X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

কেনজি মিজোগুচির স্ট্রিট অফ শেইম : রাতের আলোয় পথের গল্প

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:০০আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:০০

কেনজি মিজোগুচির স্ট্রিট অফ শেইম : রাতের আলোয় পথের গল্প যুদ্ধে হেরে যাওয়া একটি দেশের জনবহুল রাজধানী। ১৯৫০-এর দশকের টোকিও। সারা শহর বিবর্ণ, মলিন। অর্থনৈতিক মন্দা পরিবারের পর পরিবারকে গৃহহীন, খাদ্যহীন, এমনকি জীবনহীন করে ছুড়ে ফেলছে পথে। শহরের একেকটি পথে তাই অন্ধ-বন্ধ নগর জীবনের অজস্র গল্প পড়ে থাকে। কেনজি মিজোগুচির জীবনের শেষ ছবি স্ট্রিট অফ শেইম এই রকম একটি পথের গল্পই বলে। যদিও আপাত দৃষ্টিতে পথটি অন্যরকম, আর দশটি পথ থেকে ভীষণ আলাদা। এই পথ দিনের আলোয় ঘুমিয়ে থাকে, রাত এখানে জমজমাট।

মিজোগুচি তার কাজে বারবার জাপানের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে টিকে থাকতে নারীর সংগ্রামের গল্প বলেছেন। ইশিকো শিবাকির উপন্যাসকে ভিত্তি করে তৈরি স্ট্রিট অফ শেইম ১৯৫৬ সালে যখন মুক্তি পায় জাপানের সংসদ ডায়েটে তখন যৌনতাকে পেশা হিসেবে নিষিদ্ধ করার আয়োজন বা চেষ্টা চলছে। রেডিওতে সেই চেষ্টার খবর ভেসে আসে ‘ড্রিমল্যান্ডে’। ‘ড্র‌িমল্যান্ড' টোকিওর অন্যতম প্রধান যৌনালয়। এইখানে কাজ করে এমন পাঁচজন নারীর অতীত আর বর্তমানের সংগ্রাম আর সংকটকে ঘিরে আবর্তিত হয় ছবির কাহিনী।

ইউমেকো, ইয়াসুমি, হ্যানেই, ইয়োরি, মিকি : পাঁচ নারীর পেশা আর কর্মস্থল এক হলেও তাদের পরিচয়, অতীত, সংগ্রাম আর উদ্দেশ্য ভিন্ন। একজন একমাত্র ছেলের আলোকময় ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকা মা, আরেকজন স্বামী আর শিশুসন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার প্রত্যয়ে দৃঢ় সংগ্রামী স্ত্রী, বাবাকে মুক্ত করতে সবকছিু করতে রাজি এমন মেয়ে একজন, অন্য একজন বাবার হাতে মাকে প্রতিনিয়িত নিগৃহীত হতে দেখে ক্লান্ত-স্বপ্নহীন, কোনো একদিন ঘর-সংসার হবে এমন আশায় গৃহস্থালির জিনিসপত্র কিনে জমায় আরেকজন। এক সুতায় গাঁথা জীবনগুলো প্রচণ্ড পরিমাণে পরাধীন। সবাই দেনাগ্রস্থ। স্বাধীন হওয়ার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।

এই পাঁচ নারীর গল্পের পেছনের গল্প যেন আরও গুরুত্বপূর্ণ। সেই গল্প না থাকলে এই ছবিকে নিতান্তই মনে হতো ব্যক্তি জীবনের কষ্ট-সমৃদ্ধ মেলোড্রামা; অশ্রু, আর্তনাদ আর বিষাদের সমাহার।

পাঁচজন ব্যক্তির জীবনের সংকট, হতাশার চেয়েও আমার মন হয় কেনজি মিজোগুচি বেশি বলতে চেয়েছেন সময়, রাজনীতি আর যুদ্ধের কথা। জাপানের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময় ছিল একেবারেই আলাদা। পরাজিত শক্তির অসহায় মানুষের দেশ। দু্’টি শহর তখনও পারমানবিক নৃশংসতায় জ্বলছে। সেই আগুন সারা জাপানজুড়ে মানুষকে শারীরিক, অর্থনৈতিক, মানসিক আর সামাজিকভাবে পুড়িয়ে মারছে দিনরাত। অভাব, অভিযোগের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। প্রতিদিন মানুষ একলা অথবা সপরিবারে আত্মহত্যা করছে। রাজধানীতে কর্মহীন, গৃহহীন জীবিত ও মৃত মানুষের স্তূপ। একটি পথের গল্প দিয়ে মিজোগুচি মূলত টোকিও শহরের প্রায় সব পথের কাহিনী জানাতে চেয়েছেন।

এখন প্রশ্ন—ছবির নাম নিয়ে : স্ট্রিট অফ শেইম। ‘ড্রিমল্যান্ড’র পথটি লজ্জার কেন? বা কার লজ্জার কথা বলতে চাচ্ছে ছবির এই কাব্যিক শিরোনাম?

যৌনতাকে পেশা হিসেবে নেওয়াটা বেশিরভাগ সমাজ, শহরেই ট্যাবু। বাংলায় ‘পতিতা’ শব্দের ব্যবহার এই পেশার মানুষের প্রতি অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়। ১৯৫০-এর দশকের জাপানও এর থেকে আলাদা নয়। তখনকার টোকিও শহরও পৃথিবীর অনেক স্থানের মতো অস্বস্তি বোধ করে এই নিয়ে। রাষ্ট্র, সরকার, সংসদ এরা আইন করে এই পেশাকে বিলুপ্ত করতে চায়।

তাহলে কি এই লজ্জা সমাজ আর রাষ্ট্রের?

অন্যতম যৌনকর্মী ইউমেকোর মধ্য বয়স। একমাত্র ছেলে বড় হয়ে প্রায় কর্মক্ষম। না জানিয়েই হঠাৎ একদিন ছেলে এসে হাজির মায়ের কর্মস্থলে। তখন রাত। মা সেজেগুজে প্রস্তত খদ্দেরের জন্য। এই অবস্থায় ছেলেকে দেখা দেয় না মা। ছেলে তখনও জানে না—‘ড্রিমল্যান্ড’ আদতে কেমন জায়গা, তার মা এখানে কী কাজ করে। ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়ার খানিক পরে সেই ছেলের জন্যই নববর্ষে নতুন পোশাক কেনার স্বপ্ন নিয়ে মা পথে বের হয়। আলোর চমক জাগা রাতের পথে মা খদ্দেরকে নানান প্রলোভনে ডাকছে—ছেলে আড়াল থেকে এই দৃশ্য দেখে ঘৃণা আর অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয়, কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়।

তবে কি এই রকম হাজার ছেলের লজ্জার অনুভূতি নিয়েই এই ছবি?

হ্যানেই নামের আরেকজন কর্মী—একদিন শেষ রাতে ঘরে ফিরছে। হঠাৎ সে তার শিশু সন্তানের অস্বাভাবিক কান্নার শব্দ শুনতে পায়। দৌড়ে ঘরে ঢুকে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যায় উদ্যত স্বামীকে কোনোরকমে ফেরায় সে। ‘যাই ঘটুক না কেন, আমাদের বাঁচতেই হবে’ বলতে বলতে হ্যানেই যখন ক্রন্দনরত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে, তার স্বামী তখনও ঘরের মেঝেতে মুখ গুঁজে আর্তনাদ করে যাচ্ছে—প্রচণ্ড অপরাধীর ভঙ্গিতে।

ছবির শিরোনামে মিজোগুচি কি তাহলে এই রকম স্বামীদের লজ্জার কথা বলত চেয়েছেন?

নতুন আসা তরুণ যৌনকর্মী মিকি একদিন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত—ঘুমাচ্ছে। তখনও দুপুর হয়নি। আরও একজন খদ্দের এসেছে ভেবে দরজা খুলে নিজের বাবাকে দেখতে পায় সে। বীতশ্রদ্ধ, বৃদ্ধ বাবা এসে মিকিকে তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ দেয়। মরে যাওয়ার আগে মেয়ের পরিণতির জন্যে মায়ের কষ্ট আর বিলাপের কথা বলতে বলতে বাবার চোখেমুখে রাগ আর ক্ষোভ জ্বলে ওঠে। মেয়েকে সে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। মিকি জানতে পারে বাবা আরেকটি বিয়ে করে ফেলেছে এরই মধ্যে। মিকি এরপর বাবার অপকর্মের বর্ণনা দিতে থাকে একে একে— মাকে ঠকিয়ে কীভাবে একাধিক অন্য নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক চালিয়ে গেছে বাবা। মিকির কণ্ঠে বিদ্রোহ আর প্রতিশোধের আগুন। ‘তুমি সারাজীবন ফূর্তি করে কাটিয়েছ। আমি তোমার দেখানো পথেই চলছি…’ বলতে বলতে বাবার উপর বজ্রের মতো ঝাপিয়ে পড়ে সে—যেন আরও একজন খদ্দের ঢুকেছে ঘরে। বাবা অপমানে, রাগে দৌড়ে দ্রুত বের হয়ে যায়।

স্ট্রিট অফ শেইম  কি তবে ছেয়ে আছে এমন কোন বাবার লজ্জায়?

অবশেষে রেডিওতে খবর আসে যৌনপেশা নিষিদ্ধকরণ আইন সংসদে পাশ হয় নাই। রাতে আবার কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে। লাজ-লজ্জা ভুলে কর্মীরা সব পথে নামে। ছবির শেষে দেখা যায় দরজায় দাঁড়িয়ে এক নতুন কিশোরী। এই পেশায় আজকেই তার প্রথম রাত। ভয়ে, লজ্জায় মুখ লুকিয়ে আছে। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ? জড়তা ভেঙে শেষমেশ কোনো এক খদ্দেরকে নরম সুরে ডাক দেয়—কাঁপা কাঁপা হাতে সংকোচভরা ইশারা!

আমার মনে হয় স্ট্রিট অফ শেইম নামটি আসলে আয়রনিক। মিজোগুচি আসলে লজ্জা পাওয়ার নয় লজ্জা ভাঙার গল্প বলেছেন। রাষ্ট্র থেকে শুরু করে পরিবার, ব্যক্তি জীবনে সংকোচের আগল ভাঙার একটা পরোক্ষ আহ্বান আছে ছবির পরতে-পরতে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আর রাষ্ট্রব্যবস্থার লজ্জাহীন দ্বিচারিতা, হীনমন্যতা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই ছবি আদতে প্রবল এক প্রতিবাদ!

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আজ নির্বাচন
বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতিআদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আজ নির্বাচন
আলোচিত কিশোরী ইয়াসমিনের মায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু
আলোচিত কিশোরী ইয়াসমিনের মায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু
বদির বিরুদ্ধে চেয়ারম্যানের জিডি
বদির বিরুদ্ধে চেয়ারম্যানের জিডি
ছেলের মৃত্যুর ৪ দিনের মাথায় চলে গেলেন বাবা, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া
ছেলের মৃত্যুর ৪ দিনের মাথায় চলে গেলেন বাবা, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা