জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামালের ‘তেলবাজ’ উপন্যাসে এই সমাজেরই বাস্তবচিত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটে উঠেছে। হাস্যরসাত্মক এই সৃষ্টিকর্মে লেখক তার বাস্তব জীবনের মুখোমুখি সত্যের আলোকে সমাজের নির্মহ রূপটি নিখুঁতভাবে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। সমাজে তেলবাজ, তোষামদ আর অর্থের দাপটে কিভাবে মানবিকতা কলুষিত ও বিপন্ন তা লেখক যথাযথ শব্দ চয়ন, শক্ত হাতের লিখনি দিয়ে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন। কাহিনির মূল রস হিসেবে হাস্যরসকে স্থান দেওয়ার প্রয়াস খুব কম বাংলা উপন্যাসেই দেখা যায়। বাংলায় মজার হাসি, তামাশা, পরিহাস, উপহাস, বিদ্রুপ প্রভৃতি শিরোনামে বৈচিত্র্যময় সাহিত্য আছে। প্রহসন রচনার যুগ ছিল একসময়। আবার কৌতুক রচয়িতার রসের কারবারিতে আমরা মুগ্ধ হয়েছি বারবার। জীবনের কথা বলতে গিয়ে মোস্তফা কামাল জীবনরসিক রসস্রষ্টা হিসেবে সরস কৌতুক আর গভীর সহানুভূতিকেই শেষ পর্যন্ত মুখ্য করে তুলেছেন ‘তেলবাজ’ উপন্যাসে। সংগতির অভাব বা অসংগতির কারণেই হাসির উদ্ভব হয়। নিয়মের মাঝে অনিয়ম যখন সব এলোমেলো করে দেয় তখন তা কৌতুকবোধ জাগায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কৌতুক আমাদের চিত্তের উত্তেজনার কারণ, এবং চিত্তের অনতিপ্রবল উত্তেজনা আমাদের পক্ষে সুখদায়ক।’ এই সুখদায়ক রসের পরিচয় আছে ‘তেলবাজ’-এর তেলায়েত তরফদার চরিত্র রূপায়ণের মধ্যে।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আবদুল হালিম তেলায়েত তরফদার একটি আবাসন কোম্পানির উপব্যবস্থাপক (ডিএমডি)। অফিসের অনেকে তাকে তেলবাজ বলে তিরস্কার করলেও তিনি তাতে কিছু মনে করেন না। বরং তিনি তেল দেয়াকেই ভালোভাবে রপ্ত করেছেন। তেলায়েত সাহেব বিশ্বাস করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সেই কথা ‘তেল ছাড়া যেমন গাড়ি চলে না। তেমনি তেল ছাড়া বসের মনও গলে না।’ আর সেজন্য এই তেলায়েত সাহেব কেবল অফিসের বস নয়, পরিবারের সদস্যদের সাথেও চলে তার তেলবাজি। বড় বড় কর্মকর্তাদের দুর্বলতাকে ঠিকভাবেই ধরতে পেড়েছেন তেলায়ত। তেলবাজিকে প্রধান নিয়ামক এবং অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে জীবনের অর্থবিত্ত এবং ঐশ্বর্যের মালিক হয়েছেন তেলায়েত সাহেব। আর এই তেলবাজি করতে গিয়ে তাকে অবশ্য যথেষ্ট বুদ্বিমত্তা এবং ত্যাগও শিকার করতে হয়েছে।
উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখি, পুরো অফিসের অবস্থা থমথমে। সবাই যখন কোম্পানির চেয়ারম্যানের ভয়ে ভীত হয়ে তার কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিল না, তখন কিন্তু এই মেরুদণ্ডহীন তেলায়েত সাহেবই পুরো অফিস তার বাগে নিয়ে আসেন। যেভাবেই হোক অফিসের বসকে খুশি করতে পটু এই তেলায়েত সাহেবই ধীরে ধীরে অফিসের সবার কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি একটি বিষয় খুব ভালোভাবে জানেন কখন কাকে কোন কথার মাধ্যমে মন জয় করা যাবে। তাই তো আমরা দেখি অফিসের যখন রাখাপ অবস্থা যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে তেলায়েত কোম্পানির চেয়ারম্যানকে সুসংবাদ দিতে পেরেছিলেন। এমন আচরণে তিনি অতি সহজে মালিকের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন।
বর্তমানে আমাদের সমাজে তেলায়েত সাহেবের মতো লোকের কোনো অভাব নেই। দেখা যায়, অফিসের অকর্মা লোকরাই তেলবাজ হয়। তারা তেলবাজি করেন এবং গায়ে হওয়া লাগিয়ে ঘোরেন। কিন্তু তারপরও এই সব তেলবাজ লোকের কদর বেশি। যেমনটি লেখক দেখিয়েছেন, অফিসের একটি ফাইল উদ্ধারের জন্য এই তেলায়েত সাহেব কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিলেন। আর এই ফাইল উদ্ধারের জন্য তেলায়েত সাহেব অসৎ উপায়ে একজন সরকারি কর্মকর্তার পিয়ন এবং ওই কর্মকর্তার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কিন্তু যখনই তিনি জানতে পেরেছেন ওই কর্মকর্তা সৎ। টাকা দিয়ে কাজ হবে না, তখন বেছে নিয়েছেন অন্য পন্থা। কবিতাপ্রেমী ওই সরকারি কর্মকর্তার লেখা কবিতাগুলো মুখস্থ করে তার সামনে আবৃত্তি করে ঠিক মন গলাতে পেরেছেন তেলায়েত সাহেব। আর কয়েকশ’ কোটি টাকার ওই ফাইল উদ্ধারের মাধ্যমে তেলায়েত সাবেহ পেয়েছেন গাড়ি এবং মালিকের কাছে অর্জন করেছেন আরো আস্থা। সেই সাথে ওই সরকারি কর্মকর্তার বউও একটি গাড়ির মালিক হয়েছেন। এর মানে এই যে, ভালো মানুষের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে এ সমাজে কিভাবে দুর্বৃত্তরা আগ্রাসন চালাচ্ছে তা এই উপন্যাসে অনুমেয়। তেলায়েত সাহেব তাদের কাজের জন্য এখন তিনি অফিসের হর্তকর্তা। তাকে নিয়ে যারা এক সময় তিরস্কার করত, তারাও রীতিমতো সম্মানের চোখে দেখে। তেলায়েত সাহেবের সিদ্ধান্ত ছাড়া অফিসে আর কোনো কাজ হয় না।
অর্থ হলেই যে এই সমাজের সব কিছু নিমিষেই করা যায়, সে চিত্র উপন্যাসটিতে দেখা যায়। অফিসের মালিক যখন অর্থবিত্তে স্বয়ংসম্পন্ন, তখন তার ইচ্ছা জাগে সম্মান পেতে। আর অর্থের জোরেই বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে আব্দুল করিম থেকে বনে যান ড. আবদুল করিম পাটোয়ারি। এতেই শেষ নয়, শিক্ষানুরাগী হিসেবে পুরস্কার পাওয়ার আশায় প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্ববিদ্যালয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যানও হয়ে যান আবদুল পাটোয়ারি। এতো সব কিছুর ব্যবস্থা করার জন্য তেলায়েত পেয়ে যান একটি প্লট। যা তার জীবনের বড় পাওয়া।
তেলায়েত সাহেবের এমন গুণ রপ্ত করেছিল অফিসে আরেক কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান। তাকে অনুসরণ করেই হাবিবুর রহমান মালিকের কাছে প্রিয় হয়ে তিনটি প্রমোশন পান। কিন্তু তা সহ্য করতে পারেনি তেলায়েত। তার জন্য বড় মাশুল দিতে হয় হাবিবুর রহমানকে।
টাকা হলে এই সমাজের সবই সম্ভব, তার একটি নজির দেখা যায় আবদুল করিম পাটোয়ারির আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জনের মধ্য দিয়ে। অবশ্য তার এই পুরস্কার পাওয়ার পিছনে তেলায়েত সাহেবের কোনো অবদান ছিল না। এতে অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েন তেলায়েত। তিনি ভাবেন আমার মতো তেলবাজ লোকের পক্ষে বসের জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি, এক্ষেত্রে অন্য কারো অবদান রয়েছে। তখন তিনি ভেবেছেন তিনি আর কী তেলবাজ, এসমাজে তার চেয়েও আরো বড় তেলবাজ রয়েছে। এ যেন তেলবাজ মানুষের তীব্র প্রতিযোগিতা।
উপন্যাসের আরেকটি চরিত্র তেলায়েত সাহেবের ছেলের বস সারোয়ার মিয়া। একজন চা বিক্রেতা থেকে মাফিয়া হয়ে ওঠা এই সারোয়ার মিয়ারা এই সমাজের কীট। সমাজে তারা তাদের সুনাম, খ্যাতি ও যশ পাওয়ার জন্য মড়িয়া হয়ে উঠেছে। এদের নিজের সৃজনশীল ক্ষমতা বলতে কিছুই নেই, কেবল অর্থের জোরে বনে যাচ্ছেন গীতিকার, সুরকার, নাট্যকারসহ নানা উপমায়। কিন্তু এর নেপথ্যের মানুষগুলো তাদের জীবিকার স্বার্থে বেঁচে থাকার তাগিয়ে মুখ বুজে দিয়ে যাচ্ছেন বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদগুলো।
উপন্যাসটিতে আমাদের গণমাধ্যমের বাস্তব অবস্থার কিছুটা চিত্র পাওয়া যায়। টিভি চ্যানেল মালিকগুলো গণমাধ্যমকে ব্যবহার করছেন নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য। তারা পাচ্ছেন পরিচিতি, রাষ্ট্রের শাসকদের সাথে গড়ে তুলছেন নিবিড় সম্পর্ক, উদ্ধার করছেন তাদের ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্য। যেমনটি আমরা দেখি সরোয়ার মিয়ার টিভি চ্যানেলে। নানা স্থানে দেখা যায় বড় বড় বিলবোর্ড, নিজ নামে চালিয়ে দেওয়া যায় অন্যের সৃষ্টিকর্ম। চ্যানেলে কে গান গাইবেন, আর কে পুরস্কার পাবেন তাও নির্ধারণ করছেন এই সমাজের সরোয়ার মিয়া এবং সেরাজুল হক নামের মাফিয়ারা। উপন্যাসটিতে এটাও দেখা যায়, নিজেদের স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ায় তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের চিত্রও দেখা যায়। সমাজের নিরীহ মানুষগুলো তাদের ভয়ে মুখ খোলার সাহস পায় না। অর্থের জোরে তারা জিরো থেকে হিরো বনে গেছেন।
তেলায়েত সাহেব তার বসকে তেল দিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করেছে, অন্যদিকে তার ছেলে তাহমিদের সৃষ্টিকর্ম নিজ নামে চালিয়েছে সারোয়ার মিয়া। এর অর্থ দাঁড়ায় অন্যায়ের মাধ্যমে আমরা যেমন এক দিকে উপকৃত হচ্ছি, ঠিক তেমনি অন্যদিক থেকেও আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। যা একটি সমাজের জন্য কোনোক্রমেই শুভকর নয়। অর্থ বিত্তের কাছে এই সমাজের হাত-পা বাঁধা। সেখানে যোগ্যদের কোনো স্থান নেই। তেলায়েতের মতো লোকেরা এই সমাজের মাফিয়াদের পা চাটা চামচা হয়ে কাজ করে নিজেরা উপকৃত হচ্ছে, তেমনি মাফিয়ারাও দিন দিন আরো বেশি ধনবান ও ক্ষমতাশীল হয়ে উঠছে। কিন্তু এতে ক্ষতি হচ্ছে কার? নিঃসন্দেহে বলা যায়, এতে ভেঙে পড়ছে আমাদের সমাজব্যবস্থা, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান তীব্রতর হচ্ছে। সমাজের ক্ষমতাশালীদের অপতৎপরতায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে।
পেশাগত কারণে সাংবাদিক হওয়ায় লেখক মোস্তফা কামাল খুব কাছ থেকে সমাজের এই চিত্র অনুবাধন করেছেন। অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে লেখক সমাজের এই বাস্তব রূপকে তুলে ধরেছেন। তার এই উপন্যাসটি একুশ শতাব্দির সমাজ ব্যবস্থাকে বুঝতে অত্যন্ত সহায়ক। তিনি সত্যের পক্ষে লিখেছেন। তার ‘তেলবাজ’ উপন্যাসটি পড়ে আমরা ন্যায় ও অন্যায় সম্পর্কে অবগত হয়ে সুন্দর সমাজ বির্নিমাণে অগ্রসর হতে পারি। যেখানে থাকবে না তেলায়েত, আবদুল করিম, সারোয়ার কিংবা সেরাজুল হকের মতো অন্ধকার জগতের মানুষরা।
তেলবাজ; প্রকাশকাল : ২০১৬; প্রকাশক : অনন্যা; প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ; মূল্য : ২২৫ টাকা।
লেখক : প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।