X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ঈদসংখ্যা ২০২২

ছয় দেশের ৭টি ফ্ল্যাশ ফিকশন

অনুবাদ : মাইনুল ইসলাম মানিক
২৩ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০

পরিপ্রেক্ষিত যখন তেলাপোকার ।। কিউ জিয়াওলং, চীন

রাত দুইটার কাছাকাছি। আপনি শরীর ম্যাসেজের বিছানায় শুয়ে আছেন। আপনাকে ওপরের দিকে ছোড়া হচ্ছে, আপনি নিচের দিকে উল্টে পড়ছেন, আমরা নিচে কাঁপতে থাকি। এখনো আলোর ঝলসানি, কোলাহলের ভেতর কিছুই ভাবার ফুরসত নেই। আপনার শরীরে কালশিটে পড়ে আছে, পাজোড়া দুর্বল, আপনি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী এক দিন-রাত্রি! বাইরে চারজন পা ধোয়ানোর ভোক্তা, ভেতরে আরও তিনজন ম্যাসেজের ভোক্তা, বিশেষ করে শেষেরটার অবস্থা শোচনীয়। সালুনের মালিকের সাথে বিশেষ সম্পর্ক থাকায় সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বিরতিহীন ম্যাসেজ বিছানায় আপনাকে সামনের এবং পেছনের দিক থেকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছেন, তিনি দাঁড়িয়ে থাকছেন, ম্যাসেজ বিছানাটিকে টান দিচ্ছেন, ধাক্কা দিচ্ছেন, আপনি যতটা প্রত্যাশা করেছেন তার চেয়েও বরং দ্রুততার সাথে। শীতল স্বেদবিন্দুতে আচ্ছাদিত হতে হতে আপনি অনুভব করছেন, অসংখ্য পোকামাকড় আপনার উলঙ্গ দেহে হামাগুড়ি দিচ্ছে। 
আমাদেরকে বিধ্বস্ত করার মতো করে দাঁত খিঁচিয়ে আপনি চিৎকার করলেন, ‘তেলাপোকা!’
রাতের বিভৎসতায় আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লাম। 
আপনি নেমে এলেন, খালিপায়ে ছোটাছুটি করলেন, আপনি রান্নাকক্ষের পর্দার কাছে ছোটাছুটি করলেন এবং প্লাস্টিকের চটিজোড়া আঁকড়ে ধরলেন। খুব নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আশ্রয়ের জন্যে বিভিন্ন স্থানে ছুটতে থাকা আমাদেরকে আপনি পেছনের জানালার ছিদ্র দিয়ে ভেতরে আসা চাঁদের আলোয় শনাক্ত করে ফেলেছিলেন। আপনি আমাদের খুঁজতে শুরু করলেন, আপনি আমাদেরকে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা বাটিতে, পাত্রে, বেসিনে খুঁজতে লাগলেন, আমাদেরকে সয়া সসের বোতলে, তেলের বোতলে, কলসিতে, ওপরের তাকে জমানো দইয়ের হাড়িতে শিকার করতে লাগলেন, চালের বস্তা থেকে তাড়াতে থাকলেন। তারপর বেসিনের সামনের মেঝেতে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে আপনি একটা ভয়ংকর অনুসন্ধান চালাতে থাকলেন। আপনার উরু ও পাজোড়া নাইলনের বেল্টহীন পাজামার মধ্যদিয়ে দেখা যেতে লাগল। তখনও সেখান থেকে ভেসে আসছিল সঙ্গমের ঘ্রাণ। 
টকটকে লাল চটিজোড়া দিয়ে আপনার হস্তদ্বয় ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে, আড়াআড়ি থাকা চপস্টিকের দিকে আপনি ঝাঁপিয়ে পড়েন, আপনার সবটুকু রাগ ঢেলে দেন আমাদের ওপর। আপনি ছোঁ মেরে আমাদের টেনে নেন আপনার গোলাকার কোমল আঙুলের নিচে এবং আমাদের শরীরটাকে পিষ্ট করে দেন। শূন্য দেয়ালে আলো প্রতিফলিত হয়ে আপনার কালো চুলে ফিরে আসে এবং রাত্রিকে আরও অন্ধকার করে তোলে, আরও উন্মত্ত করে তোলে সেসব স্মৃতির ভেতর―আপনার গ্রামের বাড়িতে ভূমিধসে পাহাড় ও উপত্যকার বৃক্ষ ও আগাছা আপনার পরিচ্ছন্ন বগলের মতো সাফ হয়ে গেছে, গৃহহীন হওয়া উদ্বাস্তু মানুষেরা ‘থ্রি জর্জেস ড্যাম’-এর ছায়ার দিকে ছুটে যাচ্ছে। উদ্বাস্তু মানুষের পলায়নে রাস্তাগুলো এমনভাবে ধূলিকর্দমময় হয়ে ওঠে যে তারা যেন কীট-পতঙ্গের মতো হাবুডুবু খাচ্ছিল... হায় ঈশ্বর!
আলো জ্বলে উঠলে আমরা দেখতে পাই, মেঝের পেছনের দিক থেকে লোকটা আপনাকে বর্বরভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক যেভাবে আমাদের একটা তেলাপোকাকে টেনে নেওয়া হয়। 


বৃক্ষ হতে দূরবর্তী নয় ।। কারিনা এম. স্কুরেক, দক্ষিণ আফ্রিকা

খুবই আঁটোসাঁটো। সাঁতার কাটার গগলস তার চোখের চারপাশের মাংসের ওপর একটা অর্ধবৃত্তাকার অবস্থা তৈরি করে রেখেছে এবং দোলায়মান মাথার চারপাশে প্যাঁচিয়ে আছে। এই ডুবো অবস্থায়, প্রতিটি ঘাইয়ের সাথে, বাহু ছড়িয়ে দেওয়ার সাথে, করতল সংকোচন-প্রসারণের সাথে তন্বী আঙুলগুলো দৃঢ়ভাবে একত্রে চাপ দেওয়ার সময় বাম হাতের যে আঙুলে বিয়ের আংটি পরানো হয় সেখানে এই বিয়েবন্ধনীর দিকে সে গুরুত্ব দিয়ে নজর রাখছে। তার সম্মুখস্থ নীলাভ-সবুজ নির্মলতার ভেতরেও সোনালি রঙটা আলাদাভাবেই ধরা পড়ে চোখে। পোশাকের ভেতরের চামড়া একটা শৃঙ্খলিত ওক গাছের বহিরাংশের মতোই কুঁচকে গেছে। তার হাতগুলো অবশ্য জলপাইরঙা, বাঁকা চাঁদের মতো ছোট ছোট নখ।
স্বামীর সংসার ছেড়ে আসা অপরাপর মহিলাগণের মতো তার মা গত ত্রিশ বছর ধরে ডান হাতের আঙুলে এমন আংটি পরে আসছেন। রীতি অনুযায়ী শুধু বিধবাগণ এই আংটি পরার ব্যত্যয় ঘটাতে পারবেন। ম্যাডোলিন একজন ভীনদেশিকে বিয়ে করার পর থেকেই মা তাকে এই আংটির বিষয়ে বারবার স্মরণ করিয়ে দেন। তারপর একটা সময় সে নিজের পক্ষে এ নিয়ে প্রতিবাদ শুরু করে। এই প্রতিবাদটুকু মৃত্যু নিয়ে নয়, বরং প্রিয়জনের মৃত্যুর সাথে যেসব নিষ্ঠুর রীতিনীতি জড়িয়ে আছে, সেসব নিয়ে।
ম্যাডোলিন বুঝতে পারে। তার বাবা আবার নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে। তার মা এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি। তাই একাকিত্বের এই যন্ত্রণাময় জীবন বেছে নিয়েছেন। তিনি ম্যাডোলিনকে সতর্ক করেন, ‘ম্যাডি, একদিন তুমিও বুঝতে পারবে―যদিও আমি চাই না তোমার ক্ষেত্রেও এমনটা হোক, কিন্তু তুমিও এমনটাই ঘটতে দেখবে। পুরুষরা সবাই একই প্রকৃতির।’
জলের নিচে চলতে চলতে তার পাজোড়া ব্যাঙের মতো সমানতালে এগোতে থাকে, পায়ের তলাদ্বয় চলতে থাকে ঈষদোষ্ণ নীলের মধ্যদিয়ে। তাদের ঘরের ওপর ঘামতে থাকা আকাশে উঁকি দেয় অনিচ্ছুক সূর্য। ব্যবসার কাজে তার স্বামী এখন বাড়ির বাইরে।
গতরাতের পার্টিতে তার ভালো বন্ধুটি হাতের আংটিটি লক্ষ করে অনুযোগ করে, ‘পরদেশীর স্ত্রী। আংটিটা না পরলে কেউ বুঝতেই পারত না তুমি বিবাহিতা। আমরা তো কখনোই তোমার স্বামীকে দেখিনি।’ কাচের গ্লাসের ভেতর থাকা আরেকটা সতেজ পিনা-কোলাডোর মিশ্রণের পাশে তার হাত ঘুরতে থাকে, বরফময় গ্লাসে টুংটাং শব্দ করতে থাকে হাতের আংটিটি।
পানীয়ের গ্লাসটি হাত থেকে পাশের হলুদাভ কাঠের টেবিলে রাখতে রাখতে সে বাহুর ওপর উঠে আসা লিনেনের ড্রেসটা ঠিক করে নেয় এবং বলে, ‘কেউ কি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন? আমি একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছি।’
ম্যাডোলিন চালকের পেছনের আসনে বসে। চালক পেছনের দিকটা দেখার আয়নায় সতর্কভাবে ম্যাডোলিনকে পর্যবেক্ষণ করে। চালকের পাশের যাত্রীর জন্যে যে দরজা সেটির স্ফটিক নীলে সে চোখ রাখে। দরজাটি খুলে যায় এবং ভেতরে আলো প্রবেশ করে। পার্টির আরেকজন অতিথি পথিমধ্যে কোথাও নেমে যাবেন। সে জানালার দিকে মাথা এলিয়ে দিতে দিতে বলে চালককে বলে, আজ রাতে যেন তাকে বাসায় পৌঁছে না দেয়। একথা শুনেই খণ্ডিত সেকেন্ডের জন্যে ছানাবড়া হয়ে ওঠে দুজনের চোখ।


পরিবার ।। জেনসেন বিচ, যুক্তরাষ্ট্র

কেউ কেউ সাঁতার কাটার কথা বলল, আবার অন্য কেউ বলল, এমন আবহাওয়ায় বরং আমাদের অন্যকিছু করার বিষয়ে ভাবা দরকার। কেউ কেউ ঠিক এই সময়ের কোনো একটা ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সময়টিকে ব্যাখ্যা করল। কেউ কেউ বলল, এ ঘটনা তাদের মনে পড়ছে, কিন্তু একই স্থানে বজ্রপাতের ঘটনা দুবার ঘটে না, আবার কেউ কেউ বলল, তাদের বন্ধুর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। কেউ কেউ বলল, এই ঘটনা প্রথম বার শুনে কেউই বিশ্বাস করেনি, তারাই-বা কেন বিশ্বাস করবে। কেউ কেউ বলল, তারা এই বিষয়টির ওপর ইন্টারনেটে আর্টিকেল পড়েছে। অন্য কেউ বলল, তাহলে এ বিষয়টি সত্যই হবে নিশ্চিত। কেউ কেউ পরামর্শ দিলো, সবাই দ্রুতই শান্ত হোন।
কেউ কেউ বাইরের দিকে হাঁটতে শুরু করল এবং কেউ কেউ হাত বাড়িয়ে তাদেরকে থামাতে চেষ্টা করল। 
কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়ায় এবং তাদের নিজেদের হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করে কিন্তু তারা নিজেদেরকে অন্যদের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়াতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ বলল যে, এখন মধ্যাহ্নভোজ পরিবেশন করা হতে পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ কেউ তাদেরকে ধরে রাখতে চেষ্টা করল। এরপর মধ্যাহ্নভোজের খাবারই বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে এবং সবাইকে শান্ত করে তোলে। কেউ কেউ খাবার গ্রহণের প্রস্তুতি নেয়, আবার কেউ কেউ টেবিলে বসে। কেউ কেউ ওয়াইনের বোতলের ছিপি খোলে আবার কেউ কেউ অন্য কারও বিরুদ্ধে অধিক ভোজনের অভিযোগ তোলে। কেউ কেউ ফোন হাতে তুলে নেয় কথা বলার জন্যে আবার কেউ কেউ বলে, এখন খাবার সময়, অনুগ্রহ করে ফোনটা রাখতে পারেন কি?
কেউ কেউ রান্নাঘরের কাছে বসে যাতে চুলার ওপর থেকে খাবার তুলে আনা যায় এবং খাবার পরিবেশনের শূন্য থালা প্রয়োজন অনুযায়ী ভর্তি করা যায়। কেউ কেউ রান্না নিয়ে মন্তব্য করছে, আবার কেউ কেউ এটিকে যথেচ্ছার মনে করছে, কেউ কেউ এটিকে নিছকই মিথ্যাচার বলে অভিহিত করছে। কেউ কেউ বলল, তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। কেউ টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ে এবং ঘর থেকে উঠোনে বেরিয়ে পড়ে এবং বৃষ্টির দিকে তাকাতে থাকে, দূরে কোথাও প্রবল ঝড় তরঙ্গায়িত হচ্ছিল এবং তখনও ঘরের ওপর হালকা বৃষ্টি পড়ছিল, উঠোনেও এমনভাবে বৃষ্টি পড়ছিল যেন শুধু কারও ওপর বৃষ্টি হচ্ছিল। কেউ কেউ আসন্ন ঝড়ের দিকে দেখাল এবং কেউ কেউ বলতে থাকল, হঠাৎ করেই কতটা অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। কেউ কেউ বরং সতর্ক হয়ে যাওয়ার কথা বলতে থাকল এবং কেউ কেউ বৃষ্টির দিকে দেখাতে থাকল, বৃষ্টি আরও ভারী এবং আরও অন্ধকার হয়ে ঝরছে এবং কেউ ছাউনির জন্যে দৌড়াতে থাকে। কেউ কেউ বজ্রপাত দেখতে পায় এবং অন্য কেউ বলতে থাকে, আমরাও দেখতে পেয়েছি। কেউ কেউ আর উঠোনে দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরে ফেরে, কেউ কেউ এই পরিবর্তন নিয়ে কথা বলে, কেউ কেউ জানালা থেকে উঠোনের যতটুকু দেখা যায় সবটুকু খুবই মনোযোগের সাথে দ্রুত দেখতে থাকে যদিও সে জায়গাটা এখন বৃষ্টির পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। কেউ কেউ একইভাবে আরেকটু বড় পরিসরে উঠোনটি দেখার জন্যে রান্নাঘরের দিকে ছুটে যায়। কেউ কেউ এখনও বসে আছে এবং প্রত্যাশা করছে, কেউ হয়তো অক্ষত থেকে যাবে। কেউ কেউ শপথ করার চেষ্টা করছে যে বহু পরীক্ষিত সত্যকে ভেঙেচুরে জীবনের প্রকৃত পছন্দকেই বেছে নেবে, কেউ কেউ বসে বসে কারও কারও বলা পূর্বের ঘটনার কথা মনে করছে, একই স্থানে দুবার বজ্রপাত হয় না। কেউ কেউ জোরে জোরে বলতে থাকে, কেউ কেউ স্বার্থের জন্যে বোকার মতো ভুলে যায় এবং কেউ কেউ বলতে থাকে, এটা তেমন কোনো আশ্চর্যজনক কোনো কথা নয়। অন্য কেউ বলতে থাকে, এটা দ্বারা আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন? 
কেউ কেউ বলতে থাকে, পরিবার হিসেবে আমরা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-আশয়গুলো ভুলে যাই। কেউ একজন বলল, আপনি কি ভুলে যাওয়া না কি উপেক্ষার কথা বোঝাতে চাচ্ছেন? কেউ কেউ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে বলল এবং অন্যরা কেউ কেউ জানালার কাছাকাছি সেদিকটায় তাকাল যেখানে কেউ কেউ অন্য কারও ভেজা ঢিবির ঘাসের ওপর শুয়ে আছেন। কেউ কেউ বলল, এমনটা ঘটেছে? কেউ কেউ বলল, এমনটা ঘটেছে, আবার কেউ কেউ বলল, তেমন কিছুই ঘটেনি এবং তারা সকলেই রান্নাঘরের সামনের সেই জানালার কাছে ভিড় জমায় যেটি দিয়ে তারা আগেও বহুবার বাইরে তাকিয়েছে যদিও এভাবে সংঘবদ্ধভাবে কখনও তাকানো হয়ে ওঠেনি। তারা যে বিষয়ে ভয় পাচ্ছিল সে বিষয়ে তারা কিছু প্রামাণ্য অনুষঙ্গ খোঁজে এবং তারা সবদিকে তাকাতে থাকে, কিন্তু তারা অতীত দেখতে পায় না কারণ সময় কখনোই পেছনের দিকে ধেয়ে আসে না এবং একারণেই তারা দীর্ঘ সময় চতুর্দিকে তাকিয়ে থাকে এবং তাদের কেউ কিছুই দেখতে পায় না। 


মধু ।। আন্তোনিও আঙ্গার, কলম্বিয়া

লোহিত বর্ণের মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বেড়ার শেষ প্রান্তে আমার বোন একাকী। মধ্যাহ্নের গনগনে সূর্যের আলোয় আলোকিত চারপাশ। বাইরের মাঠের পরবর্তী সারি থেকে আমি নজর রাখছি তার ওপর। সে নিষিদ্ধ কিছু একটা সেরেছে এবং এক সেকেন্ডের জন্যেও দ্বিধান্বিত না হয়ে তার সীমহীন শক্তিমত্তা ও গুরুগম্ভীরতা প্রদর্শনের জন্যে বেড়ার বাইরে সবার দিকে (আমি হচ্ছি বাগানের নীরবতা) হেঁটে এলো। আমার বোনের বয়স চার আর আমার ছয় বছর। রান্নাঘরে মায়ের রেখে দেওয়া মধু থেকে সে তার বাহুতে, পায়ে, ছোট্ট পোশাকে এমনকি গালেও দুই ফোঁটা মধু মেখে নিয়েছে। এখন বাগানের মাঝখানে সে একাকী। এই পরিপূর্ণ আলোয় আমাদের মধ্যবর্তী পৃথিবী থেকে উঠে আসা যে তাপ আমাদেরকে পৃথক করে রেখেছে তাতে বদলে গেছে তার গায়ের রং। সে জগৎকে তার হিম্মত দেখাচ্ছে, সে হাসছে এবং অপেক্ষা করছে। ধীরে ধীরে তার শরীরের রং বদল হতে থাকে, ভারী ও গম্ভীর হতে থাকে। 
প্রতিবেশী বাগান থেকে, সিল্ক-কটন গাছের মগডালে থাকা মৌচাক থেকে, পেয়ারাগাছ থেকে হাজার হাজার মৌমাছি এসে তার শরীরে বৃষকাষ্ঠের খামের মতো স্থির হয়ে থাকে, সে সূর্যকে এবং ধোঁয়াসদৃশ উড়ে যাওয়া মেঘকে তার হিম্মত দেখাতে থাকে, পুরো ক্রান্তীয় বাগানকে দেখাতে থাকে তার শিশুসুলভ হাসির স্থিরতা ও গম্ভীরতা। আমার মনে হচ্ছিল আমি ভয়ে নির্বাক হয়ে যাচ্ছি এবং সৌভাগ্য যে আমি এই মেয়েটির প্রশংসা করতে করতেই শেষ হয় যাচ্ছি এবং আমি তার প্রশংসার কাজে অংশগ্রহণে সক্ষম। যদিও সে এখন আর মেয়ে নেই বরং সে হাজার হাজার মৌমাছি শরীরে নিয়ে হেঁটে যাওয়া এক অভেদ্য শরীর যেটিতে একটি মৌমাছিও হুল ফোটাচ্ছে না। একটি মৌমাছিও তাকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকছে যেন তারা জেনেই গেছে যে এই মেয়েটি অফুরন্ত শক্তির অধিকারী, যেন তার সাথে কুলিয়ে ওঠার ফুরসত তাদের নেই। মৌমাছিরা বরং মধু উপভোগ করছে, পরস্পরের ওপর বসছে এবং একঝাঁক ক্ষুদ্র প্রাণী উন্মত্ত হচ্ছে এবং আমার বোনকে বদলে দিচ্ছে, তাকে জাদুময়, নান্দনিক ও সুস্থির করে রাখছে বাগানের ঠিক মধ্যখানে।
এক মুহূর্ত পর যেন স্বপ্নের ভেতর, যেন বিশুদ্ধ রঙের চিত্রকর্মের ভেতর, যেন তেলরঙের ভেতর তার মাথার ওপর তুলে ধরা হাতে মায়ের ছবি উঠে আসে, মা একটা দিঘল সবুজ পোশাক পরে আছেন, তিনি বাগানের ভেতর ছোটাছুটি করছেন এবং চিৎকার করছেন, তার শরীর কাঁপছে (কোনো নড়াচড়া ছাড়াই আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি), মা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, তাকে মৌমাছি হুঁল ফোটাচ্ছে, তিনি প্রথম হুলের ব্যথা অনুভব করছেন, তারপর আরও আরও হুঁল ফোটানোর ব্যথা হচ্ছে তার, তিনি এক সপ্তাহ বসার পাথরের চেয়ারে পড়ে আছেন ফোলা ও ব্যথাময় শরীর নিয়ে। ব্যথায় এক বাহু ওপরের দিকে তুলে রেখে আরেক হাতে আমার বোনকে ধরে মা পুকুরের যে অংশে ছায়া আছে, সেদিকে যাচ্ছেন, মা আমার বোনকে নিয়ে যাচ্ছেন যে বোনটি মৌমাছির প্রতি আসক্ত, মৌমাছি যাকে একটি হুলও ফোটায় না, বোনটিকে তিনি জলের দিকে ছুড়ে মারেন, যেটুকু জলের মধ্যে সে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, আমার স্বর্ণকেশী ছুলিমুখো বোনটি, আমার বিড়ালচোখা সুন্দরী বোনটি মৌমাছি দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকে, তাকে ঘিরে মৌমাছি গুনগুন করতে থাকে, বোনটি সাদা সাদা দাঁত আর গোলাপি ঠোঁটে হাসতে থাকে, হাসতেই থাকে। সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। সে হাসি থামায় না, যখন মা প্রচণ্ড ব্যথায় সিমেন্টের পাটাতনের ওপর বসতে ব্যর্থ হয়ে নিজের দুই পায়ের মধ্যে হাত রেখে তালুতে মাথা রাখেন, যখন তাকিয়ে থাকেন লোহিতরঙা মাটির দিকে এবং কাঁদতে থাকেন। তিনি কাঁদতে থাকেন তার ব্যথার জন্যে, তার ক্ষোভের জন্যে, তারা ফিরোজারঙা চোখের মেয়েটির জন্যে যে কি-না কখনো তার হাসি থামায় না।
(গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ক্যাথেরিন সিলভার)


হোটেল কক্ষ ।। হুয়ান হোসে সায়ের, আর্জেন্টিনা

গভীর নিমগ্নতায় অতিথিটি আয়নায় তার নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে এক মুহূর্ত। উলঙ্গ শরীর আর মুখাবয়ব থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্যে তার জীবন আর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড যথেষ্ট নয় মোটেও। দেখে মনে হয় সে অনেক কিছুই পেয়েছে। বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। এখন কি নারীরা তাকে দেখে পাত্তা না দিতে শুরু করেনি? আর কয়েক বছর পরই তো সে সাদামাটা বুড়ো হয়ে যাবে, শহরের রাস্তায় সে হাঁটবে উদ্ভ্রান্তের মতো, লোকেরা তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে হয়ে উঠবে বিশেষত্বহীন, মলিন ও ধূসর। তারুণ্যে সে ভাবত, বৃদ্ধ বয়স হবে প্রজ্ঞা ও জ্ঞানসমৃদ্ধতার বয়স, পরে একটা সময় তার কাছে বৃদ্ধ বয়সকে পশুদের চেয়ে কিছুটা ধীর ও অনিবার্য পরিবর্তন মনে হলো। বছরের পর বছর বেঁচে থাকার পর মনে হলো, বয়সের সাথে শুধু থেকে যায় ভ্রমপ্রবণ শরীরটুকু। কিন্তু এই ভাবনাটুকুও দ্রুতই কেটে যায় তার। সৈকতে যেতে গড়িমসি করা তার ভ্রমণসঙ্গীটি হঠাৎ বাথরুমে করিৎকর্মা হয়ে ওঠে। সে দাঁত মাজা শেষ করে স্নানঘরের পাশে উলঙ্গ হতে শুরু করে। লোকটি আয়নায় নারীটিকে গভীর পর্যবেক্ষণ করতে থাকে : যখন নারীটি তার চুলের খোঁপা খুলে হাত দ্বারা চুলে দু-তিনটি মৃদু আঘাতের পর কাঁধের ওপর ছড়িয়ে দেয়, তার শ্যামলরঙা সুগঠিত শরীরকে আরও চিত্তাকর্ষক ও মোহনীয় মনে হতে থাকে। তারপর সে কৃত্রিম ঝর্নাধারার নিচে চোখ বন্ধ করে মাথার সামনের ভাগ কিছুটা ওপরের দিকে উঁচিয়ে এমন উৎসাহে নিজের শরীরে হাত বোলাতে থাকে যেন সে দমকা বৃষ্টিতে ভিজছে। এই সুগভীর, সুকোমল সাবলীল বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের একটি মুহূর্তের দৃশ্য দেখতে দেখতে তার নিজের ভ্রমাত্মক ভাবনা উধাও হয়ে যায়, বাথরুমের এই একটি মুহূর্ত তার কাছে প্রাণময় ও অর্থবহ হয়ে ওঠে। 
লোকটি যখন হোটেলের বিল পরিশোধ করছিল, তখন তার সাথে পনেরো মাস ধরে বসবাস করা মেয়েটি অনুভব করে, লোকটি তার কাছে নিজের সমূহ গোপনীয়তা গোপন রেখেছে। কেন এই নীরবতা, এই নিরানন্দ দৃষ্টিপাত; তাৎক্ষণিক যে উত্তর উঠে আসে (কেউ এক্ষেত্রে সাহায্য নয় বরং পর্যবেক্ষণ করতে পারে) তা কি হৃদয় উৎসারিত ক্ষমাপ্রার্থনা? বাইরের বেশভুষায় সে খুবই স্বাস্থ্যপ্রদ, সুঠাম ও প্রাণবন্ত। মেয়েটি নিজের সাথে নিজে কথা বলতে থাকে। সে নিজেকে বলতে থাকে, লোকটির এই অস্বস্তির কারণ যদি আমার অস্থিরতা, আমার স্থির হওয়ার চাহিদা, আমার অপরিমেয় চাহিদাপূরণ যদি তার জন্যে দুর্বোধ্য বোঝা হয়ে থাকে, তবে তা খুব একটা অন্যায্য বলা যাবে না। সে উদারচিত্তে ভাবতে থাকে, আমি এখন থেকে আরও উদার হব, উচ্ছল জৈবনিক হব এবং কোনো কিছুই আগবাড়িয়ে করব না। তারা যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হচ্ছিল, মেয়েটি তার দুর্বোধ্য ভাবনার কাছে পরাজিত হলো (সেটি হতে পারে আশাবাদের বা সমর্পণের) এবং লোকটির উদার অঙ্গভঙ্গির কাছে নিজেকে এলিয়ে দিলো। লোকটির বাহুবন্ধনীতে তার কাঁধজোড়া আরও সন্নিবিষ্ট হলো। খুব ধীরে ধীরে আনন্দচিত্তে তারা নির্জন শহর পেরিয়ে হোটেলকক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। কিছুটা সময় পর বিছনায় পরস্পর উলঙ্গ হয়, তারপর সঙ্গম শেষে তারা তাদের নিজের ভাবনার ভেতর পরস্পর নিজেকে সমর্পণ করে। ধীরে ধীরে পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন হতে হতে তারা ঘুমের রাজ্যে এগিয়ে যায়। এই এগিয়ে যাওয়াকে কেউ কেউ নিঃশেষ হওয়াও বলতে পারেন। কেউ কেউ এমনটাও বলতে পারেন, সত্যের ভেতর এসে কৃশতার পরিসমাপ্তি ঘটেছে বা সর্বোপরি মনোরাজ্যের পতন ঘটেছে।
সারা সকাল ধরে কাউন্টারে কাজ করা হোটেলের ম্যানেজারটি তাদেরকে দুপুরের কিছুটা আগে হোটেলের ইলাভেটর থেকে বের হতে দেখে। সে তাদের হাতে বিলের কাগজ ধরিয়ে দেয় এবং টাকাটা আদায় করে নেয়। অতিথির দিকে মুখের পরিবর্তনটাকে ধরে রেখে মাথা উপরের তলার দিকে উঁচিয়ে ইঙ্গিত করেন, কাজের লোকজনের কাজে পরিচ্ছন্নতার জন্যে কক্ষটি ছেড়ে দিতে হবে। এই জুটি অর্ধখোলা প্রশস্ত দরজাটি পেরিয়ে যেতে না যেতেই সে প্রকৃত বিলের কাগজটি তার সাথে আনা একটা জমাখরচের খাতার ভেতর গোপন করে (অতিথিদের হাতে নকল বিলের কাগজটি ধরিয়ে দিয়েছিল) এবং তাৎক্ষণিক তাদেরকে ভুলে যায়। এরকম দ্বিগুন বিলের হিসাব তার নিজের ট্যাক্স পরিশোধের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। এখন লবিতে কিছুটা নীরবতা। কোনো লোকজন এখানে নেই। গাছালির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘ জানালায় রোদের কিরণ ছড়িয়ে দিচ্ছে সেপ্টেম্বরের সূর্য। টিভি বন্ধ। শূন্য পড়ে আছে হাতলওয়ালা চেয়ারটি। দু-তিন মিনিট একদম কিছুই ঘটেনি সেখানে। লোকটি কাউন্টারের পাশে নিশ্চল দাঁড়িয়ে ডুবে আছে তার নিজস্ব ভাবনায়। তারপর ইলাভেটরের সেই চিরচেনা শব্দ, ওপর থেকে ভেসে আসা শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল আলোকোজ্জ্বল লবিতে। 
(ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন কির্ক নেসেত)


নাস্তিবাদী ।। রন কার্লসন, যুক্তরাষ্ট্র

আবার একটা প্লেনে চেপে বসেছে সে। খুবই দেরি হয়ে গেছে। ডেনভারের সঙ্গে একটা সংযোগ স্থাপনে সে ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিম আকাশটা অন্ধকার হয়ে আছে আর রাতের এই বিশাল প্লেনটা পশ্চিম দিকেই যাচ্ছে। বলতে গেলে বিমানের অর্ধেকটা আসনের যাত্রী উঠেছে। তাই লোকেরা ইচ্ছেমতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। যে যেখানটায় পারছে কেউ কেউ তিনটা আসন নিয়ে এঁকেবেঁকে শুয়ে আছে। যাত্রীসেবিকা এলেন এবং এবং তাকে একটা কফি দিয়ে গেলেন, তারপর আবার এসে তিন প্যাকেট বিস্কুট দিয়ে একগাল হেসে বললেন, ‘নিজেকে শান্ত রাখুন।’ লোকটি যাত্রীসেবিকার দিকে চোখ তুলে তাকালেন এবং বললেন, ‘আমি মূলত এই বিমানের যাত্রী নই। আগের বিমানে যাওয়ার কথা ছিল আমার।’
লং জার্নিতে এবারই সে অনেকটা ক্লান্ত। পাঁচ কি ছয়টা নগরী, তারপর হোটেল, তারপর তার স্থির হওয়া। আর তারপর আজ উতাহ পাহাড় অতিক্রম করে যেভাবে তার চিরচেনা উপায়ে সূর্য ডুবেছে এই অবস্থাটিকে সে ভালোবাসে এবং এই সৌন্দর্য মূলত তাকে বেদনাহতও করে। এটাকে তার কাছে এক ধরনের পরিবর্তন মনে হয়, এবং বছরের পর বছর ধরে পরিবর্তনই মূলত মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। সে সৌন্দর্যের প্রতি দুর্বল এবং পরিবর্তনের প্রতিও দুর্বল কিন্তু এই দুর্বলতা তার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত হওয়া থেকে নিস্কৃতি দিতে পারে না। এখন সে তার নিজেকে বলছে, ‘আমার এই অপদার্থ হৃদয়টা অনেক আগেই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে।’ 
এখন এই বিমানে সে খুবই ক্লান্ত। সে জোরে জোরে নিজেকে বলতে থাকে, ‘তোমার হৃদয় বিক্ষত হয়েছে, তাতে কার কী আসে যায়! কোন শালারপুত এর খবর রাখে?’ যখন সে ক্লান্ত থাকে এই ভাবনা ও আচরণ তাকে কিছুটা সাহায্য করে এবং সে কিছুটা ভালোলাগা অনুভব করে। বিমান এখন তার গনগন শব্দ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তাতে তার কিছুই আসে যায় না। 
কয়েকটা কারণে সে বাড়ি ফিরতে চায় এবং এখন সে সেখানেই পৌঁছে গেছে, আর তাতেই-বা তার কী আসে যায়! সে তার নতুন নাস্তিবাদের ভাবনার সাথে হাসছে। সে নিজে একটা অপদার্থ নাস্তিবাদী ছিল। ওহ, সে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালোটাকেও গাধা বানিয়ে দিতে পারত। খুব হেভিওয়েটদেরকেও সে বোকা বানিয়ে দিত। তারপর এখন তার নাস্তিবাদ খুব হালকা হয়ে ওঠে তার কাছে এবং পৃথিবী থেকে দূরের এই বিমানে সে নিতান্তই একা হয়ে পড়ে। তার নাস্তিবাদ পুরোপুরি প্রতারণাপূর্ণ। যখন সে খুব বিরক্ত হয়, সে তার মুখটা অদ্ভুতভাবে বাঁকায়। একজন প্রতারক নাস্তিবাদী হিসেবে এখন সে তার মুখ বাঁকাচ্ছে। এই বিষয়টাকে সে খুবই পরোয়া করে। মাত্র পাঁচ সেকেন্ডের জন্যে সে তার নাস্তিবাদে শান দিলে তারপর পুরো দুনিয়া তার হাতের মুঠোয় চলে আসবে, যেসব লোকজনকে সে গ্রাহ্য করে, তারাও চলে আসবে, তাদের নামগুলো, এবং যত জায়গায় তার নাম নেওয়া হয় এবং সেসব লোকেরা যারা অন্ত্বসারশূন্য প্রার্থনাসঙ্গীত গাইতে যায় তা থেকেও তারা চলে আসবে তার সামনে। জীবনভর সে এই সমীহটুকুই চেয়েছে। সে এই সমীহটুকুই প্রদর্শন করেছে। সে এটা করতে সক্ষম ছিল। সমীহর গুষ্টি কিলানো যাক। সে আবার হাসে। খুবই ক্লান্ত সে। দিনটা খুবই দীর্ঘ এবং এ বিষয়ে সে পূর্ণ সতর্ক আছে। ভালো কিছু একটা ঘটে থাকবে, সে জানে, কমপক্ষে একের অধিক প্রকৃতপক্ষে, এবং এই ঘটমান বিষয়টি তার পকেটের ভেতর এখন। বিমানসেবিকা সিলভারের বড় রকমের একটা ব্রেসলেট পরে আবার আসে এবং তাকে আরও কফি দিয়ে যায়। সে বিমানে টাইপ করছিল আর কফি খাচ্ছিল এবং মহিলাটি হয়তো কোথাও নিরাপদেই ছিল। এটাই সম্ভবত এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে বেশি জানা প্রয়োজন। ওরে আমার নরক মহিলা। এবার সে পাজামা পরিহিত অবস্থায় হলুদ বিছানায় ঘুমন্ত মহিলাটির কথা ভাবছে। সে হাসছে। তার এবারের হাসিই প্রকৃত হাসি, সে হাসি তার মুখকে ডুবন্ত সূর্যের মতো উজ্জ্বল ও রক্তিম করে তোলে। 
সে আবার একটা প্লেনে চড়েছে এবং যদিও তার ক্লান্তিতে এটিকে কোনো কিছুর শেষ হয়ে যাওয়ার মতো খুবই অন্তঃসারশূন্য বোধ হচ্ছে। সত্যিকার গাম্ভীর্য নিয়েই সে এটি জানে যে, সবকিছুই ঠিকঠাক হয়ে যাবে।


গল্পগুচ্ছ ।। নাতাশজা গোর্কি, প্যোলান্ড 

গল্প # ১, ‘বিচ্ছেদ’ : আমি বিচ্ছেদ ঘটালাম।
গল্প # ২, ‘স্মৃতি’ : আমি স্মরণ করলাম।
গল্প # ৩, ‘প্রত্যাবর্তন’ : আমি ফিরে এলাম।
এবং আরও কিছু।
এই গল্পগুলো ছোট কিন্তু ব্যঞ্জনাময়। এগুলোকে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করার কিছু নেই। শেষ বাক্যটা প্রথম বাক্যের ভেতরেই নিহিত আছে। সব রকমের সময়কে এই বাক্যটাই রক্ষা করে চলে। অন্যগুলো নিয়ে কে মাথা ঘামায়? যা কিছু লেখা যায়, সবটুকুই এর ভেতর আছে। সবার জন্যেই একজন করে মানুষ থাকে, সবকিছুর জন্যেই একটা কিছু থাকে। বর্ণনা, উদ্ভাবন, মন্তব্য―সবকিছুতেই। সময়ের আগেই সেটি পড়ে নাও।
আর আমার বিচ্ছেদ ঘটানোর বিষয়টি? সেটিই আমি স্মরণ করছি? আমার পথেই আমি ফিরে আসছি? এসব কথা কে শোনেনি আগে! একটা পর্যায়ই যথেষ্ট : একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, একটা শিরোনাম, যেকোনো পুরনো জগাখিচুড়ি, আর এই সবকিছুই একসাথে ফিরে আসে। 
স্মরণ করা। বিচ্ছেদ ঘটানো।
যার ক্ষেত্রে এসব ঘটেনি, সে কখনো এসব বুঝতে পারবে না। তা সে যেভাবেই বিশ্লেষণ করুক না কেন, সেটি কোনো ব্যাপার নয়। এই সব কথাবার্তাই এর ভেতর নিহিত। সে এর নিগুঢ় অর্থ খুঁজে বের করতে পারবে না। বিচ্ছেদ ঘটানো, স্মরণ করা, ফিরে আসা। এবং আরও কিছু।
(ইংরেজিতে ভাষান্তর করছেন : ডব্লিউ. মার্টিন)

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
গরুবোঝাই ভটভটির সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২
গরুবোঝাই ভটভটির সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২
ইউক্রেনকে ৫৫০ কোটি ডলারের সহায়তা দেবে সুইজারল্যান্ড
ইউক্রেনকে ৫৫০ কোটি ডলারের সহায়তা দেবে সুইজারল্যান্ড
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী