X
বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
২৬ আষাঢ় ১৪৩২

মন্ত্রী ছায়েদুল হকের পদত্যাগের দাবিতে প্রতিবাদমুখর ফেসবুক

সালমান তারেক শাকিল
০৪ নভেম্বর ২০১৬, ২০:২২আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০১৬, ১০:০১

সন্দিপন বসুর স্ট্যাটাস

জানুয়ারিতে নাসিরনগরে দুটি কওমি মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়ে এবং ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কাজ করে সমালোচিত হওয়ার পর, এবার হিন্দু সম্প্রদায়কে গালি দিয়ে নিন্দিত হলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হক। হিন্দু সম্প্রদায়দের উদ্দেশে ‘মালাউন’ বলার প্রতিবাদে মুখর ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় সমাজের নানা স্তরের মানুষ মন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সাম্প্রদায়িক উস্কানি বলে মনে করছেন। তারা জানতে চেয়েছেন, হিন্দু সম্প্রদায়কে অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়ে এখনও পর্যন্ত ছায়েদুলের মন্ত্রীত্ব কিভাবে টিকে আছে। ফেসবুকে বিশিষ্টজনেরা অবিলম্বে মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন।

গত মঙ্গলবার রাতে নাসিরনগরের ডাকবাংলোতে স্থানীয় সংখ্যালঘু নেতাদের উদ্দেশে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. ছায়েদুল হক ‘‘মালাউনের বাচ্চারা বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। আর এ ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে অতিরঞ্জিত করেছেন সাংবাদিকরা। অথচ ঘটনা কিছুই নয়’’-এমন বক্তব্য দিয়েছেন বলে ঢাকার কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। গত ৩ নভেম্বর ঢাকার দৈনিক ভোরের কাগজের প্রতিবেদনে বলা হয়, বুধবার বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোটেক রানা দাশগুপ্ত  বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ক্ষমতায় থাকতে একজন মন্ত্রী হিন্দুদের নিয়ে এই কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য কিভাবে করলেন? এতে জাতি বিস্মিত।’ 

ভোরের কাগজের প্রতিবেদন

গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘গণমাধ্যমে সরাসরি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের 'মালাউনের বাচ্চা' বলার পরও কিভাবে ছায়েদুল হক মন্ত্রী থাকেন, এটা আমার বোধগম্য নয়। অবিলম্বে এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীকে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কারের জোর দাবি জানাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘আজ আওয়ামী লীগের জায়গায় যদি বিএনপি-জামাতের কোনও নেতা প্রকাশ্যে এভাবে 'মালাউন' শব্দটি ব্যবহার করতো, তাহলে সারাদেশে তোলপাড় হয়ে যেতো। গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীরা তুলকালাম কাণ্ড করে ফেলতেন! অথচ এই ঘৃণ্য অপরাধের পরও সবাই একদম চুপ। কারণ, তিনি আওয়ামী লীগ, কী বললে আবার কী হয়ে যায়! এক দেশে দুই নিয়ম চলবে না। এই জঘন্য সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীকে মন্ত্রিসভায় রাখলে আওয়ামী লীগকে স্বীকার করে নিতে হবে, তারা একটা সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। আর তা না হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কথা পরিষ্কার।’

সিনিয়র সাংবাদিক বুলবুল চৌধুরী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মেঘ সাদা, আকাশ ঝরছে, গুমরে কাঁদছে বাংলাদেশ; অশ্রু-জলে ভিজছে নাসিরনগর, পোড়া বসতভিটের অনল থামে কী তাতে...।’

ফেসবুকে ফারুক ওয়াসিফের স্ট্যাটাস

 

সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা একটা মনোভাব। রাজনৈতিক দস্যুতন্ত্র এই মনোভাবের মুরোদ যোগায়। এই দস্যুতন্ত্র গোটা বাংলাদেশকেই ‘মালাউন’ মনে করে। গুম-হত্যায় মানুষ মরে, ঘৃণার আগুনে ঘর জ্বলে, আর তারা বলে ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক’! দস্যুতন্ত্রের ক্ষমতা ছাড়া সাম্প্রদায়িকতার কোনও জোর নাই। একে ক্ষমতা যুগিয়ে যাচ্ছে আপনারই ভুল চেতনা। যদি মারতে আসো, তবে বলব আমিও মালাউন।যদি মুসলমানের নামে মারতে আসো, তাহলে আমিও নাসিরনগরের জামালউদ্দিনদের মতো বলবো, আমিও মুসলমান, আমারে না মাইরা হিন্দুরে মারতে পারবি না!’

সাংবাদিক শরিফুল হাসান লিখেছেন, ‘এক যুগের সাংবাদিকতা জীবনে অনেক মন্ত্রী সাংসদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কিন্তু কখনোই কারও সঙ্গে কথা বলে আমার পুরো শরীরটা এতো জ্বলেনি। কখনোই এতো লজ্জা লাগেনি। বাংলাদেশ সরকারের একজন মন্ত্রী আওয়ামী লীগ সরকারের একজন মন্ত্রী এই ভাষায় কথা বলতে পারেন, আমার ধারণা ছিল না।’

ঢাকা ট্রিবিউনের সিনিয়র সাংবাদিক তারিক আল বান্না লিখেছেন,‘এই মালাউনের বাচ্চাদের ভোটে ওই মন্ত্রী আজ মন্ত্রিত্ব করছে। তাই ভোট এলে মালাউনের বাচ্চাদের পা ধরতে কূল পাবে না।’

শারাফাত হোসাইন নামে একজন লিখেছেন, ‘জীবনের চেয়ে বড় সত্যি নেই জেনেও আমরা মানুষকে ভাগ করি! পশুমন্ত্রীর কথাই সঠিক, এইসব বানানো, ডাহা মিথ্যা...।’

কবি মুজিব মেহেদী তার ওয়ালে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘‘ছায়েদুল নামের কেউ কোনও দেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োজিত হলে এক বছরের মাথায় সে নিজেই পশু হয়ে যায়।-একটি চীনা প্রবাদ।’’

সাংবাদিক-সাহিত্যিক স্বকৃত নোমান লিখেছেন, ‘তার মতো মন্ত্রীর কাছে মানুষ যেখানে অনিরাপদ, মৎস্য ও প্রাণীরা কিভাবে নিরাপদ থাকবে? বিদ্বেষপ্রসূত যে বক্তব্য তিনি দিয়েছেন, তা সম্ভবত সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞরা এই ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন। মন্ত্রী হিসেবে সম্ভবত তার শপথ ভঙ্গ হয়েছে। না হলেও, মানসিকভাবে অসুস্থ, ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক, বিকৃত রুচির এই লোকটিকে মন্ত্রী পদে রাখা দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণকর নয়।’

সাংবাদিক সন্দীপন বসু লিখেছেন, ‘এবার শুধু হামলা নয়, রাতে আঁধারে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হিন্দুদের ঘরে। যাদেরকে 'মালাউন' সম্বোধন করে দায় এড়িয়েছিলেন, ওই এলাকার সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী ছায়েদুল হক !’

সাংবাদিক আনিস আলমগীর লিখেছেন, ‘টানা তিন দিন টকশো করলাম নাসিরনগর নিয়ে। ফলাফল, হিন্দুদের ঘরে আগুন। রাষ্ট্র কি অন্ধ?’

রাজধানীর শাহবাগে মন্ত্রী ছায়েদুল হকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ

তরুণ সাংবাদিক সুলাইমান নিলয় লিখেছেন, ‘হামলার পরে এই গালি দেওয়ার জন্য তার মন্ত্রিত্ব কেড়ে নেওয়া হোক। সংসদ সদস্যপদ বাতিল করা হোক। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হোক। তার এই বক্তব্য আক্রান্ত মানুষের ‘রিকনসিলিয়েশন’ কার্যক্রমে বাধা হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হোক। হামলার আগেও তিনি এই ধরনের মনোভাব সমাজে ছড়িয়েছেন কিনা, তা তদন্ত হোক। পাওয়া গেলে এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’র অভিযোগে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হোক...।’

মাহফুজ জুয়েল তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন মালাউন শব্দটির নানা তথ্য। তিনি লিখেছেন, মালাউন শব্দটি আরবী শব্দ "ملعون" থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ অভিশপ্ত বা আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত। মালাউন একটি জাতি বিদ্বেষমূলক গালি, যা বাংলাদেশে মূলতঃ বাঙালি হিন্দুদের উদ্দেশে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের মুখে শব্দটির বহুল ব্যবহার হয়। পরে শব্দটি স্বাধীনতাবিরোধী ‘রাজাকারদের’ জন্য বুলি হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া, সাধারণত উগ্র এবং অশিক্ষিত মানুষ শব্দটি ব্যবহার করে। ১৯৪৬ সালে নির্মল কুমার বসু মোহনদাস গান্ধীর সঙ্গে নোয়াখালীতে সেবা কাজ করতে আসেন। তিনি লক্ষ্য করেন হিন্দুদের মালাউন বলে গালি দেওয়ার রীতি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ গণহত্যা চলাকালীন পাকিস্তানি সেনারা বিশিষ্ট বাঙালি হিন্দু অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবকে হত্যা করে। হত্যা করার পূর্বে তাকে মালাউন বলে সম্বোধন করে সেনারা। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজে আরেক বিশিষ্ট বাঙালি হিন্দু দানবীর নূতনচন্দ্র সিংহকে নিজে গুলি করে হত্যা করেন। উপস্থিত মুসলমানরা নূতন চন্দ্র সিংহের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করলে, তাদের ভর্ৎসনা করে তিনি বলেন, ‘সামান্য একটা মালাউনের মৃত্যুতে এত শোক প্রকাশ করার কি আছে?

এদিকে মন্ত্রী ছায়েদুল হকের মালাউন গালির প্রতিবাদে ফেসবুকে অনেকেই নিজেদের নামের সঙ্গে মালাউন শব্দটি যুক্ত করেছেন। সাংবাদিক উদিসা ইসলাম, কবি-সাংবাদিক সঞ্জয় ঘোষ, তরুণ কবি অজিত দাশসহ অনেকেই নিজেদের নামে মালাউন শব্দটি যুক্ত করেছেন।

গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দলীয় প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্র করেই মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হককে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদ থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছিল। ওই সময় জেলা নেতাদের অভিযোগ ছিল, ছায়েদুল হক ওই দুই ইউপিতে দলীয় প্রার্থীদের পরাজিত করার চেষ্টা করেন। কর্মী-সমর্থকদের পুলিশি হয়রানি, গ্রেফতারসহ দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কাজকর্ম চালান।

গত জানুয়ারিতে মন্ত্রী ছায়েদুলের বিরুদ্ধে ‘হযরত শাহ্জালাল কমপ্লেক্স মাদ্রাসা’ ও ‘আবু বক্কর সিদ্দিক (রা.) মাদ্রাসা’ নামে দুটি কওমি মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে জেলা কওমি ছাত্র ঐক্য পরিষদ।

জেলা কওমি ছাত্র ঐক্য পরিষদের সভাপতি মাওলানা ইমরান হোসেন বলেন, ‘মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী অন্যায়ভাবে নাসিরনগরে দুটি কওমি মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীতে হেফাজতসহ ইসলামী দলের দাবির মুখে মাদ্রাসা দুটি খুলে দেওয়া হয়।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য ও  প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,  ‘আমি হিন্দুদের কখনোই মালাউন বলিনি। এটা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার। যারা বলেছেন আমি বলেছি, তারা বিষয়টির প্রমাণ দিক। কে শুনেছে, আমি চ্যালেঞ্জ করছি।’

এসটিএস/এপিএইচ/

আরও পড়ুন:  

ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের ঘটনায় মন্ত্রীর ফাঁসি দাবি
মন্ত্রী নাসিরনগরে থাকতেই আবার আগুন

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দুই বাণিজ্য সংগঠনে প্রশাসক নিয়োগ
দুই বাণিজ্য সংগঠনে প্রশাসক নিয়োগ
এসএসসির ফল প্রকাশ, পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ
এসএসসির ফল প্রকাশ, পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ
দোষ স্বীকার করে ট্রাইব‍্যুনালে যা বললেন রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি মামুন
দোষ স্বীকার করে ট্রাইব‍্যুনালে যা বললেন রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি মামুন
‘আলোচনায় অগ্রসর হওয়া বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চায় ঐকমত্য কমিশন’
‘আলোচনায় অগ্রসর হওয়া বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চায় ঐকমত্য কমিশন’
সর্বাধিক পঠিত
ধর্ম অবমাননার অভিযোগ সরকারি চাকরিজীবীকে ওএসডি
ধর্ম অবমাননার অভিযোগ সরকারি চাকরিজীবীকে ওএসডি
বেশির ভাগ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টে ফিকশন পাওয়া যায়: গভর্নর
বেশির ভাগ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টে ফিকশন পাওয়া যায়: গভর্নর
আবার আন্দোলনে যাচ্ছেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা
আবার আন্দোলনে যাচ্ছেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা
কল রেকর্ড বিবিসি উদ্ধার করেনি, করেছে তদন্তকারী কর্মকর্তা: তাজুল
কল রেকর্ড বিবিসি উদ্ধার করেনি, করেছে তদন্তকারী কর্মকর্তা: তাজুল
প্রশ্ন উঠছে এটা বন্যা নাকি খেসারত
প্রশ্ন উঠছে এটা বন্যা নাকি খেসারত