X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
পথে নেমে পথ খোঁজা

ফেসবুক বনাম বাস্তবতা।। শেষ পর্ব

মঞ্জু সরকার
১১ নভেম্বর ২০২২, ১১:৩২আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২২, ১১:৩২

মানুষ মূলত সামাজিক জীব। এই সহজ সত্যটা ছোট-বড় জ্ঞানী-মূর্খ সব মানুষই জানে। সবচেয়ে বেশি জানে সম্ভবত ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। তার উদ্ভাবিত ও প্রতিষ্ঠিত সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুকের গ্রাহক সংখ্যা এখন দুইশত কোটির ঊর্ধ্বে। এছাড়াও আছে বিশ্বময় প্রচলিত ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও ম্যাসেঞ্জার। সব মিলিয়ে জাকারবার্গ তার প্রতিষ্ঠিত ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে বিশ্বের কতো কোটি মানুষকে জড়ো করতে সক্ষম হয়েছে, সক্রিয়দের সংখ্যা কেমন হু-হু করে বাড়ছে, তার হালনাগাদ তথ্য-পরিসংখ্যান গুগল সার্চ দিয়ে যে কেউ জানতে পারবেন। গুগল বা ফেসবুক বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে আপতদৃষ্টিতে ফ্রি সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। আর বিশ্ববাসীকে এমন দ্রুতগতির সেবা দিতে তাদের বিশাল জনশক্তির প্রয়োজন নেই। এআই তথা আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র প্রয়োগে বিশ্বের মানবসমাজ ও বিশ্ববাজারকে প্রভাবিত করছে তারা।

প্রতিষ্ঠার দুই যুগ কাটতে না কাটতেই কোনো কোম্পানির বিশ্বময় দুইশত কোটির অধিক মানুষ নিয়মিত গ্রাহক ভোক্তা! অতএব প্রতিষ্ঠাতা মালিকের বিশ্বসেরা এক প্রভাবশালী ধনাঢ্য ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই। কেননা যেমন করেই হোক অধিক মুনাফা লোটার প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই চলছে পুঁজিবাদী দুনিয়া। বিশ্ববাজারে যার যতো বেশি সংখ্যক গ্রাহক, তার বাণিজ্যিক সাফল্য ও প্রভাব ততো বেশি অপ্রতিরোধ্য। এ নিরিখেও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায় জড়িত যেসব ব্যক্তি ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান তথ্য-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবেও অভিহিত, ফেসবুক ও তার প্রতিষ্ঠাতা জাকারবার্গ এখন তাদের মধ্যে অন্যতম।

আপত ফ্রি সার্ভিস দাতা মনে হলেও ফেসবুক কোম্পানির অর্জন ও লাভের দিকটা বাস্তব জগতেও স্পষ্ট, যা অর্থমূল্যেও পরিমাপ যোগ্য। অন্যদিকে ভার্চুয়াল জগতে কোটি কোটি গ্রাহকের নগদ প্রাপ্তি বা তাৎক্ষণিক লাভের দিকটাও অস্পষ্ট নয় মোটেও। যেহেতু ফেসবুকের সদস্য হতে এক পয়সাও লাগে না, আর্থিক লাভ-ক্ষতির দিকটাও এখানে মুখ্য নয় সবার কাছে। বিনাপয়সায় সামাজিকতা ও বন্ধুত্ব বিস্তার, চেনা-অজানা হাজারো বন্ধুদের খবর ও মতামত জানা এবং নিজেরটা জানিয়ে নিজেকে সামাজিক রাখার এমন সস্তা ও সুবর্ণ সুযোগ আর কোথায় আছে? ফেসবুক ছাড়াও টুইটারসহ আরো কিছু সামাজিক মাধ্যম আছে ওয়েববিশ্বে। সব সামাজিক মাধ্যমেই এখন লক্ষ কোটি মানুষের সমাবেশ। কারণ ব্যক্তিমানুষ মাত্রই সমাজে তার ব্যক্তিগত অস্তিত্ব জাহির করতে চায়। পছন্দের বন্ধু ও সামাজিকতা যেমন সমর্থন করে, তেমনি নিজের প্রতি অন্যের মনোযোগ, স্বীকৃতি ও সমর্থন প্রত্যাশা করে। অন্যদিকে জানার কৌতূহল বা তথ্যক্ষুধাও মানুষের একটি মৌলিক স্বভাবগত চাহিদা। কিছুকাল আগে ব্যক্তিমানুষের সামাজিকতার দায়, তথ্যক্ষুধা বা মানসিক চাহিদা মেটানোর প্রধান অবলম্বন ছিল মুদ্রিত সংবাদপত্র, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বইপত্র, রেডিও, নাটক-সিনেমা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সামাজিক নানারকম পালাপর্বন, এমনকি ঘরোয়া আড্ডাও। সমাজ-রূপন্তরের প্রক্রিয়ায় সমাজে ব্যক্তির জন্য এইসব সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্র যত সংকুচিত হয়েছে, সামাজিক জীব হওয়া সত্ত্বেও বিচ্ছিন্ন ও একা মানুষের সংখ্যাও ততই বাড়ছে। এইসব বিচ্ছিন্ন বা একা মানুষের জন্য ফেসবুক হয়ে উঠেছে আত্মপ্রচারণা, নিউজফিড, বন্ধুত্ব বিস্তার এবং সামাজিক দায় পালনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যম। ফেসবুকসহ ভার্চুয়াল দুনিয়ার নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা এবং বিশ্বকে হাতের মুঠোয় পেতে ইন্টারনেটযুক্ত একটা স্মার্টফোন হাতে থাকলেই যথেষ্ট। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিগত কিছু তথ্যের যোগান দিয়ে গ্রাহক বা সদস্য হলেই হলো। জাত-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ ও ভৌগলিক সীমানার ঊর্ধ্বে থেকে ফেসবুকে ধনী-গরিব নির্বিশেষে যে কোনো ব্যক্তির জন্য পছন্দের বন্ধুত্ব বিস্তার এবং বৈষম্যমুক্ত সেবালাভের সুযোগ অবারিত। প্রকৃত বাস্তবে যার বন্ধুসংখ্যা হাতে গোনা দুচারজন মাত্র, বন্ধু থাকলেও দেখাসাক্ষাৎ ও আড্ডা দেয়ার সময়-সুযোগ পায় যারা কালেভাদ্রে, কিংবা যারা একদম বন্ধুবিহীন ঘরেবাইরে একা সময় কাটাতে বাধ্য, ফেসবুকে তাদের প্রত্যেকেরই বন্ধু সংখ্যা শতাধিক থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার অবধি। প্রতিদিন হাতের ফোন কি ল্যাপটপের স্ক্রীনে যতক্ষণ চোখ রাখে মানুষ, ফেসবুক বন্ধুদের সঙ্গ পেতে এবং সঙ্গ দিতেও ফেসবুকেই স্ক্রল করে বেশি। অন্যদের হিসাব সঠিক জানি না, ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও প্রতিদিন ফেসবুকের পাতা চটকাই অনেকবার। অনলাইনে সংবাদপত্র ও ই-বুক পাঠ, ইউটিউব দেখা কি শোনার চেয়ে ফেসবুক পাঠেই যেন আগ্রহটা বেশি। আবার মাত্রাতিরেক আসক্তি কিংবা প্রয়োজনীয়তা মনে প্রশ্ন জাগায়, এই যে প্রতিদিন ভার্চুয়াল জগতে অনলাইনে কয়েক ঘণ্টা ঝুলে থাকা, ফেসবুকের বন্ধু প্লাটফর্মে চেনা-অচেনা সহস্রাধিক বন্ধুদের দিকে হাপুস নয়নে তাকানো এবং গৃহকোণে একা হয়েও সামাজিক থাকার চেষ্টা, এতে প্রকৃতপক্ষে নিজের কিংবা মানবসমাজের লাভ হচ্ছে কতোটা? ই-স্ক্রীনে বেশি বেশি তাকালে চোখের ক্ষতিটা সহজে আঁচ করি। দেখেশুনে আজকাল লাভ-ক্ষতির আত্মজিজ্ঞাসাটাও প্রবল হয়ে ওঠে প্রায়ই। জাকারবার্গীয় রীতিনীতি মেনে এআই নিয়ন্ত্রিত ফেসবুক ব্যবহার করে মানুষে মানুষে যে কৃত্রিম বন্ধুত্ব, চেনা-অচেনা হাজারো বন্ধুর সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ এবং ভার্চুয়াল আদান-প্রদানের ফলে বাস্তব জগতেও সমাজে মানুষে মানুষে সহযোগিতা-সহমর্মিতার বোধ বাড়ছে কি? নাকি আরো বেশি একা ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে ব্যক্তি-মানুষ? ফেসবুকে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক চর্চায় বিশ্বের মানুষ ঐক্যবদ্ধ ও বিশ্বমানবতাবোধ সংহত হচ্ছে কতটা? ডিজিটাল যুগের ভার্চুয়াল জগৎ ঐতিহ্যবাহী দৃশ্যমান সভ্যতা ও মানবসমাজকে দুরন্ত গতিতে কোনো কল্যাণময় লক্ষ্যে, নাকি দ্রুত ধ্বংসের দিকেই ধাবিত করছে আসলে?

জানি, এসব কঠিন প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য গভীর জ্ঞান কিংবা গবেষণা করার শক্তি-সামর্থ্য আমার নেই। কাজেই ফেসবুক ব্যবহারকারী বিশ্বমানবের লাভ-ক্ষতির সঠিক হিসাব নির্ণয় করতে পারব না। তবে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের লাভ-ক্ষতির দিকটা খতিয়ে দেখতে পারি এবং সে অধিকার অবশ্যই আছে ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রতিটি মানুষের। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রিত বন্ধুত্ব দ্বারা নিজের ভালো-মন্দ বোঝার আগে ফেসবুক তথা ইন্টারনেটপূর্ব মানবসমাজ ও সমাজ বিকাশের ইতিহাসটা সংক্ষেপে স্মরণ রাখা প্রয়োজন।

জন্মগত প্রবণতার ফলে পৃথিবী নামের এই গ্রহে আবির্ভাবের পর থেকে মানুষ জোড় বেঁধেছে। যুথবদ্ধ হয়েছে অস্তিত্ব রক্ষার গরজে। মানুষের যুথবদ্ধ থাকার স্বভাব ও গরজকে ভিত্তি করেই এগিয়েছে সমাজ ও সভ্যতা। পারস্পরিক সহযোগিতা ও আদান-প্রদানের ভিত্তিতে বিকশিত হয়ে চলেছে মানবসমাজ এবং গোটা বিশ্বপ্রকৃতি। সমাজ সুরক্ষা ও মানবকল্যাণের নামে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে নানা পেশা, গোত্র, ধর্ম, জাত, শ্রেণিভেদ এবং রাষ্ট্র। সামাজিক দ্বন্দ্ব-বিরোধে লুপ্ত হয়েছে যেমন বহু পেশার দুর্বল মানবগোষ্ঠীর অস্তিত্ব, তেমনি শক্তিমত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে কোনো কোনো শ্রেণি বা পেশাজীবী মানুষের।

