X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
গডেস অভ অ্যামনেশিয়া

বিস্মরণের দেবীর স্মৃতি জাগানিয়া আখ্যান

উম্মে ফারহানা
১৪ মার্চ ২০২২, ১৩:২১আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২২, ১৩:২১

গডেস অভ অ্যামনেশিয়া কি ফ্যান্টাসিধর্মী উপন্যাস? এককথায় এই প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, `না’। শিরোনামে দেবীর উল্লেখ থাকাতে এ কথা স্পষ্ট যে একজন দেবীর চরিত্র এখানে আছে, অনুমান করা যায় তিনিই হয়তো উপন্যাসের মূল চরিত্র। কিন্তু সচেতন পাঠকমাত্রেই জানেন উপন্যাস বা আখ্যান আসলে মহাকাব্যের মতন, এতে মাত্র একজনই মূল চরিত্র থাকে না। তাহলে কেন এই দেবীর নামে আখ্যানের শিরোনাম? বিস্মরণের দেবী এখানে মানুষের স্মৃতিভ্রংশের মূর্ত রূপ, ইংরেজিতে যাকে বলে পারসোনিফিকেশন।
বিস্মরণপ্রবণতা নিয়ে আরেক মহান সাহিত্যিক মিলান কুন্ডেরা লিখেছেন দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং। সেখানে কুন্ডেরা বলছেন যে মানুষ ভুলে যেতে ভালোবাসে, পৃথিবীতে নতুন কোনো ঘটনা ঘটলেই ভুলে যায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আলোড়ন সৃষ্টিকারী যেকোনো কিছুকে, উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন বাংলাদেশের রক্তাক্ত নৃশংস গণহত্যার কথা। মানুষ ভুলে যেতে চায়ও, সেজন্য কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বাল্যকালে একটা ছিলো বিষম সুখ, তখন কোন বাল্যকালের স্মৃতি ছিলো না’। আবদুল্লাহ আল মুক্তাদিরের সৃষ্ট দেবী কেমন? তিনি কি ভুলে যান নাকি ভুলে যাওয়া ঠেকাতে চান? দেবী কুড়িয়ে জমা রাখেন মানুষের লোকের ভুলে যাওয়া সবকিছুর স্মৃতিচিহ্নগুলো, আবার ইচ্ছেমত ভুলে যান সবকিছুই। তাই লেখক বলছেন দেবী মহা শক্তিশালী, কেননা ভুলে যেতে পারার মতন শক্তি আর কিছু নেই। এখানে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বয়ানের সঙ্গে মিল পাই মুক্তাদিরের বচনে।
আবদুল্লাহ আল মুক্তাদির প্রথমত কবি, ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ, অন্য গাঙের গান, সমুদ্রসমান এবং যুদ্ধ যুদ্ধ রুদ্ধ দিন। উপন্যাসের ভাষায় তাঁর কবিসত্ত্বা ভীষণভাবেই প্রকাশিত। হয়তো লেখক চানইনি সত্যিকারের খটোমটো গদ্যে উপন্যাস লিখতে। বছরের দীর্ঘতম রাত শীর্ষক গ্রন্থে তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন গদ্য পদ্যের মধ্যকার সীমারেখা। আর প্রথম উপন্যাসে তিনি ভেঙেছেন উপন্যাস লেখার প্রচলিত বা লোকপ্রিয় রীতি রেওয়াজ। বর্ণনায় সময় বা কালের কিছু আগুপিছু রয়েছে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্রমানুসারে বর্ণিত হয়নি। আবার বর্তমান আধুনিক বেশ কিছু উপন্যাসে যেমন দেখা যায় ফ্ল্যাশব্যাক আর বর্তমান মিলেমিশে একাকার- তেমনও নয়।
চরিত্রায়ণের ক্ষেত্রেও লেখকের অনন্যতা বিদ্যমান। প্রধান চরিত্রদের কারো কোন নাম নেই। বিশেষ্যপদের ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়ার এই অভ্যাস তাঁর স্বভাবসিদ্ধ, সাধারণত, নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে চরিত্রদের নাম ধরে উল্লেখ করেন না তিনি। অথচ এজন্য পড়তে গিয়ে কোথাও আটকে যায় না, গুলিয়ে যায় না একের সঙ্গে অন্য চরিত্র। হয়তোবা নাম দিয়ে উল্লেখ করলে পাঠক কোন একটি চরিত্রকে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে কল্পনা করে নেবে। সেই সীমাবদ্ধতা থেকেই মুক্তি দিতে চান মুক্তাদির।
উপন্যাসের সময়কাল বিরাট, অনেকগুলো দশক জুড়ে এদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাসকারী নাগরিকদের জীবনের বিভিন্ন পরিবর্তন বর্ণিত হয়েছে। তাই বলে একে ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস বলা যাবেনা। জাতীয় ইতিহাস বা ন্যাশনাল হিস্ট্রির চেয়ে এখানে প্রাধান্য পেয়েছে ব্যক্তিগত ইতিহাস বা যাকে বলে পারসোনাল হিস্ট্রি। সবটুকু সর্বদর্শী বর্নণাকারীর (ওমনিশ্যান্ট ন্যারেটর) বয়ানেও লেখেননি। অনেকটাই ফার্স্ট পারসন ন্যারেশন, এবং সেই উত্তম পুরুষ বর্ণনাকারীর নামও পাঠক জানতে পারবেনা।
সংলাপ রচনায় বিশেষ মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। যমুনাপাড়ের মানুষের ডায়ালেক্ট দিয়ে লেখা সংলাপগুলো অত্যন্ত স্বাদু, পাঠককে বেশ ভালো রকমের তৃপ্তি দেবে। সংলাপ ছাড়াও অকস্মাৎ কোন কোন মনের ভাব প্রকাশ হয়ে যায় মুখের ভাষায়। যেমন এক জায়গায় `আমার জানি ওই ইস্কুলে যাও না নাগে। আল্লা, তুমি আমার মায়ের মন বদলায়া দ্যাও' –এটি কোন সংলাপ বা কথোকথনের অংশ নয়, তবুও আঞ্চলিক ভাষায় লেখা। কথোপকথন তেমন নেইও, এক একটি সংলাপের পরে আবার খানিক বর্ণনা। কোন কোন পাঠকের অবশ্য এতে অতৃপ্তি বোধ হতে পারে।
নামের মতন উত্তম পুরুষ বর্ণনাকারী চরিত্রের লৈঙ্গিক পরিচয়ও উল্লেখিত হয়নি অনেকক্ষণ পর্যন্ত। ঘটনার প্রয়োজনে বোঝা গেছে যে চরিত্রটি একজন ছেলের। ছেলেটির বড় হবার অভিজ্ঞতায় এমন অনেক খুঁটিনাটি বিশদে লিখেছেন লেখক যা আমাদের দেশের অনেক লেখকই এড়িয়ে যান। শৈশবে যৌন নিপীড়ন কিংবা কৈশোরে শরীরী প্রেমের অভিজ্ঞতা তেমনি কিছু বিষয়বস্তু যা হয়তো অনেক পাঠকের কাছেই অত্যাবশ্যকীয় নয় বলে মনে হবে। কিন্তু বিস্মরণ যেখানে উপন্যাসের মূল থিম, সেখানে এমন বহু কাহিনির উল্লেখ থাকবেই যা গ্লানি বা যন্ত্রণার জন্য হোক বা তীব্র বিষাদে হোক, কেউ ভুলে যেতে চায় বা ভুলে যাওয়াটাই শ্রেয় বলে ভাবে।
যার উল্লেখ না করলেই নয় সেই চরিত্রটি হলো দাদি।  মাঝবয়সে ছিলেন তিনি, আখ্যানের আরম্ভে, যখন তাঁর পুত্র নিহত হলেন। ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে তিনি বৃদ্ধ হতে থাকেন। দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে পুরুষ শাসকের পরিবর্তে নারী শাসকদের মসনদে বসতে দেখেন। বিস্মরণের দেবীর মতন নন তিনি, ভোলেননা অনেক কিছুই। ঘরে প্রথম ফিলিপ্স বাতি লাগাবার ঘটনাও তাঁর পরিষ্কার মনে পড়ে। দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসা নারীদের মতন তিনিও তাঁর পরিবারে সংসারে সর্বময় কর্ত্রীই, ভীষণ ক্ষমতাধর, সকলের সমীহের পাত্রী । পরিবারের অনেক সিদ্ধান্তও নিতে হয় তাঁকেই। সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক হলেও আখ্যানের এই পরিবারটিতে যেন চলে নারীতন্ত্র, দাদিই যেখানে মধ্যমনি।
বিস্মরণকে লেখক নানা ভাবে দেখেছেন আর দেখিয়েছেন। যমুনাপাড়ের মানুষ হিসেবে তিনি জানেন মৃত আত্মীয়ের শেষ স্মৃতি, কবরের মাটিও গিলে খায় এই নদী। স্মৃতিগুলো নশ্বর, এই পৃথিবীর আর সব নিয়ত পরিবর্তনশীল বস্তু বা ঘটনার মতনই। তবুও নদীপ্রেমী এই লেখক, কাহিনির বয়ান শেষ করেন যমুনার মতন আরেক পৌরাণিক নদ ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে এসে। সেখানে আপাতত এই আখ্যান ফুরিয়ে গেলেও পাঠকের মনে তৃষ্ণা জেগে থাকবে। যেখানে ছেলেটার মনে হয় “এই শহরেরও তো বলার মতন একটা বিশাল গল্প থাকার কথা”- সেখানে পাঠক আরও একটি আখ্যানের প্রলোভন পেয়ে যেতে পারেন। আশি আর নব্বই দশকে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের যে কোন পাঠক ভুলে যাওয়া বহু স্মৃতির বহুলাংশ স্মরণ করে পুলকিতও হতে পারেন, কাতর হতে পারেন দেবীর কুড়িয়ে জমানো স্মৃতিগুলোকে নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার জন্য। 
আবদুল্লাহ আল মুক্তাদিরের গদ্যের ভাষা বিকশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাসে। আখ্যান হিসেবে বিভিন্ন কারণেই অনবদ্য গডেস অভ অ্যামনেশিয়া। ইংরেজি শিরোনাম অনেক পাঠকের মনে অস্বস্তি তৈরি করতে পারে। তবে তা সর্বজনীন নয়। সকল ক্ষেত্রে পাঠকের প্রত্যাশা মাথায় রেখে লেখা প্রতিশ্রুতিশীল লেখকের জন্য বিধেয় নয় বলেই মনে করি।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা