যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে শুরু হতে যাচ্ছে জাতিসংঘের ৭১তম সাধারণ অধিবেশন। এবারের সাধারণ অধিবেশনের আলোচনায় প্রাধান্য পাবে সিরিয়া, পারমাণবিক অস্ত্র ও শরণার্থী সংকট ইস্যু।
বিশ্বের অধিকাংশ নেতাই ৭১তম অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন। ৫ স্থায়ী সদস্যসহ ১৯৩টি সদস্যরাষ্ট্রের অন্তত ১৩৫ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এবং বেশ কয়েকজন মন্ত্রী মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) থেকে শুরু হওয়া সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিচ্ছেন। এবারের সাধারণ অধিবেশনটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুনের জন্য শেষ অধিবেশন। বান কি মুনের মহাসচিব পদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি বছরের শেষ নাগাদ, ওবামার প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে সামনের জানুয়ারিতে। এবারই নির্বাচিত হবেন জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব।
এদিকে, সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে রবিবার কানাডা থেকে নিউ ইয়র্ক পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আগামী ২১ সেপ্টেম্বর অষ্টমবারের মতো জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেবেন। ভাষণে জঙ্গিবাদ মোকাবিলা, নারী অধিকার, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে বাংলাদেশের ভূমিকা উঠে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। দ ‘দিনের ওয়াশিংটন সফর শেষে ২৫ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা রয়েছে।
এবারের সাধারণ অধিবেশনের আলোচনায় শরণার্থী সংকট ইস্যু ছাড়াও প্রাধান্য পাচ্ছে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক পরীক্ষা এবং সিরিয়া সংকট। সম্প্রতি মার্কিন বিমান হামলায় সিরিয়ার আসাদ সরকারের অনুগত বাহিনীর ৬২ জন নিহত হওয়ার পর সিরিয়ার চলমান অস্ত্রবিরতি চুক্তি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন ইতোমধ্যে বলেছেন, ‘যখন বিবিধ দুঃখজনক সংঘর্ষ আমাদের চারিদিকে, তখন আমরা দেখতে পাই, সিরিয়ার যুদ্ধের মতো এত বেশি মৃত্যু, ধ্বংসযজ্ঞ এবং বিশাল মাত্রার অস্থিরতা অন্য কোথাও নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোকে এখন তাদের প্রভাব কাজে লাগিয়ে একটি রাজনৈতিক সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে হবে।’
এদিকে, সংশয়ের মধ্য দিয়েই কাটছে সিরিয়ায় মার্কিন-রুশ অস্ত্রবিরতির সময়টা, মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও অস্ত্রবিরতির পূর্ণ কার্যকর হওয়াটা সম্ভব হয়নি। জাতিসংঘ যুদ্ধরত গ্রুপগুলোকে অস্ত্রবিরতি কার্যকর করে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, সিরিয়ায় ২০১১ সালের মার্চ থেকে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে প্রায় চার লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘরহারা হয়েছেন ১০ লাখেরও বেশি মানুষ।
সিরিয়ার চলমান সংকট নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিপরীতমুখী। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য তারা আসাদ সরকারের বিদ্রোহ ঘোষণাকারী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সামরিক সহযোগিতা করছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে বিমান হামলার নামে সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা চালাচ্ছে। আর রাশিয়া বাশার আল আসাদকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। তারা আসাদ সরকারের সমর্থনে আইএস ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধকে মার্কিন-রুশ ‘ছায়াযুদ্ধ’ বলেও মনে করছেন অনেকে। আর এমতাবস্থায় সিরিয়া ইস্যুটি সাধারণ অধিবেশনে অন্যতম প্রধান বিতর্ক হিসেবেই সামনে আসতে যাচ্ছে।
উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশ্নটি সামনে আসে সপ্তাহখানেক আগে তাদের ষষ্ঠ পারমাণবিক পরীক্ষার পর। ওই পারমাণবিক পরীক্ষাটিকে তাদের পারমাণবিক পরীক্ষার ইতিহাসে ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ বলে মনে করছে দক্ষিণ কোরিয়া।
উত্তর কোরিয়া আগে থেকেই দাবি করে আসছে, তারা পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম মধ্যম পাল্লার ব্যালাস্টিক মিসাইল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তবে উত্তর কোরিয়ার প্রকৃত পারমাণবিক সক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এরই মধ্যে উত্তর কোরিয়া বড় মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পরিকল্পনা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পারমাণবিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের একটি দল। চলতি বছরের শেষ নাগাদ উত্তর কোরিয়ার হাতে ২০টি পারমাণবিক বোমা বানাবার সরঞ্জাম মজুদ থাকবে। এর ফলে প্রতি বছর দেশটি ছয়টি করে পারমাণবিক বোমা বানাতে সক্ষম বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ‘বৈশ্বিক হুমকি’ বলে মনে করায় উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সংকট বিশেষভাবে প্রাধান্য পাবে জাতিসংঘের এবারের সাধারণ অধিবেশনে।
শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় সীমাবদ্ধতা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। আর তাই গতবারের মতো এবারও এই ইস্যুটি সাধারণ অধিবেশনে প্রাধান্য পাচ্ছে।
সোমবার শরণার্থী ও অভিবাসী সংকট নিরসনে জাতিসংঘ যে উদ্যোগ নিয়েছিল তাতে বলা হয়, প্রতিবছর দেশগুলো ১০ শতাংশ গ্রহণ করবে। প্রধান প্রধান দেশগুলো তা মেনে না নেওয়ায় ইতোমধ্যে ওই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে বিশ্বের প্রায় ২১ মিলিয়ন শরণার্থী প্রাণ সংকটে রয়েছে।
মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার নেতৃত্বে আরেকটি শরণার্থী বিষয়ক বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে কোনও দেশের নেতা সে দেশে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য পরিকল্পনা জানাতে পারেন, নগদ অর্থও দিতে পারেন।
ওবামার এই উদ্যোগও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, কারণ সামনের জানুয়ারিতে তিনি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে যাচ্ছেন। আর যিনি নির্বাচিত হবেন, তার ওপরই নির্ভর করবে ওই উদ্যোগের ভবিষ্যৎ।
বুধবার বিশ্বনেতাদের গত ডিসেম্বরে প্যারিসে হওয়া জলবায়ু চুক্তিকে অনুসমর্থন করতে বলা হবে। ৫৫টি রাষ্ট্র চুক্তিটি অনুসমর্থন করতে পারে, যারা বিশ্বের ৫৫ শতাংশেরও বেশি কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। জাতিসংঘ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী বছর ওই চুক্তিটি স্বাক্ষর করা হতে পারে।
বুধবার এন্টি-বায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুকে মোকাবিলা সম্পর্কিত জাতিসংঘের একটি পরিকল্পনা আসতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। সেখানে বিশ্বব্যাপী গৃহপালিত পশুকে অসুধ খাইয়ে মোটা-তাজা না করতে উৎসাহিত করা হবে, অহেতুক এন্টি-বায়োটিকের ব্যবহার বন্ধের পক্ষে প্রচারণা চালানো হবে।
প্রায় ১৪০টি দেশের কূটনীতিকরা সামনের দুই সপ্তাহ ধরে তাদের ‘কূটনৈতিক যুদ্ধ’ চালিয়ে যাবেন। কূটনীতিকরা প্রায় ১১ হাজার ব্যক্তিগত বা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য কক্ষ বরাদ্দ রেখেছেন। বৃহৎ পরিসরে ৫৪৫টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
কূটনৈতিক তৎপরতার দৌড়ে এবার বিশেষভাবে এগিয়ে থাকবেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, মিয়ানমারের নেতা অং সান সুচি এবং কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস। কলম্বিয়ায় ফার্ক গেরিলাদের সঙ্গে শান্তি চুক্তির জন্য তিনি বিশেষ গুরুত্ব পাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
কূটনৈতিক দৌড়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনও পিছিয়ে নন। এই সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল-ফাত্তাহ আল-সিসি এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পরোশেঙ্কোর সঙ্গে বৈঠক করবেন।
গতবারের সাধারণ অধিবেশনেই নির্ধারিত হয়েছিল এবারের সাধারণ অধিবেশনের প্রতিপাদ্য–একগুচ্ছ পরিবেশ রক্ষক এবং দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্র সম্মিলিতভাবে তা নির্ধারণ করেছিল ২০১৫ সালে। সেই সঙ্গে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছিল।
জাতিসংঘ ঘোষিত সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)-কে বৈশ্বিক উন্নয়নের ‘ব্লুপ্রিন্ট’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। সেখানে ১৭টি প্রাথমিক লক্ষ্যকে ১৬৯টি ক্ষুদ্র লক্ষ্যে ভাগ করা হয়েছিল। জেন্ডার বৈষম্য থেকে ক্লিন এনার্জি সবই রয়েছে ওই লক্ষ্যে।
চলতি বছরের জুলাই মাসে প্রকাশিত এসডিজি প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ পেট পুরে খেতে পায় না। ৫৯ মিলিয়ন শিশু-কিশোর পড়ার সুযোগ পায় না। প্রায় ২.৪ মিলিয়ন মানুষ পরিষ্কার পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জাতিসংঘ কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে সতর্ক করেছেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা নিশ্চিত করতে ২০৮৪ সাল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। মঙ্গলবার শুরু হওয়া সাধারণ বিতর্কে এসব বিষয় স্থান পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
/এসএ/এমএনএইচ/