X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
বেন ওকরির গল্প

উৎসর্গ

অনুবাদ : বিপাশা মন্ডল
০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:১০আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৩১

দীর্ঘকাল ধরেই আমি তাদের দেখতে চেয়েছি। ছোটোবেলায় বাবা পাহাড়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাদের সম্পর্কে গল্প বলে যেতেন, তখনই আমি তাদের বিষয়ে শুনেছি। আমার মা-ও কাঠে ধরানো আগুনের ধোয়া বাতাসে ছড়িয়ে তাদের বিষয়ে একটানা গল্প বলে যেতেন। প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়ার সময় মনে হত আমি তাদের দেখেছি। কিন্তু আমি তো তাদের দেখা পাইনি। বহুবছর ধরে আমি তাদের বিষয়ে আর কোনো গল্প শুনিনি। আমার মা তার গল্পগুলোসমেত কবরে চলে গেলেন এবং আমি গেলাম স্কুলে, কিন্তু স্কুলে তাদের বিষয়ে কোনো গল্প বলার চল ছিল না।

বছরগুলো দীর্ঘ ছিল। আমি দূর-দূরান্তে ভ্রমণে গেলাম, আমাদের এলাকার চেয়ে শীতল আবহাওয়ার এলাকাগুলোতে। তাদের গল্পগুলো ছিল মেয়ে ও বরফের প্রাসাদ নিয়ে ঠান্ডা বরফায়িত গল্প। আমার পুরো ভ্রমণজুড়ে আমি শুধু কাঠের ধোয়ামাখা গল্পের আকাঙ্ক্ষা করে গেলাম।

দীর্ঘদিন পরে আমার পড়াশোনা শেষ হলো। আমি এখন একজন নৃতত্ত্ববিদ হিসেবে কাজ করছি। কিন্তু কাজে ততটা মনোযোগী নই। আমি এখনো সেই মেয়েটি রয়ে গেছি যে কিনা এখনো তাদের দেখার আকাঙ্ক্ষা করে।

এই গ্রীষ্মে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম পাহাড়ের উপরে ভ্রমণে যাব। হয়তো কিছু আমাকে ডেকেই চলেছে। আমি এমন একটা এলাকায় গেলাম, সেখানের লোকজন বলল তুমি তাদের দেখতে পাবে। এটা আন্দিজ পর্বতমালার উপরে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর একটা এলাকা। ওখানের লোকজন দরিদ্র এবং তাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত সহজ-সরল ও সাধারণ। যখন আমি তাদের সীমানার মধ্যে আরোহণ করে উঠে গেলাম, তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে আমি একটা ভিন্ন ধরনের জায়গার মধ্যে ঢুকে পড়েছি।

এখানে তাদের বিষয়ে প্রচুর পরিমাণে গল্পগাঁথা চালু আছে। গ্রামবাসীরা জানাল, তুমি তাদের হ্রদের পাড়ে অথবা জলপ্রপাতের নীচে দেখতে পাবে। আমি খালি পায়ে হ্রদের পাড়ে হাঁটতে গেলাম। পুরো বেলাভূমিজুড়ে শত শত গিটার রাখা আছে দেখলাম। প্রতিটা গিটারের পাশে একগুচ্ছ লাল অথবা হলুদ রঙের ফুল শুইয়ে রাখা আছে। ওখানে এমন জায়গাও আছে যেখানে রৌদ্রের মধ্যে অথবা নদীর তীরে গিটারগুলো একটা করে পাথরের উপরে রাখা আছে। ওগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন উৎসর্গীকৃত।

কখনো কখনো আমি হ্রদের ওপার থেকে ভূতুড়ে বাজনা ভেসে আসতে শুনতে পেতাম এবং আমি যখন হ্রদ পাড়ি দিয়ে এটা দেখতে যেতে চাইতাম যে এধরনের অপার্থিব বাজনা কোথা থেকে আসছে। তখন গ্রামবাসীরা বলতো যে হ্রদ পাড়ি দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, যারা এই হ্রদ পাড়ি দিয়েছে তারা আর কখনো ফিরে আসেনি।

গ্রামের লোকেরা সেইসব গায়কদের কথা বলল যারা এই হ্রদের পাড়ে তাদের দেখার আশা নিয়ে এসেছিল। তারা তাদের বাদ্যযন্ত্র নিয়েই এসেছিল এবং তাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিল এবং জলপ্রপাতের নীচে বসে তাদের গিটার বাজিয়েছিল এই আশায় যে গায়করা পারলৌকিক অনুপ্রেরণার কোনো উপহার পাবে। অধরা কারুর কাছ থেকে উপহার অনুসন্ধান করতে করতে বহু গায়করা এখানেই মৃত্যুবরণ করেছে।  

আমি যখন ঐ এলাকায় ছিলাম, তখন সামান্য খাওয়া-দাওয়া করেছি। ঐ জায়গাটার পারিপার্শ্বিক পরিবেশই এমন ছিল যে, মনে হচ্ছিল ওখানে খাবার খাওয়া অনাবশ্যক। আমি কোনো গায়ক নই, কিন্তু আমি সেই অধরা শক্তিকে চাই যে আমার বাদ্যযন্ত্রকে সুর-লয়ে ফেরাবে, তা সে যেমন যন্ত্রই হোক না কেন। আমি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলাম এবং খালি পায়ে হাতে একগুচ্ছ হলুদ ফুল নিয়ে হাঁটতে থাকতাম, যদি তাদের দেখা পাই। 

সূর্যোদয়ের আগেই শুনতে পেলাম, হ্রদের ওপার থেকে মন কেমন করা সেই অসহ্য মধুর সংগীত ভেসে আসছে। আমি একা একাই সেই সংগীত শুনলাম। দিগন্ত রেখার উপরে সদ্যোত্থিত সূর্যকে মনে হচ্ছিল যেন মাখনের হালকা চকচকে প্রলেপ। শীঘ্রই পাহাড়গুলো থরথর করে কেঁপে উঠল এবং আকাশের চুল্লির তাপে গলতে শুরু করল। শুধু হ্রদগুলো ছিলো শীতল।

গায়কদের নির্জন বসতির মতো, শিশির ফোঁটায় সাজানো চকচকে গিটারগুলো বেলাভূমির পাথরের উপরে ফেলে রাখা ছিল। আমি সেই কুমারী বেলাভূমির উপরে কোনো পদচিহ্ন রাখিনি। এই সময়ে হ্রদটাকে মনে হচ্ছিল যেন বিশেষ-রকম মোহজালে আচ্ছন্ন। এটা একটা পাহাড়ি হ্রদ এবং প্রথমবারের মতো বেয়ে উঠে যখন ওটা দেখবে, ওটাকে মনে হবে যেন তুমি একটা অলৌকিক কিছু দু-হাতে ধরে আছো। একটা তীব্র কান্না আমার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল এবং যেটা আমার কাছাকাছি কিছু একটাকে আকর্ষণ করল এবং আমি যেটার ঝাপটানি শুনতে পেলাম না আর সেটা আবার জলের মধ্যেই ঝট করে ডুবে গেল। আমি কিছুই দেখতে পেলাম না কিন্তু জলের একেবারে মুখোমুখি হয়ে আছি। একটা বাজে জলের ঢেউ ওটার চেহারাটাকে ঢেকে দিল।

ঐ মুহূর্ত থেকে আমার স্নায়ুগুলো টানটান হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল যেন একটা ধীর গতির পাগলামি আমার মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ছে। আমি আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে একটা বিশালাকৃতির কাকাতুয়ার উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল কেউ একজন আমার আশেপাশে হাঁটছে, আমার চিন্তাগুলোকে পড়ে ফেলছে।

এটা একটা ভালো দিক যে, যখন আমি এসব অদ্ভুত অনুভূতির শিকার হচ্ছিলাম তখন আমি হঠাৎ করে ওইসব মধুর সংগীত শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন কেউ একজন জলপ্রপাতগুলোর একটা সুতো পাঠিয়ে দিচ্ছে, আমার শরীরের ভিতর থেকেই যেটা এপাশ ওপাশ চলে যাচ্ছে। আমি অনুভব করছিলাম যেন আমি এই পৃথিবীকে দেখছি না, সেইসব জিনিসই দেখছি শুধু। আমি একটা লম্বা সময়ের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, অনেক দিন ধরে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে, আর কখনো এই অপেক্ষা শেষ হবে না।

হয়তো আমার পূর্বেকার প্রশিক্ষণ-ই আমাকে এই অবস্থা থেকে টেনে সরিয়ে নিল। আমি এই বেলাভূমিতে যা কিছু শিখেছি সেসব ভুলে যেতে চাইলাম। ঐ সকালটা কিংবদন্তির সুরভিতে সতেজ হয়ে ছিল।

নীল পাহাড়ের হ্রদ যেন পুদিনা পাতার মতোই একটুকরো সবুজ। ওখানে দেখার মতো এতো বেশি সৌন্দর্য ছড়ানো ছিল যে দেখে কুলাতে পারছিলাম না। ওখানে যেন সেই সৌন্দর্যের মাদকতায় আমি সুখী মনে আমার সকল বন্ধন থেকে ছিন্ন হলাম।

তৃতীয় সপ্তাহ পার হলে, আমি ভেবে বিস্মিত হয়ে গেলাম, যে আমি ওখানে কী করছি। আমি যখন নিচে নেমে যাবার জন্য ভাবতে লাগলাম তখন একজন বৃদ্ধ লোক আমাকে অনেক উপরে পর্বতমালার মধ্যে অবস্থিত একটা গোপন হ্রদের কিংবদন্তির গল্প বলতে শুরু করল।  

‘আমি জানি তুমি কী খুঁজছো’ বলল বৃদ্ধ। ‘আরো অনেক লোক এটা খোঁজ করেছে এবং কিচ্ছু পায়নি। শুধুমাত্র ঐ সংগীতশিল্পীরা মৃত্যুকে পেরিয়ে গিয়ে নিজেদের উৎসর্গ করেছে, এই স্থানের ঐ কঠোর দেবীর জন্য, স্বেচ্ছায় তাদের মনকে হারিয়ে ফেলেছে এই ভেবে যে, যদি কখনো তারা নিজের আত্মাকে খনন করে নতুন কোনো সুরের সন্ধান করতে পারে সেই আশায়। বেশিরভাগ সময় তারা একটা নতুন বিষয়কে অথবা পর্বতচূড়ার সর্বোচ্চ চূড়াকে বিবর্তন করে এখানটা ছেড়ে গিয়েছে। আমি নিজেও একজন সংগীতশিল্পী। আমিও তাদের মধ্যে একজন যে কিনা নিজের গিটারকে তাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে এসেছি, যারা আমাকে একটা নতুন প্রেরণায় আমার বাদ্যযন্ত্রকে সুরে পরিপূর্ণ করে তুলতে দেখতে পাবে না। এটার মধ্য দিয়ে সম্ভবত আমার আত্মা নবায়িত হয়েছে এবং আমেরিকার মেজাজকে ধারণ করেছে। কোনো কোনো দিন আমি ভেবেছি যে, আমি যা খুঁজছি তা হয়তো খুঁজে পেয়েছি, এবং আমি যখন বাজাতাম তখন একটা অদ্ভুত শব্দ পানির ওপার থেকে ভাসতে ভাসতে আমার দিকে চলে আসতো। কিন্তু বহু বছর পরে আমি বুঝতে পারলাম ওটা আসলে আমার নাগালের বাইরেই থেকে গেছে, এবং তখন এসকল হালকা হাওয়ায় আমি আমার পুরনো নিজেকেই শুনতে পেলাম। এরপর একদিন আমি যা খুঁজছিলাম তা-ই দেখতে পেলাম। সেই নারী আমার গিটারকে স্পর্শ করল এবং আমার গিটার চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি আর চেনা পৃথিবীতে বোবা গিটার নিয়ে ফিরে যেতে পারিনি। কাজেই আমি এখানেই থাকতে শুরু করলাম এবং আমি এইসব পাথর ও বেলাভূমির অংশ হয়ে গেলাম। আমার বাহুর দিকে দেখো, আমার উপরে গাছ গজাচ্ছে। অজানা গোপনকে খুঁজে বেড়িয়ে উন্মোচনের চেষ্টার অর্থ হচ্ছে এই। এখনো কি তুমি সেই গোপন হ্রদের কথা জানতে চাও?’

‘হ্যাঁ’, আমি তার কথার জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে আমি মুখ ঘুরিয়ে বললাম।

‘এ এলাকার অল্প কয়েকজন লোক এটার বিষয়ে জানে। এটাকে একাকী দেখতে পাওয়াকে ঐশ্বরিক আর্শীবাদের একটা লক্ষণ। কিন্তু তুমি এই আশীর্বাদের উৎস সম্পর্কে জানতে জানতে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। ওখানেই তুমি তোমার প্রার্থিত অন্বেষণের অভীষ্ট খুঁজে পাবে।’

‘আমি কী করে জানব যে, আমি কী খুঁজছি?’

‘আমি জানি ক্ষুধা এবং উন্মত্ততা কাকে বলে, যা ঐ দুচোখে ফুটে উঠেছে। আমার চোখেও এমন দেখার ক্ষুধা ও উন্মত্ততা ছিল।’

তার কথায় আমার মধ্যে কাঁপুনি তৈরি হলো।

‘তুমি যা খুঁজছো, খুব কম নারীই তা খুঁজতে বের হয়।’

‘সত্যি কি তাই?’

‘বেশিরভাগই পৃথিবীর আগুনের চুল্লি থেকে পালিয়ে বাঁচে।’

‘তারা যা খোঁজে তা কি তারা খুঁজে পায়?’

‘একজনের কথাও তো আমি শুনিনি।’

‘একজনও নয়?’

‘না।’

‘তাদের সাথে কী ঘটেছিলো?’

‘তারা কিংবদন্তির অংশ হয়ে গিয়েছে।’

আমার আর কোনো করার মতো প্রশ্ন ছিল না এবং আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আমি দেখতে থাকলাম। সে আমাকে তখন গোপন হ্রদটা খুঁজে পেতে আমাকে যে যে পথে এগোতে হবে সেইসব বিশেষ পথের কথা বলে যাচ্ছিল, যেসব বিশেষ নিয়ম-কানুন আমাকে মেনে চলতে হবে, সেসবও বলছিল।

পরের দিন খুব সকালে, আমি তৈরি হলাম। হলুদ ঠোঁটের সাদা পাখিগুলো তখন বাতাসে উড়ছিল। একটা বেদনামথিত গিটারের কুন্ডলীপাকানো সুর একটা অর্ধেক খোলা দরজার মধ্য দিয়ে থেকে থেকে বেরিয়ে আসছিল। আমার পায়ের প্রতিটা পদক্ষেপ হ্রদের উপরে প্রতিধ্বনি তুলছিল। আমি দীর্ঘসময় ধরে ক্রমশ গরম হয়ে উঠতে থাকা উত্তাপকে লক্ষ্য করে হেঁটে এগোলাম। কখনো এমন এমন সময় এল যে আমার মাথা দুলতে লাগলো এবং এবং আমার এমন অনুভব হলো যে আমি এক পিপা কাঁচা বিয়ার খেয়ে ফেলেছি। কখনো কখনো আমি নিজেকে ভুলে গেলাম এবং কখনো এমন মনে হচ্ছিল যে রাস্তা আমাকে হাঁটিয়ে নিচ্ছে। বিকালের শুরুতে আমি যখন পৌঁছুলাম তখন আমার সারা পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে এবং আমার শরীরের প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থরথর করে লাফাচ্ছে। আমি তো পৌঁছুলাম কিন্তু তখন পর্যন্ত ঐ বৃদ্ধের বলা গোপন হ্রদকে দেখতে পেলাম না।

যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা ছোটো বাচ্চাকে আমি পথে খেলতে দেখলাম আমি টানা হেঁটে গেলাম। আমি ওকে গোপন হ্রদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম এবং সেই শিশুটা এমনভাবে হাসল যেন সে আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। আমি কথা শেষ করার আগেই সে লাফিয়ে উঠল এবং আধা দৌড়ানো আধা হাঁটার ধরনে আমাকে অনেকটা পথ ঘুরাল, পাহাড়ের সরু জায়গা সেখানে একটা সরেল ক্ষেতের ভিতর দিয়ে এগোবার সময় পাথর আমার মুখে ঘষা খাচ্ছিল। আমি ওখানে এমন অভূতপূর্ব ফুল দেখলাম যা আগে কখনো দেখিনি।

‘তুমি কী ওটা দেখতে পাচ্ছ না?’ আমি হঠাৎ করে শুনলাম বাচ্চাটা আমাকে জিজ্ঞেস করছে।

আমি উপরের দিকে তাকালাম, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। বাচ্চা ছেলেটা আমার আগে আগে চলছিল এবং আমি প্রায় দৌড়ে ওকে অনুসরণ করছিলাম।

আমি এমুহূর্তে একদমই ওকে চোখের আড়াল হতে দিতে চাইছিলাম না, যদিও উত্তাপ আমার চোখেমুখে ফোসকা ছড়াচ্ছিল। আমি ওকে বিকৃত পাথরের দিকে বাঁক নিতে দেখলাম। আমি যখন পাথরটাকে ঘুরে এগোলাম, আমি যেন ওটার মধ্যে পড়েই যাচ্ছিলাম।

আর ওখানেই সেটা ছিল। পাহাড়ের হাতের তালুর মধ্যে, গাঢ় নীল রূপালী হ্রদটা দেখা যাচ্ছিল, আমি তখনই কেবল গভীর দম নিলাম। ধীরে ধীরে পাখিগুলো এটার পুরো মুখ জুড়ে তাদের গূঢ় রহস্যময় বর্ণমালা উৎকীর্ণ করতে লাগল। ওখানে কোনো কিংবদন্তী ছিল না, কিন্তু ওটা যেন নিজেই কিংবদন্তির এক অতল উৎস।

ছেলেটা হ্রদটাকেও দেখছিল না, আমাকেও দেখছিল না। ওটা ছিল সেই সময় যখন আমি বুঝতে পারার আগেই ও আমাকে ছাড়িয়ে অন্য কোথাও দেখছিল। আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘুরে তাকালাম এবং কিছুই দেখতে পেলাম না। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি শুধু সেখানকার হ্রদের পানির ধীর গতির কলতান শুনতে পেলাম।

‘তুমি কী তাকে দেখতে পেয়েছো?’

‘কাকে?’

‘তাকে।’

‘কে?’

‘পানির নারীকে। তুমি তাকে দেখনি?’

‘না।’

‘তুমি তো তার দিকে তাকিয়ে ছিলো।’

‘না।’

‘তুমি তার দিকেই তাকিয়ে ছিলে।’

‘আমি তাকিয়ে ছিলাম?’

‘আর সেও তো তোমার দিকে তাকিয়ে ছিল।’

‘আমি তো তাকে দেখিনি।’

‘আমি তো ভেবেছিলাম তুমি তাকে চেনো।’

‘তুমি এরকম বলছো কেনো?’

‘যেভাবে তুমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলে। সে তোমাকে চেনে।’

‘তুমি কীভাবে জানলে?’

‘যেভাবে সে তোমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো, তাতেই বুঝেছি।’

‘সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো?’

‘হ্যাঁ, আমার মনে হয় সে তোমাকে খুব পছন্দ করে।’

‘এখন তো মনে হচ্ছে তুমি একেবারে বাজে কথা বলছ।’ 

‘সে যে ইঙ্গিত ও প্রতীক তোমাকে দেখাল, তা দেখনি?’

‘কোন প্রতীক?’

বাচ্চা ছেলেটা একটা প্রতীক তৈরি করে দেখাল। ওটা ছিল একটা আমন্ত্রণ, একটা ডাক। একটা আহ্বান।

‘এটাই কি সেই প্রতীক?’

‘হ্যাঁ। সে এই চিহ্নটাকে একবার তৈরি করেছিল।’

‘একবার।’

‘হ্যাঁ। সে এরকম কিছু করে, এরকমটা আমি আগে কখনো শুনিনি।’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ। আমার মনে হচ্ছে সে তোমাকে খুব পছন্দ করে।’

‘ধন্যবাদ।’

‘আরে, এটা কিছু নয়।’

বাচ্চা ছেলেটা এক মুহূর্ত ওখানে থাকল। আমি বাচ্চাটাকে একটা মুদ্রা দিলাম। ছেলেটা টাকাটা নিল এবং গ্রামের দিকে দৌড় দিল। আমি হ্রদের তীরে বসে পড়লাম, ঠিক সেই জায়গাটায় যেখানটায় ছেলেটা ঐ নারীকে দেখেছে। আমি হ্রদের দিকে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকলাম। এরপর আমি কাপড়-চোপড় খুলে ঐ নীল পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

কিন্তু যখন আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম, পানি তখন কোথায় উবে গেছে। যেখানে হ্রদটা ছিল, সেখানে একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে এবং সে বলল:

‘আমি শুনলাম যে, তুমি এখানে কিছু খুঁজতে এসেছ। তুমি কী খুঁজছো?’

‘আমি তাদের দেখতে চাই।’

‘তারা কারা?’

‘এই হ্রদের অধরা আত্মাদের।’

‘তুমি তাদের কাছ থেকে কী পেতে চাও?’

‘আমিও নিজের যন্ত্রের জন্য নতুনরকম প্রেরণাদায়ী এক সুর পেতে চাই।’

‘তোমার বাদ্যযন্ত্র কোথায়? অন্যরা তাদের গিটার বেলাভূমিতে অথবা জলপ্রপাতের নিচে ফেলে এসেছে। তোমার বাদ্যযন্ত্র কোথায়?’

‘আমিই আমার বাদ্যযন্ত্র...।’

আমি যখন পরিচিত লোকজনকে হ্রদটার ছবি দেখালাম, তারা সকলে হ্রদটার বিবর্ণ নীল রঙ আর বোবা রূপালী বর্ণ দেখতে পেল আরও দেখল পাহাড়কে বেষ্টন করে থাকা নিচু বৃত্ত।

এরপর আমি যা দেখেছিলাম কখনো তারা তা দেখতে পায়নি।


(ইংরেজিতে ‘দ্য অফারিং’ গল্পের অনুবাদ)

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
তীব্র গরমে কাজ করার সময় মাথা ঘুরে পড়ে দিনমজুরের মৃত্যু
তীব্র গরমে কাজ করার সময় মাথা ঘুরে পড়ে দিনমজুরের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড