বিতানের রোগটা পুরোনো। হাওয়া লাগলেই ওর উড়ে যেতে ইচ্ছে হয়। ছোটবেলায় অবশ্য খানিকটা বোঝানো যেত। কখনো ট্যাংকের ওপর তুলে দিয়ে, কখনো চেয়ারের ওপর দাঁড় করিয়ে চারুলতা বলেছেন ‘ওড়’। বিতান ধড়মড়িয়ে পড়ার আগেই ধরে নিয়েছেন তিনি। গান গাইতে ভালোবাসেন চারুলতা। সুরঞ্জন অফিস থেকে ফেরার আগেই হারমোনিয়াম সরিয়ে রাখেন। আগের মতো আর এখন গলা পাশের বাড়ির দাদার কানে গিয়ে পৌঁছায় না। এই বিষয়ে অবশ্য শ্যামলদা নিজেকেই দায়ী করে। বিতানকে গান শিখিয়েছে সুরঞ্জন। শিক্ষকের কাছে। বিতানের গানের গলা সুরঞ্জনের খুব পছন্দ। বিতানকে গান গাইতে শুনলেই চারুর সেই মুহূর্তে ভাত নামানোর কথা মনে পড়ে, কিংবা কী জানি, বেড়াল এসে আলগা দুধে মুখ দিলো কিনা? সুরঞ্জন বিতানকে বলেছে—“মা, তোকে হিংসে করে।”
উড়তে পারে না বিতান। মেনে নিয়েছে মায়ের কথা। তার ডানা নেই। বিতানকে পাখি পুষতে শিখিয়েছে সুরঞ্জন। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম। বিতানের কড়া ডাক বা আদর দুটোই বোঝে পাখিগুলো। খাঁচার ভেতর ওদের এদিকওদিক স্বল্প ফড়ফড় দেখে বিতানের মনটাও ভাবতে শিখে যায়, উড়ে কাজ নেই।
কিন্তু না! এই ২১ বছর বয়সে তার ডানা গজিয়েছে। স্নানের ঘরে একবার হঠাৎ দুটো হাত এমনিই ঝাপটা দিতে গিয়ে ছাদে ঠোক্কর খায় সে। প্রথমেই মনে হয় “মা মিথ্যে বলেছে’।’ মাকে গিয়ে দেখাবে বলে ২১ বছরের ছোকরা চেয়ারের ওপর সটান দাঁড়িয়ে হাত ঝাপটাতে থাকে, চারুলতা দেখতে পায় খুব ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে পা দুটো ওপরে উঠে যাচ্ছে। মা সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে জড়িয়ে ধরে দুটো পা। “নাম বাবা নাম! অমন করে না!” খুব রাগ হয় বিতানের। সেদিন সে না খেয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। মা কি কোনোদিনও ওকে বিশ্বাস করবে না? বাবা কি ঠিক বলে?
শ্রেয়া বিশ্বাস করবে?
শ্রেয়া খুব প্র্যাক্টিক্যাল মেয়ে। ওর ক্যালকুলেশন খুব সিম্পল। খিদে পেলে দৌড়তে হয়, তখন হাঁটতে নেই। ঘুম পেলে সম্পর্ক ভাঙতে হয়, আরামের কোনো অল্টার অপশন হয় না। বিতানকেও তাই বোঝায়।
“জানিস! আমি উড়তে পারি!”
“আমিও পারতাম। পৃথিবীর সব মেয়েরা আসলে উড়তে জানে। ওদের বসার মতো ছাদ নেই কিনা!”
“আরে! তুই বলিসনি কেন?”
“আইটি সেক্টরের জবটা অনেক জরুরি বলে”
বিতান ভাবতে পারেনি এমন উত্তর পাবে। শ্রেয়া ওর ছোটবেলার বন্ধু। এখন প্রেমিকা। খুব ছটফটে। একজায়গায় ধরে রাখা যায় না। জীবনের প্রতিটি বিষয়ে সে মতামত রাখতে পারে। ভীষণ সুন্দর করে কথা বলতে পারে শ্রেয়া। যখন কথা বলে, তখন যেন এই পৃথিবীতে ও থাকে না বলে মনে হয় বিতানের।
বিতান সবে সবে উড়তে শিখেছে। অথচ কাউকে দেখাতে পারছে না। পার্থকে যদি দেখায়? পার্থ চালের ব্যবসা করে। সতেরো বছরেই পড়া ছেড়ে দোকানে গিয়ে বসতে শুরু করেছে সে। মা আগে কিছু করতো না। এখন দুটো রান্নার কাজ ধরেছে। আজকাল মাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগে পার্থর। মায়ের কি টুপ করে বয়স কমে গেছে নাকি?
পার্থ যখন বস্তা থেকে হাতে চাল তোলে নেয়, চোখগুলো চকচক করে ওর। ছোটবেলায় পাওয়া মানচিত্রের গ্লোবটা চাল সেঁটে সেঁটে ভরিয়ে ফেলেছিল পার্থ, বাবার মৃত্যুর ঠিক সাতদিনের মাথায়। পার্থ দেখছিল, কেমন ছাদ ছেড়ে শূন্যে দুলছে বিতান। খুব ভয় পেয়েছে ও। বিতানকে বাবার মতো দেখাচ্ছে কেন?
“তুই নেমে আয়! এখনই নেমে আয়! আমার মা-টাকে একটু বাঁচতে দে!”
বিতান নামতে পারছিলো না। অনেক কষ্টে পার্থ পা টেনে নামিয়েছে ওকে। সারাটা রাস্তা বিতান ভাবতে ভাবতে এসেছে, সে উড়তে শিখলেও নামতে শেখেনি। উড়তে শুরু করলেই তাহলে কি কাউকে থাকতেই হবে সঙ্গে, যে মাটির কাছাকাছি পৌঁছে দেবে তাকে?
মাকে আজ খেতে বসার সময় প্রশ্নটা করেই ফেলে সে। চারুলতা বলে ওঠেন,
“পাখিরও তো একটা গাছ লাগে।”
মনখারাপ বিতানের। রাত দুটো। মা ঘুমোচ্ছে। মায়ের ঘরে প্রবেশ করে বিতান। জ্যোৎস্নার সরল আলো মায়ের পিঠে এসে পড়েছে। কিন্তু ওটা কী? যেন মনে হচ্ছে কেউ খুব যত্ন করে দুটো বিরাট ডানাকে ছেঁটে ছোট করে রেখেছে। শাড়ির আঁচলে সহজেই লুকিয়ে ফেলা যায় সেই আদল…