মা, পাখিটা কী বলছে?
রুহানের প্রশ্ন শুনে মা বারান্দার দিকে তাকান। ছোট্ট একটা পাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে। চোখগুলো কেমন অদ্ভুত গাঢ় কালো রঙের; যেন ওদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলছে। পাখির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মা তাকান রুহানের দিকে। রুহানও অবাক বিস্ময়ে দেখছে পাখিটাকে। মা যেন একটু আনমনা হয়ে পড়েন।
কথা বলছ না কেন মা? কী বলছে পাখিটা?
ছোট্ট রুহানের প্রশ্ন শুনে মায়ের আনমনা ভাব কাটে। পাখিটার দিকে আবারও ভালো করে তাকান মা। তারপর বলেন—
কিছু বলছে না, সোনা। এমনিতেই পাখিটা তার মাকে ডাকছে।
কথাটা বলেই রুহানের মা অবাক হন। কেন বললেন তিনি এ কথা? পাখিটা কি তার মাকে ডাকছে? সত্যিই কি তাই? এমনও তো হতে পারে পাখিটা সত্যি সত্যিই তার মাকে ডাকছে? নাকি সে তার নিজের মায়ের কথা ভাবছে বলেই এমন কথা তার মুখে চলে আসলো? সেই কবে তার মা মারা গেছে—রুহানের নানি।
পাখিটা বারান্দার কার্নিশ থেকে উড়ে এসে বসে রুহানদের ঘরের ওয়ার্ডরোবের উপর। তারপর রুহানের দিকে ঘাড়টা তেরছা বাঁকা করে পাখিটা বলে—মায়ের কথা ভাবছি রুহান। তুমি কি আমার মাকে দেখেছ?
খিলখিল করে হেসে উঠে রুহান। মায়ের কাপড়ের আঁচল চেপে ধরে। তার মা কত্তো ভালো মা। পাখির মনের কথাটাই বলে ফেলেছে। কিন্তু আহারে! পাখি সোনাটা ওর মাকে খুঁজে পাচ্ছে না।
তোমার মা কোথায় গেছে?
জানি না তো! খেলছিলাম ওদিকের পুকুরপাড়ের মাছদের সাথে। হঠাৎ দেখি মা নেই।
কথাটা শেষ করে পাখিটা ই-ই-ই করে কাঁদতে থাকে। পাখিটার কান্নার শব্দে রুহানেরও কান্না পায়। দরদমাখা মনে পাখিটার দিকে হাত বাড়ায় রুহান। কিন্তু না! পাখিটা উড়ে দূরে চলে যায়। রুহান হায় হায় করে ওঠে।
কী হলো, পাখি সোনা?
না, তোমার কাছে যাব না। মানুষের কাছে যাওয়া আমাদের বারণ। মা মানা করেছে।
পাখিটার কথা শুনে দুঃখ পায় রুহান। তার চোখে পানি চলে আসে।
কেন তোমার মা বারণ করেছে ছোট্ট পাখি? মানুষেরা কত্ত ভালো।
না, মানুষেরা ভালো নয়। তুমি জানো না কিচ্ছু। মানুষেরা আমাদের পাশের বাসার লইকে ধরে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে।
আহা! সত্যি নাকি? কেন খেয়ে ফেলল মানুষেরা? আমরা তো খাই না কোনো পাখি।
কিন্তু রুহানের কথাটা ছোট্ট পাখিটার পছন্দ হয় না। সে আশেপাশে ঘাড় কাত করে আরেকটু ভালো করে তাকিয়ে নেয়। তারপর রুহানের দিকে তীর্যকভাবে তাকিয়ে বলে—
তুমি পাখি খাও না? সত্যি বলছ?
না, আমরা কেউ-ই পাখি খাই না। পাখি কেন খাব? পাখি কত সুন্দর। আমার খুব ভালো লাগে।
যেন রুহানের কথাটা পাখিটার খুব মনে ধরে। সে এবার একটু সাহসের সাথে রুহানের দিকে হেঁটে আসে। রুহান খুব আনন্দিত হয়। খিলখিল করে হেসে ওঠে।
এই সময় বারান্দায় আরেকটা পাখি উড়ে এসে বসে গ্রিলে। ঘরের ভেতরের ছোট্ট পাখিটার দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলে—
উড়ি, কী করছ এখানে? দ্রুত আসো। মানুষেরা তোমাকে খেয়ে ফেলবে। জানো না, মানুষেরা তোমার মাকে ধরে নিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে?
পাখিটার কথা শুনে ছোট্ট পাখি আর রুহান দু’জনেই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকায়। ছোট্ট পাখিটার ছোট্ট গাঢ় চোখে পানি টলমল করছে। রুহান সেদিকে তাকানোর সাহস পায় না। হঠাৎ করেই রুহান ভাবে—ওর মাকেও কেউ ধরে নিয়ে যায়নি তো? রুহান ‘মা মা’ বলে কেঁদে ওঠে।
পাশ থেকে মায়ের আদরমাখা হাত রুহানের বুকে-পীঠে-মাথায় ভালোবাসার পরশ বোলায়—কী হয়েছে সোনা? দুঃস্বপ্ন দেখছিলে?
রুহান মায়ের প্রশ্নের জবাব দেয় না—বুঝতে পারে মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। বারান্দার দিকে তাকায়। সেখানে ছোট্ট পাখিটা নেই। পাখিটা নিশ্চয়ই এখন মায়ের জন্য কাঁদছে। আচ্ছা, ওর মাকে কেউ ধরে নিয়ে যাবে নাতো? ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলবে নাতো? হঠাৎ এই চিন্তাটা রুহানের মাথায় আসতেই ও কেঁদে ফেলে। মা রুহানকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। রুহানও মায়ের বুকে মিশে গিয়ে আকড়ে ধরে মাকে।