X
শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫
১৯ বৈশাখ ১৪৩২
ঈদসংখ্যা ২০২৫

চিনুয়া আচেবের ‘নাগরিক শান্তি’

অনুবাদ: মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী
২৭ মার্চ ২০২৫, ১২:৫৪আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৫, ১৩:৫৫

চিনুয়া আচেবে (১৯৩০-২০১৩) নাইজেরিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এবং আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের পথিকৃৎ। ১৯৩০ সালে ওগিদি শহরে জন্মগ্রহণ করা আচেবে তার উপন্যাসের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসন, আফ্রিকার সমাজব্যবস্থা এবং সংস্কৃতি-পরিবর্তনের দ্বন্দ্ব চিত্রিত করেছেন। তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘Things Fall Apart’ (১৯৫৮) বিশ্বব্যাপী আফ্রিকান সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনা হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস: ‘No Longer at Ease’ (১৯৬০), ‘Arrow of God’ (১৯৬৪) এবং ‘A Man of the People’ (১৯৬৬); ছোটগল্প সংকলন: ‘Girls at War and Other Stories’ এবং কাব্যগ্রন্থ: ‘Beware, Soul Brother’। নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তার রচনা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।

জোনাথন ইয়েগবু নিজেকে অতিশয় ভাগ্যবান বলে মনে করতেন। অভিবাদনকালে সব সময় তিনি 'কপালগুণে বেঁচে থাকি!' বাক্যটি বলতেন গভীর আত্মবিশ্বাসে। শান্তি প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকের দুর্বোধ্য দিনগুলোতে তিনি পুরোনো বন্ধুদের হালফ্যাশনের শুভেচ্ছা জানানোর বদলে 'কপালগুণে বেঁচে থাকি!' বলাটা অনেক যুক্তিপূর্ণ বলে মনে করতেন। এটি তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতেন। পাঁচটি অপ্রত্যাশিত আশীর্বাদ নিয়ে তিনি যুদ্ধ থেকে ফিরে আসেন—তার মাথা, তার স্ত্রী মারিয়ার মাথা এবং তাদের চার সন্তানের মধ্যে তিনজনের মাথা। বাড়তি পাওয়া হিসেবে তার কাছে নিজের পুরোনো সাইকেলটিও ছিল। এটি একটি অলৌকিক ঘটনা হলেও পাঁচটি মানুষের মাথার নিরাপত্তার সাথে এটিকে কখনো তুলনা করা যায় না।
সাইকেলটির নিজস্ব একটি ছোট ইতিহাস ছিল। যুদ্ধ যখন চরম তুঙ্গে তখন একদিন সাইকেলটিকে 'জরুরি সামরিক পদক্ষেপের জন্য' সামরিকীকরণ করা হয়েছিল। সাইকেলটি ছেড়ে দেয়া তার জন্য কঠিন হলেও অফিসারের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত থাকলে নিশ্চিন্তে তিনি এটিকে ছেড়ে দিতেন। অফিসারটির মানহীন ছেঁড়া কাপড়, নীল ও বাদামি রঙের জুতার ফাঁকে বেরিয়ে আসা পায়ের আঙুল এবং তড়িঘড়ি করে বেমানানভাবে আটকানো তার পদমর্যাদার তারকা দুটি জোনাথনকে মোটেও হতাশ করেনি। কারণ অনেক ভালো ও বীর সৈনিককে একই রকম বা আরও খারাপ দেখাচ্ছিল। বরং অফিসারটির ধরনে দৃঢ়তা এবং দক্ষতার অভাব ছিল। তাই জোনাথন সন্দেহ করেন যে সে প্রভাব খাটাতে পারে। তিনি রাফিয়া ব্যাগ হাতড়ে দুই পাউন্ড বের করে আনেন। জোনাথনের স্ত্রী মারিয়া ক্যাম্প কর্মকর্তাদের কাছে অতিরিক্ত শুঁটকি মাছ এবং ভুট্টা শস্য বিক্রি করে তাকে সেই অর্থ দিয়ে কাঠ কিনতে পাঠিয়েছিলেন। অফিসারকে তা ঘুষ দিয়ে জোনাথন সাইকেলটি ছাড়িয়ে আনেন। সেই রাতে তিনি সাইকেলটিকে ঝোপের ছোট্ট পরিষ্কার স্থানে পুঁতে দিলেন যেখানে তার নিজের কনিষ্ঠ ছেলেসহ ক্যাম্পের মৃত লোকদের কবর দেওয়া হয়েছিল। আত্মসমর্পণের এক বছর পরে যখন তিনি আবার এটি খনন করে অক্ষত বের করে আনেন তখন কেবল সামান্য পাম-তেল গ্রিজিং করা ছাড়া আর কিছুই দরকার হয়নি। তিনি অবাক হয়ে বললেন, "ঈশ্বরকে কিছুই ধাঁধায় ফেলতে পারে না!"।

তিনি সাইকেলটিকে তাৎক্ষণিকভাবে ভাড়া পরিবহণ হিসেবে খাটানো শুরু করেন। সাইকেলটির মাধ্যমে ক্যাম্প কর্মকর্তাদের এবং তাদের পরিবার পরিজনকে চার মাইল পথ পেরিয়ে নিকটতম পাকা রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার কাজের বিনিময়ে তিনি বিয়াফ্রান টাকার একটি ছোট স্তূপ জমা করে ফেলেন। প্রতি ট্রিপে তার গড়পড়তা ভাড়া ছিল ছয় পাউন্ড। যাদের কাছে অর্থ ছিল তারা এইভাবে অর্থের বিনিময়ে কিছু পথ পাড়ি দিয়ে খুশি হতেন। এক পক্ষকাল শেষে জোনাথন একশ পনেরো পাউন্ডের সম্পদ অর্জন করেন।

তারপর তিনি এনুগুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানে তার জন্য আরেকটি অলৌকিক ঘটনা অপেক্ষা করতে দেখেন। বিষয়টি সত্যি অবিশ্বাস্য ছিল। তিনি প্রথমে চোখ কচলে নিলেন, তারপর আবার তাকালেন। তিনি দেখলেন যে এটি এখনও তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বলা বাহুল্য, সেই বিশাল আশীর্বাদটিও পরিবারের পাঁচজন সদস্যের তুলনায় সম্পূর্ণ নিকৃষ্ট বলে গণ্য হবে। এই নতুন অলৌকিক বিষয়টি ছিল ওগুই ওভারসাইডের তার ছোট্ট বাড়িটি। প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরকে কোনো কিছুই গোলকধাঁধায় ফেলতে পারে না! একজন ধনী ঠিকাদার যুদ্ধের ঠিক আগে যে বিশাল কংক্রিটের ভবনটি স্থাপন করেন, তার মাত্র দুটি বাড়ি ছিল ধ্বংসস্তূপের পাহাড়ের পাশেই। আর এখানে ছিল মাটির ব্লক দিয়ে তৈরি জোনাথনের ছোট্ট দস্তার ঘরটি, ছিল একেবারে অক্ষত! তবে দরজা-জানালা ছিল না, আর ছাদ থেকে পাঁচ টুকরো দস্তার ছাউনিও ছিল উধাও। এমনই ছিল সেটি। যেভাবেই হোক, তিনি এনুগুতে ফিরে এসে আশেপাশে পড়ে থাকা পুরোনো দস্তা, কাঠের টুকরো এবং ভেজা কার্ডবোর্ডের টুকরোগুলো তুলে নিয়েছিলেন। তার পৌঁছানোর আগেই হাজার হাজার মানুষ বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে একই জিনিস খুঁজছিল। সে একজন নিঃস্ব ঘরামীকে পাঁচ নাইজেরিয়ান শিলিং বা পঞ্চাশ বিয়াফ্রান পাউন্ডের বিনিময়ে কাজ করাতে রাজি করায়। সমস্ত কাঠ, কাগজ এবং ধাতুর এই সব জিনিসপত্র দরজা-জানালার পাল্লায় রূপান্তরিত করার প্রত্যয়ে মিস্ত্রি মশাই তার হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হয়। জোনাথন পাউন্ড পরিশোধ করেন এবং কাঁধে পাঁচটি মাথা নিয়ে বেঁচে থাকা তার পরিবারের সদস্যদের সাথে সেই বাড়িতে আনন্দে বসবাস করতে থাকেন।

তার সন্তানেরা সামরিক কবরস্থানের আশপাশে আম কুড়িয়ে সৈনিকদের স্ত্রীদের কাছে কয়েক পয়সায় বিক্রি করে। এবার আদতেই পয়সা আসা শুরু হয়। তার স্ত্রী আবারও নতুনভাবে জীবন শুরু করার তাগিদে সকালের জলখাবার 'আকারা বল' তৈরি করে প্রতিবেশীদের কাছে বিক্রি শুরু করেন। সবার উপার্জনের অর্থ নিয়ে তিনি তার সাইকেলে চড়ে আশেপাশের গ্রামগুলোতে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। গ্রাম থেকে তিনি তাজা পাম-ওয়াইন কিনে আনেন। তিনি তার ঘরের ভিতর প্রচুর পরিমাণে ওয়াইন প্রস্তুত করেন এবং রাস্তার পাশের সরকারি কলের জলের সাথে প্রবাহিত করেন। এরপর সৈনিক এবং অন্যান্য সৌভাগ্যবান ও বিত্তবানদের জন্য তিনি একটি পানশালা খোলেন।

প্রথমে তিনি প্রতিদিন যেতেন, তারপর একদিন অন্তর একদিন এবং অবশেষে সপ্তাহে একবার কয়লা কর্পোরেশনের অফিসে যেতেন। সেখানে কী চলছে তা জানতে চাইতেন। সেখানে তিনি খনি শ্রমিক ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আবিষ্কার করেন যে, তার সেই ছোট্ট ঘরটি তার ধারণার চেয়েও অনেক বড় আশীর্বাদ। তার কিছু প্রাক্তন সহকর্মী খনি শ্রমিক ছিল যাদের দিনের শেষে ফিরে যাওয়ার কোনো আবাস ছিল না। অগত্যা তারা অফিসের দরজার বাইরে ঘুমিয়ে পড়ত এবং যা জুটতো বোর্নভিটা কৌটায় একসাথে খাবার রান্না করত। সপ্তাহগুলি দীর্ঘ হতে থাকল এবং তখনও কেউ বলতে পারছিল না যে কী কারণে জোনাথন তার সাপ্তাহিক পরিদর্শন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়ে পাম-ওয়াইন বারে ঢুকে রইলেন।

কিন্তু ঈশ্বরকে কিছুই গোলকধাঁধায় ফেলতে পারে না। ট্রেজারির বাইরে পাঁচদিন ধরে রোদের মধ্যে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে অবিরাম ঝগড়া-বিবাদের পর, সেই অপ্রত্যাশিত দিনটি ঘনিয়ে এলো। তার হাতে কুড়ি পাউন্ড অর্থ এলো। অর্থ প্রদান শুরু হলে পর তার এবং তার মতো আরও অনেকের জন্য দিনটি হয়ে ওঠে ক্রিসমাসের মতো। তারা এটার নাম দিয়েছিল এগ-রাশার। কারণ খুব কম লোকই এর সঠিক নাম মনে রাখতে পারত।

পাউন্ডের নোটগুলো তার হাতের তালুতে আসার সাথে সাথে জোনাথন সেগুলো শক্ত করে চেপে ধরলেন এবং মুষ্টিবদ্ধ হাত ও পাউন্ড তার প্যান্টের পকেটে লুকিয়ে রাখলেন। তাকে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হয়েছে কারণ কয়েকদিন আগে সে এক ব্যক্তিকে পাগলপ্রায় আচরণ করতে দেখেছে। কারণ জনসমুদ্রের ভিড়ের মধ্যে তার বিশ পাউন্ড গ্রহণের সাথে সাথেই একজন নির্দয় পকেটমার তার কাছ থেকে সমুদয় পাউন্ড ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়। যদিও অতটা যন্ত্রণার মধ্যে থাকা কোনো ব্যক্তিকে দোষারোপ করা অনুচিত, তবুও সেদিন লাইনে দাঁড়ানো অনেকেই ভুক্তভোগীর অসাবধানতার জন্য নীরবে তীর্যক মন্তব্য ছুড়ছিল। বিশেষ করে যখন সে তার পকেটের ভেতর থেকে চোরের মাথার আকৃতির মতো বড় একটি ছিদ্র সবার সামনে মেলে ধরে। নিশ্চিতভাবে সে জোর দিয়ে বলছিল যে, টাকাগুলো অন্য কারো পকেটে আছে। তাই সাবধান থাকা আবশ্যক ছিল।
জোনাথন খুব দ্রুত তার পাউন্ডসহ বাম হাতটি পকেটে ঢুকিয়ে রাখেন যাতে প্রয়োজনে তার ডান হাতটি করমর্দনের জন্য মুক্ত থাকে। যদিও অমন উঁচু নজরে তাকিয়ে থাকার ভান ধরে তিনি নিশ্চিত করেন যে, সমস্ত মানুষের দিকেই তিনি লক্ষ্য রেখে চলেছেন। তবে তার বাড়ি ফেরা পর্যন্ত তেমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।

সাধারণত তিনি ঘুমকাতুরে ছিলেন, কিন্তু সেই রাতে টের পেলেন ক্রমশ আশেপাশের সমস্ত শব্দ কমে আসছে। এমনকি দূরে কোথাও রাতের যে প্রহরী একটি ধাতব ঘণ্টা বাজায়, সেও রাত একটার ঘন্টাধ্বনির পর চুপ মেরে গেল। অবশেষে ঘুমের দেশে ডুব দেওয়ার আগে জোনাথনের মনে এটাই ছিল শেষ ভাবনা। যদিও সেই ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। তিনি ঝাঁকুনি দিয়ে জেগে উঠলেন।
"দরজায় কে ধাক্কা দিচ্ছে?"—মেঝেতে পাশে শুয়ে থাকা তার স্ত্রী ফিসফিসিয়ে শুধালেন।
"আমি বুঝতে পারছি না"—তিনিও রুদ্ধশ্বাসে ফিসফিসিয়ে জবাব দিলেন।
দ্বিতীয়বারে ধাক্কা এলো খুব জোরে এবং তা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে রুগ্ণ পুরোনো দরজাটি ভেঙে পড়তে পারত।
"কে ধাক্কা দিচ্ছে?"—জোনাথন তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তখন তার কণ্ঠস্বর শুকিয়ে কাঠ হয়ে রীতিমতো উত্তেজনায় কাঁপছিল।
ঠান্ডা স্বরে জবাব এলো, "আমরা হইলাম চোরের দল, দরজা খুইলা দাও"। এই কথা বলার পরপরই সবচেয়ে জোরে ধাক্কা মারা শুরু হলো।
গৃহকর্ত্রী মারিয়াই প্রথমে চিৎকার শুরু করে সতর্ক করা শুরু করলেন, তারপর জোনাথন এবং তাদের সন্তানেরা চিৎকার শুরু করে, "পুলিশ! আমাদের ঘরে চোর পড়েছে! প্রতিবেশীরা তোমরা কে কোথায়! পুলিশ ! আমরা বিপদে পড়েছি! আমরা মারা যাচ্ছি! প্রতিবেশীরা, তোমরা কি ঘুমিয়ে পড়েছ? জেগে ওঠো! পুলিশ আমাদের বাঁচাও!"
এরকম চিৎকার চেচামেচি অনেকক্ষণ ধরে চলল এবং হঠাৎ থেমে গেল। হয়ত তারা চোরকে ভয় দেখাতে সফল হলো। এমন পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ নীরবতা বিরাজ করলেও তা ছিল মাত্র ক্ষণিকের বিরাম।
"তোমাদের কাম কাজ শ্যাষ?"—বাইরের কণ্ঠস্বর জিজ্ঞাসা করল, "আমরা তোমাগো সাহায্য করবার লাইগা আসছি। বোঝবার পারছ সবাই!"
"পুলিশ ভাইয়েরা! …চোরের দল পালাইছে! ও গেরামবাসী, আমরা চোর তাড়াইয়া দিছি..."—দলপতির কণ্ঠস্বর ছাড়া আরও অন্তত পাঁচজন লোকের গলা শোনা গেল।
ওদিকে জোনাথন এবং তার পুরো পরিবার আতঙ্কে একদম স্থবির হয়ে পড়েছে। মারিয়া আর বাচ্চারা প্রেতাত্মার মতো গুমরে গুমরে কেঁদে চলেছে। জোনাথন ক্রমাগত আর্তনাদ করে চলেছেন।

চোর তাড়ানোর কলরবের পরের শুনশান নীরবতা ভয়াবহভাবে কেঁপে উঠল। জোনাথন এবার তাদের দলপতিকে আবার কথা বলতে এবং বিষয়টি সমাধান করতে অনুরোধ জানালেন।
অবশেষে দলপতি বললেন, "ওরে আমার দোস্ত, আমরা ফোনকল করবার জন্য বহু চেষ্টা করেছি কিন্তু আমার মনে হয় সবাই ঘুমায়া পড়ছিল...তাইলে আমরা কি করব? তুমি কি সৈন্যদের ফোন করতে চাও? নাকি আমরা তোমার পক্ষ হইয়া তাদেরকে ফোন দিব? সৈন্যরা পুলিশের চাইতে ভালো, তাই না?"
"মোটেও না"—তার সঙ্গীরা সমস্বরে বলে উঠল।
জোনাথন অনুভব করলেন যে, তিনি এখন আগের চেয়ে আরও বেশি শব্দ শুনতে পাচ্ছেন এবং তীব্রভাবে তিনি নিজেও কাতরাচ্ছেন। তার পা দুটো যেন তার শরীরের নিম্নভাগে ঝুলে পড়েছে আর তার গলা শুকিয়ে শিরীষ কাগজের মতো কাঠখোট্টা হয়ে গেছে।
"ও বন্ধু, তুমি আর কথা কইতেছো না ক্যান? আমি তোমারে জিজ্ঞাসা করতেছি, আমরা কি সৈনিকদের ডাকব?"
"না, ডেকো না।"
"ঠিক আছে। তাইলে এখন কাজের কথা কও। আমরা খারাপ চোর না। আমাগো ঝামেলা করার ইচ্ছাও নাই। সব ঝামেলা শ্যাষ। গৃহযুদ্ধ শ্যাষ। আর নয় গৃহযুদ্ধ। এবার গৃহশান্তি। কি বল, তাই না?''

"না, সেরকম কিছুই না!"—ভয়াবহভাবে সমস্বরে জবাব এলো।
 "তোমরা আমার কাছে কী চাও? আমি একজন দরিদ্র মানুষ। আমার যা কিছু ছিল সব এই যুদ্ধে হারিয়েছি। তোমরা কেন আমার কাছে এসেছে? যাদের কাছে টাকা আছে, তোমরা তাদেরকে অবশ্যই চেনো। আমরা এমনিতেই বিপদে..."

"ঠিক আছে! আমরা জানি তোমার কাছে অনেক পরিমাণ টাকা নাই। কিন্তু আমাদের তো একদমই কোনো টাকা পয়সা নাই। তাই তোমাকে ভালো করে কইলাম জানালাটা খুলে দাও, আমরা একে একে তোমার ঘরে ঢুকব। আমাদের একশ পাউন্ড চাঁদা দিলেই আমরা চলে যাব। নয়ত ক্রমানুসারে আমরা এখন ভেতরে এসে তোমাকে সেইরকম গিটার বাজানো দেখাব..."
ওদিকে আকাশে তখন স্বয়ংক্রিয় গুলিবর্ষণের শব্দের রোল উঠল। মারিয়া এবং বাচ্চারা আবারও তারস্বরে কান্নাকাটি শুরু করে দিল।
 "আহ, বেগম সাহেবা আবার কান্দে ক্যান? এইরকম কান্নার কোনো প্রয়োজন নাই। আমরা বলছিলাম যে, আমাদের মোলাকাত-মহব্বত ভালো থাক। আমরা শুধু অল্প পরিমাণ চাঁদা নিয়েই চলে যাব। কোনো নির্যাতন করার ইচ্ছা নাই। আমরা কি নির্যাতনকারী?''

"একদম না!"—সমস্বরে দলের সবাই চিৎকার করে বলল।

"বন্ধুরা," জোনাথন কাঁদো কাঁদো স্বরে শুরু বলা শুরু করেন, "আমি তোমার কথা শুনছি এবং তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। যদি আমার একশ পাউন্ড থাকত..."

''দেখো দোস্ত, আমাদের সাথে খেল না, আমরা তোমার ঘরে খেলতে আসি নাই। যদি আমরা জোর করে ভেতরে ঢুকে পড়তাম, তাহলে তুমি অত কথা বলার সুযোগ পেতে না। তাই..."
"ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। যদি তুমি ভেতরে এসে একশ পাউন্ড খুঁজে পাও তাহলে এটা নিয়ে আমাকে, আমার স্ত্রী ও সন্তানদের গুলি করে মেরে ফেল। ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, এই জীবনে আমার সঞ্চয় বলতে এই বিশ পাউন্ডের এগ-রাশার যা তারা আজ আমাকে দিয়েছে..."

''ঠিক আছে। অনেক সময় অপচয় হয়েছে। তুমি জানালা খুলে আমাদেরকে বিশ পাউন্ড এনে দাও। আমরা ঠিক সেইভাবে ব্যবস্থা করে নিব।"

তখন দলের মধ্যে তীব্র বিরোধপূর্ণ কথাবার্তা শোনা গেল— "মিথ্যা কথা বলছে লোকটি, ভিতরে গেলে প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে...চল ভিতরে গিয়ে ভালো করে খোঁজ কর...বিশ পাউন্ডে কি হবে?..."

''একদম চুপ!''—শূন্যে ফাঁকা গুলির শব্দের মতো দলপতির কণ্ঠস্বর চরমে উঠল এবং তৎক্ষণাৎ বচসা থেমে গেল।
"তুমি কি করতেছ ওইখানে? তাড়াতাড়ি পাউন্ড নিয়া আস!"

মাদুরের পাশে রাখা ছোট কাঠের বাক্সের চাবিটা অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে জোনাথন বললেন "আমি এক্ষুনি পাউন্ড নিয়ে আসছি"।
পরদিন ভোরে আলো ফুটে ওঠার পর প্রতিবেশীরা এবং অন্যরা যখন জোনাথনকে সমবেদনা জানাতে জড়ো হলো তখন সে তার পাঁচ গ্যালন ওজনের ডেমিজন বোতলটি সাইকেলের ক্যারিয়ারের সাথে বাঁধতে ব্যস্ত। পাশে তার স্ত্রী উনুনের আগুনের আঁচে ঘামতে ঘামতে প্রশস্ত বাটির ফুটন্ত তেলে আকারা বল উল্টে দিচ্ছিল। এক কোণে তার বড় ছেলেটি গতকালের পুরোনো বিয়ারের বোতল থেকে পাম-ওয়াইনের তলানি ধুয়ে পরিষ্কার করছিল।

"আমি এটাকে কিছুই মনে করিনি", তিনি তার সহানুভূতিশীল লোকদের বললেন, তার দৃষ্টি ছিল বাঁধনের দড়িটির দিকে। "এগ-রাশার কী? আমি কি গত সপ্তাহে এর উপর নির্ভর করেছিলাম? নাকি এটি যুদ্ধে হারানো অন্যান্য জিনিসের চেয়ে বড়? আমি বলি, এগ-রাশার আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাক! যেখানে সবকিছু চলে গেছে সেখানেই যেতে দাও।
"ঈশ্বরকে কিছুই গোলকধাঁধায় ফেলতে পারে না।"

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কমোডের ওয়াটার ট্যাংক পরিষ্কার করবেন যেভাবে
কমোডের ওয়াটার ট্যাংক পরিষ্কার করবেন যেভাবে
মিয়ানমারে পাচারের সময় ৬০০ বস্তা সারসহ দশ জন আটক
মিয়ানমারে পাচারের সময় ৬০০ বস্তা সারসহ দশ জন আটক
নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবিতে হেফাজতের বিক্ষোভ
নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবিতে হেফাজতের বিক্ষোভ
আগুনে পুড়ে মার্কিন সংগীতশিল্পীর মৃত্যু
আগুনে পুড়ে মার্কিন সংগীতশিল্পীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
অস্ত্র নিয়ে সাবেক এমপির ওপর হামলা, অল্পের জন্য রক্ষা
অস্ত্র নিয়ে সাবেক এমপির ওপর হামলা, অল্পের জন্য রক্ষা
টেকনাফে সরকারি বরাদ্দের মালামাল মিয়ানমারে পাচার
টেকনাফে সরকারি বরাদ্দের মালামাল মিয়ানমারে পাচার
সাপের কারণে জাপানে বুলেট ট্রেন চলাচল বন্ধ
সাপের কারণে জাপানে বুলেট ট্রেন চলাচল বন্ধ
চিন্ময়ের জামিন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, ইন্টেরিম সাবধান: হাসনাত আব্দুল্লাহ
চিন্ময়ের জামিন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, ইন্টেরিম সাবধান: হাসনাত আব্দুল্লাহ
কূটনীতিক সুফিউর রহমানের নিয়োগ নিয়ে হচ্ছে কী
কূটনীতিক সুফিউর রহমানের নিয়োগ নিয়ে হচ্ছে কী