X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমার চেতনার কবি

দুর্জয় খান
২১ জুন ২০২১, ১১:২৭আপডেট : ২১ জুন ২০২১, ১৭:২২

কবিতায় এইসথেটিজম এবং ডেকাডানস্ সম্পর্কে মার্কিন কবি এডগার অ্যালান পোর একটি চমৎকার মন্তব্য রয়েছে, `কোনো একটি কবিতা একমাত্র সেই কবিতার জন্যই লেখা হয়, আর কোনো উদ্দেশ্যে নয়।’ একজন কবির কাছে কবিতা হলো সবচাইতে মূল্যবান কারণ তা স্বয়ংসম্পূর্ণ যা অন্তরাত্মাকে নিখুঁত হয়ে ওঠা ছাড়া আর অন্যকোনো উদ্দেশ্য অবলম্বন করে না। কবিতায় অ্যালিগরি তথা রূপকের প্রভাবটিও সবচেয়ে বিদ্যমান। ভাষা, আকাঙ্ক্ষা থেকে সৃষ্টি হলে কবিতা সেই আকাঙ্ক্ষার অতিরিক্ত কিছু বহন করে চলেছে। যেমনটি বলা যায় অ্যালিউশনের ব্যাপারটি। ষাটের দশকের অন্যতম বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কবি নির্মলেন্দু গুণ কবিতাকে বহুমাত্রিক অর্থে তাৎপর্যময় করে তুলেছেন। সাধারণত তাঁর কবিতায় এমন সব অ্যালিউশন ব্যবহার করেছেন যা সরাসরি সমকালের যেকোনো পাঠক বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে সক্ষম। আত্মজীবনী ‘আত্মকথা ১৯৭১, ‘আমার কণ্ঠস্বর, ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক সত্যনিষ্ঠ দলিল। যারা বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে গবেষণা করবেন তাদেরকে অবশ্যই কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার সাহায্য নিতে হবে। ড. আহমদ শরীফ মন্তব্য করেছিলেন—‘এই কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে আমাদের আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলনের কাব্যিক দলিল। ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদরা এই গ্রন্থ থেকেও উপাত্ত সংগ্রহ করবেন।’

আমি যখন মাধ্যমিকের ছাত্র তখনই কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার সাথে আমার পরিচয় ঘটে। ‘স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ এই কবিতার মাধ্যমে আমি কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিসত্তার পরিচয় পাই। ছোট একটি কবিতায় অ্যাফরিজমকে এত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা এই কবিসত্তার পরিচয় পাবার পর আমি রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে থাকি। অ্যাপসট্রফি তথা কোনো ব্যক্তি, বস্তু কিংবা বিমূর্ত ধারণাকে প্রত্যক্ষ সম্বোধন করে কবি নির্মলেন্দু গুণ মৃতকে জীবন্ত, অমানবকে মানবীয় এবং অনুপস্থিতকে উপস্থিত রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতার এটিই হলো ফিগারেটিভ ভাষার একটি কৌশল। কবি নির্মলেন্দু গুণ কবিতায় জনান্তিক বিষয়টির সবরকম সূত্র নস্যাৎ করে দিয়ে সেটিকেই নতুন রূপে গঠন করেছেন। চরিত্র ও চিন্তার গোপন উচ্চারণকে স্পষ্ট উপস্থিতিতে সরাসরি খোলাসা করেছেন। নারীপ্রেম, যৌনতা, রাজনীতি, স্পষ্টনীতি কোনোটাকেই তিনি কম করে দেখেননি, উপলব্ধি করেননি। কবিতায় অ্যাটমসফিয়ার অর্থাৎ আবহকে নারীপ্রেমের চাদর দিয়ে এমনভাবে লেপ্টে দিয়েছেন যেখানে পাঠকচিত্ত কিংবা প্রেমিকচিত্তের সকল গতিধারাকে আনন্দময় কিংবা ভীতিকর কিংবা উদ্বেগাকুল একটি প্রত্যাশার চাদরে মুড়িয়ে দিয়েছেন। কবিতার ভাঁজে ভাঁজে এমনসব ধ্বনিবিশিষ্ট স্বরবর্ণের ব্যবহার দ্বারা শৈলিগত আবহনির্মাণ করেছেন যার প্রক্রিয়ায় পাঠকের ভেতরে অ্যাসোন্যান্সকে জাগিয়ে তুলেছে। একটি বিষয় স্পষ্ট সত্য যে, কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় সম্ভোগের বিষয়গুলো বাদ রাখা যায় না। এর একমাত্র কারণ হলো, তাঁকে নারী-পুরুষের মিলনের আনন্দ ও বেদনা সবসময় তাড়িত করেছে। মূলত যৌনতা মানুষের এমন এক সীমাবদ্ধতা যা একা কখনো সম্পাদন করা যায় না। এক্ষেত্রে কবি নির্মলেন্দু গুণ কবিতা ও যৌনতার সূক্ষ্ম সুতোয় নিরবচ্ছিন্ন হেঁটেছেন। বস্তু ও দৃশ্যমান জগতের সারল্য সিদ্ধান্তকে তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। একপায়ে খাড়া হয়ে নরকেও যাবার বাসনা রেখেছেন। বাংলা কবিতায় আমি মনে করি,  কবি নির্মলেন্দু গুণ নিন্দিত ও নন্দিত। আমি তার কামকলা কাব্যের নিন্দা, প্রশংসা, যুক্তিতে যেতে চাই না, তবে এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, বাংলা ভাষা ও শব্দের রূপকল্পসমূহ সামাজিক কাঠামো বিনির্মাণের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠেছে। 

বিমোক্ষণের দিক থেকে চিন্তা করলে হয়তো আমিই তাঁর প্রজন্মের শেষ পাঠক। এই যে এক পুঞ্জীভূত আবেগ তা আমার ব্যক্তিচিত্তে আনন্দ ও স্বস্তি এনে দিচ্ছে। এই বিমোক্ষণের দ্বারাই আমার ভরাক্রান্ত মন হালকা হয়ে আসছে। তাঁর কবিতার ঔজ্জ্বল্য ও মহৎ চরিত্রের আবিষ্কার আমার মতো পাঠকচিত্তে ক্যাথারসিসের ভাব জাগাচ্ছে। কবিতা যে শোভন, মার্জিত, বৈদগ্ধ্যমণ্ডিত এবং হালকাভাবে প্রেম-ভালোবাসার প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে তা আমি সহসাই টের পেয়েছি! রচনারীতির নিয়মকানুন, প্রথাসমূহ ও বিষয়বস্তুর প্রভৃতির কথায় যদি ধরি তাহলে বলতে হবে এ এক আকস্মিক বিস্ফোরণ আমার ভেতরে। উপলব্ধির শেষ সীমান্তে আদৌ পৌঁছাতে পেরেছি কি না জানি না, তবে কবি নির্মলেন্দু গুণের বিমূর্ততার চাইতে সুস্পষ্ট ঘনসন্নিবদ্ধ মূর্ততাকে সাধারণভাবে মস্তিষ্কে জায়গা করে নিয়েছে। তাঁর গতিবল কোনদিকে ছুড়েছে কিংবা দর্শনকে কাব্যিক শব্দসম্ভার দিয়ে কোনদিকে ঠেলেছেন তা বলার অপেক্ষা না করে বলাই যায় যে, বিমূর্ত গুণাবলিকে স্পষ্ট ও মূর্ততার উপমায় চিত্রকল্পের ক্ষেত্রে অনেকটা ঋজু সংহতি আনয়ন করেছেন। প্যাটার্ন কবিতার যে দৃষ্টিগ্রাহ্য আকার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ষাটের দশকের পর পুরো ফর্মকে কবি নির্মলেন্দু গুণ নানান আকার দিয়ে শানিত করেছেন। আকর্ষণীয় ও প্রীতিপদ ধ্বনিকে ভাবের সমাবেশ ঘটিয়ে অ্যাসোন্যান্সের বিপরীতে কনসোন্যান্সকে দৃঢ় অবস্থানে টেনে তুলেছেন। কবিতায় বৈষম্য ও বৈসাদৃশ্য প্রদর্শনের জন্য তিনি চিত্রকল্প থেকে কিংবা ধারণার ভাব থেকে বিচ্যুত হননি। ক্রিটিসিজমকে এমন স্পষ্ট করে তুলতে আমি আর কোনো কবিকে দেখিনি আজ পর্যন্ত। আর এই দর্শনটি তাঁর প্রজন্মের শেষ পাঠককে নিঃসন্দেহে আকর্ষিত করেছে। অন্তত ‘আমি কী' এই ধারণাকে স্পষ্ট করে তরুণ প্রজন্মকে শিখিয়ে দিয়েছেন দ্ব্যার্থহীন চিন্তার কথা। ভাষা নির্মাণ ও মূল্যায়নের যে তত্ত্বীয় মার্গ রয়েছে সেটাকে তিনি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে তরুণকে শিখিয়েছেন মূল্যায়নের মানদণ্ড। কবিতাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সুস্পষ্ট অর্থব্যঞ্জক শব্দগুচ্ছ দ্বারা সাম্প্রতিকালের সকল আবহকে ভেঙে ফেলতে সফল হয়েছেন। এজন্যই তিনি সুস্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘কবিতা আমার নেশা, পেশা প্রতিশোধ গ্রহণের হিরন্ময় হাতিয়ার! আমি কবি, কবি এবং কবিই।’

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী