X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

মায়ার জালে আটকে পড়া মায়ারা

ফজিলাতুন নেসা
০৩ জুলাই ২০১৯, ১৬:৩৭আপডেট : ০৩ জুলাই ২০১৯, ১৬:৩৯

মায়ার জালে আটকে পড়া মায়ারা

একজন মায়া অজস্র মধুচন্দ্রিমা এবং উড়াল বই দুটি লেখা হয়েছে মূলত বেশিরভাগ নারীর প্রাত্যহিক জীবনে ঘটে যাওয়া নির্যাতন নিয়ে। নারীর জীবনের চূড়ান্ত অপমান ও বৈরিতার মধ্যে কী করে ঘুরে দাঁড়াতে হয় এবং জীবনকে জিতে নিতে হয় সেই মন্ত্রের বীজ বপন করেছেন লেখক তার বই দুটিতে। নিঃসন্দেহে তিনি অনেক নারীর জীবনে আশার আলো জ্বালিয়েছেন। অসংখ্য নারী যারা খুব গোপনে প্রতিদিন নির্যাতিত হন কিন্তু লোকলজ্জা এবং আজন্ম সংস্কারের ভয়ে মুখ খুলতে পারেন না, তাদের মুখপত্র হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে বই দুটিকে। অসংখ্য নারীর মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণার উৎস এই বই দুটি।  

শব্দশৈলী প্রকাশন থেকে ২০১৮ এর বই মেলায় প্রথমে প্রকাশিত হয়, একজন মায়া অজস্র মধুচন্দ্রিমা এবং এ বছরের বই মেলায় একই প্রকাশন থেকে সিক্যুয়াল হিসেবে প্রকাশিত হয় উড়াল। দু’খন্ডের উপন্যাস হলেও উড়াল আলাদাভাবে উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্যতা রাখে। কী আছে এই বই দুটোতে?  

বাংলাদেশসহ আজকের বিশ্বে প্রতিদিন  নানাভাবে ঘটছে নারী নির্যাতনের ঘটনা। লেখক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, বেশিরভাগ নারীর জীবনে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তার নিজের ঘরেই। একজন নারী সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হন তার খুব কাছের মানুষের দ্বারা যাকে তিনি সবচেয়ে বেশী ভালোবাসেন, বিশ্বাস করেন। নারীর জীবনের এই বেদনা, কাউকে বলতে না পারার লজ্জা। পাশাপাশি লেখকের মুনশিয়ানায় চমৎকারভাবে নারীর প্রতি মানুষের সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে।

বিলেতে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে যেসব নারীরা নির্যাতিত হন, তাদের প্রথম দূর্বলতা হলো শিক্ষার অভাব এবং সামাজিক অসচেতনতা। তদুপরি ইংরেজি ভাষাটা দখলে না থাকায় পারিবারিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে আইনগত সহায়তা চাইতে পারেন না।  

যেসব নারীরা নিজেদের ঘরে নির্যাতিত হচ্ছেন, তারা কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন তাদের জীবনটা এরকম হবে? প্রত্যেকটি নারীই স্বপ্ন দেখে তার সংসারটা সুখের হবে, যাপিত দিনের প্রতিটা ক্ষণ হবে মধুচন্দ্রিমা। তাই তো লেখক অসংখ্য নারীর বেদনার মুহূর্তগুলোকে উল্লেখ করেছেন অজস্র মধুচন্দ্রিমা হিসেবে। আর একজন মায়া হিসেবে তিনি নির্যাতিত নারীদের লম্বা লাইনের সামনে নিজেকেই দাঁড় করিয়েছেন। তৈরি করেছেন একটা সরলরেখা। সে জন্যই আমরা এ গল্পে একজন মায়ার মধ্য দিয়েই অজস্র মায়াকে দেখি।

মায়া বিলেন গমন থেকে শুরু করে তখনকার সামাজিক ব্যবস্থাকে লেখক দারুণভাবে খুব সহজ ভাষায় উল্লেখ করেছেন। গল্পের মায়ার মা যখন তার বিয়ে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন, তখন মায়ার বাবা জবাব দেন,

“বাপ ভালা তার পুত ভালা মা ভালা তার ঝি

গাই ভালা তার বাইচ্চা ভালা দুধ ভালা তার ঘি”

অর্থাৎ বংশ ভালো হলে তার সবকিছুই ভালো হবে। কাজেই ছেলে কেমন, কী করে, তার মানসিকতা কেমন, নারীর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন এসব কিছুই আর বিবেচ্য নয়। বিশেষ করে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলেই এ ধরণের ভ্রান্ত বিশ্বাস এখনো অনেক পরিবারেই গভীরভাবে প্রোত্থিত।

মায়া যখন বিলেত পাড়ি দিলো, তখন মায়ার প্রতি আরমানের আচরণগুলোর মাধ্যমে বাঙালি সমাজের কিংবা পুরুষতন্ত্রের মনস্তাত্ত্বিক সূক্ষ্মতার দূর্দান্ত বর্ণনা করেছেন লেখক। নারীর প্রতি নির্যাতনের কৌশলকে মোটা দাগে দু’ভাগে ভাগ করা যায় : একটি দৃশ্যমান অর্থাৎ শারীরিক নির্যাতন এবং অন্যটি অদৃশ্য অর্থাৎ মানসিক নির্যাতন। মানসিক নির্যাতনেরও একটি ছদ্মবেশ থাকে যা সহজ সরল মায়া সহজে চিনতে পারে না।

নারীকে সবদিক দিয়ে পিছিয়ে রাখার একটা দূর্দান্ত কৌশল হলো, তাকে তথাকথিত ভালোবাসায় বেঁধে ফেলা, যেখানে নারীর আলাদা কোন সত্ত্বা থাকবে না। তার সিদ্ধান্ত নেবার কোন ক্ষমতা থাকবে না। নারী আটকে থাকবে কপট মায়ার বাঁধনে। এটা একধরণের ব্ল্যাকমেইলিং কন্ডিশন। এক্ষেত্রে নারী বলতে পারবে না যে তাকে নির্যাতন করা হচ্ছে, সে বুঝতেই পারবে না সে নির্যাতিত হচ্ছে। এমন সংসারে নারী মুখ খুলে না মায়ার অনুভূতি থেকে, কারণ সে ভাবে স্বামী তাকে অনেক বেশি ভালোবাসে বলেই এভাবে আগলে রাখতে চায়। এই বিশ্বাস থেকে বেশিরভাগ নির্যাতিত নারীই তিলে তিলে নিঃশেষিত হতে থাকে, এক জীবনে তার আর জ্বলে ওঠা হয়না। “নারীর আমার আমিকে চিনে ওঠা হয়না”।  

মায়া বা ভালোবাসার একটা জীবনে সে কেবল ভাত রাঁধতে শেখে। সন্তানের যত্ন নিতে শেখে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সেবা করতে শেখে। স্বামীর ইচ্ছায় হাসে-কাঁদে। স্বামীর ইচ্ছায় সাজে। দিন শেষে সে স্বামীর ওপর নির্ভরশীল একজন চলৎশক্তিহীন প্রাণীতে পরিণত হয় যেখানে তার নিজের ইচ্ছা, মতামত বা আত্মবিশ্বাস বলে কিছু থাকে না। এভাবে চলতে চলতে কখনো কোনো নারী যদি উপলব্ধি করতে শিখেও ফেলে যে, সেও একজন মানুষ, তারও বলার কিছু আছে, করার কিছু আছে, তখন আর তার হাতে সময় বা উপায় কোনোটাই থাকে না।

উপন্যাস দুইটি দারুণভাবে পাঠকনন্দিত হবার আরও একটা বড় কারণ হচ্ছে মূল চরিত্র মায়ার ক্রম বিবর্তন। ‘একজন মায়া অজস্র মধুচন্দ্রিমা’র মায়া ছিলো নিরীহ মার খাওয়া এক নারী যার সারল্য আর সিদ্ধান্তহীনতায় তার কিশোরী  সন্তানও তার থেকে অনেক দূরে সরে যায়। কান্না আর শোক ছাড়া যার কাছে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। যে মেয়েটা ঘরের বাইরে এক পা ফেলতে পারতো না, উড়াল-এ এসে সে গুটি গুটি পায়ে ঘর থেকে বাইরে বের হয়। সে একা এবং এই একাকীত্বের সাথে দুরুদুরু বুকে লড়াই করে যায়। নারীকে হারিয়ে দিতে হলে, তাকে পদানত রাখতে হলে প্রয়োজন—তার ক্ষমতাকে বিকশিত হতে না দেয়া, তাকে অশিক্ষিত করে রাখা। তাকে দাবিয়ে রাখার আরেকটা কৌশল হলো তার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া। এই সব বাঁধা পেরিয়ে মায়া ধীরে ধীরে সাহসী হয়ে উঠছে। রেশম পোকার মতো ধীরে ধীরে পরিপক্ক হয়ে ওঠছে। জীবন তাকে ভীষণভাবে ডাকছে। কিন্তু তার কি পাখা গজাবে? অন্ধকার গহ্বর থেকে সত্যিই কি সে প্রজাপতির মতো উড়ে যেতে পারবে জীবনের দিকে?

উপন্যাস : উড়াল/ লেখক : জেসমিন চৌধুরী/ প্রচ্ছদ: সোহেল আনাম/ প্রকাশক: শব্দশৈলী/ দাম: ৩৬০ টাকা

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিসিসিআইর গাইডলাইন অমান্য করেও শাস্তি পেলেন না জাদেজা
বিসিসিআইর গাইডলাইন অমান্য করেও শাস্তি পেলেন না জাদেজা
রাশিয়ার কাছে প্রথম স্বীকৃতি পেলো তালেবান
রাশিয়ার কাছে প্রথম স্বীকৃতি পেলো তালেবান
বরগুনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ: হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৮৬
বরগুনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ: হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৮৬
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি জাতীয় নির্বাচন পেছানোর চক্রান্ত: বাংলাদেশ এলডিপি
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি জাতীয় নির্বাচন পেছানোর চক্রান্ত: বাংলাদেশ এলডিপি
সর্বাধিক পঠিত
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীসা কারখানায় অভিযান, তিন চীনা নাগরিকসহ ৬ জনকে কারাদণ্ড
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীসা কারখানায় অভিযান, তিন চীনা নাগরিকসহ ৬ জনকে কারাদণ্ড
খেলাপিতে ধসে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান: বিপদে আমানতকারীরা
খেলাপিতে ধসে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান: বিপদে আমানতকারীরা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল