময়িককালের কথাসাহিত্যের একটা প্রধান প্রবণতা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যাদুবাস্তবতা বিষয়টি একটি মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে। এরকম কথাসাহিত্যের পরিধি লাতিন আমেরিকার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড (১৯৬৭) থেকে শুরু করে উত্তর আমেরিকার মার্ক হেল্পরিনের উইন্টার্স টেল (১৯৮৩) উপন্যাস এবং এশিয়ার কথাসাহিত্যের সালমান রুশদীর মিডনাইট চিলড্রেন (১০৮১) পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রায় সবখানেই সমসামসয়িক কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে বাস্তবতাধর্মী বর্ণনায় মোটের ওপর সার্বিক প্রেক্ষিতে যাদুর সঙ্গে পার্থিবতার মিশ্রণ ঘটানোর প্রবণতা দেখা যায়।
‘যাদুবাস্তবতা’ অপেক্ষাকৃত নতুন হলেও এর দ্বারা যে বিষয়কে প্রকাশ করা হয়ে থাকে সাহিত্যের আধুনিক রূপ হিসেবে উপন্যাস এবং গল্পের শুরুর কাল থেকেই সেটি বিদ্যমান ছিল। যাদুবাস্তবতার আদি উপাদান গালিভার্স ট্রাভেলস (১৭২৬) -এও দেখা যেতে পারে। এখানে প্রকৃতপক্ষে একজন ইংরেজ শল্যবিদের কতিপয় অবাস্তব অভিযানের বর্ণনা রয়েছে। এরকমই দেখা যায় নিকোলাই গোগলের ‘নোজ’ গল্পেও। গল্পটিতে দেখানো হয়েছে জার শাসনামলের একজন পাতি বুর্জোয়ার নাক লোকটার মুখ থেকে চলে গিয়ে সেন্ট পিটারবার্গে নিজের মতো স্বতন্ত্র জীবন শুরু করে। অর্থাৎ এই গল্পটিতে কার্যত সমসাময়িককালের ইঙ্গিতবাহী এই শৈলীর সব উপাদানই রয়েছে। এই শৈলীরই পূর্বদৃষ্টান্ত দেখা যায় ডিকেন্স, বালজাক, মোপাসাঁ, কাফকা, বুলগাকোভ, কালভিনো, শিভার, সিঙ্গারসহ আরো অনেকের রচনাতেও। সুতরাং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যাদুবাস্তবতা আসলে কাল্পনিক প্রণোদনার ভক্তিভাজনের সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ।
গল্প বলার সম্ভাবনাগুলো সব সময়ই আপাতসত্য ও পুরাণকথা, প্রকৃত অবস্থা ও অবাস্তবতা, বাস্তবতা ও অলীক কল্পনার বিপরীত মেরুর মাঝখানে দোদুল্যমান অবস্থায় থাকবে। এফ আর লিভিস, ভি এস প্রিটশেট, এফ ডাব্লিউ উিউপি, ইরভিং হো, লাওনেল ট্রিলিংদের মতো মধ্য শতাব্দীর সমালোচকগণ যদি বস্তবতার ধারার প্রতিই একচেটিয়া পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে থাকেন তাহলে তাঁদের এই গুরুত্ব প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে নিকট অতীতের প্রতি তাঁদের প্রজন্মের বোধগম্য পর্যায়ের মোহ প্রকাশ পেয়েছে বলা যায়। তখনও তাঁরা মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক বাস্তবতার উপন্যাসের (লিভিসের মতে) ‘মহান ঐতিহ্যের ছায়াতলেই ছিলেন। লিভিসের ইংরেজপ্রেমী তালিকা আরো একটু দীর্ঘ করলে, এই ঐতিহ্যের পরিধির মধ্যে দেখা যায় জেন অস্টেন, জর্জ এলিয়ট, হেনরি জেমস, এডিথ হার্টন, যোসেফ কনরাড, ভার্জিনিয়া উল্ফ, ডি এইচ লরেন্স, উইলা ক্যাথার, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং প্রথম পর্যায়ের জেমস জয়েসকে।
বাস্তববাদী উপন্যাস শতাব্দীর প্রথম দশকগুলোতে চলমান থাকার কারণে অতি চেনা বা সহজ হওয়ার জন্য কারো চোখেই পড়েনি, এই ধারা উপন্যাস-পূর্ব যুগের গল্প বলার কায়দাকে পিছে ফেলে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে গেছে। লন্ডন, অক্সফোর্ড এবং নিউ ইয়র্কের এই সকল সমালোচক খুব একটা কল্পনা করতে পারেননি, তাঁদের বোধগম্যতার বাইরে আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া এবং পেরুতে পুরোপুরি আলাদা ধরনের কথাসাহিত্য পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গার্সিয়া মার্কেস এবং ল্যাটিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের বিশাল বিস্তারের আরো সব সমকক্ষ লেখকদের যখন পরিপক্কতা এসে গেছে তখন কথাসাহিত্যের কল্পনাপ্রধান ধারার পুনরুত্থান প্রায় সেখানকার রাজনীতির মতোই বিপ্লবী চেহারা পেয়ে গেছে।

গার্সিয়া মার্কেস আইনের ছাত্র হিসেবে অল্প বয়সেই কাফকার মেটামরফসিস পড়েন। বিষয়টিকে অবশ্যই নিশ্চয়ক এবং আকস্মিক সাক্ষাৎ বলা যেতে পারে। তাঁর ওপরে কাফকার প্রভাব দেখতে হলে খুব কষ্ট করতে হয় না। তাঁর প্রথম দিকের গল্পগুলোতে কাফকার প্রভাব সুস্পষ্ট

লাতিন আমেরিকার যাদুবাস্তবতার সকল বৈশিষ্ট্যই পাওয়া যায় গার্সিয়া মার্কেসের “আ ভেরি ওল্ড ম্যান উইথ ইনরমাস উইংস” গল্পে। গল্পটি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত দি ইনক্রোডবল অ্যান্ড স্যাড টেল অব ইনোসেন্ট এরিন্দিরা অ্যান্ড হার হার্টলেস গ্র্যান্ডমাদার ভলিউমে। ইংরেজি অনুবাদে ১৯৭২ সালেই প্রকাশ করা হয় লিফ স্টর্ম অ্যান্ড আদার স্টোরিজ-এর অংশ হিসেবে। যেহেতু লিফ স্টর্ম স্প্যানিস ভাষায় লেখা হয়েছিল ১৯৫৫ সালে, অনুবাদের ভলিউম পরবর্তীতে দেখার কারণে আমেরিকার অনেক সম্পাদক এবং সমালোচক এটির প্রকাশনার সময় নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন। ওদিকে “আ ভেরি ওল্ড ম্যান উইথ ইনরমাস উইংস” খুব বেশি আগের লেখা নয়। এটি লেখা হয়েছিল গার্সিয়া মার্কেসের প্রধান উপন্যাস হিসেবে গণ্য ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার অব সলিটিউট লেখার পর পরই।
গার্সিয়া মার্কেস আইনের ছাত্র হিসেবে অল্প বয়সেই কাফকার মেটামরফসিস পড়েন। বিষয়টিকে অবশ্যই নিশ্চয়ক এবং আকস্মিক সাক্ষাৎ বলা যেতে পারে। তাঁর ওপরে কাফকার প্রভাব দেখতে হলে খুব কষ্ট করতে হয় না। তাঁর প্রথম দিকের গল্পগুলোতে কাফকার প্রভাব সুস্পষ্ট। সে সব গল্পে সাধারণ পরিপার্শ্বে সব অদ্ভূত ঘটনা ঘটে। উপকথাকে আধুনিক প্রাত্যহিক জগতে উপস্থাপন করার মাধ্যমে কাফকা যদি উপকথাকে পুনরাবিষ্কার করে থাকেন, মার্কেস সেটাকে তৃতীয় বিশ্বের অপরিচিত ভূখণ্ডে পুনস্থাপন করেন। কাফকা যদি আত্মিক বিষয়গুলোকে আমলাতান্ত্রিক কার্যপ্র্ণালির বেড়াজালে ঘিরে আরো রহস্যময় করে তুলে থাকেন, তাঁর কলম্বীয় শিষ্য জোর দিয়ে দেখিয়ে দেন, এই নতুন জগতে স্বপ্নময় ভাবলুতা শুধুই সংবাদপ্রতিবেদন। এভাবে লাতিন আমেরিকা সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণাটাকেই বদলে ফেলেন তিনি। মার্কেস আরো একজন বিজ্ঞ গুরুকে পেয়েছেন হাতের কাছে। তিনি হলেন আর্জেন্টিনার হোর্হে লুই বোর্হেস।
তিনি বয়সে মার্কেসের চেয়ে মাত্র ত্রিশ বছরের বড়। তিনি নীরব প্রশান্ততার ভেতর দিয়ে ল্যাটিন আমেরিকান কথাসাহিত্যের কল্পনাশ্রয়ী সাীমানা পুনর্ধিারণ করেছেন। প্রায় একাকীই তিনি কাল্পনিক কাহিনীকে উচ্চ পর্যায়ের শিল্পমান সম্পন্ন কথাসাহিত্য হিসেবে পুনার্বাসিত করেছেন। ধর্ম এবং অতিপ্রাকৃতকে যে কোনো রকমের নির্ধারিত আদর্শ থেকে সরিয়ে ফেলে অধিভৌতিক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছেন খ্রিস্টধর্মের পুরাণকথা, ইহুদিধর্ম, ইসলাম এবং কনফুসিয়ানিজমকে। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে বোর্হেস তাঁর পরিশীলিত কথাসাহিত্যকে পরীক্ষামূলক আকারে প্রকাশ না করে বরং প্রচলিত আকৃতিতেই প্রকাশ করেন। উপকথা, গোয়েন্দা গল্প, অতিপ্রাকৃত কাহিনী এবং রাখালী লোককাহিনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রথম উত্তরাধুনিক গল্পবলিয়ে এবং তিনি গার্সিয়া মার্কেসের মধ্যে এবজন আগ্রহী শিক্ষানবীশের উপস্থিতি দেখতে পান। মার্কেস তাঁর কাছ থেকে নেয়া নতুন নতুন ধারণাগুলোকে আরেকটু আলাদাভাবে এবং সচরাচর আরো ব্যাপক পরিসরে ব্যবহার করেছেন তাঁর লেখনীতে।
গার্সিয়া মার্কেসের কোনো গল্পের রূপরেখা খুব সহজেই সারাংশ করে ফেলা যায়। টানা তিন দিনের ঝড়বৃষ্টির শেষে পেলেও দেখতে পায় তার উঠোনের জল কাদার মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে আছে এক বুড়ো, তার শরীরের সঙ্গে লাগানো বিশাল দুটো পাখনা। এরপর সে তার স্ত্রী এলিসেন্দাকে ডেকে নিয়ে আসে। দুজনে মিলে টাক মাথার ফোকলামুখো আধমরা লোকটাকে পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করে। তারা লোকটার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু বুড়ো লোকটা কী বলে কেউ বুঝতে পারে না। বুড়োকে নিয়ে আলাপ পরামর্শের এক পর্যায়ে তাদের এক প্রতিবেশি মতামত জানায় এ লোকটা আসলে ফেরেস্তা। কাজেই পেলায়ও ধূলিময়লাঅলা লোকটাকে কোনো রকমে টেনে হিচড়ে বাড়ির মধ্যে নিয়ে গিয়ে একটা মুরগির খাঁচার ভেতর স্থান দেয়। এরপর তাদের বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়; প্রথমে তারা আসে লোকটাকে খেপিয়ে মজা লুটতে, এরপর আসতে থাকে অলৌকিক ঘটনাবলী দেখতে। স্থানীয় পাদ্রী মহাশয় পরীক্ষা করে দেখতে চেষ্টা করে বুড়ো লোকটা আসলেই ফেরেস্তা নাকি কোনো অশুভ চক্রান্ত। লোকটার গায়ের গন্ধ এবং পোকায় খাওয়া পাখা পরীক্ষা করে দেখে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না সে। শেষে লোকটা সম্পর্কে বিশপের কাছে লিখে পাঠায় এবং রোমে খবর পাঠায় যাতে তারা কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। রোম থেকে আরো তথ্য চেয়ে পাঠায় কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। কাহিনীর পরিস্থিতির চেহারা কাফকার গল্পের মতোই।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস খুব শিঘ্রই পেলেও এবং তার স্ত্রী তাদের ফেরেস্তাকে দেখতে আসা লোকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা শুরু করে। অন্যান্য আকর্ষণীয় আনন্দোৎসেব বিষয় শুরু করার আগ পর্যন্ত দর্শনার্থীদের ভীড় বাড়তেই থাকে। মুল আকর্ষণের পাশাপাশি বাড়তি হিসেবে একবার এক মেয়েকে হাজির করা হয়: স্পাইডার ওম্যান মেয়েটা ভেড়ার আকারের এবং মনুষ্য মুখমণ্ডলঅলা এক অদ্ভূত জীবে পরিণত হয়েছে। তার আচরণ চুপ করে থাকা এবং প্রায় নিশ্চল ফেরেস্তার মতো নয়। সে আগতদের সঙ্গে আগ্রহ নিয়ে কথা বলে। সে কারণে দর্শকদের আকর্ষণ কমে যায়। যা-ই হোক ততদিনে পেলেও দম্পতি একটা সুন্দর দোতলা ম্যানসন তৈরি করার মতো অর্থ কামিয়ে নিয়েছে। কয়েক বছর পার হয়ে যায়। গল্পের শুরু যখন তখন তাদের ছেলে একদমই শিশু ছিল। এখন সে স্কুলে যাওয়ার মতো বড় হয়ে যায়। দুর্বল শরীরের ফেরেস্তা তাদের বাড়ির বিভিন্ন জিনিসের চারপাশে নিজেকে কোনো রকমে টেনে হিচড়ে চলাচলের চেষ্টা করে। তাতে অবশ্য এলিসেন্দা বিরক্ত হয়। তার গা থেকে মাটি কাদা জড়ানো শেষ পালকটাও খুলে পড়ে যায়। একবার শীতে জ্বর হয়ে তার মরার অবস্থা হয়ে যায়। তবে বসন্ত আসতে আসতে তার শরীরে আবার নতুন পালক গজিয়ে ওঠে। একদিন রান্নাঘর থেকে এলিসেন্দা দেখতে পায় সে আস্তে ধীরে ওড়ার চেষ্টা করতে করতে সত্যিই উড়তে সক্ষম হয় এবং পাখা ঝাপটিয়ে সমুদ্রের ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়।
যাদুবাস্তবতার কথা বাদ দিলে মার্কেসের গল্পের রূপরেখা মোটামুটি নীরস। গল্পের শেষটায় খুব পরিষ্কারভাবেই দেখা যায় বর্ণনার মধ্যে উদ্ভাবনকুশলতা নেই। যেমনটি উত্থানের বৈপরিত্বপূর্ণ হওয়ার কথা ছিল তেমনটি হয়নি। সাদামাটা রূপরেখার কারণে গল্পের কোনো রকম একটা নিজস্বতা তৈরি হয়েছে- খবরের কাগজের প্রতিবেদনের মতো নৈর্ব্যক্তিক হয়েছে এবং প্রচলিত গল্পের মতোই কাহিনীমূলক হয়েছে। দূরত্ববোধের এই অনুভূতি তৈরি হয়েছে সর্বজ্ঞ বয়ানকারীর কারণে। তিনি নিরাবেগ নৈর্বক্তিকতা নিয়েই অদ্ভূত ঘটনার বর্ণনা করে যান। গল্পের বিশেষ শক্তির উৎস হলো অসাধারণ বর্ণনা; বর্ণনার ভেতরে যে সব জিনিস এসেছে সেগুলোর কোনোটাই নীরস নয়; বরং কোনোখানে বর্ণনার ভেতরের জিনিসগুলো বেশ চোখ ধাঁধানোর মতো। মানুষ এবং বিভিন্ন জিনিসের মিশ্র আগমন (মহল্লার সাধারণ পাদ্রী থেকে শুরু করে স্পাইডার ওম্যান পর্যন্ত) এমন প্রাচুর্যের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে, পাঠক ঠিক জানেন না এর পর কী হবে- রহস্যময় কিছু, সাধারণ পার্থিব কিছু নাকি যাদুর মতো কিছু। এই মনোযোগহারী তবে বিভ্রান্তিকর প্রভাব যাদুবাস্তবতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর এই উপাদানই মার্কেসের অগ্রজদের থেকে তাঁকে অনেকটাই আলাদা করেছে। গোগল, কাফকা এবং সিঙ্গার একই ধরনের কথাসাহিত্য সৃষ্টি করে থাকতে পারেন। কিন্তু তাঁরা কখনওই মার্কেসের মতো করে কল্পনার সবিস্তার বর্ণনা এত উদারভাবে, এত অমিতব্যয়ী নির্লিপ্ততার সাথে দেননি।
“আ ভেরি ওল্ড ম্যান উইথ ইনরমাস উইংস” আপাত সব রকমের প্রতীকী এবং রূপক গল্পের পঠন দাবী করে। কিন্তু মার্কেস কোনো রকম সহজ ব্যাখ্যাকে নিরুৎসাহিত করেন। যদি মাটি কাদাঅলা অসুস্থপ্রায় জীব সত্যিই দৈনন্দিন জীবনে অদ্ভূত ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করে থাকে তাহলে এই জগতে কারো পূর্ব-ধারণার সঙ্গে তার কোনো কিছুই মেলে না। পাদ্রী, প্রার্থনাকারী কিংবা মজা দেখতে আসা কোনো দর্শক- কারো ধারণার সঙ্গেই খাপ খায় না তার বৈশিষ্ট্য। এই অনুমিত ফেরেস্তা শুধু যে দুর্জ্ঞেয় এবং অনাকর্ষণীয়ই থেকে যায় তা নয়, বরং কিছুটা বিরক্তিকরও থেকে যায়। গল্পের কেউই তার সঙ্গে সফলভাবে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। যদি সে স্বর্গের ভাষা ব্যবহার করে থাকে, আমরা তো সে ভাষার একটা শব্দও বুঝতে পারি না। তার আবির্ভাব ঘটে, সে কিছু দিন এখানে অবস্থান করে এবং কোনো রকম ব্যাখ্যা ও আপাত উদ্দেশ্য প্রকাশ না করে এখান থেকে চলেও যায়। যদি কেউ গল্পটি প্রতীকী অর্থে পড়তে চান তাহলে তিনি বড় জোর বলতে পারেন পাখাঅলা বুড়ো লোকটা এই জগত এবং পরজগতের দুর্ভেদ্য রহস্যের প্রতিমূর্তি। সে সত্যিকার অর্থে স্বাভাবিক কিংবা অতিপ্রাকৃত যা-ই হোক না কেন, তার অস্তিত্ব আমাদের বোধগম্যতার বাইরে। তার ইতিহাসের সাদা পর্দায় আমাদের নিজেদের অনুমানের প্রক্ষেপণ ঘটাতে পারে। তবু তার গুণাবলী চিরতরে অদৃশ্য রয়ে যায়। যখন সে উড়ে চলে যায়, তার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছু আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তার আবির্ভাবের সময়ের চেয়ে প্রস্থানের সময়ে তার সম্পর্কে আমাদের জানার নিশ্চয়তা একটুও বেশি নয়।


পড়ুন-

কবিতার পাঠককেও তৈরি হতে হয় : পৌলমী সেনগুপ্ত

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন: বিচারের অপেক্ষায় এক দশক পার
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন: বিচারের অপেক্ষায় এক দশক পার
জাতীয় পার্টির (কাদের) কেন্দ্রীয় বর্ধিত সভা শুরু
জাতীয় পার্টির (কাদের) কেন্দ্রীয় বর্ধিত সভা শুরু
লোহিত সাগরে আরেক তেলবাহী জাহাজে হুথিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
লোহিত সাগরে আরেক তেলবাহী জাহাজে হুথিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
‘আমার স্ত্রী শুধু অন্যের পরামর্শ শোনে’
‘আমার স্ত্রী শুধু অন্যের পরামর্শ শোনে’
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!