ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। চারদিক সুনসান অন্ধকার। তনু সোফার উপর থেকে একটা কুশন নিয়ে সোজা বারান্দায়। তারপর কুশনটা মাথার নীচে দিয়ে শরীরটা এলিয়ে দিল বারান্দার কোণে সাজিয়ে রাখা ইজিচেয়ারে।বারান্দাটা বেশ ঝকঝকে তকতকে। সেই ঝকঝকে বারান্দায় শুয়ে শুয়ে সে আরো একটি ঝকঝকে জিনিসের দিকে আনমনে তাকিয়ে রইল। সেটি হচ্ছে আকাশ, গভীর অন্ধকারে ঝুলে থাকা ঝিকিমিকি তারাখচিত আকাশ।
তনুর পুরো নাম তনিমা আহমেদ। ডাক্তার সৌরভ আহমেদের স্ত্রী। বয়স পঁয়ত্রিশ, ছত্রিশ হবে। দুই সন্তানের মা। বড় ছেলে অনুপ এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, আর মেয়ে সরলা ধানমন্ডির একটি স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। ছেলেমেয়ে দু'জনেই এ যুগের তথাকথিত স্মার্ট এবং আধুনিক। তাদের মতে মা এখনও সেই সেকেলেই রয়ে গেছে। এখনও রবীন্দ্রনাথের যুগেই পড়ে আছে। সামান্য ফেইসবুক একাউন্ট পর্যন্ত নেই। তনুর অবশ্য এসব কথায় কিছু আসে যায় না। সে সবসময় আছে তার নিজস্ব ভুবনে, যেখানে বাতাসে বেটোফেনের সিম্ফনি ভাসে, বাজে রবীন্দ্রনাথের অতলতার আহ্বান।
তনুদের বাসাটা ঢাকা শহরের ভেতরের দিকে হওয়ায় একটু সুবিধাই হয়েছে। চারদিক বেশ খোলামেলা। বিশেষত বাসার সামনেটা খোলা হওয়ায় প্রচুর বাতাস এসে ধুয়ে দেয় ঘরটাকে। এই বাতাসের হুটোপুটি খেলা দেখতে বেশ লাগে তার। যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি ঢেকে দেয় পুরো বাড়ি। যখন আগুনরঙা রোদ ওঠে, তখন সেই ছোট্ট বাড়িটাও খুশিতে কেমন যেনো চনমন করতে থাকে। আর রাত। রাততো তার জন্য অন্য এক পৃথিবী। প্রায়ই লোডশেডিং হলে অথবা লোডশেডিং না হলেও রুমের লাইট অফ করে তনু চলে যায় বারান্দায়। ঝিরঝিরে বাতাস আর কৃষ্ণ আকাশ তাকে তখন ইশারায় ডাকে।
তনু যখন বারান্দায় ইজি চেয়ারে শুয়ে আকাশের তারা দেখছে, সেই একই সময় একদল নারী পুরুষও কয়েক'শ মাইল দূরে টিলার উপর বসে মুগ্ধ হয়ে তারা দেখছে। টিলার উপর দাঁড়িয়ে আছে টালির ছাদ দেয়া ছোট ছোট কিছু কটেজ। সামনে ফুলের বাগান। যতদূর দু'চোখ যায় বিস্তীর্ণ নারিকেল গাছের সারি। যেনো এক অজানা সৌরভের দেশে ঢুকে পড়েছে ওরা। পাশের কাঠের টেবিলে পড়ে আছে সেখানকার দেশীয় কিছু খাবার ও ড্রিংকস। মাঝে মাঝে ওখান থেকে খাবার তুলে নিয়ে টুকটুক করে মুখে দিচ্ছে। এই সুনসান নীরবতার অন্যরকম একটা শব্দ আছে। রাহাত মিতার কাঁধে হাত রেখে বলল, "মিতা একটা কবিতা শোনাওতো"। মিতা একটু ভেবে রুমে ঢুকে জীবনানন্দের কবিতা সমগ্র নিয়ে আসল। তারপর আবৃত্তি করতে লাগল—
"স্বপ্নের ভিতরে বুঝি—ফাল্গুনের জ্যোৎস্নার ভিতরে
দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে
হরিণেরা; রুপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়;
বাতাস ঝাড়িছে ডানা—মুক্তা ঝরে যায়
পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে—বনে বনে—হরিণের চোখে;
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে।"
মিতার কণ্ঠে জীবনানন্দ দাশের কবিতা। সাথে সাথে ড্রিংক্স এ চুমুক দিয়ে অসীম'দাও সুর মেলায়—
"ঐখানে সারাদিন উঁচু ঝাউবন খেলা করে
হলদে সবুজ নীল রঙ্গ তার বুকে:
পাখি মেঘ রৌদ্রের;
তবু আজো হৃদয়ের গভীর অসুখে
মানবেরা পড়ে আছে কেন।"
দুজনের কণ্ঠই থেমে গেছে। শুধু পাতার শিরশিরানি শব্দ আর দূর থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত এক প্রাণীর ডাক। মিতা, রাহাতরা, অসীম দা, রিতা, সবুজ ও তার বউ বাচ্চারা বেড়াতে এসেছে শ্রীলঙ্কায়। থাকবে চার দিনের মতো। উঠেছে একটা চমৎকার বাংলোর মতো বাড়িতে। অনেক খুঁজে বনের ধারে এই হোটেলটির সন্ধান পেয়েছে তারা। একটু পুরোনো বলে অনেকে এদিকটায় আসতে চায় না। ভালোই হলো, শাপে বর। মিতারা এমনই একটা জায়গা খুঁজছিল যেখানে প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়া যাবে, আবার চাইলেই বের হয়ে শ্রীলঙ্কাকে তারিয়ে তারিয়ে দেখা যাবে।
এই মুহূর্তে তনুর খুব মন খারাপ। তনু মিতার খুব কাছের বন্ধু। এই ভ্রমণে তনুরও থাকার কথা ছিল। শ্রীলংকার ট্যুরে যাবার জন্য অফিস থেকে ছুটি নেয়া, বরকে বুঝিয়ে বলা, ভিসা পাসপোর্ট রেডি করা, সবই প্রায় সম্পন্ন করে এনেছিল সে। কথা ছিল তনু প্রথমে চলে যাবে মিতাদের সাথে, তার দুদিন পর সৌরভ অর্থাৎ তনুর বর শ্রীলঙ্কায় গিয়ে তাদের সঙ্গী হবে। কিন্তু শেষমেশ বাধ সাধলো তনুর অফিস থেকেই। ওদের অফিসে জাপান থেকে হঠাৎ করেই এক গবেষক দল আসছে, যাদের জন্য তাকে আর দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন না অফিসের এমডি। ব্যাগ গোছানোও কমপ্লিট ছিল তার। একেবারে শেষ মুহূর্তে সব কিছু ভন্ডুল হয়ে গেল। তনুর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। দুটো দিন অফিস থেকে এসে সে তেমন কোনো ঘরের কাজকর্মও করল না, ঠিকমতো খেলোওনা।
বারান্দায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছে তনু। নাহ, মিতার মোবাইলটা বন্ধ। বারবার বলছে, "দুঃখিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে একটু পরে আবার চেষ্টা করুন।"
দেখি রিতার নাম্বারে ফোন দেই তো। হঠাৎ যদি কানেকশন পেয়ে যাই। "Sorry you are not allowed to call this number" ধ্যাৎ, অভিমান ভরা কণ্ঠে তনু আবার মিতার নাম্বারে কল দেয় "হ্যালো মিতা শুনতে পাচ্ছ?"
"হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি বল।"
"তোমরাতো অনেক মজা করছ দেখি। আমাকেও একটা কবিতা শোনাও!"
মিতার খোলা চুল বাতাসে উড়ছে। কাঠের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে মিতা আবৃত্তি করে—
"চাঁদ এখনো ওঠেনি
তাই চেনা যায় না
তবু কেমন যেন মনে পড়ে
পুরনো দিনের কথা।"
আজ সারাদিন মিতা, রাহাত, রিতা, অসীমদা, সবুজ তাদের একপাল বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে টই টই করে ঘুরলো। শ্রীলঙ্কার দর্শনীয় সব স্থানে ঘুরে বেড়ালো। চমৎকার সব ঐতিহ্যবাহী জায়গাগুলো দেখল। সেখানকার খাবার খেলো। যদিও তারা মাছ ভাতে অভ্যস্ত তবু শ্রীলংকার খাবার খেতে যতটা ভেবেছিল তত একটা কষ্ট হলো না বরং নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া গেল। তবে বাচ্চারা ভীষণ বিরক্ত করছিল খাবার-দাবার নিয়ে। শ্রীলঙ্কার মানুষের চেহারা শারীরিক কাঠামো অনেকটা বাঙালির মতো। বাঙালির মতো ওখানকার মেয়েরা হরহামেশা শাড়িও পড়ে। কচি পাতার মতো স্নিগ্ধ সবুজ তাদের গায়ের রঙ। প্রকৃতির মায়া মাখা চোখে মুখে।
বাচ্চারা সমুদ্র থেকে বেশ কিছু ঝিনুক আর পাথর কুড়াল। মিতা, রিনা আর বহ্নি সংগ্রহ করল ওখানকার পোশাক আর অলংকার। তারপর সন্ধ্যাবেলা হোটেলে ফিরে স্নান সেরে শ্রীলঙ্কার পোশাক পরে মিতা রিনা আর বহ্নি যখন কাঠের বারান্দায় এসে দাঁড়াল, তখন আকাশ সিঁদুর রঙে নেয়ে গেছে। এক বোতল লাল রঙ যেনো ঢেলে দিয়েছে কেউ পশ্চিমাকাশে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে একদল যুবক যুবতী বিভূঁইয়ের এর আশ্চর্য সৌন্দর্যে ডুবে যায়। সন্ধ্যা নামে ধ্যানের মতো। প্রকৃতির গন্ধ আর পাখির বাড়ি ফেরার সুগন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
ওখানকার বিশেষ উপায়ে তৈরি চা আর নাস্তা খেয়ে তারা গানের আসরে বসবে।
"Sorry you are not allowed to call this number"
"দুঃখিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহ করে একটু পরে আবার চেষ্টা করুন।"
"হ্যালো? হ্যালো? কেডা?"
"আমি। চিনেন নাই?"
"ও আল্লাহ, আফনে? কিমুন আছেন?"
"হেরাতো হক্কলে মিল্যা শ্রীলংকা গেছে।"
"জানি।"
"দুইদিন ওইয়া গেছে। আইব পরশুদিন। তয় আফনে বালা আছুইন্যি?" আনন্দিত কণ্ঠ ভেসে আসে ওপাশ থেকে।
"হ্যাঁ বুয়া, আমিতো ভালোই আছি। আপনি কেমন আছেন? ঘরদোর ঠিকমতো আছে তো?"
"হ আফা বালাই আছি। তয় রাত্রেবেলা সাপ আইছিল। কুত্তার সাথে ফাইট লাগছিল। পরে কুত্তার ঘেউ ঘেউয়ানিতে মিস্ত্রি বাবু আইসা সাপটারে মারে।"
"তাই নাকি? বলেন কি? তাহলে তো খুব ভয় পাইছিলেন?"
"না আফা, অত ডরাই নাই। দরজা, জানালা লাগাইয়া হুইয়া পড়ছি। কত বড় বাড়ি, একলাই তো আছি, আজকাল আর কিছুতেই ডরাই না। ডরের উপরে দিয়া চইল্যা গেছি।"
"কি রান্না করছেন বুয়া?"
"হ, ইছা মাছের ভর্তা, হিদলের ভর্তা আর লাউ দিয়ে টাকি মাছ। একলা মানুষ, আমি আর কতটুকু বা খামু।"
"ইস,আর বইলেন না। ঝাল ভর্তার গন্ধ পাচ্ছি। আমারতো জিভে পানি চলে আসছে। প্রত্যেকটা খাবারই স্পেশাল। খালি বাসা পেয়ে মজার মজার রান্না করে খাচ্ছেন, না?"
হাসতে হাসতে গড়ায় মিতাদের বুয়া, "বুঝছি, বুঝছি। আরেকবার আসলে আপনারে এইগুলানই রাইন্দা খাওয়ামু, আর কিছু খাওয়ামু না।"
ফোন রেখে তনু আকাশের দিকে তাকায়। খুব দূরে একটা তারা ঝিকমিক করছে। ভীষণ অন্যরকম দেখাচ্ছে তারাটাকে। যেনো কোনো খবর নিয়ে এসেছে। তনু কান পাতে। টুংটাং দোতারার শব্দ কি শোনা যাচ্ছে না? আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয় সেটা। তনু শুনতে পায় রাহাত গাইছে—
"মানুষ ধর, মানুষ ভজ, শোন বলিরে পাগল মন
মানুষের ভিতরে মানুষ করিতেছে বিরাজন।"
তনু কান পাতে। আরো গভীরভাবে কান পাতে। শুনতে পায় এখন তারা সবাই মিলেই গানটা করছে। বাতাসে বাঙালি গানের সুরের মূর্ছনা। ওয়েটার খাবার নিয়ে এসেছে। মিতা গান শুনতে শুনতে প্লেটের খাবারগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে। বাচ্চারা ভীষণ উত্তেজিত কি একটা পোকা ধরা নিয়ে। সন্ধ্যাতারা নামল।
"তনু, এই তনু? কি হলো তোমার? বারান্দায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছো যে! এদিকে তোমার খিচুড়ি যে পুড়েছে শেষ!"। "হায় হায়, সর্বনাশ!"— বলে দৌড়ে উঠে রান্না করে ছুট দেয় তনু। সৌরভ রাতে গরুর মাংস দিয়ে খিচুড়ি খেতে চেয়েছিল। গরুর মাংস বিকালে ভুনা করে রেখেছে সে। আর এদিকে খিচুড়ি নামানোর কথা আর মনে নেই। তনু দৌড়ে গিয়ে খিচুড়ি নামাতে গিয়ে দেখে, নাহ এখনো লেগে যায়নি। খাওয়া যাবে।
এয়ারপোর্ট থেকে নেমেই বাসায় খবর দেয় মিতা। "আমরা চলে এসেছি। আধা ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাব।" বুয়া হৈচৈ করে রান্নার আয়োজন শুরু করল। সকালের নাস্তায় ঘিয়ে ভাজা পরোটা, ডিম ভাজা আর হাঁসের মাংস। দিদি এসে ঘরদোর পরিষ্কার করতে লাগল। ফার্নিচারগুলো মুছে, বিছানাপত্র ঝেড়ে তকতকে করে ফেল চারদিক। মিতারা ফিরে এসেছে। দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর তারা যখন একটু বিছানায় গড়িয়ে নিতে যাবে তখন দিদি মিতার হাতে একটা খাম দিয়ে বলল, বিছানা ঝাড়ার সময় বালিশের নিচে এটি পেয়েছে। মিতা খামটা খুললো। খামের ভেতর একটি তাজা সবুজ পাতা। পাশে ছোট্ট একটি চিঠি "আমি তোমাদের সাথেই ছিলাম।"