X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
ঈদসংখ্যা ২০২২

নয় দেশের ১০টি ফ্ল্যাশ ফিকশন

অনুবাদ : কবির চান্দ
২১ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০

সাপ। এরিক রুগারা, কেনিয়া

সবার আগে একটা বাচ্চা ওটাকে দেখল। অন্যরা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্পে মশগুল ছিল। এসময় বাচ্চাটা চিৎকার করে উঠল, ‘সাপ! সাপ!’ বাবা মাসাই উপজাতির খাঁটি যোদ্ধার মতো ক্ষিপ্র গতিতে উঠে দাঁড়ালেন। ‘কোথায়?’ ‘ওই তো, ওখানে।’ বাচ্চাটা হাতের আঙুল দিয়ে যে দিকটায় দেখাল সেখানে একটা ধূসর দেয়াল। দেয়ালটাতে, জানালার উপরে আর দরোজার পাশে একটা কুচকুচে কালো লম্বা জিনিস পিছলিয়ে পিছলিয়ে এগুচ্ছিল। বাবা দেয়াললাগোয়া টেবিলে লাফ মেরে উঠলেন, উত্তেজনায় তার শিরাগুলো ফুলে গেছে। ‘জলদি আমাকে একটা লাঠি দাও!’ তিনি চিৎকার করলেন। মা বের হয়ে গেলেন আর সঙ্গে সঙ্গেই বাঁশের একটা লম্বা লাঠি নিয়ে এসে তাঁকে দিলেন। লড়াইয়ের যে প্রতিভা বাবার মধ্যে লুকিয়ে ছিল তা চাগিয়ে উঠল। সর্বোচ্চ দক্ষতা আর অবাক করা নৈপুণ্যে তিনি লাঠিটা ব্যবহার করলেন। তিনি ঘুষি মারার মতো সহজাত ভঙ্গিতে এমনভাবে এটাকে সাপটার মাথা বরাবর নামিয়ে আনলেন যেন লাঠিটা তাঁর হাতেরই বর্ধিত অংশ। সাপটা দেয়াল থেকে মেঝেয় পড়ল। বাবা টেবিল থেকে লাফিয়ে নেমে লাঠিটার উল্টো মাথা দিয়ে সাপটাকে ঠেলে দিতে লাগলেন। ‘সাবধান!’ কেউ একজন বলল। সাপটা ছোবল দিচ্ছিল, কিন্তু বাবা অত্যন্ত দ্রুত শরীরটাকে পিছিয়ে নিলেন আর মাথা বরাবর বাড়ি মারলেন। লাঠির ডগায় সাপটাকে তুলে সর্বশক্তি দিয়ে বাইরে ছুড়ে মারলেন। ওটা হিসহিস করতে করতে বাতাসে ভেসে আঙিনায় গিয়ে পড়ল। ‘দেখো যেন ওটা ঘাসে চলে যেতে না পারে,’ কেউ একজন বলল, ‘একবার ঘাসে ঢুকে গেলে দেখা যাবে না, আর ওটা বিদ্যুতের মতো আচমকা ছোবল মারবে।’ কিন্তু বাবা যেন তখন অন্য জগতে। দুহাতে লাঠিটাকে শক্ত করে ধরে মাথার ওপর তুললেন। সাপটা তাঁকে কামড় দেওয়ার চেষ্টা করল আর তিনি ওটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত সমানে লাঠি চালালেন। নিষ্ঠুরভাবে বাড়ি মেরেই চললেন, যতক্ষণ না শরীর চূর্ণ হলো আর ওটা মারা গেল। মারের চোটে সাপটার এখানে-ওখানে চামড়া উঠে গেল আর মাথাটা চিবুনো মাংসের মতো দলাদলা হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘চলো এটাকে পুড়িয়ে ফেলি।’ মা ভেতরে গেলেন আর একবাটি তেল ও একটা লাল দেশলাই নিয়ে এলেন। বাবা সাপটাকে লাঠিটার মাথায় পেঁচিয়ে সামনে এগুলেন আর সবাই তার পিছনে পিছনে গেল। ওটাকে ময়লার গর্তে ফেলে তেল ঢালা হলো। আগুন জ্বলে উঠলে সাপটার চামড়া যেন জীবন্ত হয়ে উঠল, একইসঙ্গে ঝলসাতে এবং পুড়তে পুড়তে ওটা এঁকেবেঁকে কুণ্ডুলি পাকাতে থাকল। সবারই, বিশেষ করে সেই মূহূর্তের দুই বীর, বাবা আর সেই বাচ্চাটার খুব ভালো লাগছিল। বাচ্চাটাই প্রথম সাপটাকে দেখেছিল আর বাবা ওটাকে পিটিয়ে মেরেছিল। আশপাশের সবাই বাড়িটাতে জমায়েত হলো। একটা জগে নতুন করে বানানো চা দেওয়া হলো, আর সবাই নিজনিজ কাপে চা ঢালতে ঢালতে কথা বলতে লাগল। তাদের গল্পের বিষয় সে মূহূর্ত, সে আবেগ, সে কাজ আর বেঁচে থাকার সে অনুভূতি যা তারা তখন অনুভব করছিল। 


একজন কুৎসিত মানুষ। মার্সেলা ফুয়েন্তেস, যুক্তরাষ্ট্র

দুপুরের খাবার খেতে বসে মেয়েটা ঠিক করল যে লুইসকে বাদ দেবে। তাঁর বদলে সে গ্রহণ করবে ডানিয়েল টাওয়েনসকে, যে কি না এই কাউন্টির সবচেয়ে কুৎসিত মানুষ।
মেয়েটা লুইসের সঙ্গে শহরের উপকণ্ঠে একটা ক্যাফেতে ঢুকল। লুইস অবশ্য ক্যাফেটা পছন্দ করে না। সে জানালার পাশে একটা টেবিল বেছে নিল, যেন পার্কিং মিটারের দিকে নজর রাখা যায়। লুইস যেখানে গাড়ি রাখতে চেয়েছিল সেখানে আগেই কে যেন একটা পুরনো ট্রাক রেখে দিয়েছে। সে গজগজ করতে থাকল যে ওটার চালক বোধ হয় ক্যাফেটার ক্রেতাও নয়। লুইসের ধারণা ফ্যাশানবাতিকে ভোগা লোকজন, খুব শিল্পজ্ঞান আছে এমন ভাব ধরা ল্যাটিনো আর মেয়েটার মতো নাক-উঁচু স্প্যানিশ, এরা ছাড়া আর কেউ এ ক্যাফেতে আসে না। যে স্যান্ডউইচ চাইলেই বাসায় বানিয়ে নেওয়া যায়, সেটার জন্যও তারা এখানে দৌড়ে আসে। সব টাকা উড়ুনোর দল, সে মনে মনে ভাবে। লুইস রাগি রাগি ভাব করে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে।
ডানিয়েল টাওয়েনস রাস্তার ওপারের ঋণপ্রদান সমিতির কার্যালয় থেকে বের হয়ে আসে। সে ফুটপাতে দাঁড়ায় আর অপেক্ষা করে কখন যানবাহনের ভিড় কমে আসবে। সে ঢ্যাঙঢ্যাঙা লম্বা আর তার চামড়া একেবারে রোদে পোড়া। ভেতরের পোশাককে ময়লা থেকে বাঁচানোর জন্য পা থেকে কাঁধ পর্যন্ত ধূলিমাখা, সবুজ রঙের একটা অখণ্ড ইউনিফর্ম, যার পকেটে ‘জাতীয় পার্ক সার্ভিস’ কথাটা সেলাই করা। দাঁতগুলিও বিচ্ছিরিভাবে সাজানো, দেখে মনে হয় যেন কয়েকটা বিদঘুটে পুরনো কাঠের টুকরো এবড়োথেবড়োভাবে বের হয়ে এসেছে।
ব্যাটা বদখত একটা! লুইস ভাবে। ডানিয়েল যে মেয়েটার সঙ্গে মধুর ব্যবহার করে সেটা ভেবেও সে মজা পায়। মেয়েটা যখন ভ্রু কুঁচকায় সে তখন হাঙরের মতো দাঁত কেলিয়ে হাসে, সেটা একইসঙ্গে ধারালো অথচ নরম। ব্যাটা কুৎসিত! লুইস আবার বলে, আর গরুর পোড়া গোশত দিয়ে বানানো স্যান্ডউইচে কামড় দেয়। 
মেয়েটা লুইসকে নিষ্ঠুর হতে মানা করে না। সে ঠান্ডা লেবুপানীয়ে চুমুক দিতে থাকে। ঠোঁটে লাগানো নলের চারপাশে তার মুখ কুঞ্চিত হয়। ভান করে যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না, যদিও পাশের টেবিলে বসা দম্পতি ঘাড় ঘুরিয়ে লুইসের দিকে তাকায়। নিঃস্পৃহতা দেখানোর চেষ্টায় মেয়েটার মুখ কঠিন হয়ে যায়, যেন তার ওপর নদীতলের বালির মতো মসৃণ একটা প্রলেপ পড়েছে।
ডানিয়েল মরুভূমিতে খনিজ পাথরের এলাকায় ঘোরে আর ব্রাশ দিয়ে ঘষাঘষি করে। সে পাহাড়ি হাঁটা পথে অভিযাত্রীদের পথ দেখায়, শিল্পী আর নৃবিজ্ঞানীদের নিয়ে ঝোপঝাড়ে অভিযানে বের হয়, নানা রকম ছত্রাক আর ক্যাকটাসের জাত বের করে আর গুহায় গুহায় পাথর খোদাই করে তৈরি প্রাচীন শিল্পের খোঁজ করে। কিন্তু এই রাস্তাটা পার হবার সময় তার মুখ থাকে নিচের দিকে, তার মুরগির মতো চিকন কাঁধ সামনের দিকে ঝুঁকে আসে আর তার জামার সবুজ কলারে গোছা গোছা চুল এলোমেলো ঝুলতে থাকে।
ডানিয়েল থামে। তার পিঠ ক্যাফেটার জানালার দিকে। সে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে চাবি বের করে আনে। দেখা যায় যে শুকনো মাটি লেগে থাকা সাদা রঙের ছোট্ট ট্রাকটা তারই। লুইস জানালার কাচে ঠকঠক করে আর হাত নাড়ায়। ডানিয়েল তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায়। মুখে ঠোঁটচাপা অনিশ্চিত হাসি। 
তুমি অদ্ভুত, মেয়েটা উঠতে উঠতে লুইসকে বলে। সে ক্যাফে থেকে বের হয়ে আসে। এই, এই, এই―লুইসের মুখ থেকে শব্দগুলো যেন প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে হ্যাচকা টানে বের হয়ে এল। 
ডানিয়েল, মেয়েটা ডাকল। সে তার কাছে গেল, এতটাই কাছে যে ডানিয়েলের মাথা উল্টো দিক থেকে আসা বিকেলের রোদ ঠেকিয়ে দিল। তার গায়ে রুক্ষ বুনো গন্ধ। চোখ মেঘের ছায়ার মতো মৃদু আর মমতাময়। তার মুখের ওপর মেয়েটা মুখ রাখল, এবং ঠোঁটজোড়া দিয়ে ডানিয়েলের এবড়োখেবড়ো দাঁতগুলো ঢেকে দিলো।


মক্ষিকুলের দেবতা। মার্কো দেনেভি, আর্জেন্টিনা

মাছিরা তাদের দেবতা কল্পনা করেছিল। সে দেবতাও ছিল একটা মাছি, যার রং কিনা এই সবুজ, এই কালো, এই সোনালি, এই গোলাপি, এই সাদা, এই বেগুনি। আর যাকে কি না বোঝা যায় না। যে সুন্দর, আবার দৈত্যের মতো ভয়ংকরও, যে উপকারী আবার প্রতিশোধপরায়ণ, যে বুড়ো নয় কিন্তু ন্যায় বিচারে সক্ষম। তবে সব সময়ই দেবতা একটা মাছি। কেউ কেউ তার আকার সম্পর্কে এতটাই রঙচঙ লাগায় যে তাকে একেবারে ষাঁড়ের সঙ্গে তুলনা করে, আবার কেউ বলে যে তার আকার এতটাই ছোটো যে দেখা যায় না। কেউ কেউ বলে যে মাছি হলেও তাঁর পাখা নেই। তাদের মতে তিনি ওড়েন, কিন্তু পাখার দরকার পড়ে না। আবার কেউ বলে যে তার অগণিত পাখা আছে। একজায়গার মাছিরা বিশ্বাস করে তাঁর শিঙের মতো অ্যান্টেনা আছে, আবার অন্য জায়গার মাছিদের বিশ্বাস তার পুরো মাথার চারপাশে শুধু চোখ আর চোখ। কেউ মনে করে তিনি সারাক্ষণ ভনভন করেন, আবার কারও মতে তিনি একদমই চুপ থাকেন, কিন্তু একইরকমভাবে যোগাযোগ করতে পারেন। তবে প্রত্যেকেই বিশ্বাস করে যে, কোনো মাছি মারা গেলে তিনি তাকে স্বর্গে নিয়ে যান। স্বর্গ হলো গলিত আর দুর্গন্ধময় পচা মাংসের ঢিবি। মাছিদের আত্মা অনন্তকাল এটাকে কামড়াতে পারবে, কিন্তু খেয়ে শেষ করতে পারবে না। মাছিদের ঝাঁকের নিচে ওই স্বর্গীয় জঞ্জাল সবসময়ই বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এ সুবিধা অবশ্য কেবল ভালো মাছিদের জন্য। খারাপ মাছিদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা। তারা নরকে যাবে। অভিশপ্ত মাছিদের গন্তব্য সেই নরকে কোনো বিষ্ঠা নেই, আবর্জনা নেই, ময়লা বা পচা কিছুও নেই। বলতে গেলে সেখানে কোনোকিছুরই কোনোকিছু নেই। পরিষ্কার ঝকঝকে তকতকে একটা জায়গা, আর সেখানে উজ্জ্বল সাদা আলো জ্বলছে। অর্থাৎ দুষ্টু মাছিদের শাস্তির উপযুক্ত জায়গা। 


মান বাঁচানোর হত্যাকাণ্ড। কিম ইয়ং-হা, দক্ষিণ কোরিয়া

মেয়েটার বয়স ছিল একুশ। গায়ের রঙ ফর্সা, সুন্দর। প্রসাধন ছাড়াই তার মুখ জ্বলজ্বল করত, সবসময় তা থেকে রোদে শিশিরবিন্দুর মতো দীপ্তি বেরুত। ঠিক এ কারণেই চর্মরোগবিশেষজ্ঞের চেম্বারে তাকে অভ্যর্থনাকারীর চাকরি দেওয়া হয়েছিল। কাজটা ছিল সোজা। কেবল রোগীর নাম লেখা, আদুরে গলায় ‘নাম না ডাকা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন’ বলা, আর তাদের ফাইল বের করে নার্সের হাতে দেওয়া। তার আলোকোজ্জ্বল আরক্ত ত্বক চেম্বারটির প্রতি সবার আস্থা বাড়িয়ে দিত। শীঘ্রই রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল। 
কিন্তু একদিন তার চেহারা জৌলুস হারাতে শুরু করল। প্রথমে একটা ছোটো ফুসকুড়ি দেখা দিলো এবং তা বড় হতে হতে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। কারণটা কেউই ধরতে পারল না। ডাক্তার ছিল বয়সে তরুণ। সে ব্যাংক ঋণ নিয়ে চেম্বার শুরু করেছিল। গোড়ার দিকে সে ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিষয়টাকে কঠিনভাবে নিতে বাধ্য হলো। মেয়েটার প্রতি ডাক্তারের মনোযোগ যত বাড়ল, তার অবস্থা ততই খারাপ হতে থাকল। পুরোটা মুখ লাল দাগে ভরে গেল, আর দেখতে হলো যেন দূর থেকে আনা ছোপছোপ দাগওয়ালা কোনো পিৎজা। ডাক্তার হতাশায় নিজের চুল ছিঁড়ল আর সেবিকারা অভ্যর্থনাকারীকে ঘেন্না করতে লাগল। বসন্তের এক সকালে ‘আমি দুঃখিত, সবার কাছে ক্ষমা চাই’ নোট লিখে মেয়েটা আত্মহত্যা করল। চেম্বারে নতুন অভ্যর্থনাকারী নিয়োগ দেওয়া হলো। তার চামড়া এতই উজ্জ্বল যে তাকে দেখে সবাই চোখ বুজে ফেলতে বাধ্য হতো।


ইশারা। বেস উইন্টার, কানাডা

একের পর এক কয়েকজন বিবাহযোগ্যা গবেষক তাকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর কোকো নামের গরিলাটা শিখতে পেরেছিল কোন ইশারা করলে স্তনের বোঁটা বোঝায়। সে তার ভারী হাতদুটো বুকের কাছে আনে, আর চর্মবহুল তর্জনীটা আজকের স্নাতক শ্রেণির সরলমনা ছাত্রীটির বুকের দিকে তাক করে। কোকোর বানরের মতো চেহারায় একটা প্রত্যাশার ছাপ পড়ে। কখনও তার দৃষ্টি ছাত্রীটির বোতামখোলা কলারের নিচ থেকে বিশ্বাসঘাতকের মতো বের হয়ে আসা গলার হাড় বেয়ে হালকা ঢালু অংশের ওপর পড়ে, আবার কখনো-বা তা কাঁধে পাক খেয়ে শুয়ে থাকা চুলের গোছায় নিবদ্ধ হয়। কখনো-বা সে ড. টমাসের দিকে চোখ ফেরায়, যেন জিজ্ঞেস করছে সবকিছু ঠিকঠাকমতো করছে কি না।
সবসময় যেরকম ঘটে, এ ছাত্রীটিও ড. টমাসের দিকে তাকায়। আমার কী করা উচিত? আমার কী বলা উচিত?
কোকো স্তনের বোঁটার দিকে ইশারা করে। 
যেরকম সবসময় বলে থাকেন, ড. টমাস এবারেও বলেন যে মাইনে দিয়ে রাখা গবেষকের যা দায়িত্ব ছাত্রীটির তাই করা উচিত । তার উচিত কোকোর ইচ্ছা পূরণ করা এবং তা নিয়ে গবেষণা করা।
অন্যদের সময়ও যেরকম ঘটে, অনুরোধটি রাখবে কি না তা নিয়ে মেয়েটি বেশ কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে লড়াই করে। ড. টমাস অস্থিরভাবে তার পেন্সিল নাড়াচাড়া করতে থাকেন। কখনো খাতার ওপর ঠোকেন, কখনও দুআঙুলের ভাঁজে পাক খাওয়ান। তিনি এটা চালিয়ে যেতে থাকেন, যতক্ষণ না ছাত্রীটি একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিচের দিকে তাকায় আর কাঁপা কাঁপা হাতে ব্লাউজের বোতাম খুলে। 
তারপর সেই সময়টা আসে। মেয়েটি উপরের আবরণ সরিয়ে ব্রায়ের হুকে হাত দেয়। সেই সময়টাও আসে যখন সে ব্রাটা খুলে তার পাশে টেবিলের ওপর অথবা চেয়ারের কোনায় ঝুলিয়ে রাখে। 
ড. টমাস জানেন যে স্নাতক পর্যায়ে দুই ধরনের ছাত্রী আছে। একদল তাদের পাশে টেবিলের ওপর ব্রা রাখে আরেকদল তাদের পেছনে চেয়ারের ওপর ঝোলায়। চাইলে ব্রায়ের রকম দিয়েও তাদের ভাগ করা যেতে পারে : কোনোটা সাধারণ অন্তর্বাস আবার কোনোটা বা রঙচঙা। আবার কিছু মেয়ে আছে যারা ব্রাই পরে না। তিনি কখনো বুঝতে পারেন না কে ব্রা পরেছে আর কে ব্রা পরেনি। শুধু এটুকু জানেন যে ব্রা না পরা মেয়েগুলোর বুক সাধারণত ছোটো হয় আর ছেলে ছেলে ভাব থাকে। 
আর সেই মূহূর্তটা, নারী ও পশুর মধ্যকার সেই রহস্যময় মূহূর্তটা, যখন গবেষক গভীরভাবে শ্বাস নিতে নিতে কোকোর সামনে অর্ধনগ্ন হয়ে বসে, কিন্তু গরিলাটি একেবারেই আর কোনো ইশারা করে না। কোকো যেন প্ররোচিত না হয় সেজন্য মেয়েটি তার চোখের দিকে না তাকাতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। কোকো নীরবে তার দিকে সরাসরি তাকায়। ড. টমাস নোট নিতে থাকেন, কিন্তু বুঝতে পারেন না আজ কেন সে মেয়েটির হাত ধরতে চাচ্ছে। তিনি কেবল অনুমান করতে পারেন কেন সামান্য স্পর্শেই কোনো কোনো ছাত্রী কাঁদে, আর কেউ কেউ গরিলাটির দিকে তাকিয়ে হাসে। কেন কেউ কেউ তাদেরকে স্পর্শ ও আদর করতে, তাদের চোখ, নাক আর গলায় কর্কশ আঙুল বোলাতে কোকোকে সুযোগ দেয়। কেন কেউ কেউ কোকোর দিকে মাথা ঝুঁকায়, আর সেও পাল্টা মাথা নিচু করে। কেন হঠাৎ করেই মনে হয় যে ঘরে একটা পরিবর্তন এসেছে, আর সেখানে ড. টমাসের নিজেকে কোনো পবিত্র অনুষ্ঠানে অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথির মতো লাগে। 
আর এই ব্যাপারটাও তিনি কেবল অনুমানই করতে পারেন : একেকজন ছাত্রী সেদিনের মতো চলে গেলে, যখন তিনি ও কোকো কেবল দুজন, কেন গরিলাটা তার দিকে বিবর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কেন ওটা তার সামনে রাখা ফল ঘাঁটাঘাঁটি করে, তারপর তার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন স্বামীর সাথে রাতের খাবারের সময় কোনো স্পর্শকাতর বিষয়ে আলাপ করবে বলে স্ত্রী অপেক্ষা করছে।
এবং, শেষ পর্যন্ত কোকো যখন তাকে স্তনের বোঁটার দিকে ইশারা করে, তিনি কেন ওটার মাটিরঙা চোখের দিকে চেয়ে এর অর্থ খুঁজতে থাকেন। কিন্তু ওখানে যদি কোনো ভাষা থেকেও থাকে, তিনি তা খুঁজে পান না। চোখ দুটি গভীর এবং পরিপক্ব। সেগুলোর অভিব্যক্তির অর্থ এখনও চিহ্নিত করা হয় নি। তিনি বুঝতে পারেন না নিজের জামা খুলবেন না আবার একজন ছাত্রীকে ডেকে নিয়ে আসবেন। লাজমাখা হাতে তিনি বোতামে হাত দেন আর সামনেটা খোলার ভঙ্গী করেন। কিন্তু কাজটা সম্পন্ন করার আগেই মূহূর্তটা শেষ হয়ে যায়। কোকো ততক্ষণে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেছে।


নিখুঁতের পূজা। শেরমান আলেক্সি, যুক্তরাষ্ট্র

মেরি কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেছিল। সেটা করতে তার আপত্তি ছিল না। সে ইন্ডিয়ান। আর কে না জানে যে ইন্ডিয়ানদের নাচের উৎসব, বিয়ে বা মৃত্যু, সবকিছুতেই সময় লাগে। আজকের গলা যাচাইয়ের মহড়াটা অবশ্য ইন্ডিয়ান ছিল না, কিন্তু সে ধরেই নিয়েছিল যে দেরি হতে পারে। 
    ‘তুমি কী গাইবে?’ একজন ব্রিটিশ পুরুষ তাকে জিজ্ঞেস করল।
    ‘প্যাটসি ক্লাইন’, সে জবাব দিলো।
    ‘আস তাহলে শুনে দেখি।’
    মেয়েটা কেবল প্রথম লাইনটা গেয়েছে, তখনি লোকটা তাকে থামিয়ে দিলো। ‘তোমার গলা তো খুবই বাজে,’ সে বলল, ‘আর কখনও গানের নামও নিও না।’ 
    মেয়েটা জানত যে মহড়াটা টেলিভিশনে সরাসরি দেখানো হচ্ছে। এখানে অপমান সইতে হতে পারে তাও সে মেনে নিয়েছিল।
    ‘কিন্তু আমার বন্ধুরা, গানের ওস্তাদেরা, আমার মা, তারা সবাই বলে যে আমি খুব ভালো গাই।’
    ‘তারা মিথ্যে বলেছে।’
    মেরি জীবনে কতগুলো গান গেয়েছে? কতবার সে মিথ্যে শুনেছে? টিভি ক্যামেরার সামনেই সে সেই বুকভাঙা গণনাটা করল, আর দৌড়ে গ্রিনরুমে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
    এই পৃথিবীতে আমাদেরকে অবশ্যই মিথ্যেবাদীদের ভালোবাসতে হবে, অন্যথায় ভালোবাসাহীন থাকতে হবে। 


হারিয়ে যাওয়া। আলবার্তো ফুগুয়েত, চিলি

হারিয়ে যাওয়া লোকজনে ভর্তি দেশে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সোজা। সবার মনোযোগ মৃতদের ওপর, কাজেই আমরা যারা এখনও বেঁচে থাকাদের দলে তারা দ্রুতই ঝাপসা হতে আর ঝরে পড়তে পারি। কেউ খুঁজতে আসবে না, কেউ বুঝতেই পারবে না যে আপনি হারিয়ে গেছেন। আমি যদি আপনাকে আগে দেখেও থাকি, সেটা মনে পড়বে না। বুঝতেই পারছেন, সেখানে সকলের স্মৃতিশক্তিই বাজে। হয় তাদের মনে পড়ে না অথবা তারা মনে করতে চায় না।
একজন অধ্যাপক আমাকে বলেছিল যে আমি হারিয়ে গেছি। আমি জবাব দিলাম যে, নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হলে কোথায় আছি সেটা আগে জানা দরকার। 
তারপর ভাবলাম, যদি এর উল্টোটা হয়?
আমাকে পনেরো বছরের জন্য মুছে ফেলা হয়েছিল। আমি সবকিছু ত্যাগ করলাম, এমনকি নিজেকেও। একটা ধাঁধা ছিল আমি যা কখনও মেলানোর চেষ্টা করিনি। প্রেমিকার জন্মদিনের পার্টি ছিল, কিন্তু যাইনি। আমি লস ভেলোসমুখি একটা বাসে উঠে পড়লাম। কোনো পরিকল্পনা ছিল না, এটা এমনি এমনি ঘটে গেল। এমনি ঘটবার কথা ছিল, আর এর অন্যথা হবারও উপায় ছিল না।
প্রথমে নিজেকে দোষী মনে হলো। তারপর মনে হলো কেউ তাড়া করছে। কেউ কি আমার পিছু নিয়েছে? কেউ কি আমাকে খুঁজে পাবে? কী ঘটবে যদি কারও সঙ্গে আচমকা দেখা হয়ে যায়?
কিন্তু কারও সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে নি।
কেউ কেউ বলে যে পৃথিবীটা একটা রুমালের মতো। তাদের কথা ঠিক নয়। যারা একথা বলে তারা জানে না পৃথিবীটা কেমন। এটা অনেক বড়, এবং সবচেয়ে বড় কথা, অচেনা আর অদ্ভুত। আপনি যেখানে, যেদিকে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারেন, কেউ লক্ষ করবে না। 
এখন আমি প্রাপ্তবয়স্ক। কোনো কোনো দিক থেকে। আমার পিঠে লোম গজিয়েছে, আর প্যান্টের চেইনও সহজে আটকানো যায় না। আমি অনেক জায়গায় গিয়েছি আর এমন অনেক কিছু করেছি যা করব বলে কখনও ভাবি নি। এসব নিয়েই আমরা বেঁচে থাকি। আমরা কিছু কিছু বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। কোনো কিছুই তেমন খারাপ নয়। কিছুই না।
আমি অনেক জায়গায় গিয়েছি। আপনি তুমবস বন্দরে গিয়েছেন কি? বুয়েনাভেনচুরা বন্দরে? কিংবা সান পেদ্রো সুলা? অথবা মেমফিসে?
একটা কুকুরছানার মতো আমি ক্যালিফোর্নিয়ার এল সেন্ট্রো নামক জায়গাটার কেমার্ট শপিং সেন্টারের কর্মচারী মেয়েটার পিছু নিয়েছিলাম। শহরটায় সারের ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যায়। সম্পর্কটা বেশ ভালোভাবেই শুরু হয়েছিল, তারপর শেষ হয়ে গেল। তারপর আমি নেভাদার লাফলিনে কলোরাডো নদীর তীরে সার ধরে দাঁড়ানো জুয়ার আড্ডাগুলোতে কাজ করলাম। তখন বাসা ছিল বুলহেড শহরে। একই বাসায় একজন মহিলা আর একজন পুরুষ থাকত, কিন্তু তাদের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয় নি। কোনো দরকার পড়লে আমরা পরষ্পরের জন্য টোকা লিখে যেতাম। তারা দুজনই বানান ভুল করত।
একবার, তুলসার একটা রেস্টুরেন্টে এক মহিলা আমাকে বলেছিল যে আমি দেখতে তার ছেলের মতো, যে কখনো বাড়ি ফিরে আসেনি। ‘কেন সে চলে গিয়েছে, তুমি কী বলতে পারবে?’ সে জিজ্ঞেস করল। জবাব দিলাম জানি না। কিন্তু, হয় তো আমি জানতাম।
অথবা, জানতাম না।
চাইনি, তবু গ্যালভেস্টোনে স্প্যানিশ বাচ্চাদের ইংরেজি শেখানোর কাজ নিলাম। চিলির জাতীয় পতাকার সাথে টেক্সাসের পতাকার মিল আছে। একটা বাচ্চা আমার বাহুতেই মারা গেল। সে দোলনা থেকে পড়ে গিয়েছিল। আমি খুব জোরে ধাক্কা দিয়েছিলাম আর সে সিট থেকে ছিটকে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল সে দুমিনিট ধরে মেক্সিকো উপসাগরের ঝাপসা আকাশ দিয়ে উড়ছে। আমি তাকে আঘাত দিতে চাই নি, কিন্তু যেভাবেই হোক, আমি তা দিয়েছি। তাতে... কী?
আপনি কী করতে পারেন?
আপনি কি ইউকাতানের পাড়ে মেরিডাতে গিয়েছেন? গরমের দিনে তাপমাত্রা সেখানে একশ’ ডিগ্রি ফারেনহাইটে ওঠে। আর তারা রবিবারে শহরতলির সবকিছু বন্ধ রাখে যেন লোকেরা নাচতে পারে। কখনো কখনো আমি একজন তরুণীকে পাই আর নাচতে যাই।
গতবছর গুগলে নিজের নাম সার্চ দিয়েছিলাম। হয়তো গুগল আমার হয়ে সেটার খোঁজ করেছিল। কিন্তু আমিই তো আমাকে খুঁজে পাইনি। ওটা যার খোঁজ দিলো সে আমারই নামের আরেকটা লোক, একজন দাঁতের ডাক্তার, যে ভেনেজুয়েলার বারকুইজিমেতোতে থাকে। তার তিনটা বাচ্চা আছে আর সে ভগবানে বিশ্বাস করে। 
কখনও কখনও স্বপ্নে দেখি যে, আমিও বারকুইজিমেতোতে বাস করছি, আমারও তিনটা বাচ্চা আছে আর আমিও ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। কখনও কখনও, এমনটাও স্বপ্ন দেখি যে কেউ আমাকে খুঁজে পেয়েছে। 


