অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। ছাতার ছোট্ট ফুটো দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ছে আমার কাঁধে। টপ টপ করে একেকটা ঠান্ডা বিন্দু আমার বুকটাকে কাবু করছে এবং আমার অসহ্য ঠান্ডা লাগছে। বৃষ্টিতে এভাবে আটকাব ভাবিনি।
আমার শার্টটা হালকা গোলাপি রঙের—ইন্টারভিউর জন্য কিনেছিলাম। জুতোগুলোও অনেক দামি। আমার জুতোর ভেতরে পানি ঢুকেছে এবং ঝড়ের দাপটে শরীরের পিছন দিকটা পুরোপুরি ভিজে গেছে। তবু মাথার উপরে শক্ত হাতে ছাতাটা ধরে আছি। মাথাটা বাঁচাতে পারলে বেঁচে যাব। এ জীবনে মাথা বাঁচিয়েই সবদিক বেঁচে গেছি; ঝড় থেকেও বেঁচে যাব।
দুপাশ থেকে বাতাস পীড়া দিলে আমি হাঁটতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলাম; খুব রোমান্টিক পরিবেশ! কোনো মানুষ নেই, শো শো বাতাস আর বৃষ্টির ঝনঝন শব্দ।
সতেরোর সময়ে গরমের দিনেও আমি কল্পনা বিলাসী ছিলাম। এখন এত বড় শরীর নিয়ে ছোট্ট সুখানুভূতি মাথায় ঠাঁই করে না। দুঃখ হয় যে, আমার অনুভূতিগুলো ফেরত আসার নাম নিচ্ছে না।
কঠিন পরিস্থিতি; হঠাৎ বজ্রপাত শুরু হলো। দুই-একবার গুড়ুম করে বিদ্যুৎ শেকড় বাকড়ের মতন আলোকিত করল আকাশটাকে এবং সাথে আমার আশেপাশের অন্ধকার গাছ-বাড়িগুলোকেও।
চারিদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, খোলা রাস্তায় কেউ নেই। অসম্ভব অপ্রকৃত পরিবেশ! শুধু আমিই বাড়ির বাইরে আটকা পড়েছি।
হঠাৎ আকাশে একটা ফ্ল্যাশ লাইট পড়ল। গু গু ডাক ছেড়ে আমাকে স্পট করল লাইটটা। আমি হতভম্ব হলাম এবং দ্রুত সরে এলাম। তারপর স্পট লাইটের জায়গাতে ধড়াম করে বজ্রপাত হলো।
আমি একমুহূর্ত কিছু বুঝতে পারলাম না। যেদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছি আবারও সেদিকে এসে একটা আলো পড়ল এবং আবারও বজ্রপাত হলো। কি নতুন ধরনের বজ্রপাত হলো এটা! যেন খুঁজে খুঁজে মারছে!
বুঝতে পেরে আমি দৌড়ে পালালাম—দেখলাম একটা না, বহু আলো এবার আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আলো আমি ভয় পাই, বিশেষত রোদের আলো আমার কাছে আতঙ্কের। এই মুহূর্তে আকাশ ছিঁড়ে এক ফাটল গোলকাটা রোদ আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং আমাকে লক্ষ্য করে ক্রমাগত বজ্রপাত ফেলছে। বজ্রপাত না বলে বোমা বলা যায়, আমাকে পয়েন্ট করে যেন বোমাগুলো ফেলা হচ্ছে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় সুযোগ বলে কিছু নেই যে, ভুল থেকে শিক্ষা নেব। একবার ভুল করলেই... পানিশড্ টু ডেথ্।
আমি ছুটতে লাগলাম। আমার আশপাশে পড়তে লাগল বিদ্যুতের শেকড় বাকড়। এতটা ভয়ানক! আমি ছুটতে লাগলাম এক নিঃশ্বাসে; অফিসের জুতোগুলো খুলে গেল। তবু ছুটতে লাগলাম নগ্ন পায়ে।
...
আমার ঠোঁটগুলো এখন বেগুনি নীল। এবং শরীর ঠান্ডায় পানিশূন্য সাদা। মাথা বাঁচানোর ছাতাটা তো শুরুতেই ফেলে দিয়েছিলাম। সবসময়ের মতন মাথাটা বাঁচাতে পারলে হয়ে যেত হয়ত বা। কিন্তু সন্দেহ আছে, আমাদের জীবনে কোনো না কোনো সময় এমন আসে...যেটা আসলে অন্যের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফল।
সে জায়গায় চিন্তাহীন খোশমেজাজ নিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে করতে আমি বেঁচে যাব, এটা ভাবা যায় না। কেউ এমন ভাবলে সে নেহাতই ইন্টারভিউতে বাদ পড়ে যাবে আমি গ্যারেন্টি দিতে পারি।
এই মুহূর্তে আমি ছুটছি। গু গু সাইরেনের শব্দে কোনো দল যেন আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে খুন করার জন্য। পায়ের নিচে একটা বড় বটগাছ মতন শৈবাল পেলাম। ছোট বলে তার ছায়া পেলাম না।
বুঝতে পারলাম পায়ের নিচে অজস্র আগাছাদের বন আছে। অদ্ভুতভাবে কোথাও একটা ঘরবাড়ি দেখলাম না অথচ একটু আগেও ফ্ল্যাশের আলোয় গাছ-বাড়ি দেখেছিলাম; সম্ভবত হাস্যকরভাবে বৃষ্টিতে মরুভূমির মরীচিকা দেখেছিলাম। শহরে হঠাৎ করেই ঘরবাড়িগুলো উধাও হয়েছে। অথচ আমি ভেবেছিলাম রোমান্টিক, জনমানবহীন পরিবেশ।
কোথাও মাথা রাখার ঠাঁই নেই। আশ্রয় নেয়ার মতন কোনো চাল পেলাম না। আমার ছাতাটা কিন্তু বড় ছিল। কিন্তু সেটা আমি ফেলে দিয়েছি।
স্পটলাইটগুলো সংখ্যা দুই, চার করে বাড়ছে; আমি দৌড়ে মরছি। অবশেষে ইট সমান একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। আলো আমার দিকে ফেলা হলো এবং আমি ভয়ে কেঁদে উঠলাম। মৃত্যুর পূর্বে আমি নিজের প্রেমিকার কথা ভাবলাম যার ছোঁয়া পাওয়া বৈদ্যুতিক শকের চাইতেও বড় ব্যাপার ছিল। যার ছোঁয়া শুধু আমি স্বপ্নে পেতাম।
ইতোমধ্যে একটা স্পট লাইট আমার দিকে তাক করা হলো; আমি নড়লাম না। এবার আর পালানোর জায়গা নেই। স্পটলাইট সংখ্যায় এতোবেশি বেড়েছে এখন যে আর দৌড়ানোর মতন স্পেসও নেই। বরং স্থির হয়ে একটা বজ্রপাতের অপেক্ষা করা শ্রেয় মনে করলাম; বেহেশতি আলোর মতন ধীরে ধীরে স্পটলাইটটা আমার গায়ে পড়ল। আমার মঞ্চ মঞ্চ অনুভূতি হলো। তারপর এক লাফে বজ্রপাতটা শেকড়ের মতো আমাকে এসে জাপটে ধরল। আর কোলে করে নিয়ে ছাই করে ফেলে দিল পৃথিবীতে। আমার ছাতা আর ইন্টারভিউর জুতো আগাছার উপর পড়ে রইল।