X
শনিবার, ০৩ মে ২০২৫
১৯ বৈশাখ ১৪৩২

সালমান রুশদির ‘নাইফ’

রিটন খান
২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১১:০৪আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১১:০৪

সালমান রুশদি—এই নামটা বহুদিন ধরেই সাহিত্যের জগৎ এবং বিতর্কের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৮৮ সালে তার উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি একদিকে যেমন সাহিত্যিক প্রশংসা অর্জন করেন, অন্যদিকে তেমনই প্রচণ্ড বিতর্কের মুখোমুখি হন। ইরানের আয়াতুল্লাহ তার বিরুদ্ধে ১৯৮৯ সালে একটি ফতোয়া জারি করে, যার ফলে রুশদির জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে। এই দীর্ঘ ৩৩ বছরের মধ্যে, মৃত্যুর হুমকি সবসময় তার চারপাশে অন্ধকার ছায়ার মতো অনুসরণ করত। অবশেষে, সেই ঘন অন্ধকারের বাস্তব রূপ দেখা দিল যখন তিনি ২০২২ সালে একটি বক্তৃতা অনুষ্ঠানে আক্রমণের শিকার হন—তাকে ১৪ বার ছুরিকাঘাত করা হয়।
এই ঘটনার পর সালমান রুশদির লেখা ‘Knife’ বইটি মূলত তার সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার স্মৃতি এবং এই ঘটনা তার ওপর কী প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে রচিত। আমি বইটি প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে পড়ে শেষ করি। যখন আমি তার উপরে আক্রমণের খবর পাই তখন কীভাবে যেন আমার সঙ্গে একটা অদ্ভুত যোগাযোগ তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

‘Knife’ বইটি একদিকে সাহিত্যিক রচনা, আবার অন্যদিকে দার্শনিক চিন্তাধারা এবং মানবীয় অভিজ্ঞতার অনন্য মিশ্রণ। বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানবজাতির সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন দিকের মেলবন্ধন। একদিকে, তার আক্রমণকারী—যে মাত্র কয়েকটি ইউটিউব ভিডিও দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল রুশদিকে হত্যা করতে হবে। অন্যদিকে, যারা রুশদিকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এসেছিলেন, এবং তার স্ত্রী, যিনি সারাক্ষণ তার পাশে ছিলেন, তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সাপোর্ট দিয়েছেন। এই দুই বিপরীত দিক, একদিকে ঘৃণা আর অন্যদিকে ভালোবাসা, রুশদি যা একটি ত্রিভুজ আকারে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে তিনি মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন।

বইয়ের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী অংশটি ছিল ছুরিকাঘাতের ঠিক পরের মুহূর্তগুলির বিবরণ। রুশদির চারপাশে কী ঘটছে তা বোঝার ক্ষমতা কমে আসা, এবং সেই মুহূর্তগুলির একটি বিচ্ছিন্নতা তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তা গভীরভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছে। নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করলে, আমার জীবনে একবার একটি গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটেছিল, যেখানে আমি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলাম। হাসপাতালের আয়নায় নিজের প্রথম প্রতিফলন দেখার অভিজ্ঞতা ছিল বেশ চমকপ্রদ—আমাদের শরীর কতটা ভঙ্গুর, তা এক লহমায় উপলব্ধি করা যায়।

রুশদি এই বইয়ে একটি কল্পিত সংলাপ তৈরি করেছেন তার আক্রমণকারীর সঙ্গে, যাকে তিনি কখনও সরাসরি দেখেননি। সেই সংলাপটা পড়তে গিয়ে মনে হলো, ভাষার শক্তি আসলে কতটা অদ্ভুত। ঘৃণা দিয়ে পরিপূর্ণ হলেও কথোপকথনের মাধ্যমে মানুষকে বোঝার চেষ্টা। এই কথোপকথন আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে—আমরা কি সত্যিই ঘৃণার পেছনের কারণ খুঁজে পেতে পারি? ভাষা কি এই ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে? এই ভাবনাগুলো আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

রুশদি যখন তার আক্রমণকারীর সঙ্গে কল্পিত সংলাপ তৈরি করেন, সেই মুহূর্তে মনে হলো—আমার যদি কখনও তার সাথে সরাসরি দেখা হতও, তবে আমি নিশ্চিত তার সঙ্গে কথোপকথনের ক্ষমতা আমাদেরকে ঘৃণার ঊর্ধ্বে নিয়ে যেত।

বইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো তার ধর্মীয় বিশ্বাস। রুশদি নিজেকে একজন নাস্তিক হিসেবে পরিচিত করিয়েছেন, কিন্তু এই ঘটনার পরেও তিনি ‘অলৌকিকতা’ শব্দটা ব্যবহার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তার জীবনকে অলৌকিকভাবে বাঁচানো হয়েছে বলে বিশ্বাস করেন। তবুও, তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়নি। আমি সব সময়ই ভাবতাম, বড় বড় ঘটনা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে বাধ্য করে, কিন্তু রুশদির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উলটো। আমি যদি কখনও তাকে সামনে পাই, তাহলে তাকে জিজ্ঞেস করতাম—এই ধরনের ‘অলৌকিক’ ঘটনা তাকে কতটা প্রভাবিত করেছে?

‘Knife’ বইয়ে রুশদির রাজনীতি সম্পর্কেও অনেক কথা বলা হয়েছে, যেটা তার আগের কাজগুলির মতোই গভীর এবং তীক্ষ্ণ। যদিও আমি তার রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে একমত নই, কিন্তু তার লেখা এবং ইংরেজি ভাষার প্রতি তার ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করে। বইয়ের প্রতিটি বাক্য যেন একটা শিল্প, খুব সূক্ষ্মভাবে প্রতিটি শব্দ আলাদা আলাদা ভাবে সঠিক জায়গায় বসানো।

‘Knife’ শুধু একজন বেঁচে থাকার গল্প নয়—এটা সাহিত্যের শক্তি এবং মানবজীবনের জটিলতার উপর রুশদির ভাবনা। তিনি এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে এমন এক শিল্পে পরিণত করেছেন যা সেই আক্রমণের স্মৃতিকে ছাপিয়ে যাবে। রুশদির আক্রমণকারী হয়ত কখনও ভাবেনি যে তার ঘৃণাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে এত অসাধারণ একটি সাহিত্যকর্ম তৈরি হবে।

শেষ পর্যন্ত, সাহিত্য আবারও জয়ী হয়েছে। এটি রুশদির অবিচল মানসিকতা এবং সাহিত্যের প্রতি তার গভীর ভালোবাসার উদাহরণ—এবং মনে করিয়ে দেয়, শেষ পর্যন্ত কলমই তলোয়ারের চেয়ে শক্তিশালী।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পুকুরে গোসল করাকে কেন্দ্র করে দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহত ২০
পুকুরে গোসল করাকে কেন্দ্র করে দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহত ২০
১৪ বছর পর নিয়াজ-ফাহাদদের নিয়ে তিতাস চ্যাম্পিয়ন
১৪ বছর পর নিয়াজ-ফাহাদদের নিয়ে তিতাস চ্যাম্পিয়ন
ভারতের সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা মডেলের গুলি পাওয়া গেলো বাংলাদেশের সীমান্তে
ভারতের সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা মডেলের গুলি পাওয়া গেলো বাংলাদেশের সীমান্তে
আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
সর্বাধিক পঠিত
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয় আটক
দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয় আটক
নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়ীর বুকে-পেটে প্রকাশ্যে গুলি
নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়ীর বুকে-পেটে প্রকাশ্যে গুলি
‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট যুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার’
‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট যুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার’