X
শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫
১৯ বৈশাখ ১৪৩২

ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কার: ‘গুরুত্ব পায়নি’ ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রস্তাবনা

জুবায়ের হোসাইন
০২ মে ২০২৫, ১২:০০আপডেট : ০২ মে ২০২৫, ১২:০০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) গঠনতন্ত্র সংস্কারের বিষয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনার পর একটি নির্দিষ্ট সংস্কার আনা হয়েছে। তবে এই সংস্কারে ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রস্তাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটে ডাকসুর ‘চূড়ান্ত সংশোধনী প্রস্তাবে’ ভোটার ও প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা, কার্যক্রমের পরিধি এবং নেতৃত্ব কাঠামোতে পরিবর্তনসহ উল্লেখযোগ্য কিছু সংস্কার পাস হয়েছে। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলো বলছে, প্রশাসন নিজের ইচ্ছামতো সংস্কার করেছে। গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠনের প্রস্তাবনা।

নতুন গঠনতন্ত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়— ডাকসু নাম অপরিবর্তিত রাখা হলেও কিছু বিষয় স্পষ্ট করে সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে। তা হলো, ডাকসু নির্বাচনে পূর্ণকালীন, ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তিকৃত, আবাসিক হলের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরাই ভোটার ও প্রার্থী হতে পারবেন। এ ছাড়া ভোটারের সর্বোচ্চ বয়স হবে ৩০ বছর। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ব্যাপারে আগে শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যবোধ লালনের কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু বর্তমান গঠনতন্ত্রে জুলাই গণঅভ্যুত্থানসহ বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

‘ছাত্র সংসদের কার্যাবলির ক্ষেত্রে আগে কমনরুম, পত্রিকা প্রকাশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা এবং খেলাধুলা আয়োজন— এসবই ছিল মূল কার্যাবলি। কিন্তু বর্তমান সংশোধনীতে এগুলোর পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি, সামাজিকসেবা কার্যক্রম জোরদার, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় সক্রিয় অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সদস্যপদ, ভোটার এবং প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতার ক্ষেত্রে আগের গঠনতন্ত্রে প্রথম অনুচ্ছেদে বর্ণিত মানদণ্ড অনুযায়ী— বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র ডাকসুর সদস্য ও ভোটার হতে পারতেন। কিন্তু সংশোধিত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেবল প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রী, পূর্ণকালীন অধ্যয়ন এবং যাদের বয়স ৩০ বছরের নিচে তারাই ছাত্র সংসদের সদস্য ও ভোটার হতে পারবেন।’

এছাড়া আগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ডাকসুর সব সভায় সভাপতিত্ব করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। কিন্তু নতুন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ভিসি শুধু কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করবেন। তবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ডাকসু পরিচালিত হচ্ছে কিনা— তা তদারকি করবেন তিনি। এছাড়া জরুরি ভিত্তিতে গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে যেকোনও পদক্ষেপ নিতে পারবেন ডাকসু সভাপতি। ভিসি ও কোষাধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে ভিপি সব সভায় সভাপতিত্ব করবেন। এ ছাড়া জিএস ও এজিএসের কার্যক্রম আগের মতোই রাখা হয়েছে।

ছাত্র সংগঠনগুলোর মতে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংগঠনগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে, কিন্তু তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়নি। বেশিরভাগ সংগঠনের প্রস্তাবনাকে গুরত্ব না দিয়ে এমনভাবে সংশোধন করা হয়েছে— সেখানে ডাকসুতে উপাচার্যের একচ্ছত্র আধিপত্য বহাল রাখার পাশাপাশি ডাকসু নির্বাচন নিয়মিত করার নিশ্চিত হয় না।

ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি গণেশচন্দ্র রায় সাহস এবং সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডাকসু গঠনতন্ত্রে আহামরি কিছুই সংস্কার করা হয়নি। আমরা যে প্রস্তাবনা দিয়েছি— সেখান থেকে কিছুই নেওয়া হয়নি। এখনও ডাকসুর নিয়মিত নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। ভিসি ক্ষমতা কমানোর কথা বললেও আল্টিমেট ক্ষমতা তার হাতেই। ছাত্রদল ডাকসুর নিয়মিত নির্বাচন চায়, সভাপতি পদে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি চায়। ভিপি ও জিএস দুজন করে চায়, এসব প্রস্তাবনার সঙ্গে বেশিরভাগ সংগঠনই একমত ছিল। এই প্রস্তাবনাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ছাত্রলীগের আমলেও যা ছিল, এখনও মোটামুটি তাই আছে।’

ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ বলেন, ‘প্রশাসন অংশীজনদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। কিন্তু অংশীজনের মতামতকে কি আদৌ গুরুত্ব দিয়েছে? বেশিভাগ অংশীজন যেসব অতিগুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত সংস্কারে মত দিয়েছে, সেগুলোকে তোয়াক্কা না করে, তারা একটি সংশোধিত গঠনতন্ত্র হাজির করেছে। এতে না ডাকসুতে উপাচার্যের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হয়, না নিয়মিত নির্বাচনের বিষয় নিশ্চিত হয়। অনেকেই বলছেন, দলীয় সরকার আসলে আর ডাকসু হবে না। কাজেই এই প্রশাসনের সময়েই ডাকসু হয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ডাকসু যেকোনও আমলে না হওয়ার সুযোগটা আমরা কেন রাখবো? কেন অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত করে, কিংবা গঠনতান্ত্রিকভাবে মেয়াদ শেষের এক মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত না করে, ভিসির মর্জির ওপর ছেড়ে দেবো?’

তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ অংশীজন ডাকসুর সভাপ্রধান হিসেবে উপাচার্যের বদলে নির্বাচিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধি এবং সভাপ্রধানের ক্ষমতা কমানোর পক্ষে। তাহলে কেন এই ন্যায্য চাওয়াকে অগ্রাহ্য করা হবে?  প্রশাসনের তো এসব ছাত্রবান্ধব বড় পরিবর্তন আনতে দুর্বলতা প্রকাশের সুযোগ নেই। যেকোনও ধরনের বহিরাগত চাপ মোকাবিলায় তারা অংশীজনদের পাশে পাবেন। তাহলে অনীহা কেন?’

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ঢাবি সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ডাকসুর টাইমলাইন ঘোষণা এবং নির্বাচনের জন্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে স্বাগত জানাই। গঠনতন্ত্র সংস্কারের ক্ষেত্রে ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রস্তাবিত কিছু বিষয় নেওয়া হয়েছে। ভিসির এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা কমানো হয়েছে। তবে ডাকসুতে প্রশাসনিক আধিপত্য এখনও বহাল আছে। কেননা, ভিসি সিন্ডিকেটের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেবেন, যেখানে কোনও ছাত্র প্রতিনিধি নাই। ভিসি সিনেটের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেবেন— এই নিয়ম চালু হলে প্রশাসনিক আধিপত্য কমতো। ডাকসু নির্বাচনে বাইরের কারও প্রচারণা না চালানোর বিধান করা হয়েছে। এটা অপ্রয়োগযোগ্য। কেননা, ডাকসু হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের মতো। এখানে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীরা আসেন। তার দলের পক্ষে প্রচারণা চালান।’

এ ছাড়া ডাকসু নির্বাচনের আচরণবিধি প্রকাশ করা হয়েছে। নির্বাচনে আচরণবিধি ভঙ্গ করলে প্রার্থিতা বাতিল ও বড় অঙ্কের অর্থদণ্ডের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সাজাও রাখা হয়েছে। আচরণবিধি সংস্কার  কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বেশকিছু বিধিমালা চূড়ান্ত করেছে সিন্ডিকেট।

ডাকসুর আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র সংগ্রহ এবং দাখিলের সময় কোনও ধরনের মিছিল বা শোভাযাত্রা করা যাবে না। প্রার্থী পাঁচ জনের বেশি সমর্থক নিয়ে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দিতে পারবে না। মনোনয়নপত্র দাখিল এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় অন্য কোনও প্রার্থী বা ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা কোনও ছাত্র সংগঠনের কেউ কোনও ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। যানবাহন ব্যবহার করে শোডাউন, মিছিল কিংবা কোনও ভোটারকে আনা-নেওয়া করা যাবে না। তবে রিকশা অথবা সাইকেল ব্যবহার করা যাবে।

বিধিমালায় বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালানো যাবে, তবে সেটা হতে হবে আইনসিদ্ধ ও ইতিবাচক পদ্ধতিতে। এ ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ কোনও কাজ করা যাবে না। পাশাপাশি ব্যক্তিগত আক্রমণ, চরিত্র হনন, গুজব ও অসত্য তথ্য ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে।

সংশোধিত আচরণবিধিতে  বলা হয়েছে, সভা-সমাবেশ করার অনুমতি অন্তত ২৪ ঘণ্টা আগে নিতে হবে। একজন প্রার্থী বা তার গ্রুপের পক্ষে প্রতিটি হলে একটি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি প্রজেকশন মিটিং করতে পারবে। হলের অভ্যন্তরে বা ক্যাম্পাসে চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা বা রিটার্নিং কর্মকর্তাদের অনুমোদিত স্থান ছাড়া কোনও সভা, সমাবেশ বা শোভাযাত্রা করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় জনগণ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে— এমন সড়কে সমাবেশ, এমনকি কোনও মঞ্চ তৈরি করা যাবে না।

নতুন গঠনতন্ত্রের আচরণবিধি অনুযায়ী প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার দিন থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিনের ২৪ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত প্রচার চালানো যাবে। তবে এই সময়ের মধ্যে প্রতি দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত প্রচার চালানো যাবে। রাত ১০টার পর কোনও ধরনের প্রচারকাজে মাইক ব্যবহার করা যাবে না। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোটার বা প্রার্থী ছাড়া অন্য কেউ কোনোভাবে কোনও প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রচার চালাতে পারবে না।

/এপিএইচ/ইউএস/
সম্পর্কিত
রাজধানীতে মাদরাসা শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
গরুর হাট না বসানোর দাবিতে রাস্তায় আফতাবনগরবাসী
নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি মেন ফাউন্ডেশনের
সর্বশেষ খবর
রাজধানীতে মাদরাসা শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
রাজধানীতে মাদরাসা শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
পারমিট ছাড়া হজ না করার অনুরোধ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের
পারমিট ছাড়া হজ না করার অনুরোধ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের
চিলির উপকূলে ৭.৪ মাত্রার ভূমিকম্প, সুনামি সতর্কতা
চিলির উপকূলে ৭.৪ মাত্রার ভূমিকম্প, সুনামি সতর্কতা
সরকারি বরাদ্দের মালামাল মিয়ানমারে পাচারের ঘটনায় মামলা 
সরকারি বরাদ্দের মালামাল মিয়ানমারে পাচারের ঘটনায় মামলা 
সর্বাধিক পঠিত
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয় আটক
দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয় আটক
এনবিআরের বিভক্তিতে সুফল মিলবে?
এনবিআরের বিভক্তিতে সুফল মিলবে?
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
রবিবার দেশে ফিরছেন খালেদা জিয়া
রবিবার দেশে ফিরছেন খালেদা জিয়া