চলমান জঙ্গি সংকট মোকাবিলায় জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিরোধপর্ব শুরু করতে চায় দেশের রাজনৈতিকদলগুলো। সংসদের বাইরে ও ভেতরে থাকা প্রায় সবগুলো দলের নেতারাই মনে করেন, ঢাকার গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, এর রেশ আরও বাড়ার আগেই গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এর সমাধানে আসা উচিৎ। তবে এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর এই মতামতকে আওয়ামী লীগ সরকার কতটা গুরুত্ব দেবে-এর কোনও ইঙ্গিত মেলেনি। এক্ষেত্রে দলটির দায়িত্বশীলরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার (২ জুলাই) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেবেন, ওই বক্তব্যেই করণীয় উল্লেখ থাকবে।
সংসদের বাইরে থাকা প্রধানবিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি মনে করছে, দেশেবিরোধী রাজনৈতিক মত চর্চাহীনতা, বিরোধী মতকে চেপে ধরার মধ্য দিয়ে দিনে দিনে জঙ্গিবাদের বিকাশ ঘটেছে। শুক্রবার রাতে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ফলে সৃষ্ট অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি মিলেমিশে দেশে এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, যা পৈশাচিক স্বৈরতন্ত্রে অধপতিত হয়েছে। যার বিকৃত প্রতিক্রিয়া সারাদেশে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। গত রাতের দুষ্কৃতিকারীদের নির্মম রক্তাক্ত অভ্যুত্থান দেশে বিরাজমান দুঃশাসনেরই বহিপ্রকাশ।
খালেদা জিয়া বলেন, আমরা বারবার উগ্রবাদীদের অমানবিক রক্তঝরা অশুভ পরিকল্পনা মোকাবিলা করার জন্য দলমত নির্বিশেষে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার আমাদের সেই আহ্বানকে উপেক্ষা করে বরং বিএনপিসহ বিরোধীদলের প্রতি বিষোদগারেই ব্যস্ত থেকেছে। প্রকৃত জঙ্গি দমনে কোনও ধরনের ইতিবাচক তৎপরতা দেখানো তো দূরে থাক, বরং বিএনপিকে অভিযুক্ত করতে ব্লেমগেম খেলতে গিয়ে সরকার জঙ্গিদের স্বাস্থ্যবর্ধন করেছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান সরকার শাসনযন্ত্রের দমন ক্ষমতা বিরোধীদলের বিরুদ্ধেই কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে। ফলে জঙ্গিবাদ আরও উৎসাহিত হয়ে তাদের হিংসার আচরণ তীব্রতর করেছে। সরকার এখন যদি এই মানবতাবিরোধী উগ্রবাদীদের নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের খেলায় মেতে থাকেন, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে।
সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি মনে করে, জঙ্গিবাদ ও উগ্র সন্ত্রাসবাদ একটি জটিল সমস্যা। এর সমাধানে দেশবাসীর ঐক্য জরুরি। ঐকান্তিকভাবে সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া লক্ষ্য অর্জন শুধু কষ্টসাধ্য নয়, প্রায় অসম্ভব বলা যায়।
দলটির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদবলেন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় একটি সর্বদলীয় বৈঠকের আয়োজন করার জন্য কয়েকদিন আগে আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আবারও সেই আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করছি।
সাবেক এই রাষ্ট্রপতির ভাষ্য, এদেশে উগ্র সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের বিষয়টিকে আর ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। এটি এখন ব্যক্তি নিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাচ্ছে না। সন্ত্রাসবাদমুক্ত নিরাপদ দেশ হিসেবে আমাদের পরিচয় আজ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য, দেশি/বিদেশি বিনিয়োগ, পর্যটন ছাড়াও দ্বিপাক্ষিক যেকোনও সম্পর্ক ও কর্মকাণ্ডে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, ধরে নেওয়া যায়। এ প্রেক্ষিতে, দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখিন। ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষের ভুগান্তি হবে অপরিসীম।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, দেশে জঙ্গিবাদ নেই, আইএস নেই- এ ধরনের বক্তব্য থেকে বিরত হয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠান ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিৎ।
বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব ও ১৪ দলীয় জোটের কেন্দ্রিয় নেতা এম এ আউয়াল এমপি বলেন, জঙ্গিবাদ ইস্যুতেসবাইকে এক থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবাইকে একসঙ্গে বসে ঠিক করতে হবে আগামী েদিনের এই ধরনের সঙ্কট কীভাবে মোকাবিলা করব।
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এম এ আউয়াল বলেন, সরকারের উচিৎ এই মুহূর্তে রাজনৈতিক চিন্তা বাদ দিয়ে বিষয়টিকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা। শক্ত হাতে কন্ট্রোল করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ অন্যান্য রাজনৈতিকদলগুলোকে নিয়ে একসঙ্গে বসা।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার-এর অবসান ছাড়া শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ধর্মীয় উগ্রবাদকে আদর্শিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে মৌলবাদী শক্তি এবং তার উৎসমূল গণবিরোধী পুঁজিবাদী দুঃশাসন ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।”
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ একাশের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি এবং সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এক বিবৃতিতে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর মধ্যযুগীয় বর্বর হত্যা-খুনের রাজনীতির বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ এবং জঙ্গি দমনে সরকারের পাশে থাকার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, এই সংকটকালে অন্যান্য গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল দল, গণসংগঠন ও সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে গণজাগরণ গড়ে তোলতে হবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, জঙ্গিগোষ্ঠীর এই বর্বর আক্রমণ এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় এদেশের সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান ঘটনার তদন্ত করে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
খেলাফত মজলিসের আমির মুহাম্মদ ইসহাক বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা সমুন্নত রাখতে দল-মত নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
এছাড়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, কামরুল হাসান নাসিম, ববি হাজ্জাজসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও জঙ্গিসঙ্কট মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্যের প্রতি জোর দেন।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ শনিবার রাতে ভাষণ দেবেন। উনিই দিকনির্দেশনা দেবেন। আমি এই মুহূর্তে কিছু বলতে চাই না। আমাদের করণীয় কি হবে, এ নিয়ে উনি বলবেন। এর আগে কিছু বলা সঠিক নয়।
এসটিএস/এপিএইচ/
আরও পড়ুন:
কমান্ডো অভিযানে মাত্র ১০ ঘণ্টার মধ্যে গুলশানে জিম্মি সংকটের অবসান: প্রধানমন্ত্রী
গুলশান হামলা: ২০ বিদেশিকে গলা কেটে হত্যা
‘মানুষ রুখে দাঁড়ালে দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ ঠাঁই পাবে না’