X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

আবিষ্কার

অভিষেক সরকার
১৬ এপ্রিল ২০২২, ১৬:০৩আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২২, ১৬:১০

এই কাকডাকা ভোরে বড়ো একলা লাগে। রাতের চেয়েও ভোর বুঝি আরও বেশি একা। রাতের একটা শরীর আছে। দিনান্তের শ্রম, মদের গন্ধ, ঘুমন্ত মানুষের বিড়বিড়... দিন ফুরালো। ফুরিয়ে যাওয়া মানুষের মতো। একতলার গানের মাস্টারমশাই যখন পা টেনে টেনে বাড়ি ফেরেন, আরও এক দিন মৃত ইচ্ছের দেহ বয়ে বাড়ি ফেরেন, কতকটা রাতের মতো দেখায়। দীর্ঘ ছায়া পড়ে রাস্তায়। যেন ছেড়ে আসা দিন পিছু ছাড়তে চায় না। পিচের আস্তরণে শুয়ে থাকা ছায়া নাছোড় পিছুটানের মতো—অবাধ্য, শরীরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেতে চায়। শহরের কত জায়গায় তো দিন-রাতের তফাৎ বোঝাই দায়। নাইটক্লাব, ডিস্কো... আমাদের পাড়াটা শহরের সীমান্তে। শান্ত অনেক। আমি কখনো নাইটক্লাবে যাইনি। একবারই কী একটা বিতর্কসভায় গিয়েছিলাম শান্তনুর সঙ্গে। ক্যালকাটা ক্লাবে। সে সব বড়ো বড়ো ব্যাপার। শান্তনু মাঝে মাঝে এখানে সেখানে অ্যাওয়ার্ড নিতে যায়। এই ক্লাব, সেই ক্লাব। আমি যাই না। এই ছাদের পাঁচিলে ভর দিয়ে আমি মাস্টারমশাইয়ের ফেরা দেখি। রাতের মতো, দিনের পিছুটানের সঙ্গে লড়তে লড়তে ফেরা। ভোরের কোনো পিছুটান নেই। বিড়বিড় থেমে যায়। ঘুম গাঢ় হয়ে আসে। একটা ফুরিয়ে যাওয়া গতকাল আছে। সে আজ আবার ফিরে আসবে বটে কিন্তু আজ যে এখনো শুরুই হয়নি। সময়ের নিরবচ্ছিন্ন স্রোতের মধ্যে ভোর খানিকটা যতিচিহ্নের মতো। এইসব টাইম-স্পেস-টেস নিয়ে আমি বিশেষ কিছু জানি না। ওসব শান্তনুর ডিপার্টমেন্ট। আমার অনার্স ছিল বাংলায়। কবিতা ভালোলাগত। ভেবেছিলাম কাব্যতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করব। বিদেশ যাবো। তারপর তো এমএ পড়তে পড়তে বিয়েই হয়ে গেল। বর বড়ো সায়েনটিস্ট। বড়োসড়ো চাকরি। তার চেয়েও বড়ো মন আর মাথা। ভালোই হলো।

শান্তনু এখন ঘুমোচ্ছে। কাজপাগল মানুষ তো, নাওয়া খাওয়ার ঠিক নেই এমনিতে।  ওর যত রোম্যান্স সব ওই কাজ নিয়েই। বিয়ের পর মাঝে মাঝেই ছাদে আমরা বিছানা পাততাম। শুয়ে শুয়ে আমাকে আকাশ চেনাত শান্তনু। এত আদর করতে ইচ্ছে করত। কী তন্ময় আর তৃষ্ণার্ত হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে ছেলেটা।  এই আমি, গানের মাস্টারমশাই, পঞ্চাদা আমাদের দৌড় তো দোকানপাট কি বড়োজোর শপিং মল বা মাল্টিপ্লেক্স। যারা আরেকটু ভাগ্যবান তারা জুরিখের বরফ বা লন্ডনের রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি অবধি যায়। শান্তনু গোটা আকাশটা চিনতে চায়। ছায়াপথ, নক্ষত্রের মালা, কৃষ্ণগহ্বর, ওয়র্ম হোল সঅব। দেশ আর কাল আমরা যেভাবে বুঝি তার ভেতরের বড়ো বড়ো ফাঁকিগুলো টপ করে ধরে ফেলতে পারে। যেমন ধরুন, আমরা সময়কে কেমন অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে ভেসে যেতে দেখি তো? গতকালের পর আজ আসে, আবার আজের পর আগামীকাল। কেউ তো আজ আর গতকালে একসঙ্গে থাকতে পারে না। পারে? শান্তনু বলে কোয়ান্টামের দুনিয়ায় নাকি এমনটা হয়। এই যে আমার তিরিশ ছুঁই-ছুঁই শরীরের বাঁধন, রাস্তাঘাটে লোকে যে বুকের দিকে তাকায়, এ তো আর চিরকাল থাকবে না। ধীরে ধীরে চামড়া ঝুলে যাবে, পেশিগুলো শিথিল হবে। ছাদের জল বেরোনোর নলগুলোর মতো। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জং ধরবে।  এমনই তো হয়। ক্রমশ ক্ষয়ের দিকে হেঁটে যায় সব। কেউ তো আর একইসঙ্গে জোয়ান আর বুড়ো হতে পারে না। কিন্তু খুব ছোটো ছোটো কণাদের দুনিয়ায় নাকি ব্যাপার-স্যাপার অন্যরকম। সেখানে নাকি একটাই কণা একসঙ্গে দু’দিকে ঘুরতে পারে। কী কাণ্ড! একটা লাল বল একসঙ্গে ডাইনে আর বাঁয়ে ঘুরছে। একই সঙ্গে দুটো আলাদা অবস্থায় আছে—আজ আর গতকালে একসঙ্গে থাকার মতো। চোখ বুজে কতবার দৃশ্যটা ভাবার চেষ্টা করেছি। পারিনি। কিন্তু কবিতা পড়তে গেলে ব্যাপারটা খানিকটা বুঝতে পারি।  যখন কৃষ্ণদাস কবিরাজ আদি লীলায় লিখছেন, “রাধিকার প্রেম গুরু আমি শিষ্য নট/ সদা আমা নানা নৃত্যে নাচায় উদ্ভট”, কী ভেবে যে লিখছেন কে জানে! হয়ত নটের সঙ্গে নেহাত ছন্দ মেলাতে উদ্ভট বসিয়ে দিয়েছিলেন। হয়ত গুরুর ওই রাশভারী একটা ব্যাপার, কর্তৃত্ব জাহির করার কথা মাথায় রেখেছিলেন। শিষ্যের দাস্যভাবের কথাই হয়ত বলতে চেয়েছিলেন। কে আর কবির মাথার ভেতর ঢুকে ভাবনা চিন্তা ঘেঁটে দেখতে যাচ্ছে? আমি যখন গ্রীষ্মের দুপুরে বুকের নিচে বালিশ রেখে মফস্বলের মামাবাড়ির বিছানায় শুয়ে লেখাটা পড়ছি, তখন কে কৃষ্ণদাস কবিরাজ? তাকে এক মুহূর্তের জন্যও মনে পড়ে না। তখন যাকে মনে পড়ত, তাকেও তো ভুলেই গেছি প্রায়। এখন শান্তনুকে মনে পড়ে, মনে পড়ে আমার এই বেসুরো গলায় বৃষ্টিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গান গাইছি, আর পা টিপে টিপে বাড়িতে ঢুকে একটুও শব্দ না করে ছোটো টেবিলটাতে আমার জন্য এক কাপ চা নামিয়ে রাখছে আধপাগলা একটা ছেলে—শান্তনু। আমার রাধিকা তো কৃষ্ণকে ছন্দ শেখায়। সমপদী আর বিসমপদী তালের তফাৎ বুঝিয়ে দেয়। নাচতে নাচতে পা টলে গেলে আলতো হাতে দাঁড় করিয়ে দেয়। পড়ে যেতে দেয় না। শিষ্যকে নাচায় না, তার ভেতরের নটকে ঘুম থেকে তুলে দেয়। ওই যে নাচানোর কথাটা আছে, ওকে আমার কর্তৃত্ব অর্থে পড়তে অস্বস্তি হয়।  ওরকম নাচানোর কথা ভাবলেই আমাদের এমএলএ শতদলকে মনে পড়ে। কী ভালো যে বক্তৃতা করে ছেলেটা! মাঝে মাঝে আমার তক্ষুণি ভোটটা দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।  অথচ কিছু একটা কাজ কর্ম নিয়ে গেলেই, ‘আরে বৌদি! আপনি নিজে এসেছেন! খুবই লজ্জিত। আজই করে দেব’, বলে হপ্তাখানেক বেপাত্তা হয়ে যায়। রাধার প্রেম তো তেমন নয়। সে যখন স্থবির কৃষ্ণের ভেতরের অজস্র নৃত্যময়, ছন্দোময় কৃষ্ণদের জাগিয়ে দেয়, বেচারা কৃষ্ণের মাথার ভেতর কী হুলুস্থূল ভাবুন! আর নিজেকে চিনতেই পারছে না। এতদিন যে লোকটাকে সে আমি বলে ডাকত, তার দফারফা! একদিকে প্রেমের উন্মাদ আনন্দ, আবার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ার ভয়। উদ্ভট না তো কী? ভয়, লজ্জা, অনিশ্চয়তা, আনন্দ, রোমাঞ্চ মিলেমিশে এক উদ্ভট অবস্থা। কিন্তু এসব মানে তো আমার মাথায় আজ তৈরি হচ্ছে।  শব্দগুলো তো আর আমি লিখিনি। কবেকার কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ শব্দের গণ্ডি কেটে রেখেছেন। আমি তাতে মানে বুনে দিচ্ছি। শব্দগুলো যেন ঠিক কোয়ান্টার মতো অতীত আর ভবিষ্যতের দিকে একইসঙ্গে ঘুরে চলেছে। শান্তনুর হাতে মাথা রেখে ওর কথা শুনতে শুনতে ওর বিজ্ঞানের সঙ্গে আমার কাব্যতত্ত্ব মিশে যায়। বিদেশে না যেতে পারার জন্য আমার আর কোনো আফসোস থাকে না।

আমার আজকাল আর কিছু নিয়েই খুব আফসোস হয় না। আমাদের ছোটো ছোটো জীবনের পাওয়াগুলোও যেমন ছোটোখাটো, না-পাওয়াগুলোও তাই। ও নিয়ে আর আফসোস করে কী লাভ? এই যে গান শেখাটা হল না বলে আফসোস করতাম।  হলে কী হত? গলায় সুরের কারুকাজ ফুটে উঠত? ক’দিন থাকত? তাকে যত্ন করতাম? কোনো কাজেই তো আমার দীর্ঘদিন মন টেকে না। একেক দিন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা হলে মাস্টারমশাই হারমোনিয়াম নিয়ে বসেন। কোনোদিন মল্লার, ছায়ানটের দোলা, কোনো কোনো দিন বাংলা আধুনিক গান। চলতে থাকে যতক্ষণ না গাঢ় হয়ে বুজে আসছে রাত আর গলা। সন্ধেবেলা শান্তনু স্টাডিতে থাকে। দরজা বন্ধ। চা-কফি দিতে গেলে দেখি আপন মনে ল্যাপটপ আর একগাদা বইয়ের সঙ্গে বিড়বিড় করে কীসব বলছে। মাঝে মাঝে শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। যেন চিনতেই পারছে না। সম্বিৎ ফিরে পেলে একটু হাসে, অথবা হাল্কা দু-একটা কথা ‘আজ তোমার খুব খাটনি গেল না? ডিনারটা আমার দায়িত্ব’, কিংবা ‘দাঁড়াও দাঁড়াও, এই ইক্যুয়েশনটা সল্ভ করে ফেলেছি প্রায়। এক মিনিট বসবে? দেখবে?’ আমি বাধ্য মেয়ের মতো বসি। ইকুয়েশনের ল্যাজা-মুড়ো কিছুই বুঝি না, কিন্তু শান্তনুর চোখের আলো, মুখের ওপর ভেসে ওঠা তৃপ্তিটুকু গায়ে মেখে নিই। আরাম হয়। এরই মধ্যে মাস্টারমশাইয়ের গানের সুর ভেসে এলে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। কাজের চাপ কম হলে শান্তনুও চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় চলে আসে। চেয়ার টেনে এনে দু’জনে বসি। একতলা থেকে সুর ভেসে আসে। ভাঙা ভাঙা গলায় মীড়গুলো কেমন কেঁপে যায়।  তিরতির করে কাঁপতে থাকে স্বর। যেন দাঁড়াবার জমি পাচ্ছে না। ভাঙাচোরা শরীর আর মাথায় স্থিরতা নেই কোনো। শান্তনু প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে, ‘মাস্টারমশাইয়ের সিগারেটটা বন্ধ করা উচিত’। কিন্তু আমি জানি, শুধু সিগারেট নয়, আশরীর ভেসে বেড়ানো দ্বিধা আর অবিশ্বাস সুরগুলোকে স্থির হতে দেয় না। এক এক সময় হারমোনিয়ামের রিডগুলোর সঙ্গে গলা মেলে না আর। একই সুর বাজতে থাকে বারবার, নানান লয়ে। ধীঈঈরে, অতর্কিতে দ্রুত—হারমোনিয়ামের ওপর অস্থির চরে বেড়ায় আঙুল। গলা ক্রমশই পিছিয়ে পড়তে থাকে। একসময় ঘড়ঘড় আওয়াজ হয় শুধু। কর্কশ স্বরে শুধু গোঙানি পড়ে থাকে। তারপর সব থেমে যায় বেশ কিছুক্ষণের জন্য। শান্তনু মাথা নাড়িয়ে চুক চুক আওয়াজ করে দু-একবার। তারপর উঠে যায়। একতলার ঘরে ভাঙাচোরা মানুষটা তখন হয়ত সিগারেট ধরাচ্ছে। গেলাসে আরেকটু রাম ঢেলে নিল। ফেলে আসা সময়, কোন যুগে ফেলে আসা সুর তার কানে বেজে চলেছে। সেই কণ্ঠকে হয়ত লোকটা ভুলে যেতে চায়, হয়ত শাসায়, যাতে এই অন্ধকার গলির ভেতরে একতলার সবজেটে দেওয়ালের ঘরটায় সে আর কখনো বিনা অনুমতিতে ঢুকে না পড়ে। কোন জন্মের এক আমির সঙ্গে প্রতিযোগীতায় লোকটা একই লাইন গেয়ে চলে বারবার। হেরে যায়।  থেমে যায়। ওস্তাদের স্নেহধন্য সেই উদ্ধত যুবক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় পা টেনে টেনে বাড়ি ফেরা প্রৌঢ় গানের মাস্টারকে। আলোর বিপরীতে পড়ে থাকা ছায়ার মতো দেহের দখল চায়। ছেড়ে আসা পথ লোকটার পিছু ছাড়তে চায় না। হারমোনিয়ামের কাঠের কড়িবরগা ছুঁয়ে যাওয়া আঙুল আর ভারী হয়ে বুজে আসা গলা কোনো প্রেতের সঙ্গে কথা বলে চলে। নালিশ করে। ভয় দেখায়। তর্ক করে।  হার-জিতের হিসেব কষে। আফসোস। বিদেশে না যেতে পারার আফসোস, গান না জানার আফসোস, স্বপ্ন ব্যর্থ হওয়ার আফসোস, স্বপ্ন দেখতে না পারার আফসোস... এই সব আফসোসেরা মিলে এই আধো অন্ধকার গলির ভেতর এক প্রেতলোক গড়ে নেয় নিজেদের মতো করে। আফসোসের ছায়ারা দীর্ঘ হতে হতে শরীর গ্রাস করে নেয়। সেই মরা শরীরের ভেতর সময় একতরফা ভাটির টানে পিছিয়ে যেতে থাকে।  যা হতে পারত কিন্তু হল না, অথবা যা ছিল কিন্তু আজ আর নেই তাদের দীর্ঘশ্বাস মাস্টারমশাইয়ের নৈঃশ্যব্দের ভেতর দলা পাকিয়ে ওঠে। কেমন যেন গা ছমছম করে আমার।  মাঝে মাঝে আমারও মনে হত জানেন, যদি সত্যিই টাইম মেশিনের মতো কিছু একটা থাকত! যদি এই দীর্ঘ ছায়াপথের শেষ বিন্দু অবধি চলে যাওয়া যেত, তাহলে হয়ত গান শিখতাম।  হয়ত কাব্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতাম। কিন্তু সময়কে কি ওভাবে পাল্টানো যায়? ঠিক যতটা চাই ততটুকুই? কতটুকু বদলাতে চাই তাও কি ছাই জানি? আমি কি শুধুই গান শিখতে চাই? ফরমায়েশি আসরের শেষে মাস্টারমশাইয়ের মতোই পা টেনে টেনে বাড়ি ফিরতে চাই? যদি গান শেখার পরে গান গাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে যেত? যদি কাব্যতত্ত্বের গবেষণা শেষ করে ফিরে আসতে হত এই ভোরবেলার একলা ছাদে? তবু চাইতাম? আমি কি সত্যিই গান শিখতে না পারার জন্য আফসোস করি? নাকি আসলে আমার পাশাপাশি অন্য যে আমিগুলো ঘুরে বেড়ায়, যেসব সমান্তরাল জীবন হতে পারত অথচ হল না, তাদের ছায়ারা এই ভোরবেলার ছাদে, এই আলো-আঁধারির বারান্দায় আফসোস হয়ে এসে পড়ে?

অশরীরির ছায়া হয়? নাকি না-হওয়া আমিরা এই হাড়-পাঁজরের খাঁচার ভেতর বসত গড়ে নেয় কোথাও? আমার পাশাপাশি কোনো গান জানা আমি, কোনো কাব্যতাত্ত্বিক আমিও কি এই ছাদের পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে? যে সুরগুলো গুনগুন করি, যে কবিতার বই তাক থেকে নামিয়ে আনি তাদের পছন্দ করে দেয় কে? আমি না অন্য অনেক না-হওয়া আমিরা?

শান্তনুদের ইনস্টিট্যুটের শান্ত, ঠান্ডা করিডোরে কিংবা বাড়িতে ওর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় অসংখ্য টুকরো টুকরো শব্দ উড়ে বেড়ায়। শব্দেরা নিজেদের শহর গড়ে তোলে।  সে শহরের প্রবেশদ্বারে কোনো প্রহরী নেই বটে, তবে দরজা খোলার মন্ত্র জানা চাই।  প্রজেক্ট ফান্ডিং বন্ধ হয় হোক; বিরুদ্ধতা, বদনাম আর অপমানের বোঝা বইতে বইতেও সে মন্ত্রের সাধনা করে যেতে হয় দশকের পর দশক। শান্তনুর মতো। নগরদ্বার খোলার সে চিচিং-ফাঁক এ জীবনে আমার আয়ত্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই আর। তবু শান্তনুর হাত ধরে তোরণের ফাঁক-ফোকর দিয়ে মাঝে মাঝে অন্দরমহলে উঁকি দেওয়া যায়। আর তখনই দু-একটা শব্দ আলোর ফুলকির মতো বাইরে ঠিকরে আসে। তেমনই একদিন ঠিকরে এসে পড়েছিল শব্দটা—এনট্যাংগলমেন্ট। শান্তনু যখন বক্তৃতার খসড়া পড়ে শোনায়, তর্ক করে বন্ধুদের সঙ্গে অথবা ওদের ল্যাবের দেওয়ালে কান পাতলে শব্দটার অনুরনণ শোনা যায়। বারবার। একটি অতিক্ষুদ্র কণা অন্য কণাটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অদৃশ্য বাঁধনে। দুটি কোয়ান্টাম একই কোয়ান্টাম স্টেটে আলিঙ্গনাবদ্ধ—সে তারা একে অন্যের থেকে যত দূরেই থাক। তাদের গতিপ্রকৃতি এক সুতোয় বাঁধা। তাদের একজনের অবস্থা নির্ণয় করতে বসলেই অন্যজন নিজের অবস্থা পাল্টে নেয় হিসেবমাফিক। যতক্ষণ তারা চারপাশের দুনিয়ার সংস্পর্শে না আসছে ততক্ষণ এক অনির্দিষ্ট অদৃশ্য নিয়তি তাদের একইসঙ্গে এক ও পরস্পরের অন্য করে রেখেছে। যেমন ওই অন্য আমিগুলো আমি হয়েও আমি নই। তাদের দু-চারজনকে চিনি, কতজনকে যে চিনি না! কিছু সম্ভাবনা মাত্র নয়, জানেন? ওরা আছে। অনন্তের ঠিকানায় হয়ত এই সব চেনা আর অচেনা আমিরা মিলেমিশে থাকে। যখন তাদের বুঝতে চাই, চিনতে চাই তখনই তারা পরস্পরের অন্য হয়ে যায়। কোয়ান্টার মতো। ভাবছেন, মাথা খারাপ হয়ে গেছে! প্রলাপ বকছি? আমিও এসব কথা আগে কখনো ভাবিনি জানেন? কখনো মনে হয়নি। পরশু যখন শান্তনুর ল্যাবে গিয়ে যন্ত্রটার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, তখনও না। গোটা ইনস্টিট্যুটে শান্তনুকে ঘিরে তখন কত গুণীজনের ভিড়। ভিড়ের মধ্যে আমার একা লাগে। তাই শান্তনুর হাত থেকে ল্যাবের চাবিটা নিয়ে ভেতরে এসে বসেছিলাম। চোখের সামনে যন্ত্রটা দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।  দেশ-কালের সমস্ত হিসেব গুলিয়ে দেওয়া আশ্চর্য এক যন্ত্র। একটা ড্যাশবোর্ড—দেখতে ছোটো ল্যাপটপের মতো।  একটু দূরে মাটিতে রাখা ধাতব পাতে অসংখ্য ছোটো বড়ো চিপ। কার্পেটের মতো পাতা আছে ফাইবারের প্লেট। প্লেটগুলো থেকে উপচে আসছে নরম নীল আলো। আর এই সব কিছু রয়েছে একটা ফাইবারের ঘরের ভেতর, অনেকটা অর্কিড রাখার কাচের ঘরগুলোর মতো দেখতে। টেলিপোর্টেশন—যে কোনো নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে চকিতে পৌঁছে যাওয়া অন্য কোথাও—আলোর চেয়ে দ্রুততর।  দুটি এনট্যাংগলড ইলেকট্রনের পথ ধরে মুহূর্তে দেশান্তরী আলোক কণা মাইলের পর মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে যেতে পারে। এইসব ঠান্ডা করিডরের দু’পাশের গবেষণাগারগুলোয় পদার্থবিদের কড়া নজরদারিতে সময়কে অস্বীকার করে ছুটে যায় তারা। রোজ। কিন্তু ইঁদুর, খরগোশ অথবা মানুষ? এই অসংখ্য কোষের জটিল জৈব জ্যামিতিতে বাঁধা দেহ কি পারে সময়কে অতিক্রম করতে? শান্তনু পেরেছে। সারা বিশ্বের বিজ্ঞানী, দার্শনিক, প্রযুক্তিবিদদের অবাক করে দিয়েছে অস্পষ্ট এক শহরের আরও আবছা গলির ভেতরের এক মাঝবয়সী মানুষ। টেলিপোর্টালের এই প্রোটোটাইপ জ্যান্ত প্রাণীকেও পৌঁছে দিতে পারে ওই ধাতব পাত থেকে যে কোনো ফাইবার প্লেটের ওপর। চোখের নিমেষে। কিন্তু মানুষ? এতদিন শান্তনুর ল্যাপটপে যন্ত্রটার নকশা দেখেছি, মেইলে বা হোয়াটস্যাপে পাঠানো ভিডিওতে দেখেছি ওই ড্যাশবোর্ডের সবুজ বোতামগুলো টিপলে কেমন ডান দিকের প্যানেলে আলোগুলো জ্বলে ওঠে, তারপর, মাঝখানের লাল এনটারে টোকা মারলে ধাতব পাত থেকে উঠে আসে আলোর গরাদ।  ম্যাজিক! কেমন যেন ঘোরের মধ্যেই ওই ফাইবারের খাঁচায় গিয়ে ঢুকেছিলাম। সোঁ সোঁ শব্দে আলোর রেখাগুলো উঠে আসতেই সমস্ত দেহটা হাল্কা হয়ে গেল, জানেন? হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে রক্তের ছলছল শব্দ। ধমনির ভিতরে সেই গতির চাপ অনুভব করতে পারছিলাম। সমস্ত দেহটা যেন স্বচ্ছ হয়ে আসছিল, যেমন অশ্বথ্থের পাতায় রোদ্দুর পড়লে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে শিরা-উপশিরা।  বাইরের শব্দ, রূপ, আলো সব মুহূর্তে মিলিয়ে গেলেও অন্ধকার নামে না চোখে। যেন অজস্র তারার আকাশে আমি ডুবে যাচ্ছি—এই বেসুরো আমির সঙ্গে সুরেলা আমি, এই আটপৌরে চিরচেনা আমির পাশাপাশি কাব্যতাত্ত্বিক আমি—ডুবে যাচ্ছি।  আমার সমস্ত আমিরা একইসঙ্গে বিলীন হয়ে যাচ্ছি কোনো অনন্ত আমির গর্ভে।  সে আমির দেশ নেই, কাল নেই। তাই স্থানাঙ্ক নেই কোনো। তার দেহ নেই, লিঙ্গ নেই, আফসোস নেই, আকাঙ্ক্ষা নেই... ঝড়ের সমুদ্রে জাহাজ ডুবে যায়, তবু সমুদ্রকে ঝড় স্পর্শ করতে পারে না।  সংবেদনহীন জলের ভেতর ডুবে যেতে যেতে আমি ও অন্য একাকার হয়ে যায়।  নিরাবয়বের কোনো অন্য থাকে না আর।  আমিও কি থাকে? বিলুপ্তির, মহাপ্রলয়ের এই অতলস্পর্শ কৃষ্ণগহ্বরে মিলিয়ে যেতে যেতে মনে হয় আসলে সমস্ত রঙ আমিরই রঙ, আসলে সমস্ত অন্য আমিরই অন্য।  আসলে সমস্ত আমি, অন্যের আমি।  সেই চুড়ান্ত নৈর্ব্যক্তিকতায় ডুবে যেতে যেতে বোঝা যায়, এই সমস্ত আমিরা আসলে ছিল, আসলে এই অসীম অনন্ত আমি ওই নানান আমিদের রতিক্রিয়া ছাড়া কিছু নয়—এনট্যাংগলমেন্ট।

মৃত্যুর কোনো বর্ণনা হয় না। ভাষা বড়ো বাচাল। সেদিনের কথা আমি কাউকে বলিনি।  বলতে পারিনি। শান্তনুকেও না। যখন সম্বিৎ ফিরল, আমি তখন মাত্র কয়েক ফুট দূরে ফাইবার প্লেটের ওপর দাঁড়িয়ে। অথচ অনন্ত যুগ কেটে গেছে, অনন্ত আলোকবর্ষ পার হয়ে ব্রহ্মাণ্ডের কোনো এক কোণে পুনর্জাত সেই আমিকে বড়ো অচেনা লাগে। এ দেহ যেন ঠিক আমার নয়। অথচ অশরীরের কোনো আমি হয় না। টলতে টলতে বেরিয়ে এসে চেয়ারে বসেছিলাম। নিজেকে বিশ্বাস হচ্ছিল না ঠিক—এ কি আমি না আমারই এক ছদ্মবেশ? অথচ আমারই স্মৃতি, আমারই দেহ, আমার... আমি কি আমার অভ্যাসমাত্র? তারপর কী ঘটেছিল মনে নেই।  পরের দিন যখন চোখ খুললাম, শান্তনু মাথার কাছে বসে।

এখন এই ঘর-বাড়ি, গলির অন্ধকার, সিঁড়ির রেলিং ঘেঁষে জেগে ওঠা অশ্বথ্থের চারা সব কেমন নতুন বলে মনে হয়।  যে আধমরা শুকিয়ে যাওয়া গাছটাতে কখনো নজর দিইনি, ভোরবেলা ছাদে এসে তার মাটিতে জল দিই। পাতায় আঙুল বুলিয়ে দিই।  আর খানিক পরে শান্তনু উঠে পড়বে। সকাল সকাল ফ্লাইট। বিদেশে বিজ্ঞানীদের বিরাট মঞ্চে শব্দের শহর গড়ে উঠবে আবার। অথচ আলোর গরাদে আটকে থাকা ইঁদুর, গিনিপিগ আর আটপৌরে মানুষের আবিষ্কার একান্ত ব্যক্তিগত। ঐতিহাসিকের নথিতে বা বিজ্ঞানীর গণিতে তাকে বয়ান করার উপায় নেই কোনো—ভাষা নেই।  আসলে অশ্বথ্থের পাতায় আলো পড়লে সব সময় শিরা-উপশিরা দৃশ্যমান হয় না।  কখনো কখনো প্রাচীন ধুলোর আস্তর রোদ্দুরকে আবছা করে দেয়।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানসহ ২৬ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত
উপজেলা নির্বাচনচেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানসহ ২৬ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন অপহরণের শিকার সেই প্রার্থী
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন অপহরণের শিকার সেই প্রার্থী
‘হোম অব ক্রিকেটে’ বাংলাদেশের স্পিন কোচ মুশতাক
‘হোম অব ক্রিকেটে’ বাংলাদেশের স্পিন কোচ মুশতাক
গরমে রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
গরমে রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
সর্বাধিক পঠিত
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