বর্তমানের পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা বিকাশের যে স্তরে এসে পৌঁছেছে, তাতে প্রতিটি রাষ্ট্র ও সমাজে ধনবৈষম্য বাড়ছে অস্বাভাবিক উচ্চহারে। বিশ্বায়নের ধাক্কায় কেন্দ্রীভবন ঘটেছে বিশ্বপুঁজির। তৈরি হয়েছে বিশ্ববাজার ব্যবস্থা ও বিশ্বময় অভিন্ন ভোক্তা শ্রেণির। নগদ মুনাফা লোটার ধান্ধায় বিশ্ববাজার ও বিশ্বমানবকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করার জন্য পুঁজিপতি শোষক ও শাসক শ্রেণির প্রতিযোগিতা যেমন বিশ্বকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছে, তেমনি উদ্ভব হয়েছে মানব-অস্তিত্ব বিনাশের নানারকম হুমকি এবং বিধি-ব্যবস্থাও। এসবের মধ্যে জলবায়ু সংকটের কুফল ভোগ করতে শুরু করেছে বিশ্ববাসী। পরিবেশ বিনষ্টির কারণে বহু প্রজাতির প্রাণীকূল চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে। সমুদ্র পৃষ্ঠ উচ্চ হওয়ায় এবং জলবায়ুর বিরূপ আচরণে কোটি কোটি মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবে এআই-এর ব্যবহার বাড়তে থাকলে বিপুল সংখ্যক মানুষের বেকারত্ব বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

 

 

স্বাভাবিকভাবে বিশ্বব্যাপী নানামুখী হুমকি ও সংকটের ফলে নিজের জন্মগত সহজাত প্রবণতাটি ভুলে বিপন্ন মানুষ ক্রমবর্ধমান হারে বিচ্ছিন্ন ও অসহায় বোধ করছে। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় বিশ্বায়ন ও বিপন্ন মানুষের একাকিত্ব কী হারে বাড়িয়েছে, সম্প্রতি তার একটি টাটকা দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল করোনা ভাইরাস। অদৃশ্য করোনা ভাইরাস-আতঙ্ক বিশ্বব্যাপী মানুষকে অসামাজিক ও সঙ্গরোধক পরিবেশে থাকতে বাধ্য করায় মানুষের ঘরকুনো একাকিত্ব ও অসহায় দশা প্রকটভাবে মূর্ত করে তুলেছিল। একদিকে মহামারিতে সব মানুষের মনে কমবেশি জেগেছিল মৃত্যুভীতি, অন্যদিকে ভাইরাস দ্রুতগতির বিশ্বায়নের সঙ্গে প্রমাণ করেছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি ও ভৌগলিক সীমানার খোপে আবদ্ধ মানুষ আসলে বিশ্ব জুড়ে এক এবং অভিন্ন, বৃহত্তর মানবপ্রজাতির অংশ। একইরকম টিকা ও সেবা-শুশ্রুষা দিয়ে করোনা মহামারি থেকে বিশ্বমানবকে রক্ষা করার চেষ্টা চলছে প্রতিটি দেশে।

অবশ্য করোনা ভাইরাসের আগেও, শিল্প বিপ্লবের পর বিশ্বায়নের গতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভিন্ন মানবজাতির বিশ্বজনীন ভোগবাদী চাহিদার খবর ভালোভাবেই জানতো এক শ্রেণির মানুষ। এদের বলা যায় শিল্পপতি, উদ্যোক্তা, পুঁজিপতি ও মুনাফা সন্ধানী বণিক শ্রেণি। চাহিদা সৃষ্টি ও চাহিদা পূরণের কৃতকৌশল কাজে লাগিয়ে বহুজাতিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রীভূত পুঁজি রাষ্ট্র-ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করতে পারে সহজে। এভাবে ক্রমে বিশ্বব্যাপী মানবসমাজের উপর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা কায়েম করেছে তারা। ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির বৈপ্লবিক ভূমিকাকে বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগ। এ যুগে বিশ্বব্যাপী মানুষের তথ্য চাহিদা জোগানোর দায় নিয়ে গোটা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দিতে সবাইকে টেক্কা দিয়ে গড়ে উঠেছে কিছু জায়ান্ট টেক-কোম্পানির তথ্য সাম্রাজ্যবাদ। একদা বিশ্বে উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য বিস্তারকারী কিছু দেশ নানা জাতির অসংখ্য মানুষকে প্রজার মতো নিয়ন্ত্রণে রেখে যেভাবে শোষণ ও নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করেছে, তথ্য সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিগুলিও সেভাবে গোটা বিশ্বকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনেছে যেন। পুঁজিবাদী বিশ্বে নগদ মুনাফা লোটার বাজার-ব্যবস্থা একদিকে ভাইরাসের মতোই মানুষকে আতঙ্ক-উদ্বেগে একা এবং বিচ্ছিন্ন করতে তৎপর। অন্যদিকে এই ব্যবস্থাবলেই সৃষ্ট এবং ফুলেফেঁপে ওঠা টেক কোম্পানিগুলো মানুষের অসহায় অবস্থা ও মানসিক চাহিদার সুযোগ নিয়ে তাদের প্লাটফর্মে জড়ো করেছে কোটি কোটি ভোক্তা কিংবা ব্যবহারকারীকে। ফেসবুক বন্ধুদের ভার্চুয়াল মেলামেশায় তাদের লাভ-ক্ষতি ও মানবসমাজের অগ্রগতি এবং ভূত-ভবিষ্যত নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছি এ লেখাটিতে, এবারে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞার স্মৃতিচারণের মাধ্যমে জবাব খোঁজার চেষ্টা করা যাক।

এই মুহূর্তে আমার ফেসবুক বন্ধুসংখ্যা দেখতে পাচ্ছি ৪৬৮৪ জন। বন্ধুত্বের রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে অপেক্ষমানের তালিকায় ৮৬৮ জন। আর বন্ধু হিসেবে যুক্ত হতে পারেন, এমন তালিকা আরো দীর্ঘতর। ফেসবুকের এআই মশাই নিত্যনতুন ছবিসহ তাদের নাম-তালিকা পাঠিয়ে দেয়। ইচ্ছে করলে তাদের প্রোফাইলে ঢুকে বিশদ পরিচয় জানতে পারি। কিন্তু ফেসবুকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারসাজি বা নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম বন্ধুত্বের বিস্তার, সস্তা সামাজিকতার দায় পালন কিংবা অবিরাম আত্মপ্রচারণার জয়ঢাক পেটানো-কোনোটাতেই বিন্দুমাত্র আগ্রহ বোধ করিনা আর। বরং দেখেশুনে মাধ্যমটির প্রতি বিরাগ-বিতৃষ্ণা প্রবল হয়ে উঠছে। এর কারণ হিসেবে কৃত্রিম বন্ধুজগতের লব্ধ অভিজ্ঞতার বয়ান দেয়ার আগে নিজের বাস্তব অবস্থা ও একাত্মতা বোধ জাগানো প্রকৃত বন্ধুদের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন।

সেই যে যৌবনের শুরুতে প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থা, সামাজিকতা এবং রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রক ক্ষমতার সঙ্গে বিরোধের সম্পর্ক তীব্র হয়ে উঠেছিল, সেই বিরোধিতা বোধের অবসান এখনো ঘটেনি। কিন্তু অসামাজিক হলেও নিজেকে একা মনে হয়নি কখনো। ১৯৬৯ ও ১৯৭১-এ মুক্তিকামী বাঙালি জাতির সংগ্রামে একাত্ম হতে পেরেছিলাম বলে মৃত্যুঝুঁকির মধ্যেও নিজেকে একা ও অসহায় মনে হয়নি। স্বাধীনতার পরও দেশে স্বাধীনতার সুফল বঞ্চিত মানুষরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং অব্যাহত আছে তাদের মুক্তির লড়াই। সামাজিক ও মানসিক অবস্থানের দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের সঙ্গে নৈকট্যবোধ প্রবল থাকায় নিজেকে একা মনে হয়নি। এখনো একা ভাবি না নিজেকে। তবে মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে একাত্ম থেকে প্রত্যক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক লড়াইয়ে যুক্ত হইনি। পরিবার হওয়ার পর ছা-পোষা নিম্ন-মধ্যবিত্ত হিসেবে যেটুকু সামাজিকতা না করলে নয়, ততটুকু সামাজিক থাকাও সম্ভব হয়নি। এর প্রধান কারণ অবশ্য নিজের লেখক-সত্তা। লেখার কাজটি আপনমনে একা গৃহকোণে চুপচাপ করতে হয়। ফলে আপাতদৃষ্টিতে লেখককে একা, আত্মকেন্দ্রিক ও অসামাজিক মানুষ মনে হতে পারে। কিন্তু লেখকের কাজ তো আসলে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েই। এই সম্পর্কের ভালো-মন্দ বুঝতে লেখায় মানবসমাজ ও তাদের মুক্তির প্রশ্ন আসবেই। তাই গৃহকোণে একা হয়েও বৃহত্তর মানবসমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হন লেখক। আবার এটাও সত্য যে, মানবসমাজের সঙ্গে আদর্শিক বা মানিসক একাত্মতার বোধ ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত সব চাহিদা মেটাতে পারে না। একাকিত্ব বোধ, অপরের ভালোবাসা, সহানুভূতি ও বন্ধুসঙ্গ পাওয়ার তৃষ্ণা জাগে সব মানুষেরই।

মনে পড়ে, ইন্টারনেট আসার আগেও গত শতাব্দীর সত্তর দশক থেকে বর্তমান শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত নাগরিক জীবনে নিঃসঙ্গতা ও কিছু ভালো না লাগার অস্থিরতা থেকে ঘরে-বাইরে পছন্দের বন্ধুসঙ্গ খুঁজতাম। নির্দিষ্ট কোনো দল বা সংগঠন না করলেও সমমনা চেনা-অচেনা বন্ধু খুঁজে পেতাম রাজনীতি ও সংস্কৃতির অঙ্গনে। নানারকম অনুষ্ঠানে, সমাবেশে কি ঘরোয়া আড্ডাতেও মেলামেশার সুযোগ ছিল তাদের সঙ্গে। বিশ্বায়নের সঙ্গে দেশেও পুঁজিবাদী উন্নয়ন ও ডিজিটাল বিপ্লব শুরু হওয়ায় সমমনা বন্ধুদের সংখ্যাও যেন কমতে শুরু করেছে। ঘনিষ্ঠদের মধ্যে অনেককেই হারিয়েছি চিরতরে। আড্ডার পরিবেশ ও সময়-সুযোগও সংকুচিত হয়েছে। ফলে অস্বীকার করা যাবে না, আপত দৃষ্টে নিজের একা সময় কাটানোর পরিসরও প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু অ্যানালগ যুগের বন্ধুসঙ্গের তৃষ্ণাটা ডিজিটাল যুগেও কমেনি বলে ভার্চুয়াল জগতেও বন্ধু ও সমমনাদের খুঁজতে শুরু করেছিলাম। ফেসবুকের চাহিদা মাফিক প্রয়োজনীয় তথ্য-পরিচয় দিয়ে নিজের একাউন্টটি খুলেছিলাম অন্তত চৌদ্দ/পনের বছর আগে। বন্ধু শিকার অভিযানের নতুন এ প্লাটফর্মে ‘কী হয় দেখা যাক’ ধরনের কৌতূহলটাও ছিল প্রবল। এরমধ্যে ফেসবুক তার ভোক্তাদের জন্য বহুমুখী সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে। গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফেসবুক বন্ধুদের জগৎ প্রসারিত ও বৈচিত্র্যময় হয়ে চলেছে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন-গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজের টেকনো-দক্ষতা বাড়েনি মোটেও। এ ক্ষেত্রে নিজের অজ্ঞতা ও আনাড়িপনার সত্য উদাহরণ দিলে অভিজ্ঞরা হাসবেন হয়তো।

ফেসবুকের এআই বা অ্যালগরিদমে যেহেতু সব সদস্যকেই একইরকম সুযোগ-সুবিধা দেয়, আমি সুযোগটা নিয়ে এক সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও পরবর্তী ডোনাল্ড ট্রামসহ অনেক ক্ষমতাবান ও বিশ্ববিখ্যাত তারকাব্যক্তির সঙ্গে ফেসবুকে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব স্থাপনের কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু অভিজ্ঞরা ভুল ভাঙিয়েছে, বিশ্বখ্যাত ক্ষমতাবান সেলিব্রিটিদের বাছাইকরা বন্ধুকোটা তো পূর্ণ হয়েছে, আমি বড়জোর তাদের ফলোয়ার হতে পারি। ফলোয়ার হলেও ফেসবুকে বা টুইটারে তাদের প্রোফাইল-স্ট্যাটাস-মন্তব্য দেখতে পাবো, প্রতিক্রিয়াও জানাতে পারব। কিন্তু মিলিয়ন বিলিয়ন ফলোয়ারদের ভিড়ে নিজেকে ভেড়াতে ইচ্ছে হয়নি। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিআইপি ও তারকাদের খবর তো নিউজ মিডিয়াতেও দেখতে পাই। অন্যদিকে সম্ভাব্য বন্ধু হিসেবে ফেসবুক যাদের নাম-ছবিসহ তালিকা দেখায়, তাদের কাউকে বন্ধু হিসেবে যুক্ত করার অনুরোধ জানাইনি। তারা আমার মতো সাধারণ কি অসাধারণ তাও খতিয়ে দেখিনি কখনো। তবে পছন্দের কিছু চেনা মানুষ ও অচেনা কিছু সুন্দর ছবির নারীমুখ দেখে অনলাইনেও তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও প্রেমের সম্পর্কটা নিবিড় করার ইচ্ছে যে কখনোই জাগেনি, তা হলফ করে বলতে পারব না। এ ক্ষেত্রে দু’একবার উদ্যোগ নিয়েও তাদের অনলাইন প্রচারণার সঙ্গে বাস্তবের এমন অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছি যে, তা প্রতারিত হওয়ারই সামিল। এর বেশি এসব বাজে অভিজ্ঞতা এখানে বিস্তারিত না বলাই ভালো।

সত্য বলার অভ্যাসে ফেসবুকেও আমি নিজের সম্পর্কে সত্য তথ্য দিয়েছিলাম, এমনকি ফোন নাম্বারটাও ঠিক দিয়েছিলাম। একদিন আমেরিকা থেকে কৈশোর-যৌবনের হারানো এক বন্ধুর ফোন পেয়ে অবাক হয়েছিলাম। ফেসবুক থেকেই সে আমার ফোন নাম্বার পেয়েছে। ফেসবুকের এরকম উপকারিতা দেখে আমার কাছে কেউ বন্ধু রিকোয়েস্ট আসা মাত্র চোখ বুজে তাদের গ্রহণ করেছি। বেশি বেশি রিকোয়েস্ট আসে যখন, খুশি হয়েছি এই ভেবে যে, নিজে সমাজে হেলাফেলার অতি সাধারণ ব্যক্তি নই সম্ভবত। আমাকে লেখক হিসেবে চেনেজানে এবং পাঠ করে ভালো লেগেছে বলেই হয়তো আমার বন্ধু হতে রিকোয়েস্ট পাঠায় এরা।

বন্ধুত্বকামী সবাইকে উদারভাবে গ্রহণ করার পর, রোজ ফেসবুক খুলে নিজের ওয়ালে বন্ধুদের উপস্থিতি দেখে দেখে চেনা হয়ে গেছে অনেককেই। তালিকায় প্রবাসী সন্তান থেকে শুরু করে নিকট আত্মীয়-স্বজনরা যেমন আছে, তেমনি সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের পরিচিত বেশ কিছু মুখ। নিজে লেখক বলেই হয়তো বন্ধু তালিকায় চেনা, অচেনা, বিশেষ করে নবীন লেখকের সংখ্যাই বেশি। এখন ফেসবুকের মুখর বন্ধুসমাজের চাওয়া-পাওয়া ও প্রচারণা দেখেশুনে নিজের বিরক্তি ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণটা সংক্ষেপে উল্লেখ করি।

কিছু পেতে হলে যে দিতে হয়, সামাজিকতার এ নিয়মটি ফেসবুকেও বেশ লাগসই। লেনদেনের সম্পর্কটাও বেশ সহজ। প্রতিদিনই কোনো না কোনো বন্ধু নিজেকে নানাভাবে প্রকাশ করছে। ছবি দিয়ে, ব্যক্তিগত হাঁচি-কাশির মতো তুচ্ছ কিংবা জন্মদিনের আনন্দ কি স্বজনের মৃত্যুশোকের খবর জানিয়ে, পারিবারিক টুকিটাকি কি সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে নিজের অনুভূতি বা মতামত জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে। প্রত্যক্ষ কি পরোক্ষ এসকল আত্মপ্রচারণার মূল উদ্দেশ্য একটাই-বন্ধুদের পছন্দ, স্বীকৃতি বা সমর্থন পাওয়া। এ ক্ষেত্রে মার্কিনী প্রেসিডেন্ট, বিশ্বখ্যাত স্টার, কোটিপতি ব্যবসায়ী কি আয়-উপায়হীন বেকার, ছাত্র-শিক্ষক তথা ফেসবুকের বৈষম্যহীন গ্রাহকদের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। আর সর্বজনীন এই মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য ফেসবুকের ব্যবস্থাবলীও দারুণ কার্যকর। নানারকম অনুভূতির চিহ্ন সম্বলিত লাইক, কমেন্ট, শেয়ার বাটন রেডি হয়েই থাকে। বন্ধুরা সাড়া দিলে তৎক্ষণাৎ ফিডব্যাক জানিয়ে দেয় পোস্টদাতাকে। অন্যদিকে একটি স্ট্যাটাসে আত্মপ্রচারণার পর কয়টা লাইক বা শেয়ার পেলাম, কে কী প্রতিক্রিয়া দেখাল, স্বভাবতই জানার জন্য উদগ্রীব থাকেন পোস্টদাতারা। ব্যবসায়ে নগদ আর্থিক লাভের মতো ফেসবুকের সামাজিকতায় এসব নগদ মানসিক প্রাপ্তিও হয়তো-বা মূল্যবান অনেকের কাছে। আর নগদ লাভের দিকটি স্মরণ করিয়ে দিতে ফেসবুকের এআই মশাই বন্ধুর মতো ভোক্তাদের নাম সম্বোধন করে বন্ধুদের জন্মদিন মনে করিয়ে দিয়ে উইশ করার পরামর্শ সহ নোটিশ পাঠায়। ব্যক্তি মানুষ ভুলে যায়, কিন্তু কোটি কোটি ব্যবহারকারীর বন্ধুত্ব ও ব্যক্তিগত তথ্যাবলী আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্সের স্মরণ রাখা যেনবা কোনো সমস্যাই নয়। ফেসবুকে বা ম্যাসেঞ্জারে কোনো বন্ধু যদি কোথাও কোনো গ্রাহকের সম্পর্কে কিছু বলে, তাও ওরা তৎক্ষণাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জানিয়ে দিতে ভুলে না।

নিজে পেশাদার লেখক হওয়ার কারণেই সম্ভবত ফেসবুকের বন্ধু তালিকায় চেনা-অচেনা, বিশেষ করে নবীন লেখকদের সংখ্যাই বেশি। বইমেলা এলে তাদের নতুন বইয়ের সচিত্র খবর, প্রচারণা, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাদের লেখা পড়ার আমন্ত্রণ, এমনকি সরাসরি ফেসবুকেও কবিতা, গল্প ও সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ-প্রবন্ধ লেখেন অনেকেই। সব মিলিয়ে ফেসবুক কখনো-বা সম্পাদকবিহীন নিম্নমানের রম্য পত্রিকা মনে হয়। মুদ্রিত বইপত্রের তুলনায় অনন্ত ওয়েবজগতেই যেন অন্তহীন বর্জ্য ও আবর্জনা জমছে বেশি। কতিপয় নবীন লেখকের নগ্ন আত্মপ্রচার, গ্রুপিং ও পারস্পরিক পিঠচাপড়ানি দেখে মনে হয়, সাহিত্যে ভালো কিছু সৃষ্টির জন্য নিভৃত সাধনার চেয়ে এরা নগদ লাভ তথা খ্যাতি ও সামাজিক সুবিধা অর্জনকেই প্রধান করে দেখছে। বন্ধুদের সেলফি আর নগ্ন আত্মপ্রচারণার মাঝেও ক্বচিৎ কিছু বন্ধুর পোস্ট বা লেখার নমুনা ভালো লাগে। লাইক বাটনে টিপ দিয়ে কি সংক্ষিপ্ত মন্তব্যও করেছি এসব ক্ষেত্রে। ফেসবুক বন্ধুরা তাদের বই দিলে পাঠের পর মৌখিক পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানাই অবশ্যই। কিন্তু নিজে সমালোচনা-সাহিত্যে আগ্রহী বা পারদর্শী নই, তাই অনুরোধ সত্ত্বেও সংক্ষিপ্ত লিখিত সার্টিফিকেট দিইনি কোনো নবীন লেখককে। ফেসবুকে আমার নিষ্ক্রিয়তা দেখে কে বা কারা আমাকে তাদের বন্ধু তালিকা থেকে বাদ দিল কি রাখল, তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি কখনো।

যে কোনো রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবাদপত্রের ইতিবাচক ভূমিকা অনস্বীকার্য। ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়াও ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণমতের প্রতিফলন ঘটিয়ে অনেকে দেশে ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত রেখেছে। নিকট অতীতে মিশর, তিউনিশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা ও সরকার পরিবর্তনে ব্যাপক আন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান হয়, যা পরবর্তীতে আরব স্প্রীং নামে অভিহিত হয়েছিল, সেই আরব স্প্রীং সংগঠনেও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিল। বাংলাদেশেও সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে ঘোষিত রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ কিছু ক্ষেত্রে সরকারি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আবার অনলাইন মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ার অবাধ স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনও হয়েছে দেশে। ধর্ম, জাতির পিতা ও সরকার-প্রধানের বিরুদ্ধে অবমাননাকর ছবি বা বক্তব্য ছেপে মামলা ও শাস্তি পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সরকারি ভয় বা দমন-নিয়ন্ত্রণ আইন দিয়েও সামাজিক মানুষের অসন্তোষ একেবারে নির্মূল করা যায় না, তার প্রমাণও হয়তো জনপ্রিয় এ সোশ্যাল মিডিয়াতেও খুঁজে পাওয়া যাবে। আমার ফেসবুক বন্ধুদের মধ্যে কিছু বামপন্থী রাজনীতিক, সাংবাদিক ও সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট বন্ধু আছেন, যাদের ফেসবুক পোস্টে সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা ও ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ ও ঘৃণা ফুটে ওঠে। সময়োপযোগী ঘন ঘন সামাজিক বিষয়ে পোস্ট দিয়ে তারা লাইক, প্রশংসাসূচক মন্তব্য ও শেয়ারও পান প্রচুর। সন্দেহ নেই, ফেসবুক তাদের জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছে এবং সামাজিক দায় পালনের নগদ তৃপ্তিও যোগাচ্ছে কিছুটা। কিন্তু উপরতলার এসব ভাসমান দায়িত্ব-প্রচারণা-প্রতিবাদ বাস্তবে বঞ্চিতদের স্বার্থে যায় কতটুকু, যদি না সামজে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটানোর জন্য বাস্তব শক্তিগুলো সংঘবদ্ধ ও কার্যকর না থাকে? এটা খুব পরিস্কার যে, ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ অভিন্ন রীতিপদ্ধতিতে বিশ্বের শতকোটি মানুষকে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করলেও, তার মূলে কোনো কল্যাণময় লক্ষ্যে পৌঁছাতে বিশ্বমানবকে ঐক্যবদ্ধ রাখা কিংবা বিশ্বমানবতা বোধকে সংহত করার উদ্দেশ্য-আদর্শ নেই। বরং পুঁজিবীদী ব্যবস্থা মেনে নিজেদের নগদ মুনাফার পাহাড় সৃষ্টি তাদের আশু লক্ষ্য এবং এ লক্ষ্য অর্জনে তারা সফলও বটে। একইভাবে ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে রাষ্ট্র ও সমাজের নিয়ন্ত্রক শক্তি তাদের ক্ষমতা ও নগদ লাভাকে যতটা নিশ্চিত করতে পারছে, দেশের সুবিধা বঞ্চিত গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর পক্ষে তা সম্ভব নয়। কারণ দেশ জিজিটাল উন্নয়নে বাঁধা পড়লেও খেটে খাওয়া-মানুষের একটা বড় অংশই ফেসবুক বা অনলাইনে নিজের অস্তিত্ব জাহির করার সময় ও সুযোগ পায় না। বড় জোর তারা একটা কমদামী মোবাইল ফোনে প্রয়োজনীয় যোগযোগ সারে। বঞ্চিত জনসাধারণের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মিডিয়ায় যারা লড়তে চায়, সেই লড়াইয়ে বঞ্চিত সাধারণ শ্রেণির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কল্যাণ যাই হোক, লড়াকু সৈনিকদের আত্মপ্রচারণা ও নগদপ্রাপ্তি কিছুটা হয় অবশ্যই। ফেসবুক করে আমারও যে কিছু নগদ বা পরোক্ষ প্রাপ্তিযোগ ঘটেনি, তা নয়। বন্ধু বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকলে, এবং বেশি বেশি পোস্ট দিলে হয়তো লাভটাও বেশি হতো। কিন্তু ফেসবুকে একাউন্ট খোলার পর বাংলায় লিখে বা ছবি আপলোড করে কীভাবে পোস্ট বা স্ট্যাটাস দিতে হয়, এ ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলাম বেশ কয়েক বছর। শেখার আগ্রহও ছিল না তেমন। ফেসবুকে নিজের বইয়ের ফ্রি প্রচার দিলে আমার পাঠকরা জানতে পারবে। নতুন পাঠক ও ক্রেতাও বাড়বে। ফেসবুকের প্রচার মাহাত্মে অখ্যাত নবীন লেখকেরও বই কয়েক শ’ কপি মেলায় বিক্রি হয়ে যায়। এরকম যুক্তি দেখিয়ে কতিপয় অভিজ্ঞ তরুণ বন্ধু আমাকে ফেসবুকে পোস্ট দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ছবি ও লেখা আপলোড করার কায়দা-কৌশলও শিখিয়ে দিয়েছে। অতঃপর গত কয়েক বছর ধরে নতুন বই বেরুলে প্রকাশকের ভরসায় না থেকে কভারের ছবিসহ পোস্ট দিয়েছি কয়েকবার। লাইক ও কমেন্টস যা পেয়েছি, তার পরিমাণ জনপ্রিয়দের ধারেকাছে যাবে না অবশ্যই। উদাহরণ হিসেবে দু বছর আগে প্রকাশিত আমার সর্বশেষ উপন্যাস ‘উজানযাত্রা’-কে নিয়ে পোস্টটির প্রাপ্তি-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাক। লাইক পেয়েছি ৫৫৪, কমেন্টস করেছেন ১৩১ ও শেয়ার করেছেন ২৩ জন। এদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কয়জন বইটি কিনেছেন কিংবা পড়েছেন, তা নির্ণয় করা কঠিন। কারণ প্রকশকের সঙ্গে প্রথম সংস্করণে তিনশত কপি প্রকাশের চুক্তি হয়েছে, তার মধ্যে দু’বছরে কয় কপি বিক্রি হয়েছে লেখক এখনো জানতে পারেননি। তবে লেখককে লাইক দেয়া, শেয়ার করা কিংবা কমেন্টস-এর ঘরে শুভেচ্ছা জানানো যত সহজ, তার লেখা বইটি কিনে পড়া যে তার চেয়েও শতগুণ কঠিন কাজ, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবাকশ নেই।

প্রায় পাঁচ হাজার ফেসবুক বন্ধুর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন পাঠকবন্ধুর পরিচয় পেয়েছি, যারা ব্যক্তিগতভাবে লেখককে চেনা ও আত্মপ্রচারণার আগেও কঠিন কাজটি করেছেন। আমর বই কিনে পড়েননি শুধু, ফেসবুকে অকপট পাঠ-প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন কেউ-বা। আমি নিশ্চিত যে, ফেসবুকের আগেও আমার অচেনা কিছু পাঠক ছিল এবং ফেসবুকের বাইরেও আছে, এখনও যারা নিজস্ব রুচি ও বিচারবোধ থেকেই আমার লেখা পড়বেন। ফেসবুকের হাতেগোনাদের মধ্যে এক তরুণ পাঠক বন্ধুর কথা এখানে না বললেই নয়। এ যাবত প্রকাশিত আমার প্রায় সব বই, এমনকি ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত উপন্যাসের কাটিংগুলিও সে সংগ্রহ করেছে এবং পড়েছেও। সাক্ষাৎ পরিচয় না ঘটলে ও স্বচক্ষে তার সংগ্রহ না দেখলে হয়তো বিশ্বাস হতো না নিজেরও। এরকম কিছু অসাধারণ পাঠকের খবর ফেসবুকের মাধ্যমে জানলেও, সেই পাঠক বা আমার প্রাপ্তি ফেসবুকের কীর্তি নয় অবশ্যই।

আসলে ফেসবুক বা ডিজিটাল যুগের বর্তমান গতিময় বিবিধ সুযোগ-সুবিধার সহজ প্রাপ্তির দিকগুলো তুচ্ছ করে অ্যানালগ যুগের বন্ধুত্ব ও সামাজিকতা থেকে চাওয়া-পাওয়ার স্মৃতিগুলি নিজের কাছে বেশি গুরুত্ব পায়। জানি, বয়স বাড়লে সব মানুষই অধিক স্মৃতিকাতর হয়। তাছাড়া তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লব যে স্তরে এসে উঠেছে, ভোক্তা ও ব্যবহারকারী হিসেবে নিজের চাহিদা ও দক্ষতা সেভাবে বিকশিত হয়নি। দেখ দেখ করে মোবাইল ফোনগুলি কী রকম বিস্ময়কর ও স্মার্ট হয়ে উঠেছে! এখন শুনি, রোবট গাড়ি চালাবে, কল-কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে, এমনকি হাসপাতালেও মানুষের বদলে এআই বা রোবটই নিখুঁত দক্ষতায় ক্লান্তিবিহীন কাজ করবে। অগাধ বিত্তের অধিকারী মানুষ বেড়ানোর আনন্দ খুঁজতে রকেটে চড়ে মহাশূন্যে গিয়ে ভেসে বেড়াবে। এসব প্রাপ্তির আনন্দ-স্বপ্ন তুচ্ছ করে আমার এখনো পায়ে হেঁটে প্রকৃতি দেখা, প্রকৃতি এবং অতীত ইতিহাসের ও ভবিষ্যতের মুক্তিকামী মানবাত্মার সঙ্গে একাত্মতা বোধ জাগাতে পারলেই বরং অধিক আনন্দ হয়।

মুদ্রিত বইপত্রের সামান্য এক সৃজনশীল লেখক আমি। হতে পারে, ডিজিটাল যুগের অগ্রগতি ও ফেসবুকের মতো অনলাইন সমাজের চাহিদা এবং সহজ প্রাপ্তি লেখক হিসেবে নিজের উপেক্ষিত দশা বাড়িয়ে তুলছে। কিন্তু ফেসবুকের মতো মিডিয়ার বাণিজ্যিক আত্মপ্রচারণায় লেখক হিসেবে নিজের সাফল্য কিংবা সামাজিক অবস্থানের বড় একটা হেরফের ঘটবে বলে মনে হয় না। আর সাহিত্য সৃষ্টির দায় বা উদ্দেশ্য নগদ প্রাপ্তি তথা ফেসবুক সুলভ চটজলদি ফিডব্যাক নির্ভর নয় বলে, সব ধরনের সামাজিক প্লাটফর্ম ও কোলাহল এড়িয়ে নিভৃতে নিজের কাজটি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারলেই আনন্দ হয়। সাহিত্যিকের কাজ রাজনীতিক, শিক্ষক, সমাজকর্মী বা শিল্পকলার অন্যান্য শাখার (যেমন নাটক, সিনেমা ও সঙ্গীত) শিল্পীদের মতো নয়, সমাজে যাদের তাৎক্ষণিক আবেদন ও প্রাপ্তিটাও প্রায়শ নগদ ঘটে। নিভৃতে একা লেখকের সৃজনশীল রচনাটিও তার নিজগুণেই প্রথমে একা কোনো পাঠকচিত্তেই আবদেন সৃষ্টি করে। শুধু ব্যাপক প্রচার-প্রোপাগান্ডা ও মিডিয়ার আনুকুল্য দিয়ে কোনো লেখা বা লেখক অধিকসংখ্যক পাঠকচিত্তে স্থায়ী আবেদন সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করি না।

জানি আমার মতো অসামাজিক, অখ্যাত ও ঘরকুনো একজন মানুষ মিডিয়াকে গুরুত্ব না দিলেও মিডিয়ার মালিক-নিয়ন্ত্রক বা ফেসবুকের বন্ধুসমাজের কিছুমাত্র যায় আসবে না। অন্যদিকে নিজেও যদি এসব ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম ও নগদ লেনদেনের কৃত্রিম সামাজিকতা পুরোপুরি এড়িয়ে চলি, তবে নিজেও কি বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব? মোটেই না, শতভাগ অবশ্যই না। ব্যক্তিগত কিছু মানবিক গুণের কারণেই যেমন সমাজসম্পর্কিত কিছু মানুষের স্মৃতিতে এবং মুক্তিকামী সংগ্রামী মানুষের ধারাবাহিকতায় যুক্ত থাকব, আমার লেখাও তেমনি নিজস্ব গুণেই একশ্রেণির ব্যক্তি-পাঠকের কাছে সমকালে ও ভাবীকালেও গ্রহণযোগ্য হবে বলেই বিশ্বাস করি।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা