X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

কামাল চৌধুরীর কবিতায় বঙ্গবন্ধু

দিপন দেবনাথ
১৫ আগস্ট ২০২১, ০০:০৬আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২১, ০০:২২

সুদীর্ঘ কাল ধরে নির্যাতিত-নিপীড়িত বাংলার মানুষের মুক্তির রাজটিকা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মধুমতীপাড়ের খোকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্ত আকাশ, স্বাধীন পতাকা, মুক্ত বাংলা জননী—এই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আন্দোলন, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে রাজনীতির এই মহাকবি তাঁর কণ্ঠের বজ্র নিনাদ বাজিয়ে, অঙ্গুলির বরাভয়ে সমস্ত কিছুকে জাগিয়ে বাঙালির জন্য রচনা করেছিলেন ‘বাংলাদেশ’ নামক অনবদ্য এক মহাকাব্য। অথচ সেদিন—১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট, আলো-আঁধারি বেলায় এই মাটিরই কিছু কুসন্তান ভিনদেশি মগজের ক্রীড়ানক হিসেবে বাংলার ধ্রুবতারাকে সপরিবারে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে নৃশংসভাবে হত্যা করে এ দেশের আকাশে-বাতাসে মেখে দেয় অপরিমেয়, দুঃসহ বিষবাষ্প। সময় যেন থমকে যায় ইতিহাসের ঘৃণ্য এক মুহূর্তে। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ হয়ে যায় নিষিদ্ধ।
বঙ্গবন্ধু তো শুধু কোনো ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ছিলেন আদর্শ—মুক্তিকামী, অপরাজেয়, সকল অন্যায়কে তুচ্ছ করে মাথা উঁচু করে দাড়ানোর অবিনাশী চেতনা। তাই তো সেইরকম এক প্রতিকূল অবস্থায় তাঁর আদর্শ ও চেতনাকে বুকে ধারণ করে দুরন্ত এক যুবক কবি কামাল চৌধুরী লিখেন—‘রক্ত দেখে পালিয়ে গেলে/ বক্ষপুরে ভয়, ভাবলে না কার রক্ত এটা/ স্মৃতিগন্ধময়, দেখলে না কার জন্ম-মৃত্যু জাতীয়তাময়’; (জাতীয়তাময় জন্ম-মৃত্যু, ৯ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৭)। এই কবিতাটি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রথম প্রকাশিত কবিতা। সেই থেকে আজ অবধি তিনি লিখে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর জীবন, অর্জন ও সংগ্রাম নিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবি কামাল চৌধুরীর লেখা অধিকাংশ কবিতায় পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে দুঃসাহসী প্রতিবাদের কাব্যভাষা। 

বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী উত্তাল সময়ে কবি কামাল চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত টগবগে যুবক। বুকের ভিতর জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধের লেলিহান শিখা। তাঁর লেখা স্লোগান ‘মুজিব লোকান্তরে, মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে’ ছড়িয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়, নগর-মহানগরের দেয়ালে দেয়ালে; প্রতিশোধের আগুনে প্রজ্বলিত করে তরুণ সমাজকে। ১৯৭৭ সালের ২৬ মার্চ আদমজী জুটমিলে স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রকাশ্য প্রতিবাদ এবং কবিতা পাঠ করে দুঃসাহসের পরিচয় দেন তিনি। তিনি মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মের কাছে বাংলা ও বাঙালির অস্তিত্ব চিরঋণী এবং সে ঋণ কবি আজীবন স্বীকার করেছেন। তাঁর ‘তোমার মৃত্যুর কথা মনে হলে’ কবিতায় তাই দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন—‘আমি সেই বেদনার হাত রেখে কাঁদি/ জল-চোখে একজন ব্যথিত তরুণ হয়ে/ তোমার জন্মের কাছে ঋণী হয়ে যাই/ আজীবন শ্রদ্ধাভরে নতজানু থেকে/ প্রিয় সেই জন্মকে লালন করি ভেতরে ভেতরে’। 

কবি কামাল চৌধুরী নিজেকে মুজিবের লোক পরিচয় দিয়েছেন, পরিচিত হয়েছেন—‘আমরা ব-দ্বীপের লোক/ আমরা ভাত ও মাছের স্বপ্নে বেঁচে থাকি/ আমরা মুজিবের লোক’; (বিজয় দিবস)। বঙ্গবন্ধুর মুখ কবিতার বড়ো ছিল কেননা, সেই মুখখানি স্বাধীনতাপ্রিয় ছিল, সেই মুখখানি মিছিলে মানব হতো, শিশিরের কাছে পদচিহ্নের মতো সেই মুখখানি ফিরে ফিরে আসে (সেই মুখখানি কবিতার বড়ো ছিল)। পৃথিবীর ঘাসজুড়ে তাঁর সেই বজ্রকণ্ঠ জেগে থাকে (একজন প্রেমিকের কথা)। তাঁর বজ্রকণ্ঠ কবিকে শিখিয়েছে যৌবনের গান (তোর জন্য নাম)। 

কবি কামাল চৌধুরী বলেন মার্চ বাঙালির জন্ম মাস। মার্চ বাংলার মানুষের জাগরণের মাস। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে চূড়ান্ত পটপরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়ার সময় লাখো জনতার মিছিলে উপস্থিত কিশোর বালক কামাল চৌধুরী। সেই অগ্নিঝরা ভাষণের স্মৃতি নিয়ে তিনি তাঁর ‘মার্চ’ কবিতায় লিখেছেন—মার্চ এসে গেছে শেখ মুজিবের নামে/ মার্চের ভাষা সাহসের তর্জনী/ জনসমুদ্রে স্বাধীনতা স্বাধীনতা/ আকাশে বাতাসে জয়বাংলার ধ্বনি... এই মার্চ মানে মুক্তি ও স্বাধীনতা/ এই মার্চ মানে বাঙালির জয়গান/ স্বদেশ আমার, সাহসে ও সংগ্রামে/ আমরা সবাই মার্চের সন্তান।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর; দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ মুক্তি লাভ করে। কবি তাঁর ‘নিয়াজি যখন আত্মসমর্পণ লিখছে’ কবিতায় লিখেছেন—‘এই দৃশ্য বজ্রকণ্ঠ, মুজিবের সাহসী তর্জনী/ এই দৃশ্য চির উন্নত মম শির’। কিন্তু যার নামে এদেশের মুক্তিকামী মানুষ যুদ্ধ করেছে, যার তর্জনী স্ফুলিঙ্গে উদ্দীপ্ত হয়ে পুরো বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল; তিনি তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি; বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাধীন স্বদেশে ফিরে আসেন; কিশোর কামাল চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন রেসকোর্স ময়দানের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে; যখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দ্যাখো, আমি মরি নাই। তোমাদের ভালোবাসা আজ আমাকে ফিরিয়ে এনেছে।’ সেদিনের স্মৃতি নিয়ে কবি লিখেছেন— 
যেদিন তিনি ফিরে আসলেন, সেদিন
শীতার্ত আলো হাওয়ার মধ্যে ঋতু বদল হলো স্বদেশের
ঝরাপাতায় জেগে উঠলো বসন্ত
......
তখন সারা বাংলায় অপেক্ষায় অধীর মানুষ
প্রতিটি হৃদয় স্পন্দিত বজ্রকণ্ঠে
পিতার জন্য করছে সন্তান
বন্ধুর জন্য ভাই
নেতার জন্য মুগ্ধ অনুসারী
জনকের জন্য আবহমান এক দেশ। (১০ই জানুয়ারি ১৯৭২)

বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়ি ছিল বাংলার মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল, সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের নিশ্চিন্ত ঠিকানা এবং বাংলা জননীর মুক্তির আঁতুরঘর। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে এই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাই জাতির পিতার হন্তারকেরা হয়তো ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের জন্য এই বাড়িকেই বেছে নিয়েছিল। কিন্তু তারা পারেনি জাতির আত্মপরিচয়ের এই ঠিকানা মুছে দিতে। কবি তাই তো তাঁর ‘বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়ি’ কবিতায় লিখেছেন—‘এই বাড়িটার জাতির পিতার, এই বাড়িটার সবার/ এই বাড়িটা মুজিব নামের পলাশ, রক্তজবার... এই বাড়িটা তোমার আমার আত্মপরিচয়/ এই বাড়িটা বঙ্গবন্ধু, জাতির হিমালয়’।

কবি কামাল চৌধুরী তাঁর অধিকাংশ কবিতায় পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন—আমি প্রতিশোধ নেবো/ আমার রক্ত ও শ্রম দিয়ে/ এই বিশ্বের মাটি ও মানুষের দেখা/ সবচেয়ে মর্মস্পর্শী জঘন্য হত্যার আমি প্রতিশোধ নেবো; (টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে)। ‘টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে’ কবিতাটি ১৯৭৮ সালে লেখা। তিনি আরও লিখেছেন—পাঁজরের হাড়ে আগুন জ্বালিয়ে আছি/ ছাড়বো না আমি কিছুতেই ছাড়বো না/ যতদিন বাঁচি গোত্রের প্রতিশোধ/ রক্তবর্ণ ক্রোধ জ্বেলে জ্বেলে নেবো; (প্রতিশোধ)। ‘বীরের এ রক্তস্রোত’ কবিতায় তিনি লিখেছেন—জনক মরতে পারে, কিন্তু তাঁর চেতনা মরে না... দশ কোটি, বারো কোটি, শত কোটি অগ্নিপুত্র বাড়ে/ জননী বাংলায় তারা স্থপতিকে অর্ঘ্য দিয়ে যায়। তিনি তাঁর ‘টুঙ্গিপাড়ায় ঘুমাও বাংলাদেশ’ কবিতায় লিখেছেন—‘তবু আমি রক্তলেখা লিখি/ তবুও লিখি অশ্রু-সরোবর/ একটি ঝরাপাতার পাশে লিখি/ শোকার্ত ফুল, স্মৃতিও মর্মর’।

সময়ের পথ ধরে জাতির পিতাকে হারানোর ব্যথা ফিরে ফিরে আসে কবির অনুভূতিতে। লিখছেন—‘এখানে করুণ মৃত্যু নামে ঘাতকের ঘৃণ্য হাতে অকস্মাৎ/ ঋতু বদলের মতো বারবার ফিরে আসে পরাজিত মুখ/ আমরা হারাই তাঁকে যাকে পেয়ে দেশ পেলো ভোরের সুষমা; (এখনো দাঁড়িয়ে ভাই)।

কবি তাঁর কাব্য-প্রার্থনায় আবার ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন টুঙিপাড়ায়, ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন সেই বাঙালির ভোর—‘আবার দেখা হবে টুঙ্গিপাড়ায়/ আশ্চর্য শব্দের গায়ে ঝরে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা বিনম্র আকাশ/ সেখানে প্রতিদিন তোমাকে লিখছে বাংলা কবিতা/ মহাদেশ পাড়ি দিচ্ছে তোমার মুক্তির মন্ত্র, জাতিরাষ্ট্র, জাগরণ/ বাঙালির ভোর; (আবার দেখা হবে)’। টুঙ্গিপাড়ার মাটি বাংলার মানুষের চির শক্তি, সাহস ও প্রেরণার উৎস, যেখানে বাংলার মহাকবি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে আছেন। এই পবিত্র মাটি নিয়ে কবি লিখেছেন—‘যেখানে ঘুমিয়ে আছ, শুয়ে থাকো/ বাঙালির মহান জনক/ তোমার সৌরভ দাও, দাও শুধু প্রিয়কণ্ঠ/ শৌর্য আর অমিত সাহস/ টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামগুলো/ তোমার সাহস নেবে/ নেবে ফের বিপ্লবের দুরন্ত প্রেরণা (টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে)’। টুঙিপাড়ার সেই পবিত্র মাটি আজ মিশে গেছে আজ বাংলার সমস্ত পলি মাটিতে; মিশে আছে বাংলার অনুভবে এবং নিশ্বাসে। অশ্রু, শোক ও রক্তের স্রোত পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু কোথাও নেই; মিশে গেছেন বাঙালির শাশ্বত ও অবিনাশী প্রেরণায়। কবি কামাল চৌধুরী তাঁর ‘কোটি মানুষের অনুভবে’ কবিতায় লিখছেন— 
আমারও কবিতা নিবেদন করি তোমাকে
তোমার মৃত্যু কোথাও যে দেখি না আমরা
অশ্রু ও শোক, রক্তের স্রোত পেরিয়ে
কোটি মানুষের অনুভবে আছো জীবিত।
                     
তথ্যসূত্র
১। কামাল চৌধুরী, টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে, অন্য প্রকাশ, ঢাকা (২০২০);
২। কামাল চৌধুরী, স্থব্ধতা যারা লিখে গেছে, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি., ঢাকা (২০২১)।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাজশাহীতে বইছে তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগী
রাজশাহীতে বইছে তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগী
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