X
শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩
১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩০

প্রিয় দশ

আসাদ মান্নান
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৩২

আমার মৃত্যুর পর

আমার মৃত্যুর পর শোনা যাবে আমার কবরে.
নদীর নিঃসঙ্গ স্বর, অপসৃত অরণ্যের সুর—
ঘড়ি ও ঘাসের সব স্মৃতির গজল, জরায়ুর চরে
যে শিশু জন্মের মূল খুঁজে গায়-পাখি ও পশুর
উড়ন্ত ছায়ার মধ্যে যে প্রেম জলের দাহ পাবে,
একদিন আমার কবরে তার গান শোনা যাবে।

আমার মৃত্যুর পর দেখা যাবে আমার কবরে
দ্বিতীয় জন্মের চাঁদ-সূর্য-গীতা-বাইবেল-কোরান
আলো দিচ্ছে লতাগুল্মে ঘাসে; হাজার বছর ধরে
আমার কবর ঘিরে তৈরি হবে রবীন্দ্রবাগান;
পাহাড় সমুদ্র নদী অবারিত নির্ঘুম আকাশ
আমার কবরে খুঁজবে নক্ষত্রের নীল দীর্ঘশ্বাস।

আমার কবর ছুঁয়ে কেউ যদি ভরাট আঁধারে
পুরনো চুমুর গন্ধ কখনো বা ফিরে পেতে চায়
তবে সে তা ফিরে পাবে; জীবনের সবুজ খামারে
কখনো জলের ফেনা যদি ভাসে প্রাণের ভেলায়
বন্ধুসব! তাহলে কবিতা শুনো, প্রকাশ খবরে—
এ আমি আবার ফের জন্ম নেব শব্দের ভেতরে।



পা দুখানা দেখতে দেখতে

পা দুখানা দেখতে দেখতে তোমার মুখ দেখতে ভুলে গেছি।

পা থেকে মুখ বেশি দূরে নয়.
পা থেকে মুখ অল্প দূরে ছিল
তবু পা দুখানা দেখতে দেখতে বারো বছর কেটে গেল
                        মুখ দেখতে মনে ছিল না;
পায়ের পাতায় জলের মতো স্বচ্ছ সবুজ
জোনাকপোকার আলোর খেলা দেখতে দেখতে
                        তোমার মুখের আলো দেখতে ভুলে গেছি—.
না-ভুলে কি উপায় ছিল?

ইতোমধ্যে অনেক কিছুই ভুলতে হলো, ভুলে গেছি :
মায়ের কাছে শিখে নেয়া পিতৃদেবের নাম-পরিচয়,
                        এবং আমার নিজের নামটাও;
বাল্যকালে সাতঘরিয়ার আঁকাবাঁকা পথের ওপর মার্বেল খেলা
কালির চরে কোজাগরি মাছের মিছিল, রাখাল রাজার
বাঁশের বাঁশি, ডাংগুলি আর লাট্টু ঘুড়ি
বেলা শেষে ঘরে ফেরা পাখির মতো ভুলে গেছি
পাড়া-পড়শির ঈর্ষা এবং ষড়যন্ত্র; অবশেষে ভুলে গেছি
আমার প্রথম প্রেমের সাক্ষী কুসুম নামের সেই কুমারীর সাবধানতা
এবং আমার খালার বাড়ি।

শুধু পা দু’খানা দেখতে দেখতে অবশেষে ভুলতে হলো
সহজ এবং সত্য কথা : ‘সব মানুষের মুখ আছে’;
মুখের মধ্যে যতই পড়ুক আলো-আঁধার
একজোড়া চোখ ঠিকই জ্বলে প্রয়োজনে;
আর চোখের মধ্যে চোখ পড়লে
                        ভালোবাসার কালো বোতাম খসে পড়ে
                        শিউলি-চাঁপার চোখের ওপর
আর চোখের মধ্যে চোখ পড়লে বোঝা সহজ :
ভালোবাসা আসবে কখন, আসতে এখন কত দেরি।

পাছে তুমি বিবাহিতা, অন্ধ কিংবা অন্য কোনো যুবার চোখে
চোখ রেখেছ কিংবা তোমার ভালোবাসা আসতে দেরি বুঝতে পারব
এ আশঙ্কায় বারো বছর তোমার চোখে চোখ না-রেখে
কাটিয়ে দিলাম-মুখ দেখতে মনে ছিল না।

শুধু পা দুখানা দেখতে দেখতে তোমার মুখ দেখতে ভুলে গেছি
শুধু পা দুখানা দেখতে দেখতে তোমার মুখ দেখা হলো না
শুধু পা দুখানা দেখতে দেখতে—
তুমি হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছ নদীর ওপারে—
                        শুধু পা দু’খানা রেখে গেলে।



সূর্যাস্তের উল্টোদিকে

তারপর সেই সূর্যমুখী অন্ধকারে
একটু একটু রোদ; রোদে জ্বলে ঘর-বাড়ি আমার স্বদেশ, প্রিয়তমা
স্বদেশের নারী। বঙ্গোপসাগর তীরে অমলিন রক্তের জোয়ারে
শুরু হলো সর্বহারা অস্তিত্বের শর্তহীন ঝড় :
গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ, কৃষ্ণচূড়া ঝরে পড়ে আগুনের আত্মার ওপর—
পাহাড়-অরণ্যব্যাপী শতবাহু উদ্ভিদের মূলে
নতুন প্রাণের বীজ, নতুন নদীর বান, নতুন নারীর প্রেম
বিদ্রোহের অস্ত্রাবলি ঝোলে
সমূহ তছনছ করে আগুনের অস্থির শিখায়;
তৃতীয় বিশ্বের বুকে শিশু মরে, ফুল ঝরে নাপাম বোমায়।

ওই শস্যখেত এই রক্তমাখা মাটি গর্জে ওঠে কামারশালায়;
খোদার ফেরেশতা নয়, নয় আর বেশ্যার দালাল—তবে কারা
বিদ্রোহের আগুন জ্বালায়
প্রাণে প্রাণে ঘরে ঘরে মন্দিরে গির্জায় আর স্বপ্নের মিনারে?
হিংসায় প্রমত্ত এই পৃথিবীর কীর্তিনাশা নদীর কিনারে
সে কোন নির্ভীক চাষা রক্তের অঙ্কুরে বসে সবল দুহাতে
আবাদ করেছে এক মরুভূমি ওই কৃষ্ণরাতে?

অদৃশ্য হাপরে আজ সে কোন কামার বিদ্রোহের মৃত্যুর ফুলকি তোলে?
লোহার ভেতরে ক্রমে উজ্জ্বল শবের কলরোলে
আর্তনাদ করে ওঠে এই মৃত্যু, ওই রক্তমাখা মাটি—
ফ্যাসিস্ট আকাশে চাঁদ-তারা অন্য কিছু নয়, অ্যাটমিক ঘাঁটি।

হে চাঁদ, মেহেদিমাখা চাঁদ! তোমার শীতল আলো নষ্ট করে দাও—
তুমি চক্ষু খুলে দেখো-মানুষ মানুষে নেই, মনুষ্যত্ব হয়েছে উধাও;
এই মৃত্তিকার মর্মমূলে মারি আর মন্বন্তরে
উর্দিপরা জংলিরাজ, বেশ্যাবাজ বুর্জোয়ারা ছাড়া
       আর বুঝি সবকিছু মরে!
হায় নষ্ট অমরতা!
এ সব পশুর জন্য জন্ম নিয়ে তুমি বুঝি ভুলে গেলে
এই সব ছিন্নমূল আদমের কথা!

ওই দেখো, মানুষের আত্মা থেকে বের হচ্ছে গুচ্ছ গুচ্ছ পাপ
গোলাপে কীটের পরিবর্তে জন্ম নিচ্ছে জোড়া-জোড়া সাপ
   নদী থেকে জলের দূরত্ব ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে
   পাতা থেকে বৃক্ষের দূরত্ব ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে
   শস্য থেকে বীজের দূরত্ব ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে
   বৃষ্টি থেকে মাটির দূরত্ব ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে
   রাত্রি থেকে দিনের দূরত্ব ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে
   জন্ম থেকে মৃত্যুর দূরত্ব শুধু কমে আসছে কমে আসছে

আত্মা থেকে আত্মার দূরত্ব তাই ঝড় তোলে
এই সব সর্বহারা মানুষের অস্তিত্বের দগ্ধ মর্মমূলে :
নবীন নদীর মোহনায় এরা আজ হয়েছে মিলিত;.
এদের ঐক্যের তেজে প্রোজ্জ্বলিত উল্লসিত
তৃতীয় বিশ্বের সব ক্ষুধার্ত মানুষ তৃণলতা মাটি;
ঘুণেধরা মানচিত্রে ওই দেখো,
নতুন জলের বীজ তিতুমীর বাঁশ ও বাঁশের লাঠি।
ওই আসছে, ওই দেখো, ওরা আসে যে-পথে আসার কথা :
এ পোড়া দেশের চৌচির খরার তাপে ওরা আসে বৃষ্টির মতন
ওরা আসছে হাতে হাতে ঘুরেফেরা মুদ্রার মতন; ওরা আসে
বিপ্লবের ক্যাশবাক্সে নিরন্নের বুকের পকেটে-
ওই জলমগ্ন শস্যের স্বপ্ন দেখা মানুষের আদি ও অস্থির
বিপ্লবের অস্ত্র নিয়ে ওরা আসছে জলের ভেতর থেকে
                                জলচর প্রাণীর মতন
উদিত দুঃখের মেঘে বিদ্রোহের ডিম ছেড়ে
বোমারু বিমান নিয়ে ওরা আসছে আবাবিল পাখির মতন।

ভেতরে বাহিরে আজ সমূহ আঘাত করে ভাঙচুর খেলা খেলে
সমস্ত জন্মের বোধে দোলা দিয়ে বৈশাখী হাওয়ার মতো
নক্ষত্রের ডানা ভেঙে ওরা আসছে যে পথে আসার কথা—
                                             বিদ্রোহের সনাতন স্রোতে।

নতুন দ্রাক্ষার রসে ভাসমান সূর্যের উত্তাপ নিয়ে কুমারী মাতার গর্ভে
ওরা আসছে—সব ধর্মালয়ে জন্মালয়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে
হ্যাঁ, ওরাই তো আসছে, সুখ ও শান্তির গায়েবি পতাকা হাতে
মুহাম্মদ যিশু আর বুদ্ধের বিদীর্ণ আত্মা থেকে।
হ্যাঁ, ওরাই তো আসছে—
উল্লসিত রাখালের মতো ওরা আসছে ফসলের মাঠে
অন্ধ কৃষকের লাঙলের ফলায় ফলায়
পৃথিবীর সকল কবির আত্মা থেকে বিদ্রোহের গান নিয়ে
ওরা উঠে এলো
তৃতীয় বিশ্বের এক ছন্নছাড়া কবির কলমে;
ওদের পায়ের কালো রক্তাক্ত পাতায় লেখা আছে
পৃথিবীর সর্বশেষ কবির কবিতা;
ওদের হাতের মধ্যে এই মৃত্যুবীজ, ওই রক্তমাখা মাটি—
        আমি কার বুকে কাকে নিয়ে হাঁটি?

আমার উত্তরে নদী দক্ষিণে সমুদ্র আর পেছনে পাহাড়
সম্মুখে বিশাল বধ্যভূমি; এবং মাথার
উপরে ঝুলছে প্রিয় জনকের রক্তে ভেজা মায়ের কফিন; আর
আমার পায়ের নিচে—এই দেখো, সূর্যাস্তের উলটোদিকে
রোদে জ্বলে ঘরবাড়ি ঘাসফুল প্রিয়তমা
                                  স্বদেশ জননী আর স্বদেশের নদী।



সৈয়দ বংশের ফুল-১৮

কবির প্রেমিকা ছাড়া আর সব নারী এ সংসারে
আমৃত্যু নারীই শুধু; কেউ-কেউ মুদ্রার মতন
যার-তার পকেটে শয়ন করে, খোঁজে আলিঙ্গন;
প্রতিটি বছর শেষে কেউ কেউ মাতৃঅহংকারে
সংগমস্বাক্ষর রাখে; কারও-কারও নহলি যৌবন
গজার মাছের মতো একটানা জোরে ঘাই মারে;
মৃত্যুর হিমেল স্রোতে অতঃপর অচিন আঁধারে
এভাবে নশ্বর নারী ছিন্ন করে দেহের বন্ধন।

সমস্ত ভোগের ঊর্ধ্বে সুন্দরের প্রধান উপমা
কবির প্রেমিকা শুধু; সামদ্রিক কামের বাতাসে
কাঁপে না শরীর তার; কোনো পাপ কিংবা গাঢ় অমা
সে দেখে না কোনো দিন; তার চোখে অন্ধকার হাসে
প্রেমের আলোর মতো-চিরকাল অক্ষয়-অব্যয় :
কবির প্রেমিকা শুধু জয় করে মৃত্যু, পরাজয়।



সৈয়দ বংশের ফুল-৫০

আমাকে গভীর রাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছে
ওই নিশিজাগা নদী; এই হিম হেমন্ত রাত্রির
জানালায় মেয়ে চাঁদ ফাঁদ পেতে মেঘের আড়ালে
আমাকে বসিয়ে রাখে-লক্ষ যুগ পার হয়ে যায় :
একটা মেয়ের জন্য একজন্মে কয় লক্ষ যুগ
এইভাবে পার হয়ে যাবে? ওগো ইছামতি!
আমার রক্তের মধ্যে আদমীয় পাপের গুন্দম
আমাকে তোমার জলে ধুয়ে মুছে শুদ্ধ করে নাও।.

ঘুমের ভেতরে আমি প্রতিরাতে একটা রমণী
প্রজাপতি হত্যা করি; ফুলের বাগানে গোলাপের
আস্ফালনে আমার ভেতরে কাঁদে ওই অবিনাশী
নক্ষত্রের বালিকা কুসুম। দূরে উড়ে চলে যাই :
আমি এক ইকারুস-বহুদূরে আমার আকাশ;
মোমে নয় প্রেমে তৈরি এ পালক কখনো খসে না।



চিতাবাঘ

হাওয়ার ভেতর দিয়ে হাওয়া হয়ে যায়
অদৃশ্য একটা পথ, আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পথ
চলে যায়, চলে গেছে ওই দূর নক্ষত্র-পাড়ায়
কাঁটায় আকীর্ণ এই মায়াপথ গন্তব্যের ঠিকানা জানে না।

এই পথে এই আমি একজন নিঃসঙ্গ পথিক
হাতে নিয়ে ভাঙা কুপি, চোখে জ্বেলে তাজা অন্ধকার
পার হয়ে চলে যাচ্ছি ভ্রাম্যমাণ আলোর গোলক-
প্রেমের ভাল্লুক এসে এই রক্তে বহুরূপী আগুন জ্বালাল।

আকাশে তখন ছিল কামাতুর চাঁদের খোয়ারি-
চাঁদের বাঁ-পাশ থেকে একফালি জ্যোৎস্নার মাদক
তরঙ্গিয়া নেমে আসে রাতজাগা শরীরী নদীতে—
নদীতে রমণী গন্ধে গর্জে ওঠে যৌন চিতাবাঘ।



ভালোবাসা আগুনের নদী-১৩

একটা মানুষ খুন হলে দেখা যায় চারদিকে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে; একটা হৃদয় খুন হলো—কোথাও অরণ্যে কোনো পাতাও নড়েনি, ছায়াও ঝরেনি। যে হৃদয় ভালোবেসে মেয়েটাকে নিয়ে গেল অন্তহীন প্রেমের আঁধারে, প্রত্যেক মুহূর্তে তাকে ওই মেয়ে লক্ষবার হত্যা করে যায়।

কবরে যাবার আগে এই আমি বহুবার কবরে গিয়েছি : সমস্ত মৃত্যুর ঊর্ধ্বে এই হাত বারবার ছুঁয়েছে তোমাকে; আমাকে কবর থেকে টেনে তোলে তোমার চুম্বন—মৃত্যুর বিরুদ্ধে আমি দাঁড়িয়েছি মৃত্যুহীন প্রেমিক ফিনিক্স।

প্রত্যেক মুহূর্তে তুমি জরাজীর্ণ একটা হৃদয় হত্যা করে যাও—বাতাসে তোমার চুলে অন্ধকার ঝুলে আছে; ওই চুলে বাঁধা আছে আমার কফিন, কফিনের ঢাকনা আমি বারবার খুলে ফেলি—কফিনের ঢাকনা হলো তোমার হৃদয়।



ভালোবাসা আগুনের নদী-১৫

কবি ও গণিকা ছাড়া পৃথিবীকে কে আর অমন করে ভালোবাসে? কে আর অমন করে পৃথিবীকে ভালোবেসে নষ্ট হতে চায়? এক জোড়া হাত আর দশটি আঙুল কবি ও গণিকা ছাড়া কে আর অমন করে পেতে চায়?

বাতাস বিছানা পাতে শূন্যতার পাশে; রাত্রি এসে অন্ধকারে খুলে ফেলে অরণ্যের বেণী; দূরে কাঁদে একা চাঁদ মেঘের গুহায়; কবরে কবির সঙ্গে তর্ক করে খোদার প্রহরী।

একটা ক্ষুধার্ত বুনোবাঘ কবরের পাশে বসে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে কবির হৃদয়, কবিতার হৃৎপিণ্ড; আর তখন মেয়েটা গোলাপের পাপড়ি ছিঁড়ে ছুড়ে দিচ্ছে তার দিকে, যে নির্বোধ পশু তাকে শিখিয়েছে কামকলা। শরীরের পুজো দিয়ে হরিজন হয়ে ওঠে ক্ষত্রিয় প্রেমিক, বেজন্মা কুকুর হয় অন্তরঙ্গ বাসরশ্রমিক।

পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ে, শুধু মানুষ বাড়ে না; লম্পটের সংখ্যা বাড়ছে-প্রেমিকার সংখ্যা কমে যায়; আমার হৃদয় জুড়ে গণিকারা জেগে আছে, প্রেমিকা জাগেনি।

হৃৎপিণ্ড ছিন্নভিন্ন; তবু কবি স্বপ্ন দেখে গোলাপের জন্য এক সবুজ পৃথিবী—গণিকার গর্ভ থেকে জন্ম নেবে আলোর মানুষ। আলোর মানুষ মিলে একদিন গড়ে তুলবে স্বপ্নময় আলোর পৃথিবী।

এইভাবে একদিন একটা প্রাসাদ মাটি দিয়ে তৈরি হলো বালুচরে। ঝড়ে আর জলোচ্ছ্বাসে স্বপ্নগুলো ভেসে যায়,...ভেসে যাচ্ছে কবির নিয়তি। এ আমার ভালোবাসা, এ আমার আগুনের নদী।



মরভূমি স্বপ্ন দ্যাখে জল-১৭

সমুদ্রে আমার জন্ম; লবণের গন্ধ বুকে নিয়ে
জন্মগতভাবে আমি সমুদ্রের খুব অনুরাগী;
সমুদ্রের হাত ধরে একদিন পাহাড়ে উঠেছি;
কবিতা পাহাড়ে এসে ছুঁয়েছিল আমার চিবুক—
সমুদ্র আমার সঙ্গে কবিতাকে বিয়ে দিয়েছিল।

জীবনের প্ররোচনা, জীবিকার পরকীয়া চোখ
আমাকে কবিতা থেকে বহুদূরে সরিয়ে রেখেছে;
আমার হবে না ফেরা পুনর্বার কবিতার ঘরে—
আমার হবে না আর কবিতার সঙ্গে সহবাস।
হবে না আমাকে দিয়ে তৈরি করা কবিতার বাড়ি।
কবিতা আমাকে ছেড়ে হয়ে গেছে পরের ঘরনি—
আমি সমুদ্রকে বলি; যাও ভাই, কবিতা হবে না।
সমুদ্র নাছোড়বান্দা—আমি যাতে যুদ্ধের বিরুদ্ধে
কবিতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশ্যে জেহাদে নামি আজ,
তার জন্য সে আমাকে নিয়ে যাবে কবিতার ঘরে।

যুদ্ধের বিরুদ্ধে আজ আমি আর আমার কবিতা
সংসারের ধর্মকর্ম ছেড়ে কী করে দাঁড়াবে, বলো—
‘অসম্ভ—আমাদের যাত্রাপথে মৃত্যুর পোশাকে
এক পায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কবর দুয়ারে এসে
ক্ষমা চেয়ে হয়তো বা বলবে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে গিয়ে
কী লাভ বলুন; অনেক হয়েছে, আর নয় কবি!
আপনি এখন ক্লান্ত; প্রয়োজন একান্ত বাসর,
এবার চলুন কবি দিগন্তের দীর্ঘপথ ছেড়ে
আমার বাড়িতে গিয়ে নিরিবিলি বিশ্রাম নেবেন।

সমুদ্র আমাকে কেন লোরকা হতে সাহস জোগায়!
বিষাক্ত সাপের লেজে পা রেখে কেউ রক্ষা পায়?



তোমার কীর্তন-১

তোমাকে দেখার পর অবিরাম তোমাকে দেখার
এ কেমন ইচ্ছে পাখি স্নায়ু জুড়ে সকাল উড়ায়;
তোমার চোখের মতো এত তীব্র আলোময় ভোর
কী করে নিমগ্ন চিত্তে ধরে রাখে উড়ন্ত প্রেমিক!
কেন সে পারে না ছুঁতে নাভিমূল, কামচুলশিখা—
কেন সে নদীর মতো বেজে ওঠে অচেনা সন্ধ্যায়?

তোমাকে দেখার পর মনে হলো তোমাকে দেখিনি—
দেখেছি বিজন মাঠে একফালি আত্মা জেগে আছে।

যে চাঁদ আমাকে তুমি প্রতিদিন চেয়েছ দেখাতে
সে চাঁদে আগুনজলে ভেসে যায় মদন মন্দির;
লোকনিন্দা জয় করে ইচ্ছে হয় মেঘের দেয়াল
ইচ্ছার শাবল মেরে ভেঙে ফেলি; অতৃপ্ত ক্ষুধায়
আমার প্রেমের জিভ চেটে নিক তোমার গোপন
পৃথিবীর মধুজল, একবুক কামের যমুনা।


---

আসাদ মান্নান
সত্তর দশকের অন্যতম কবি আসাদ মান্নান। জন্ম ৩ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে চট্রগ্রামের সন্দ্বীপে। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ অনার্স, এমএ করেছেন। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : সুন্দর দক্ষিণে থাকে, সূর্যাস্তের উল্টোদিকে, সৈয়দ বংশের ফুল, দ্বিতীয় জন্মের দিকে, ভালোবাসা আগুনের নদী, তোমার কীর্তন, যে-পারে পার নেই সে-পারে ফিরবে নদী, হে অন্ধ জলের রাজা, নির্বাচিত কবিতা, প্রেমের কবিতা ইত্যাদি। কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০২১ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
পৃথিবীর শূন্যতম স্থান
জাঁ ককতোর চারটি কবিতা
দুপুরবেলা
সর্বশেষ খবর
ঢাকায় পৌঁছেছে কক্সবাজারের প্রথম ট্রেন 
ঢাকায় পৌঁছেছে কক্সবাজারের প্রথম ট্রেন 
রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় রেললাইনে ইউক্রেনের হামলা
রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় রেললাইনে ইউক্রেনের হামলা
আচরণবিধি লঙ্ঘন, হুইপ সামশুল হককে নোটিশ
আচরণবিধি লঙ্ঘন, হুইপ সামশুল হককে নোটিশ
বারবার ন্যাড়া করলে কি চুল ঘন হয়?
বারবার ন্যাড়া করলে কি চুল ঘন হয়?
সর্বাধিক পঠিত
যুক্তরাষ্ট্র কি একা হয়ে পড়ছে?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিযুক্তরাষ্ট্র কি একা হয়ে পড়ছে?
একই আসনে একসঙ্গে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন স্বামী-স্ত্রী
একই আসনে একসঙ্গে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন স্বামী-স্ত্রী
বিএনপিতে সাজা আতঙ্ক
বিএনপিতে সাজা আতঙ্ক
আজকের আবহাওয়া: সুস্পষ্ট লঘুচাপটি নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে
আজকের আবহাওয়া: সুস্পষ্ট লঘুচাপটি নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে
সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৭৪৭ জন 
সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৭৪৭ জন