X
শনিবার, ০৩ মে ২০২৫
১৯ বৈশাখ ১৪৩২

বটতলার `ক্রাচের কর্নেল’

মোহাম্মদ মারুফ
২০ অক্টোবর ২০১৭, ২০:১৮আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০১৭, ২০:৩২

বটতলার `ক্রাচের কর্নেল’
ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের একজন মহানায়ক আবৃত্তি করছেন, ‘জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে, করেই গেলাম। জন্ম আর মৃত্যুর দুটো বিশাল দুটো পাথর রেখে গেলাম। পাথরের নিচে শোষক আর শাসকের  কবর দিলাম। পৃথিবী অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম।’ নাটকের শেষ দৃশ্যে এসে প্রায় সব দর্শককে আর্দ্র চোখ মুছে নিতে হয়েছে।

বেইলি রোডের মহিলা সমিতির মঞ্চে ১৩ সেপ্টেম্বর ‘বটতলা’র প্রযোজনায় ‘ক্রাচের কর্নেল’ নাটকের ১৬ তম প্রদর্শনীতে এরকমই এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। নাটকের শুরুতেই নির্মাণের ভিন্নতা চোখে পড়ে। ভিন্নতা গল্পেও। গল্পের শুরু একটি থিয়েটার দলের মঞ্চনাটকের মহড়াকক্ষ থেকে। তারা কর্নেল তাহেরের জীবনীনির্ভর একটি নাটকের মহড়া করছে। কিন্তু বিতর্কিত চরিত্রে অভিনয় করবে না বলে শেষ মুহূর্তে তাদের নায়ক অনুপস্থিত। তারা নায়ক খুঁজতে থাকে। সিদ্ধান্ত হয় তারা সকলেই করবে নায়কের চরিত্রে অভিনয়। শুরু হয় মহড়া, তারা  বলতে থাকে ইতিহাসের অগ্রণী যোদ্ধা কর্নেল তাহেরের সাহসের গল্প, প্রেমের গল্প, মাথা নত না করার গল্প।

কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্নেল’ উপন্যাসের ব্যাপক বিস্তৃত পটভূমি থেকে ‘বটতলা’র নির্দেশক মোহাম্মাদ আলী হায়দারের নির্দেশনায় মঞ্চে উঠে এসেছে কর্নেল তাহেরের মধুময় পারিবারিক জীবন, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, যুদ্ধক্ষেত্রে পা হারানো, যুদ্ধ শেষে পিপলস আর্মি গঠনের ভাবনা, মেজর জিয়াউর রহমানের প্রতি তার অকৃত্রিম বিশ্বাস ও ভালোবাসার কথা।

কথকের বয়ানে উপস্থাপিত হয় ইতিহাসের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও চরিত্রের বর্ণনা। টেকনিক্যাল শো’র আগে নাটকের দলের মহড়ার খণ্ড খণ্ড চিত্রে উঠে আসে : ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদল ও অস্থিতিশীল সময়। সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে জাসদ গঠন ও কর্নেল তাহেরের সেনাবাহিনী ছেড়ে রাজনীতিতে যোগদান। খন্দকার আব্দুর রশিদ ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ গংদের চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা। খন্দকার মোশতাক আহমেদ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ। মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান, মোশতাক সরকারের শেষ কামড় হিসেবে জেলখানায় বন্দি চার জাতীয় নেতাকে হত্যা। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে গৃহবন্দি দশা থেকে মেজর জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার। পরবর্তীকালে ক্ষমতালোভী জিয়াউর রহমানের অকৃতজ্ঞতা ও প্রহসনের বিচারে ইতিহাসের এক মহানায়ক কর্নেল তাহেরের ফাঁসির ঘটনা বেশ ভালোভাবে উঠে এসেছে মঞ্চে।

বটতলার `ক্রাচের কর্নেল’ নাটকের দলটির মহড়ার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দৃশ্যের ফাঁকে ফাঁকে নাট্যকর্মীদের বিশ্লেষণধর্মী কথোপকথনে উঠে আসে ইতিহাসের সেই সমস্ত ঘটনার পক্ষ বিপক্ষের তাদের নিজস্ব যুক্তি। যেটি নাটকে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। নায়ক সঙ্কটে থাকা দলটির প্রত্যেকেরই কর্নেল তাহেরের চরিত্রে অভিনয় করাটা প্রশংসার দাবি রাখলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্নেল তাহেরের মতো একজন বলিষ্ঠ নেতার চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রায় সকলেই। তবে শেষের দিকে কর্নেল তাহেরের চরিত্রে ইমরান খান মুন্নার অভিনয় দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছে। কথকের ভূমিকায় কাজী রোকসানা রুমা ও সামিনা লুৎফা নিত্রার উপস্থাপনা ছিল চমৎকার। তবে নাটকের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সকলের অভিনয় ছিল অনেকটা প্রাণহীন। সাধারণ চোখে দেখে মনে হয়েছে তারা চরিত্রকে ধারণ না করে কেবলমাত্র মুখস্থ সংলাপ বলে গেছেন। সেই সাথে খন্দকার মোশতাক ও তার তোষামোদকারী চরিত্রদের অভিনয় দর্শকদের খানিকটা হাসির খোরাক জোগালেও সেটিকে অতি-অভিনয় মনে হয়েছে। ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সমৃদ্ধ না হলে ২ ঘণ্টা ব্যাপ্তির নাটকে উচ্চারণে অস্পষ্টতা ও অভিব্যক্তির চরম  ঘাটতি রেখে দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন ছিল।
তবে পিন্টু ঘোষের অসাধারণ আবহ সংগীত নাটকটির ছোট ছোট ত্রুটিগুলোকে পিছনে ফেলে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। বিভিন্ন দৃশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শব্দের ব্যবহার ও গানের ব্যবহার মনোমুগ্ধকর ছিল। সেই সাথে নাটকের কোরিওগ্রাফি ছিল  এককথায় অসাধারণ। সেই সাথে মঞ্চে আলোর ব্যবহারও ছিল চমৎকার।

নাটকটি মহড়ার প্রেক্ষাপটে নির্মিত হওয়ায় কস্টিউম ও প্রপস নিয়ে কথা বলার সুযোগ কম থাকলেও কোথাও কোথাও প্রপসের ব্যবহারে অবিশ্বাসযোগ্যতা ছিল স্পষ্ট। যেমন, কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আগ মুহূর্তের একটি দৃশ্যে কর্নেল তার স্ত্রীর পাঠানো আম খাওয়ার সময় মাথার টুপিকে আম রাখার পাত্র হিসেবে ব্যবহার করে সিপাহিদেরকে আম খাওয়ানোর জন্য এগিয়ে যান। সিপাহিরা কেউ আম নিতে না চাইলে অভিনেতা সেখানে দাঁড়িয়েই আবার আম রাখার পাত্রকে মাথায় পরে নেন। যেটি কিছুটা দৃষ্টিকটু ছিল।

এইসব ছোটখাটো ত্রুটি বাদ দিলে ‘বটতলা’র ‘ক্রাচের কর্নেল’ একটি অনবদ্য প্রযোজনা। আর এটির নাট্যরূপ দেয়ার জন্য সৌম্য সরকার ও সামিনা লুৎফা নিত্রা প্রশংসার দাবি রাখেন। বড় একটি উপন্যাস থেকে কিছু অংশ বেছে নেয়াটা কঠিন হলেও সেটির দারুণ নাট্যরূপ দিয়েছেন তারা। কথকের বর্ণনায় এবং অভিনয়ের আদলে তারা শাহাদুজ্জামানের উপন্যাসটিকে দর্শকের কাছে দারুণভাবে তুলে ধরতে পুরোপুরি সফল।  

 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পুকুরে গোসল করাকে কেন্দ্র করে দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহত ২০
পুকুরে গোসল করাকে কেন্দ্র করে দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহত ২০
১৪ বছর পর নিয়াজ-ফাহাদদের নিয়ে তিতাস চ্যাম্পিয়ন
১৪ বছর পর নিয়াজ-ফাহাদদের নিয়ে তিতাস চ্যাম্পিয়ন
ভারতের সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা মডেলের গুলি পাওয়া গেলো বাংলাদেশের সীমান্তে
ভারতের সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা মডেলের গুলি পাওয়া গেলো বাংলাদেশের সীমান্তে
আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
সর্বাধিক পঠিত
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয় আটক
দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয় আটক
নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়ীর বুকে-পেটে প্রকাশ্যে গুলি
নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়ীর বুকে-পেটে প্রকাশ্যে গুলি
‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট যুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার’
‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট যুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার’