X
মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫
২ আষাঢ় ১৪৩২

শহীদ কাদরীর স্মরণসভায় নীরা কাদরীর বক্তব্য || শেষ পর্ব

.
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২১:১০আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২১:১৬

বাম থেকে তৃতীয় নীরা কাদরীআগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- শহীদ কাদরীর স্মরণসভায় নীরা কাদরীর বক্তব্য || পর্ব-১
পূর্ব প্রকাশের পর

শহীদ কাদরীর কাছে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশ ছিলো না। তার ভাবনায়, তার মনে, হৃদয়ে, তার লেখায়, সব জায়গায় বাংলাদেশকে খুঁজতো। তার কাছে যারা আসতো তাদেরকে বলতো, ‘আমি তো বাংলাদেশে যেতে পারছি না। আমার দেশে যাওয়া তো হলো না। তোমাদের হাত ধরলে মনে হয় আমি বাংলাদেশের হাত ধরে আছি। বাংলাদেশ আমার দেশ।’
কয়েকজন কবি বললো, শহীদ ভাই আপনাকে নিয়ে আমরা একটা কবিতার আসর করবো। সে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, ঠিক আছে বাসার নিচে একটা হল আছে। তুমি রাজী আছো? বললো,  এক শর্তে রাজী। তোমরা যদি আমাকে নিয়ে কোনো কবিতার আসর করো তাহলে আমাকে অনুষ্ঠানের সম্পূর্ণটা নিয়ন্ত্রণটা করতে দিতে হবে। যদি সেটাতে রাজী না থাকো তাহলে আমি কোনো কাজ করবো না। ওরা বললো, আপনি যেভাবে চান সেভাবেই হবে। আসরটার নাম হবে ‘একটি কবিতার সন্ধ্যা।’

প্রথম দিন গিয়ে শহীদ বললো, আমরা এখানে কবিতা পড়তি দেখি কিন্তু বাংলাদেশের কারো কবিতা পড়তে দেখি না। আমি এবং নীরা বহু অনুষ্ঠানে গিয়েছি, সেখানে দেখেছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দ ভৈরবী’ অথবা সুনীল গাঙ্গুলীর ‘কেউ কথা রাখেনি’ পড়ে। আচ্ছা, এছাড়া কী আর কবিতা নেই বাংলা ভাষায়? আমি এখানে এসেছি এবং এখানে বাংলাদেশের কবিদের ছাড়া আর কোনো কবিতা পড়বো না। আমি নিজে বাছাই করবো, তারপর; এবং যারা কবিতা শুনতে ভালোবাসেন তারা আসবেন। কবিতার ভিতরে যে মিউজিক আছে, সুর আছে, সেটা আমি তৈরি করতে পারবো। আর আমাকে বললো, নীরা যারা কবিতা আবৃত্তি করবে তাদের ঠিক করো এবং তাদের কাছে কবিতা পাঠিয়ে দাও। আর কবিতার কপি নিয়ে তুমি নিচে নামবে। কবিতা যেন বিলি করে দেওয়া হয় দর্শকদের মধ্যে। সবাই যেন অন্তত একটা কপি নিয়ে বাড়িতে যায় এবং পড়ে। ২০১১ সালের আগস্ট মাসে আমরা কবিতা সন্ধ্যা শুরু করি। যতদিন পর্যন্ত কবিতা সন্ধ্যা চলেছে ততদিন পর্যন্ত শামসুর রাহমানের কবিতা দিয়ে কবিতা পাঠ শুরু হতো। শামসুর রাহমানের পরে যারা আছেন সব কবির কবিতা পড়া হতো। তবে শামসুর রাহমানের কবিতা প্রথমে পড়া হতো। সে বলতো, অনেক চেষ্টা করা হবে বাংলাদেশে, অনেক চেষ্টা করা হবে কলকাতায়, দুই বাংলার প্রধান কবি শামসুর রাহমান। নীরা আমি বেঁচে থাকতে এটা বলে যেতে হবে। অনেক চেষ্টা করা হবে তাকে ফেলে দিতে। কোনো অবস্থাতে তাকে ফেলে দেওয়া সম্ভব না।

আগে মিউজিকের মাধ্যমে কবিতা আবৃত্তি হতো। ও মা! কদিন পর দেখা গেলো সাহিত্য একাডেমি, সাহিত্য পরিষদ নামে ছোট ছোট সংগঠন সমস্ত জায়গায় ১ ঘণ্টা করে কবিতার আসর করতে শুরু করলো। সেখানে মানুষ বাংলাদেশের কবিতা পড়েছে। কারও ইচ্ছে হচ্ছে সৈয়দ শামসুল হক, কারও ইচ্ছে হচ্ছে রফিক আজাদ পড়ছে, কারও ইচ্ছে হচ্ছে আবিদ আজাদ পড়ছে, কারও ইচ্ছে হচ্ছে আবুল হাসান পড়ছে, ফজল শাহাবুদ্দীন পড়ছে। শহীদ একটা কথা বলেছিলো, একটি কবিতা সন্ধ্যায় যেহেতু আমি সঞ্চালক সেখানে শহীদ কাদরীর কবিতা পড়া যাবে না। এতে লোকে বলবে শহীদ কাদরী নিজের কবিতা পড়ানোর জন্য এই আসর করেছে। অনেকদিন পর্যন্ত তার কবিতা পড়াতে পারিনি। আমি সেখানে ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব ছিলাম। একদিন আমি বললাম, দেখো আমাকে কিন্তু মানুষ বলবে, প্রশ্ন করবে, আসরে কোনো শহীদ কাদরীর কবিতা পড়া হয়নি? তার উত্তর আমি কী দেবো? তুমি একদিকে আমার স্বামী কিন্তু আমি দায়িত্বে আছি এই কবিতার আসরের। এই দায়িত্ব থেকে তোমার কথার অবাধ্য হয়ে তোমার কবিতা আমাকে পড়াতেই হবে। এই কথা শুনে ওর খুব মন খারাপ হয়ে গেলো। আমি ওর মন খারাপকে অগ্রাহ্য করে সুযোগ পেয়েছিলাম শহীদ কাদরীর কবিতা পড়াতে। বেশির ভাগ কবিতা শহীদ নিজে পড়েছে।

কত বলবো আর! আমার সমস্ত স্মৃতিই ভালোর স্মৃতি। আমি খুঁজতে চেষ্টা করছিলাম কোনো একটা কষ্টের স্মৃতি, কোনো একটা দুঃখের স্মৃটি, যেটা হয়তো আমাকে ভোলাতে চেষ্টা করবে। এই সেপারেশনকে ভোলাতে চেষ্টা করবে। আমার জীবনে কোনো দুঃখের স্মৃতি নেই শহীদ কাদরীর সঙ্গে। আমার জীবন ধন্য যে, ওনার মতো একজন মানুষকে আমার জীবনে পেয়েছিলাম। কোনো কিছু নিয়ে সে আমাকে বিরক্ত করতো না। কোনো চাহিদা ছিলো না। কোনো কিছু নিয়ে কিছু বলতে হতো না। ওষুধ খাওনি কেনো? সাধারণত মানুষ ডায়ালিসিসের পর ১০ বছর বাঁচে, শহীদ বেঁচেছিলো ১৪ বছর।

আমার কথা শেষ করা দরকার। আমি বাংলাদেশ সরকারের অবদান- বিশেষ করে শেখ হাসিনার অবদান স্বীকার করছি। কৃতজ্ঞতা ছোট্ট একটা জিনিস। এই কৃতজ্ঞতা দিয়ে তাঁর যা ভূমিকা তা শেষ করতে পারবো না। শহীদ কাদরী হসপিটালে যাওয়ার পর সরকারের প্রতিনিধি শামীম এহসান প্রধানমন্ত্রীর আদেশে এক ঘণ্টার মধ্যে দেখা করেছেন। বলেছেন, ভাবী আপনি যেহেতু চাইছেন শহীদ কাদরীকে দেশে নিয়ে যাবেন সে অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার থেকে আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সে দায়িত্ব থেকে যা যা করার আমরা করবো। আপনি ভাববেন না। আমি সবকিছু করবো। শামীম এহসানের সাথে যা যা করা দরকার হাসপাতালে সেসব করেছেন হাসান ফেরদৌস। শহীদের খুব ভাল বন্ধু, প্রাবন্ধিক। হাসাপাতালে নানা ধরনের প্রতিকূলতা থাকে। একটা ডেড সার্টিফিকেট পেতে তিন দিন লাগে। ওই দিন ছিলো রবিবার। ওই দিন ডাক্তাররা কিছু করতে চান না। ওইদিন কী হলো জানি না। হাসপাতাল ভরে গেছিলো মানুষে। হাসপাতালে তিল পরিমাণ জায়গা ছিলো না। অনেক জানা মুখ, অনেক অজানা মুখ। কতৃপক্ষ এসব দেখে হাসপাতাল থেকে একসেপশন টু দ্য রোল করে তাকে রিলিজ দিয়ে দিচ্ছে। এবং এটার সঙ্গে যিনি জড়িত ছিলেন তিনি ড. অমর আশরাফ, শহীদের প্রাইমারি মেডিক্যাল ডাক্তার। অসম্ভব কবিতার অনুরাগী। এখনো কবিতা পড়েন। শহীদ বলতো, তুমি কবিতা পড়, ডাক্তার হতে গেলে কেনো? তখন সে বলতো শহীদ ভাই, আমার ভুল হয়ে গেছে ডাক্তার হওয়া। তিনি শুধু ডাক্তার না প্রফেসরও, মেডিসিনের ক্লাস নেন। প্রথম দিন থেকে তিনি ডাক্তারদের সঙ্গে কমিউনিকেট করছিলো যাতে কোনো অবস্থাতে কোনো ত্রুটি না হয়। এই মানুষগুলো সব সময় আমার জীবনে আছেন। আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। আমি শ্রদ্ধা জানাই শামসুজ্জামান খান, আবুল হাসনাত, মফিদুল হক, মাহাবুবুল হক শাকিল- এরা আমার জীবন জুড়ে আছেন। এরা আমার আত্মার আত্মীয়। এরা শহীদ কাদরীকে আমার মতোই বুকে ধারণ করেন। সারা জীবন শহীদ কাদরী এদের সঙ্গে থাকবেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, অভিবাদন ও কৃতজ্ঞতা। তিনি যেন সুস্থ থাকেন, তিনি যেন ভালো থাকেন। তিনি যেন এভাবেই বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা ও স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেত পারেন।

আরো ধন্যবাদ জানাচ্ছি বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। আমি এখানে আসার পর তারা সবকিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছেন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ড. ইউনূস-তারেক রহমান বৈঠকের বিস্তারিত আলোচনা করেছে বিএনপি
ড. ইউনূস-তারেক রহমান বৈঠকের বিস্তারিত আলোচনা করেছে বিএনপি
ডেমরায় ছাদ থেকে পড়ে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু
ডেমরায় ছাদ থেকে পড়ে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু
ইউনূস স্যারের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলবো, পরিবেশ তৈরি হলে তারপর নির্বাচন দিয়েন
ইউনূস স্যারের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলবো, পরিবেশ তৈরি হলে তারপর নির্বাচন দিয়েন
একদিনে সারা দেশে গ্রেফতার আরও ১৬৩৬ জন
একদিনে সারা দেশে গ্রেফতার আরও ১৬৩৬ জন
সর্বাধিক পঠিত
নগরভবনে সভা করছেন ইশরাক, নামের সঙ্গে ‘মাননীয় মেয়র’
নগরভবনে সভা করছেন ইশরাক, নামের সঙ্গে ‘মাননীয় মেয়র’
ইরানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা থেকে সরে দাঁড়ালো ভারত?
ইরানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা থেকে সরে দাঁড়ালো ভারত?
ইরানের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ‘অবমূল্যায়ন’ করেছে ইসরায়েল
ইরানের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ‘অবমূল্যায়ন’ করেছে ইসরায়েল
ক্রিকেটার সাকিবসহ ১৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
ক্রিকেটার সাকিবসহ ১৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
তেহরানের আকাশসীমায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি ইসরায়েলের
তেহরানের আকাশসীমায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি ইসরায়েলের