উলঙ্গ রমণীর বাড়াবাড়ি। জোসেফিনা এস্ত্রাদা, মেক্সিকো

সান্তা মারিয়ার রাস্তায় রমণীটিকে উলঙ্গ হেঁটে যেতে দেখে শিশুরা অবাক, বড়রা পুলকিত আর মহিলারা ক্রোধান্বিত হয়। তারা দৃশ্যটা বিশ্বাস করতে চায় না। সে বাইসাইকেল মেরামতের দোকান লাগোয়া একটা অতিথিশালার কোনায় বসে। কাছের দুটো বস্তির ছেলেমেয়েরা রাস্তা পার হয়ে তাকে দেখতে আসে। একটা ব্যাগ ছাড়া তার আর কিছু নেই। সে ওটার আঠা শুঁকে। সে যে ন্যাংটো এ বিষয়ে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এ কথাও বলা যাবে না যে সে ইচ্ছে করেই নিজের মাংসল কালো শরীর দেখাতে চেয়েছে। 
সে বসে থাকা অবস্থায়ও তাকে দেখে বলে দেয়া যায় যে সে বিশালদেহী। কাঁধ বরাবর তার চুল যেন জটার জঙ্গল, তাতে মাটি, চুইংগামের দলা, ধুলা, আর তুলার টুকরো লেগে আছে। দর্শকদের তালি আর শিস চরমে উঠে যখন সে পা ছড়িয়ে দেয়, আর তার হাত পৌঁছে না এমন জায়গায় চুলকানোর চেষ্টা করে। এ সময়, তরুণের দল, যারা সবসময়ই আশপাশে ঘুরঘুর করে, তারা আর হাসি চেপে রাখতে পারে না। আপনাআপনিই আঙুল দিয়ে নিজেদের প্যান্টের চেইন স্পর্শ করে, যেনবা ভয় পেয়েছে যে তাদেরও গোপন জিনিস বের হয়ে যেতে পারে। 
মহিলা যখন শুয়ে পড়ে আর তাদের দিকে পিঠ ফেরায়, দর্শকরা তার দিকে নানান কিছু ছুড়ে মারে। সে প্রতিক্রিয়া দেখাতে একটু সময় নেয়। সবাই জানে যে সে বসলেই আর দেরি করবে না, উঠে দাঁড়াবে আর আক্রমণকারীদের তাড়া করবে। তখন শিশুরা দেখতে পাবে যে দৌড়ানোর সময় তার স্তনজোড়া পেটের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকে না। একেবারে ছোটো বাচ্চাদের কেউ কেউ তাদের মাকে গিয়ে বলে যে, যে মহিলা প্যান্ট বা অন্য কিছু পরে না সে আবার বের হয়েছে। মায়েরা তাদেরকে বাইরে যেতে মানা করে।
একটা সময় ছিল যখন সে বড় দুই রাস্তার মোড়ে থাকত। এরপর বছর দুই ধনী এলাকায়ও কাটিয়েছে। সে ঘুমাত স্বচ্ছল মানুষদের দেওয়া একগাদা কাপড়চোপড়ের মধ্যে, যা একইসঙ্গে তার বিছানা আর বালিশের কাজ করত। কাপড়-চোপড় নিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলে, সে নিশ্বাসের সঙ্গে যে রাসায়নিকের গন্ধ নিত ওটা দিয়েই ওগুলো পুড়ে ফেলত।
বিশালদেহী কালো রমণী নির্মাণাধীন দালানগুলোতে হাতপা ধুতে যায়। পানির কল থেকে পানি খাওয়ার জন্য সে উবু হলে শ্রমিকদের আনন্দ তুঙ্গে ওঠে। পাশাপাশি বসা লোকগুলো আমোদ পায় যখন দেখে যে সে কিছু চুনের গুঁড়ো হাতে নিয়ে পাউডারের মতো করে বগলে ঘষছে। সাহস করে কোনো পুরুষ তার দিকে এগিয়ে গেলে সে তীব্র অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। এলাকার মহিলারা তার ওপর রুষ্ট। তবে তাদের নালিশ তার এই দেখিয়ে বেড়ানো নিয়ে নয়, বরং সে যে পুরুষদের চেয়েও স্বাধীন সেই বিষয়ে। তারা বলাবলি করে যে, কোথায় পুলিশ ওই রমণীর বাড়াবাড়ি বন্ধ করবে, তা না করে মাতালদের পেছনেই পুরো সময় ব্যয় করছে। 


নিদ্রার অভ্যাস। ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, জাপান

কেউ যেন ওর চুল টানছে এরকম তীব্র ব্যথা নিয়ে তিন বা চারবার ওর ঘুম ভাঙল। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারল যে ওর একগোছা চুল প্রেমিকের গলা প্যাঁচিয়ে রয়েছে, ও নিজের মনেই হাসল। সকালে ও বলবে, ‘দ্যাখো, আমার চুল কত লম্বা হয়েছে। আমরা একসঙ্গে রাত কাটালে ওগুলো সত্যি সত্যি বেড়ে যায়।’
সে আস্তে করে চোখ বুজল।
‘আমি শোয়াশুয়ির ব্যাপারটা পছন্দ করি না। কেন আমাদের এটা করতে হবে? যদিও আমরা পরষ্পরকে ভালোবাসি, জগতে এত কাজ থাকতে কেন ওটাই করতে হবে?’ যে রাতগুলোতে প্রেমিকের সঙ্গে থাকতে ওর অসুবিধা হতো না, তখন ও এরকম বলত, যেন শোয়ার ব্যাপারটা ওর কাছে একটা রহস্যপূর্ণ ঘটনা। 
‘আপনি হয়তো বলবেন যে লোকে প্রেম করে কারণ তাদের শারীরিক সম্পর্কের প্রয়োজন রয়েছে। ভালোবাসবে অথচ শোবে না ভাবতেই ভয় করে। চিন্তাটা যেন কতই খারাপ।’
‘সেটা সত্য নয়। প্রথমেই তো আমরা বিছানায় যাই না, তাই না? এর মতো স্বার্থপর ব্যাপার আর নেই।’
ব্যাপারটা ছিল তাই। প্রেমিক ঘুমিয়ে পড়ার পরপরই অচেতন অবস্থায় ভ্রু কুঞ্চিত করে মেয়েটার গলার নিচ থেকে তার হাতটা টেনে বের করে নিয়ে যেত। মেয়েটা নিজেও ঘুমের আগে যত নিবিড়ভাবেই ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরুক না কেন, জেগে উঠে দেখত যে ওর বাহু থেকে সে টান চলে গিয়েছে। 
‘ঠিক আছে, তাহলে আমি আমার চুল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তোমার বাহু বেঁধে রাখব আর শক্তভাবে ধরে থাকব।’
প্রেমিকের নির্জীব কিমোনোর হাতাটা নিজের হাতের চারপাশে পেঁচিয়ে ও তাকে শক্ত করে ধরেও দেখেছে। ওই একই ব্যাপার, ঘুম ওর আঙুল থেকেও শক্তি কেড়ে নিয়েছে।
‘ঠিক আছে, সেই পুরোনো প্রবাদে যেমনটি বলে, নারীর চুল দিয়ে তোমার গলায় শিকল পরাব।’
একথা বলে মেয়েটি ওর দাঁড়কাকের মতো কালো চুলের থেকে একটা লম্বা গোছা বেছে নিত আর তা দিয়ে তার গলার চারপাশ ঘিরে দিত। 
সেদিন সকালে অবশ্য ওর কথায় প্রেমিক হেসেছিল। 
‘চুল লম্বা হয়েছে বলে কী বোঝাতে চাইছ? এগুলো এমনভাবে জট পাকিয়ে আছে যে চিরুণীও চালাতে পারবে না।’
সময় যত বয়ে গেল, তাদের মধ্যে এ ধরনের ব্যাপারগুলোও কমে গেল। এখনকার রাতগুলোতে মেয়েটা এমনভাবে ঘুমায় যেন পাশে যে প্রেমিক আছে সেকথাও ভুলে গিয়েছে। কিন্তু, ও যখনি জাগে দেখে যে ওর হাত সবসময়ই তাকে এবং তার হাতও ওকে ছুঁয়ে আছে। অবশ্যি এখন তারা আর এটা নিয়ে চিন্তা করে না। এতদিনে এটা তাদের নিদ্রার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।


নিশীথে গাড়ি চালানো। রুবেম ফনসেকা, ব্রাজিল

ব্যাগ বোঝাই চুক্তিপত্র, প্রস্তাব, প্রতিবেদন, গবেষণা আর কাগজপত্র নিয়ে আমি বাড়ি পৌঁছুলাম। স্ত্রী বিছানায় বসে একা একা তাস খেলছিল। পাশে একগ্লাস হুইস্কি। তাস থেকে মুখ না তুলেই সে বলল, ‘তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।’ অন্যসময় যেরকম থাকে বাসার শব্দগুলো সেরকমই ছিল। মেয়েটা তার কক্ষে গলার অনুশীলন করছে, আর ছেলেটার কক্ষ থেকে রক গান ভেসে আসছে। ‘ব্রিফকেসটা নামিয়ে রাখছ না কেন?’ স্ত্রী বলল। ‘জামাটা খোল, আর একটু হুইস্কি খাও। একটু আরামও তো করতে হবে, না কি?’
আমি পড়ার ঘরে গেলাম। বাসার এই কোণটায় আমি নিজের মতো থাকতে পারি এবং থাকতে ভালোবাসি, যদিও তেমন কিছু করি না। আমি টেবিলে গবেষণাপত্রটি খুলে বসলাম, কিন্তু এর অক্ষর বা সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালামও না। আমি অপেক্ষা করছিলাম। ‘তোমার খালি কাজ আর কাজ। বাজি ধরে বলতে পারি তোমার সহকর্মীরা এর অর্ধেকও করে না, কিন্তু বেতন তো তোমার সমানই পায়।’ হাতে একটা গ্লাস নিয়ে স্ত্রী এ ঘরে এল। ‘রাতের খাওয়া দিতে বলব কি?’
গৃহকর্মী ফরাসি কায়দায় খাবার সাজাল। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গিয়েছে, আমি আর স্ত্রী মোটা হয়েছি। ‘এটা তোমার পছন্দের ওয়াইন,’ গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে স্ত্রী বলল। কফি পানের সময় ছেলে টাকা চাইল, আর মেয়ে টাকা চাইল মদ খাওয়ার সময়। স্ত্রী কিছু চায়নি, চাওয়ার দরকারও পড়ে না। আমাদের ব্যাংক হিসাবটা এমন যে দুজনের যে-কেউ চেক লিখে টাকা তুলতে পারি।
‘গাড়ি নিয়ে বের হলে কেমন হয়?’ আমি প্রস্তাব করলাম। যদিও জানতাম যে স্ত্রী যাবে না, সে এসময় টিভিতে ধারাবাহিক নাটক দেখে। 
‘খোদাই জানে রোজ রাতে গাড়ি চালিয়ে তুমি কী মজা পাও। এর পেছনে খরচও তো কম হয় না। এসব ভোগবিলাসের দিকে আমার টান দিনকে দিন কমছে।’
গ্যারেজের দরজার মুখেই ছেলেমেয়ের গাড়ি রাখা, আমারটা ভেতরে। ওদের গাড়ি দুটো বের করে রাস্তায় রাখলাম, তারপর আমারটা বের করলাম। ওদেরগুলো আবার গ্যারেজে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করলাম। এসব করতে একটু বিরক্তি লাগল, কিন্তু নিজের গাড়ির মোটা বাম্পারের দিকে তাকিয়ে মনটা আনন্দে ভরে গেল। বিশেষ ধরনের ক্রোমপ্লেটের দ্বিতীয় একটা আস্তরণ ওটাকে আরও শক্ত করেছে। আমি ইগনিশনে চাবি ঘুরিয়ে গাড়িটা চালু করলাম। এর ইঞ্জিনটা খুবই ভালো, কোনো শব্দ না করেই অনেক শক্তি যোগাতে পারে। আমি রোজই বেরুই বটে, কিন্তু কোথায় যাবো সেটা আগে থেকে জানা থাকে না। আজও গন্তব্য ঠিক না করেই বের হয়ে পড়লাম। এ শহরে মাছির চেয়ে মানুষের সংখ্যা বেশি। কোনো পরিত্যক্ত রাস্তা হলে ভালো হয়। ব্রাজিল এভিনিউতে যাওয়া যাবে না, ওটা ভয়াবহ ব্যস্ত। আমি এমন একটা রাস্তা বেছে নিলাম যেটাতে তেমন আলো নেই, তার ওপর বড়বড় গাছের ছায়ায় ভার হয়ে আছে। হ্যাঁ, এরকম জায়গাই চাচ্ছিলাম। ওটা কে আসছে―নারী না পুরুষ? এতে অবশ্য তেমন কিছু আসে যায় না, কেবল যেরকম চাই সেরকম হলেই হলো। কিন্তু সেরকম বৈশিষ্ট্যের কেউ আসছিল না। আমার অস্থির লাগতে থাকল। সবসময়ই এরকম হয়। অবশ্য ভালোও লাগে, অস্থিরতা বাড়লে তা থেকে মুক্তির আনন্দটাও বেশি হয়। তখনই মহিলাটাকে দেখতে পেলাম। তাকে দিয়েও চলবে, যদিও অতটা উত্তেজনাপূর্ণ হবে না কারণ মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সহজ হয়। সে খুব দ্রুত হাঁটছিল। হাতে সস্তা কাগজে মোড়ানো একটা প্যাকেট। বোধ হয় বেকারি বা বাজার থেকে কিছু কিনে ফিরছে। পরনে স্কার্ট আর ব্লাউজ।
ফুটপাতে বিশগজ পরপর গাছ। এটা একটা আকর্ষণীয় সমস্যা কারণ এখানে সফল হতে হলে অনেক ওস্তাদি লাগবে। আমি হেডলাইট নিভিয়ে গতি বাড়িয়ে দিলাম, কিন্তু শব্দ হলো না। গাড়িটার চাকা ফুটপাতের কিনারায় উঠে যাবার আগে মহিলাটা বুঝতেই পারল না যে আমি তাকেই নিশানা করেছি। ধাক্কাটা লাগল হাঁটুর একটু ওপরে, উরুর মাঝ বরাবর। বাঁ পায়ের দিকটায় খানিকটা বেশি―একেবারে মোক্ষম নিশানা। হাড় ভাঙার মরমর শব্দ পরিষ্কার শুনতে পেলাম। দ্রুত গাড়ি ঘোরালাম, একটা গাছকে পাশ কাটিয়ে আবার রাস্তায় নেমে এলাম। গাড়িটা সাত সেকেন্ডেরও কম সময়ে শূন্য থেকে ষাট মাইল বেগে উঠে যেতে পারে। আমি দেখতে পেলাম যে একটা বাড়ির সামনের নিচু দেয়ালের ওপর রক্তে ভাসা লাশটা নিথর পড়ে আছে।
গ্যারেজে ফিরে গাড়িটা ভালো করে দেখলাম। গর্বের সঙ্গে বাম্পারটার ওপর হাত বোলালাম, কোথাও কোনো চিহ্ন পড়েনি। পৃথিবীর খুব কম লোকই এমন একটা গাড়ি আমার মতো নিপুণভাবে চালাতে পারবে।
পরিবারের সবাই টিভি দেখছিল। স্ত্রী সোফায় শোয়া। ‘গাড়ি চালিয়ে ভালো বোধ করছ কি?’ টিভির পর্দা থেকে চোখ না সরিয়েই সে জিজ্ঞেস করল। 
‘ঘুমোতে যাচ্ছি,’ আমি জবাব দিলাম। ‘সবাইকে শুভরাত্রি। আগামীকাল অফিসে অনেক কাজ।’

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাড়তি ফসল মিষ্টিকুমড়ায় কৃষকের মুখে হাসি
বাড়তি ফসল মিষ্টিকুমড়ায় কৃষকের মুখে হাসি
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!