দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃদেশীয় রেলযোগাযোগ উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের ৮ মেগা প্রকল্পের সঙ্গে এ বছর যুক্ত হয়েছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। শুধু দক্ষিণ এশিয়াই নয়, এ প্রকল্প ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপন করবে। ঢাকা-যশোর করিডোরে অপারেশনাল সুবিধাসহ সংক্ষিপ্ত রুটে স্থাপন করা হবে বিকল্প রেল যোগাযোগ স্থাপন।প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের মধ্যে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আরেকটি সাব-রুট স্থাপন করা হবে।
আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে এ প্রকল্পটি সংযুক্ত করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এটির কাজ শুরু হবে চলতি বছরের জুলাই-আগস্টে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক পরামর্শক দিয়ে এ প্রকল্পের সমীক্ষা ও বিস্তারিত ডিজাইন ও দরপত্র প্রণয়ন সম্পন্ন করা হয়েছে।
আরও পড়তে পারেন: মিতুর খুনি কারা?
জানা গেছে, ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় রেলখাতে চীন সরকারের বিনিয়োগের বিষয়টি দু’দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একই বছর ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে পদ্মা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার দিন থেকে সেতুর ওপর দিয়ে রেল যোগাযোগ চালু করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মোট ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পে চীন সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যাবে ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করবে ১০ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে এ প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪ কোটি ১০২ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প চালু হলে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, নড়াইল জেলা নতুন করে রেল লাইনের অন্তর্ভুক্ত হবে। এ রুটে কন্টেইনার চলাচলের ক্ষেত্রে কোনও স্পিড ও লোড বিধিনিষেধ না থাকায় জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফ্রেইড ও ব্রড গেজ কন্টেইনার চালু করা যাবে। রেলের যাত্রী সেবার মান বাড়বে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে বরিশাল ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে রেল সংযোগের সঙ্গে যুক্ত করতে এই রুটে দ্বিতীয় লাইন নির্মাণ করা সম্ভব হবে বলেও জানায় রেলপথ সূত্র।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতাকালে বলেছেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধন হবে। একইসঙ্গে পায়রা সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। এ ছাড়াও ঢাকা-যশোর, ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-দর্শনার মধ্যকার দূরত্ব যথাক্রমে কমবে ১৮৪ দশমিক ৭২ কিলোমিটার, ২১২ দশমিক ৫ কিলোমিটার ও ৪৪ দশমিক ২৪ কিলোমিটার। শুধু দূরত্বই নয়, সময়ও বাঁচবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) আনুমানিক এক তৃতীয়াংশ অবদান রাখবে বলেও সরকার মনে করে।
আরও পড়তে পারেন: বাংলাদেশি গরিবদের ভারতে এনে কিডনি পাচার
পদ্মা সেতু সংযোগ প্রকল্পটির ১ম পর্যায়ের কাজের বিবরণে রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু রেল লাইনটি বিদ্যমান ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে শুরু হয়ে গেন্ডারিয়া- মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ভাঙ্গা জংশন স্টেশন পর্যন্ত যুক্ত করবে। প্রকল্পের ২য় পর্যায়ে ভাঙ্গা জংশন হয়ে বিদ্যমান কাশিয়ানি জংশন স্টেশন হয়ে পদ্মবিলা জংশন হয়ে ওয়াই (ণ) কানেকশনের মাধ্যমে বিদ্যমান রূপদিয়া এবং সিঙ্গিয়া স্টেশনে যুক্ত করবে। ঢাকা-গেন্ডারিয়া সেকসনে ৩ কিলোমিটার ডাবল লাইনসহ প্রকল্পের আওতায় মোট ১৭২ কিলোমিটার নতুন মেইন লাইন নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
উল্লেখ্য, ঢাকা-যশোরের মধ্যে একটি রেল সংযোগ লাইন বিদ্যমান থাকলেও তা ঘুরপথে হওয়ায় দৈর্ঘ্য বেশি। উপরন্তু, এক্সেল লোড বহন ক্ষমতা, গতি, ও সেকসনাল ক্যাপাসিটি বিবেচনায় পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর ব্রডগেজ রেল সংযোগ নির্মাণ বাংলাদেশ পরিবহন অবকাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে যাচ্ছে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ নির্মাণের জন্য মোট ৪টি সেকসনে বিভক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে সেকসন ১ ঢাকা- গেন্ডারিয়া। সেকসন ২ গেন্ডারিয়া-মাওয়া। সেকসন ৩ মাওয়া-ভাঙ্গা জংশন- মাওয়া। সেকসন ৪ ভাঙ্গা জংশন-যশোর।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ১৪টি নতুন স্টেশন নির্মাণ ও ৬টি বিদ্যমান স্টেশন উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। নতুন ১৪টি স্টেশন হচ্ছে-কেরানীগঞ্জ, নিমতলা, শ্রীনগর, মাওয়া, জাজিরা, শিবচর, ভাঙ্গা জংশন, নগরকান্দা, মুকসুদপুর, মহেশপুর, লোহাগড়া, নড়াইল, জামদিয়া ও পদ্মবিল। এ ছাড়া ঢাকা, গেন্ডারিয়া, ভাঙ্গা, কাশিয়ানী, রূপদিয়া ও সিঙ্গিয়া ৬টি বিদ্যমান স্টেশনের বিদ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ প্রকল্পের জন্য ১০০টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী গাড়ি সংগ্রহ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ১ হাজার ৯৬৮ দশমিক ৪৮ একর জমির মধ্যে ব্যক্তি মালিকানার ১৭শ একর, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ২শ দমমিক ৪৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষের ৬৮ একর জমি এ প্রকল্পে স্থানান্তর করা হবে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ৮ মেগা প্রকল্পের সঙ্গে এ বছর এটিও সংযুক্ত হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের তালিকাভুক্ত প্রকল্প। সারাদেশের রেল যোগাযোগের সঙ্গে দেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলকে সংযুক্ত করতেই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জিডিপিতে বড় ভূমিকা পালন করবে। আশা করছি, প্রকল্পটি যথানিয়মেই এগিয়ে যাবে।
আরও পড়তে পারেন: আমরা যুদ্ধ করতে চাই না
/এমএনএইচ/আপ-এমএসএম