আগামী কয়েক দিনের মধ্যে দিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু হচ্ছে। এর আগে এ আলোচনা নিয়ে ভারতে এক অদ্ভূত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই বৈঠকে যদি কোনও বিষয় চূড়ান্ত হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বক্তব্য ছাপিয়ে নেপথ্য আলোচনাই চুক্তির বিষয়ে অধিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির মতো খুব গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির ক্ষেত্রেও এটা ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশি কর্মকর্তা বা আওয়ামী লীগ নেতাদের পরিবর্তে এই নেপথ্য আলোচনায় জড়িয়ে পড়বে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি)। বিজেপি ভারতের কেন্দ্র ও বেশ কয়েকটি রাজ্যে ক্ষমতাসীন। আর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় রয়েছে টিএমসি, এই রাজ্য দিয়ে তিস্তা প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগে প্রস্তাবিত ভারত সফর বাতিল করেছিলেন। এবার সফরে যেতে রাজি হওয়ার বিষয়টি ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভারতের কাছ থেকে তিস্তা এবং অন্যান্য ইস্যু চূড়ান্ত হওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছে ঢাকা। এর একটা অর্থ দাঁড়ায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার যদি পানিবণ্টন চুক্তিতে সম্মত না হয় তাহলে রাজ্যটির সম্মতি ছাড়াই চুক্তির পথে এগিয়ে যেতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার। যদিও পশ্চিমবঙ্গ পানিবণ্টন চুক্তির বিরোধিতাই করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
কলকাতার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপি নেতৃত্ব বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটি এর মধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছেন তারা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপি সরকারের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দ্বিধা করবে না। যেমন- নোট নিষিদ্ধ অভিযান। প্রধানমন্ত্রী মোদি জানেন যে, সাংবিধানিকভাবে কলকাতার আপত্তি অগ্রাহ্য করে জাতীয় স্বার্থে দিল্লি তিস্তা চুক্তি করতে পারে। যদি তৃণমূল কঠোর অবস্থান নেয় তাহলে দলটি বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের আরও বেশি রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার হবে। তৃণমূলের সমর্থন পাওয়ার জন্য সাবেক ইউপিএ সরকারের মতো নমনীয় হবে না এনডিএ সরকার।
স্বভাতই তৃণমূল নেতৃত্বে উদ্বেগ বিরাজ করছে। সংসদের উভয় কক্ষে নোট নিষিদ্ধ নিয়ে তৃণমূলের আগের উদ্যত আচরণ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যথেষ্ট শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়েছে। হঠাৎ করে এমন পরিবর্তন এমন সময় হলো যখন তৃণমূলের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট সারদা চিট ফান্ড ও নারদা স্টিং অপারেশন শ্লথ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল সিপিআই (এম) এর নেতা সিতারাম ইয়েচুরি ও মোহাম্মদ সেলিম অভিযোগ করছেন, ‘দিদিভাই ও মোদিভাই’-এর মধ্যে কোনও ‘সমাঝোতা’ হয়ত হয়েছে।
এই সময়ে বিজেপি ও আওয়ামী লীগের সম্পর্কের চাইতে বিজেপি-তৃণমূলের সম্পর্কে উত্তেজনা বেশি। বিজেপি/তৃণমূলের সম্পর্ক বেশিরভাগ সময়েই তিক্ত। প্রধানত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তৃণমূলের পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়। জাতীয় স্বার্থের বিষয় হলেও তৃণমূল-বিজেপি উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলে।
বিজেপির লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তিটি নিশ্চিত করা। যে চুক্তি স্বাক্ষরের পুরো ভারত যাতে সম্মত সে জন্য দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করেছে বাংলাদেশ। বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারের মোকাবিলায় বেশ নাজুক অবস্থায় থাকা তৃণমূল চায় প্রথমত, বাংলাদেশকে যত সম্ভব কম দিয়ে যাতে পার পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির মামলার রয়েছে তা থেকে নিষ্কৃতি এবং সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রাজ্যের জন্য আর্থিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা।
এ অবস্থায় পরিস্থিতির নাটাই দিল্লির হাতেই। দুর্নীতির মামলার সঙ্গে কেন্দ্রের কাছে ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি রুপি দেনা রয়েছে তৃণমূলের। মমতার সরকার রাজ্য পরিচালনার জন্য নিয়মিতই ঋণ করে যাচ্ছে। তৃণমূল রাজ্যের ঋণের দায়ভার সিপিআই(এম)-এর ওপর চাপাতে চাচ্ছে। যদিও তৃণমূল ভুলে যায় ২০১১ সালে যখন তারা ক্ষমতায় আসে তখন ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি রুপি, যা অনেকটাই মানিয়ে নেওয়ার মতো।
উভয় দেশের কর্মকর্তারা যখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করবেন তখন বিজেপি ও তৃণমূলের দরকষাকষিই তিস্তা চুক্তির ভাগ্য নির্ধারণ করবে, তা যেভাবেই হোক। এর মধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, ভারত-বাংলাদেশ আলোচনায় উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে আলোচনা করলেও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেনি কেন্দ্র। এ পরিস্থিতির উন্নতি হয়। কেন্দ্র ইঙ্গিত দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিবেচনা করা হবে।
ভারত ও বাংলাদেশের সামনে থাকা প্রশ্নটি একেবারে সহজ: কিভাবে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তিস্তার ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা যায়। উভয় দেশ কয়েক বছর আগে ফারাক্কা পানি বণ্টন চুক্তি করতে সমর্থ হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ছোট প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকার পরও বাংলাদেশ ভারতের কূটনৈতিক, কৌশলতগত ও অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে।
তিস্তা চুক্তির সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা আসছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিক থেকেই। মমতার মতে, বাংলাদেশের চাহিদা পূরণ হলে পশ্চিমবঙ্গের ছয়টি জেলায় পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। (অনিশ্চিত সূত্র মতে জানা গেছে, বাংলাদেশে শুষ্ক মওসুমে ৩৫/৪০ শতাংশ পানি দাবি করেছে)। মমতার অভিযোগ সিকিমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণেই তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে গেছে।
অবশ্য মমতার দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তারা বলছেন পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে গজলডোবা জলাধারে সেচ ও অন্য কাজের জন্য পানি সংরক্ষণের কারণেই তিস্তার প্রবাহ কমে গেছে। এ বিষয়ে ড. কল্যাণ রুদ্রকে প্রধান করে মমতা একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করলেও সে প্রতিবেদনটি এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
এসব কারণে ঢাকার দাবির প্রতি মমতার বিরোধিতাকে কিছুটা গুরুত্বহীন করে তুলছে। প্রশ্ন ওঠছে, পানি বণ্টন চুক্তির বিরোধিতা আসলে মমতার রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া কিছু নয়। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য তিস্তার পানি নিশ্চিত করতে পারাটা ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতার পর অপেক্ষায় থাকা ফল এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
জানা গেছে, বিজেপি নেতৃত্ব রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখার্জীর ওপর বেশ ভরসা করছে। প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে শেখ হাসিনা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচিতি বেশ ভালো। এ বিষয়ে দুজনকে সমঝোতায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রণব মুখার্জী ভূমিকা রাখুন, এটাই চায় কেন্দ্র। আর এ জন্য কেন্দ্র সরকার রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের আওতায় থেকে শেখ হাসিনা ও মমতার সাক্ষাতের বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। যদিও এখনও মমতা দিল্লি সফরের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেননি।
ভারতের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসার চাপ রয়েছে প্রবল। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে ভারতের লুক ইস্ট ও অ্যাক্ট ইস্ট উদ্যোগের মাঝখানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ-মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বেশ কয়েক বছরে ব্যাপক কূটনৈতিক পদক্ষেপের পর ভারত বাংলাদেশের সড়ক ও নদী পথে ট্রানজিট সুবিধা আদায়ে সমর্থ হয়েছে। যা ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলকে মূলধারায় যুক্ত করেছে। খাবার ও মেশিনারি সড়ক ও নদী পথে পাঠানো যাচ্ছে। যাতে করে পরিবহনের সময় ও জ্বালানি ব্যয় কমছে। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যকরভাবে নির্মূল ও নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ। যেসব বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন বাংলাদেশে ঘাঁটি করে ভারতের সীমান্তের রাজ্যগুলোতে অভিযান চালাত তাদের উৎখাত করেছে ঢাকা। দুই দেশ ধারাবাহিক ও কার্যকরভাবে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করে চলেছে এবং সীমান্তের উভয় পাশে ইসলামি জঙ্গিবাদ ও অপরাধ দমনে যৌথ নীতি তৈরির পরিকল্পনা করছে ।
বাংলাদেশের পাশাপাশি আফগানিস্তানও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে সহযোগিতার জন্য পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারতে চিহ্নিত অপরাধী যারা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে তাদেরকে প্রত্যর্পণ করেছে ঢাকা। কলকাতা বাংলাদেশে খুলনার সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত। সম্প্রতি কলকাতা থেকে ঢাকাগামী বাসের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বাংলাদেশের এসব উদ্যোগের প্রেক্ষিতে ভারতও ঢাকাকে সহযোগিতার করতে প্রস্তুত। বাংলাদেশের রেল ও বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ভারত। ট্রানজিট সুবিধার ফি হিসেবে বাংলাদেশ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার পাবে ভারতের কাছ থেকে। বাংলাদেশ এখন দিল্লি, কলকাতা, কাঠমান্ডু ও থিম্পুতে সড়কপথে ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে সরাসরি পণ্য পাঠাতে পারে। বাংলাদেশের কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্পেও সহযোগিতা করছে ভারত। কিছুদিন আগেই ১ বিলিয়ন ডলার সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশি বেশ কিছু পণ্যের ওপর শুল্কও কমিয়েছে ভারত।
উভয় দেশের এসব পদক্ষেপের ইঙ্গিত স্পষ্ট: ভারতের কৌশলগত অর্জন ও প্রভাব শুধু পূর্বে বাড়তে পারে, পশ্চিমে নয়। বাংলাদেশ-ভারতের দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার বন্ধন থেকেই বিমসটেক-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আসতে পারে উভয় দেশ। জনসংখ্যার বিচারে ভারতের পর এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ।
সহযোগিতা ও যৌথতার বিভিন্ন ক্ষেত্র থাকলেও বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থে বাংলাদেশের পানির ন্যায্য দাবি পূরণ করার দায় বর্তায় ভারতের ওপর।
/এএ/টিএন/
আরও পড়ুন: আমাদের লক্ষ্য বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা: আইপিইউ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী