X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ওপেন টি বায়োস্কোপ

হোসনে আরা মণি
০৮ নভেম্বর ২০২২, ১২:৫৫আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২২, ১২:৫৫

গভীর রাতে সদর দরজায় মৃদু দুটো টোকা। এ টোকা শোনার আশায় কান খাড়া করে থাকে প্রকৃতি। শব্দটা এমন মৃদু যা উৎকর্ণ হয়ে না থাকলে কানে পড়ে না। প্রকৃতির মায়ের কানে ইদানীং এ শব্দ প্রবেশ করে না তেমন। আগে এ শব্দের প্রতি মায়ের উৎকর্ণতা আজকের প্রকৃতির চেয়ে কম ছিল না। কিন্তু এখন স্মার্টফোনের মৃদু বিপ বিপ ছাড়া আর কোন মৃদু আওয়াজে এত রাতে মায়ের উৎসাহ নেই।

প্রকৃতিদের শহরটা ছোট এবং শান্ত। রাত দশটার পর লোক চলাচল একেবারে সীমিত হয়ে পড়ে। এগারোটার পরে তো দূরের শেয়ালের ডাক আর টুকটাক দুয়েকটা রিকশার টুংটাং ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না তেমন। আর হ্যা, রেলগাড়ির কুঝিকঝিক রাতেই শোনা যায় ভালো। কী সুন্দর মন কেমন করা একটা ভোঁ আর সাথে ক্রমহ্রাসমান কুঝিকঝিক রাতের পর রাত কান পেতে শোনে প্রকৃতি! ইঞ্জিনের শাটারে শেষটানের শব্দটা প্রকৃতির মনে এক অদ্ভূত আবেশ ছড়ায়। কল্পনার দিব্য চোখে সে দেখতে পায় একটি পৌরুষদীপ্ত অবয়ব, শোভন কামরার দরজার হাতল চেপে দাঁড়িয়ে আছেন। সবার আগে গাড়ি থেকে নামবেন, একটুও সময় নষ্ট হতে দেবেন না বলেই না গাড়ি মন্দগতি হতে শুরু করতেই ব্যাকপ্যাক পিঠে এসে দাঁড়িয়ে আছেন একেবারে দরজার মুখে। গাড়ি থামতেই আলগোছে টুপ করে নেমে বড় বড় পায়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসবেন। সামনে যে রিকশাটা পাবেন তাতেই চেপে মিনিট আট-দশের মাথায় সোজা এসে নামবেন প্রকৃতিদের বাড়ির গেটে। তারপর জিআই শিটের গেটে তর্জনী আর মধ্যমা মিলিয়ে ছোট্ট দুটো টোকা।

কিন্তু সব ট্রেনে তো আর তিনি আসেন না। সব রিকসার টুংটাঙে তার আগমনসম্ভাবনা থাকে না। তবু দিন-রাত সব সময়েই ট্রেনের শব্দে উৎকর্ণ থাকে প্রকৃতি। বরেন্দ্র, সীমান্ত, নীলসাগর, একতা- প্রতিটি ট্রেন আসা আর ছেড়ে যাওয়ার হুইসেলের পর অন্ততঃ মিনিট পনেরো সে নিশ্বাস নেয় ধীর লয়ে। ব্যবসায়ী আঙ্কেলকে ট্রাভেল করতে হয় খুব। কখন কোন গাড়িতে চেপে এসে টুপ করে নেমে পড়েন তা কি আর বলা যায়!

ইদানীং এ টোকা একবারেই বিরল হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এ টোকা দুটো চিরকালের তরেই হারিয়ে যাবে প্রকৃতির জীবন থেকে। হয়তো অচিরেই ঘটবে তা। এমন ঘটুক তা প্রকৃতি কোনকালে না চাইলেও তার ভাই মারুফ চেয়েছে চিরকাল। কেন যেন সে মানুষটাকে একদম সহ্য করতে পারে না। মায়ের যেসব বন্ধুরা মাঝেমাঝেই বাড়িতে আসে তাদেরকে বরং সে সহ্য করে কিন্তু প্রকৃতির এত পছন্দের মানুষটাকে নয়।

আঙ্কেল অবশ্য মারুফ আর প্রকৃতি দুজনকেই বেশ স্নেহ করেন। কিন্তু প্রকৃতি জানে, ঠিক বুঝতে পারে যে প্রকৃতির দিকেই স্নেহের পাল্লাটা অনেক অনেক ভারী। প্রকৃতি এতে খুশি, খুব খুশি। দিন দিন এই খুশিটা বাড়তে বাড়তে এখন হারাবার আশঙ্কায় এসে ঠেকেছে। এই আশঙ্কা এখন প্রতি দিন প্রতি রাতেই ক্রমবর্ধমান

গতবার আঙ্কেল চলে যাওয়ার সময় প্রকৃতি তার দিকে চেয়েছিল একদৃষ্টে। সে চোখে কী ছিল কে জানে, আঙ্কেল তার দিকে করুণ মুখচোখ করে কয়েক সেকেন্ড অপলক তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিলেন। তারপর আর চোখ তুলে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে শুধু বললেন, ভালো থেকো। বললেই হলো ভালো থেকো? এভাবে ভালো থাকা যায়? ভালো থাকা এতই সহজ? ওপাশে মায়ের ঘর থেকে চাপাস্বরের খিলখিল আওয়াজ ভেসে আসছে। মা ইদানীং জলিল চাচার সাথে চ্যাট করে। জলিল চাচা খুব হাসাতে পারে।

কাল সকালে মা ফোনে মিরা খালাকে বলছিল, শোন মিরা, রূপের প্রেমে আমি আর নেই। খালি রূপে তো আর পেট ভরে না, মনও না। ওর রূপের সাথে টাকাপয়সা ছিল তখন, শরীরের যোগ্যতাও ছিল তেমন। কী বলব তোরে, বিয়ের আগে ওকে যা পাইছিলাম, একটা মেয়ের জন্য তা সাত জনমের আকাঙ্ক্ষার সম্পদ। অথচ দ্যাখ, বিয়ের পর যে কদিন যা হয়েছে, বিয়ের আগের সেই স্বাদের সিকিও মেলেনি।

কী স্বাদের হেরফের নিয়ে মা অত দুঃখ করছিল তা বুঝতে না পারার মতন ছোট তো আর নয় এখন প্রকৃতি। তবে যথেষ্ট বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকায় সে অনুভবে ঠিক মেলাতে পারে না। কেন এমন হয়? যে আঙ্কেলের জন্য মা পাগলপ্রায় হয়ে অমন একটা চক্রান্ত নাটক মঞ্চস্থ করেছিল সাত বছর আগে, সেই আঙ্কেলের প্রতি কেন মায়ের এখন এত অবজ্ঞা? খেতে-পরতে অনেক টাকা দেয় না বলে? তাতো বাবাও দিত না। বাবা যা যা দিতে পারেনি বলে মা এককালে খুব আক্ষেপ করতো তা আঙ্কেলও মাকে পুরোপুরি দেয়নি, দিতে চেষ্টা করেছে একসময়, আবার ফিরিয়েও নিতে হয়েছে তাকে পরিস্থিতির চাপে। পরিস্থিতি- কী যে এক অমোঘ শব্দ!

মা বলে বেড়ায় এই পরিস্থিতির দরুণই নাকি আঙ্কেলের সাথে তার বিয়ে হয়। অথচ প্রকৃতি ঠিক জানে যে তা ঠিক নয়। পরিস্থিতিতে মা-ই ফেলেছিল আঙ্কেলকে। বাবা তখন বেঁচে। কাজেই তার সধবা মা যখন একদিন সাররাত থানায় কাটিয়ে ভোররাতে বাড়ি ফিরে বিজয় গর্বে মিরা খালা আর নানীকে সব বলছিল, তখন প্রকৃতি চোখ পিটপিটিয়ে সব শুনছিল। মিরা খালার তখন বিয়ে হয়নি। বিয়ের বয়স পেরুনো মিরা খালা, প্রকৃতি, মারুফ আর নানী তখন এক ঘরেই ঘুমাতো। সন্ধ্যায় মা আর আঙ্কেলকে ফাঁকা বাসা থেকে  ঠ্যাটা মিলনের দল আর পুলিশ মিলে যখন ধরে নিয়ে যায় তখন মারুফ, প্রকৃতি, মিরা খালা আর নানী ছিল জনি মামার বাসায়। জনি মামার বাসায় সেদিন কোন উৎসব আয়োজন কিচ্ছু ছিল না। প্রকৃতি কিংবা মারুফেরও সেদিন বেড়াতে যাওয়ার কোন বায়না ছিল না। তবু যে কেন মা সেদিন সাজিয়ে-গুছিয়ে তাদেরকে তার খালা-নানীর সাথে ঠেলেঠুলে বেড়াতে পাঠালো তার কারণ সেদিন না বুঝলেও এখন তো প্রকৃতির বুঝতে কিছু বাকি নেই। আঙ্কেলের জন্য তাই তার মায়া হয়।

আঙ্কেলটা একটু বোকা আছে ঠিকই, আবার চালাকও খুব। মা আঙ্কেলকে সেদিন ঢপ দিলেও পরে আর কোনদিন দিতে পারেনি। এ কয় বছর মা কার সাথে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে আসছে সব আঙ্কেলের নখদর্পনে। অথচ আঙ্কেল থাকেন রাজধানীতে। সেখানে বসে বসেই কী সব কায়দায় আঙ্কেল সব খবরাখবর পান মায়ের। এমন খবর পেয়েই কিনা একদিন দুপুরবেলায় দুম করে এসে পড়লেন। ভয়ে-সঙ্কোচে মা তো কেমন সিঁটিয়ে গেল। সেদিন একটা সেমি পিকনিকের আয়োজন চলছিল প্রকৃতিদের বাসায়। বাবার পেনশনের টাকার ফয়সালা পেয়েছিল মা কয়েকদিন আগে। এ সংক্রান্ত টুকটাক কাজে যারা সাহায্য করেছিল তাদেরই কজনকে মা নিয়েছিল পিকনিকে। ছোটন কমিশনারের ভাগ্নে রউফ মামা ছিল আয়োজনের মাথা। আসলে মায়ের নামে হলেও তার টাকাতেই হচ্ছিল সব আয়োজন। প্রকৃতির মা নিজের টাকা খরচ করে একদল লোক খাওয়ানোর মতন দুরবস্থায় এখনো পড়েনি তো তখন!

আঙ্কেল আসতেই ঘরের দৃশ্য মুহূর্তে বদলে গেল। এতক্ষণ যে গান-বাজনা আর সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘর ভরে ছিল, তা সব থমকে গেল। কেউ কেউ উসখুস করে ঘর ছাড়তে শুরু করলো। কেবল রউফ মামা কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে গ্যাট হয়ে বসে পা নাড়াতে লাগলো। আঙ্কেল কাউকে কিছু বললেন না। পিঠের ব্যাকপ্যাক পিঠেই থাকলো, শুধু হাতে যে চিপস-চকোলেটের থলেটা ছিল তা প্রকৃতির হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

এরপর আঙ্কেল বহুদিন এ বাসায় আসতেন না। পরে মা কী কী সব বলে, কাকে কাকে ধরে আবার আঙ্কেলকে আনতে পারল। কিন্তু কোথায় যেন কী একটা ব্যাপার ঘটে গেছে- আঙ্কেল এবার প্রকৃতির দিকেও তেমন লক্ষ করলেন না। ঘরের দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে গমগমে গলায় মাকে কী সব বললেন, তারপর ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে মারুফকে বললেন, তুমি এখন বড় হয়েছো, তোমার বোনও বড় হচ্ছে। তোমার মা ও বোনের নিরাপত্তার স্বার্থে তুমি এই বাসায় বাইরের পুরুষদেরকে এলাউ করবে না। আমি এখানে থাকি না। থাকলে ব্যাপারটা দেখে রাখতে পারতাম। জবাবে মারুফ তখন কিছুই বললো না। কিন্তু আঙ্কেল বাইরে যেতেই আপন মনে ফেটে পড়ে বললো, এ্যা, ভারী উপদেশ দিয়ে গেলেন! আরে ব্যাটা! তুই কি আমাদের ঘরের পুরুষ? তারপর যা তা গালাগাল করতে থাকায় প্রকৃতির আর সহ্য হলো না। এগিয়ে এসে বললো, ভাইয়া, উনি আমাদের সৎ বাবা। বাইরের মানুষ না। কিন্তু মারুফ চিৎকার করে বলল, কিয়ের সৎ বাবা? আরে উনি মাকে মন থেকে বিয়ে করছে? ঠিকমত খরচ দিচ্ছে? নিয়মিত বাড়ি আসছে? দ্যাখ গিয়ে ওর আগের সংসারের জৌলুস। তিনতলা বাড়ি হাঁকায়ে কী রমরমা!

হ্যা, প্রকৃতি এটা জানে। আঙ্কেল তাদের বাসায় কখনো আগের সংসারের বিষয়ে কোন কথা বলেন না। আসলে আঙ্কেল তো এমনিতেই কথা খুব কম বলেন। নিতান্ত যতটুকু না বললেই নয়, বা যেটুকু হাসি না হেসে পারা যায় না, তিনি ঠিক ততটুকু কথা বলেন, সেটুকু হাসি হাসেন। তাই বলে আঙ্কেলকে কিন্তু গোমড়া বা মনমরা মনে হয় না মোটেও। বরং হাসির চেয়ে আঙ্কেলের রাশভারি চেহারাটাই প্রকৃতির বেশি পছন্দ। আর তার কণ্ঠস্বর, হ্যা, প্রকৃতির মনে হয় এ কণ্ঠ কেবল আঙ্কেলকেই মানায়। মোটা পুরুষালি স্বর যে এত নরম আর আন্তরিক হতে পারে তা আঙ্কেলের কথা যে না শুনেছে সে বুঝতেই পারবে না। তো সেই আঙ্কেলের প্রথম সংসারের বৌ-বাচ্চাকে প্রকৃতি কখনো দেখেনি। অথচ তারা এ শহরেই থাকে। কিন্তু একদিন তিতলি তাকে বাড়িটা দেখিয়েছিল। সে আর তিতলি  মৌমিদের বাড়িতে যাচ্ছিল। মাস্টারপাড়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ তিতলি বলে ওঠে, এই, ঐ যে লোকটা তোর মায়ের স্বামী না? ঐ দেখ কার সাথে কথা বলছে। তিতলির তর্জনী অনুসরণ করে প্রকৃতি দেখে একটা ছিমছাম সুন্দর তিনতলা বাড়ির দোতলার খোলা ব্যালকুনিতে পথের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন লম্বা-চওড়া, আকর্ষণীয় দেহগঠনের এক পুরুষ। আঙ্কেল, হ্যা, আঙ্কেলই তো! মাথাভর্তি হালকা কোঁকড়া চুল, খয়েরী চোখ, মানানসই মিষ্টি নাক, আযৌবন সিগারেটের ধোঁয়ায় দুষ্ট কালচে ঠোঁট আর দৃঢ় চিবুক নিয়ে ঐ চেহারাটা পৃথিবীতে কেবল একজনেরই। কিন্তু পাশে দাঁড়ানো খাটো-মোটা কিন্তু খুব ফর্সা মেয়েলোকটা কে? আন্টি? আর এই বাড়িটা ওনাদের? পাছে আঙ্কেল তাকে দেখে ফেলে এ কারণে প্রকৃতি তিতলির হাত ধরে তাড়াতাড়ি পা চালায়। 

মাস্টারপাড়ায় আঙ্কেলের বাড়ি এটা প্রকৃতি আগেই শুনেছিল। ইদানীং এই বাড়ি নিয়ে মায়ের সাথে আঙ্কেলের কথা কাটাকাটি হতে মাঝেমাঝেই প্রকৃতি শোনে। মা বলে, বাড়িটা ঐ মাগীকে তো পুরোপুরি লেখেই দেছ, তো সে বাড়িতে আরো টাকা ঢালা কেন?  মায়ের কথায় আঙ্কেল কঠিন হতাশা-ঘৃণামাখা চোখে এমন করে তাকায় যে আঙ্কেলের জন্য প্রকৃতির কেমন মায়া হয়, আর মায়ের জন্য ঘৃণা। আচ্ছা, তার মাটা এত লোভী কেন? আঙ্কেলের টাকা ছিল বলে তাকে ট্র্যাপে ফেলে বিয়ে করতে হবে কেন? আঙ্কেলও অবশ্য ধোয়া তুলসী ছিল না। মায়ের সাথে রাতের পর রাত মোবাইলে কথা বলতো। প্রকৃতি তখন ছোট ছিল। তাই মায়ের পাশে শুয়ে অবলীলায় অনেক কথা শুনতে পেতো। তবু এখন প্রকৃতির মনে হয়, তার মা ঠিক করেনি।

আচ্ছা, প্রকৃতি যদি কখনো কাউকে ভালোবাসে তবে কি তাকে এমন কায়দা করে বিয়ে করবে? না, না, একদম না। সে না চাইলে প্রকৃতি একটুও জোর করবে না। কিন্তু কাকে ভালোবাসবে প্রকৃতি? কে সে? সে এখন কোথায়? হঠাৎই বুকের ভেতর অন্যরকম এক অনুভূতি টের পায় প্রকৃতি-আচ্ছা, সে দেখতে কেমন হবে? আঙ্কেলের মতন? ঠিক ওরকম হ্যান্ডসাম, ক্রেজি........ছিঃ ছিঃ! কী সব ভাবছে সে!

কিন্তু ভাবনাটা পেয়ে বসে। ইদানীং মাঝে মাঝেই সে শিউরে শিউরে ওঠে। স্কুলে যেতে-আসতে কত ছেলেই তো দেখে সে। কত ছেলে তার দিকে হা করে চেয়ে থাকে। কিন্তু তাদের কাউকেই প্রকৃতির মনে ধরে না। কেমন সব হ্যাবলা টাইপ ছেলেপুলে! ওদের চেহারা, দেহভঙ্গি, হাঁটা-চলায় ব্যক্তিত্বের গভীরতা কই? ওদের তাকানো, কথা বলা কিংবা স্মিত হাসিতে হৃদয়ে ঝলক তোলা অভিব্যক্তি কই? ওদের রাগ-ক্ষোভ-কষ্টের বহিঃপ্রকাশে পৌরুষের চাপা গর্জন কই? প্রকৃতির মনের ভাষা কি মা পড়তে পারে? পুরো পড়তে না পারলেও মনে হয় কিছু আঁচ করতে পারে। ইদানীং মা মাঝেমাঝেই প্রকৃতির দিকে কেমন বিচিত্র চোখে চেয়ে থাকে! আর সেই সাথে আঙ্কেলের সাথে ব্যবহারের শীতলতাও দিনে দিনে বাড়ছে। গতবার আঙ্কেল এলে তো মা তাকে ঘর ছেড়ে দিয়ে এসে প্রকৃতির পাশে শুয়েছিল।

দরজায় ফের দুটো মৃদু টোকা। হয়তো আগের টোকা জোড়ার থেকে দু’মিনিটের ব্যবধান। নাহ্, মায়ের কানে এখন আর এ টোকার আওয়াজ পৌঁছাবে না। কিন্তু একা উঠে গিয়ে গেট খুলতে তীব্র ইচ্ছে জাগা সত্ত্বেও প্রকৃতির সাহসে কুলোয় না। মা এখন আঙ্কেলের সাথে তাকে এক মিনিটও একা দেখতে চায় না। মায়ের ধারণা প্রকৃতিই তার স্বামীর কানে বিষ ঢালে। প্রকৃতি না বললে লোকটা কী করে জানতে পারে যে নতুন কেনা সিম ও ফোন ব্যবহার করে তার দ্বিতীয় বৌ কার সাথে কখন কত সময় কথা বলে? সন্দেহ থেকে মা একদিন প্রকৃতির ফোনও কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। প্রকৃতির অনশন আর আঙ্কেলের আদেশ-এ দুই মিলে প্রকৃতিরই জয় হয়েছিল। প্রকৃতির ফোনটা তার বাবার কিনে দেয়া, পুরনো কালের নোকিয়া বাটন ফোন। একটা স্মার্ট ফোনের তার খুব শখ। কিন্তু পড়াশুনার অজুহাতে মা তাকে তা কিনে দিচ্ছে না। প্রকৃতি তাই আঙ্কেলের কাছেই একদিন লজ্জা ঝেড়ে চেয়ে বসেছিল একটা স্মার্টফোন। আঙ্কেল কথা দিয়েছেন, এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করলে তাকে একটা শাওমি ফোন কিনে দেবেন। প্রকৃতি সেই ফোনটা হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছে।

দরজায় আবার দুটো টোকা পড়ার আগেই দরজাটা খুলতে হবে। কিন্তু মাকে ডাক দিতে প্রকৃতির একটুও ইচ্ছে করে না। আর আঙ্কেলের কেমন স্বভাব! যতক্ষণ দরজা খোলা না হবে মিনিট দুয়েক পর পর দুটো করে টোকা পড়তে থাকবে, কিন্তু মা বা প্রকৃতি কাউকেই ফোন দিয়ে দরজা খুলতে বলবেন না। মায়ের সাথে বিয়েটা অনিচ্ছায় হওয়াতেই কিনা আঙ্কেল কিছু বিচিত্র আচরণ করেন। যেমন- বিয়ের পরপরই বড় বৌয়ের নামে বিষয়-সম্পত্তি প্রায় সব লিখে দেন। মা এই খবর শুনে অল্পের জন্য হার্টএটাক হতে বেঁচেছিল। আঙ্কেলকে ফাঁদে ফেলে বিয়ে করতে মাকে যেসব সরকারদলীয় পান্ডারা সহযোগিতা করেছিল তারাও আর মাকে সাহায্য করতে রাজি হয়নি। রউফ মামার সাফ কথা, ‘যদি বলো ওরে ধরে ঠেঙ্গিয়ে ওর ঋত্বিক রোশন মার্কা চেহারায় কয়েক ডজন গোল আলু গজায় দিতে পারি, ওয়ান-টুর কারবার। বিয়া করা সুয়ামি, এরচে বেশি করলে তো তুমিই মাইন্ড খাবা। মাগার এক বৌয়েরে লেখে দেয়া বিষয়-সম্পত্তি কাইড়া আইনা আরেক বৌয়েরে দেয়ার কাম তো ওয়ান-টুর মামলা না। তার উপ্রে তুমি মাইরি যা কঞ্জুস! পিঁপড়ের পাছা চিপলে মধু বারায়। তুমারও ঐ এক জায়গায় মধু ছাড়া......তা, মামায় তো খালি ঐ মধুর আশায় কোন কামে হাত দিব না।’ তবে বিষয়-আশয় তখনো যা হাতে ছিল তা হয়তো কালে-দিনে আঙ্কেল মাকে দিতেন। তেমন কিছু লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছিল। যেমন আঙ্কেলের যে নোয়াহ্ গাড়িটা ভাড়ায় খাটতো সেটাতে করে মাঝে মাঝে তাদেরকে এখানে-ওখানে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। ভাড়ার টাকাও মাকে দেবেন এমন কথাও নাকি দিয়েছিলেন। মাকে এ সময় বেশ সুখী মনে হতো। নেশাখোর প্রথম স্বামী যে সুখ ও স্বচ্ছ্বলতা তাকে কোনদিন দিতে পারেনি সম্ভবত এবার সে তা পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু বেশিদিন এ সুখ সয়নি কপালে। আঙ্কেলের মায়ের ক্যান্সার হলো, আর মাতৃভক্ত ছেলে মায়ের চিকিৎসায় আদাজল খেয়ে নেমে পড়লো। আরো কিছু সম্পদের পিছু গাড়িও অদৃশ্য হলো। একসময় এমন হলো যে দ্বিতীয় স্ত্রীর ভরণপোষণের যোগানেও টান পড়তে শুরু করলো। মা যত ক্ষেপতে শুরু করলো, আঙ্কেল ততই অদৃশ্য থাকতে শুরু করলেন। এরই মধ্যে আগের চেয়ে বেশি হারে যাতায়াত শুরু করলো মায়ের বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। সেসব শুভাকাঙ্ক্ষীদের থেকে কেটে ঝরে ইদানীং এক জলিল চাচায় এসে ঠেকেছে।

আঙ্কেল হয়তো মায়ের জীবন থেকে চলেই যাবেন। কিংবা মাই আঙ্কেলকে ছাড়িয়ে দেবে। আঙ্কেল আর এ বাড়িতে হয়তো কোনদিন আসবেন না। কাল মা মিরা খালার সাথে এ নিয়ে ফোনে কথা বলছিল। হয়তো এবারই আঙ্কেলের শেষ আসা। আচ্ছা, আঙ্কেলের সাথে আর কোনদিন দেখা না হলে প্রকৃতির কেমন লাগবে? আঙ্কেলেরও কি একটুও কষ্ট হবে না? মায়ের সাথে যখন আঙ্কেলের বিয়ে হয়- সেই সাত বছর আগে, প্রথম দিকে আঙ্কেল তাকে কখনো কখনো কোলে নিতেন, গাল টিপে আদরও করতেন। এরকম দুয়েকটা বিকেলের স্মৃতিও আছে যখন আঙ্কেল তার হাত ধরে হাঁটছেন, স্টেশনে নিয়ে ঝালমুড়ি আর বেলুন কিনে দিচ্ছেন। এ সময় অবশ্য মারুফ ভাইও সঙ্গে ছিল। তারপর মারুফ একটু বড় হতেই আর আঙ্কেলকে দেখতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতি যত বড় হয়েছে ততই আঙ্কেল তাকে আগের চেয়ে বেশি পছন্দ করেছে। আর মায়ের পছন্দ ততই কমেছে। মনে আছে একদিন আঙ্কেল প্রকৃতির চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলেন। সেদিন তারা তেঁতুলিয়ায় বেড়াতে যাচ্ছিল। তো সব গোছানো হয়ে গেলেও প্রকৃতির চুল বাঁধা হয়নি। মা তার শাড়ির কুঁচি সামলাতে ব্যস্ত ছিল। প্রকৃতি তার রুক্ষ কোকড়া চুল নিয়ে বিরক্ত হচ্ছিল। এমন সময় আঙ্কেল এসে নরম করে বললেন, মা, চিরুনীটা আমাকে দাও। তারপর কী কোমল হাতে আঁচড়ে প্রকৃতির চুলে ক্লিপ এঁটে দিলেন! কিন্ত মা এটা দেখে পরে প্রকৃতিকে বকা দিয়ে বলেছিল, দিন দিন যে ধিঙ্গি হচ্ছো সে বোধ আছে? খবরদার, যাকে-তাকে আর গায়ে হাত দিতে দেবে না। কিন্তু প্রকৃতি বুঝতে পারছিল না যে আঙ্কেল, যিনি মায়ের সাথে এক বিছানায় ঘুমান, তিনি কেমন করে ‘যাকে-তাকে’র দলে পড়েন!

দিনে দিনে প্রকৃতি ‘যাকে-তাকে’র সংজ্ঞা বুঝেছে। কিন্তু পুরোপুরি মানতে পারেনি। তার যাকে এত পছন্দ এবং যিনি এই পরিবারের একজন তিনি অস্পৃশ্য হবেন কেন? প্রকৃতির বুঝি ইচ্ছে করে না এমন একজন মানুষের স্নেহ ও সঙ্গ পেতে, যে হবে পরিবারের আপনজন, যার উপর নির্ভর করা যায়, যে তাদের জীবনে জড়িয়ে থাকে মমতা ও ভালোবাসায়? কিন্তু তেমন কেউ যে কোনদিন ছিল না। বাবা যখন বেঁচে ছিল এবং বাবা-মায়ের সম্পর্ক ছিল, তখনো বাবাকে সেই নির্ভরযোগ্য আপনজন মনে হয়নি। চারদিকে কেমন এক নিষ্ঠুর শুন্যতা! প্রকৃতির বড্ড কান্না পায়।

দরজায় ফের দুটো টোকা। এবার কি একটু জোরে? প্রকৃতি আবার মায়ের ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকায়। কোন সাড়া পাওয়া যায় না। দ্বিধা ও ভয় কাটিয়ে সে লঘু পায়ে এগিয়ে যায় সদর দরজার দিকে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বাধিক পঠিত
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি