X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

গণপরিবহনের ট্রিপের ফাঁদে যাত্রী-নিরাপত্তা

শাহেদ শফিক
২৬ মে ২০১৮, ১৬:১৩আপডেট : ২৬ মে ২০১৮, ১৬:৪৬

গণপরিহনের ট্রিপ বাড়াতে চান চালকরা, এ কারণে হুমকির মুখে যাত্রী নিরাপত্তা। (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)

১৪ বছর ধরে রাজধানী ঢাকায় বাস চালান নাজমুল হোসেন। বর্তমানে যাত্রাবাড়ী টু গাবতলী রুটের ৮ নম্বর লোকাল বাসের এই চালক এর আগে অন্তত ৯ জন মালিকের গাড়ি চালিয়েছেন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার পর এক দালালের মাধ্যমে বিআরটিএ থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সও সংগ্রহ করেছেন তিনি। নিজেকে দক্ষ চালক দাবি করে নাজমুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, জীবনে বড় ধরনের কোনও দুর্ঘটনা ঘটাননি। তবে জীবিকার তাগিদে ও মালিকদের বেঁধে দেওয়া চুক্তির কারণে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩টি করে ট্রিপ দিতে হয় তাকে। এ কারণে বেশি যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতাসহ দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া থাকে। প্রতি ট্রিপ থেকে অন্তত ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা লাভের টার্গেট রাখেন তিনি।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাজমুল হোসেনের মতো পরিবহন চালকদের ও মালিকদের অসম প্রতিযোগিতার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে। কারণ, মালিকের ভাড়া পরিশোধের পর যা থাকে তা-ই পান চালক। তাই রাস্তায় কার আগে কে যাবেন, কে বেশি যাত্রী তুলবেন— এমন প্রতিযোগিতায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন রাজধানীর পরিবহন চালকরা। তীব্র যানজট থাকার পরও এ প্রতিযোগিতা দেখা যায় বিভিন্ন রুটে একই প্রতিষ্ঠান কিংবা ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিবহনের মধ্যে।

ঢাকার একাধিক চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানী ও তার আশপাশের এলাকায় তিন ধরনের পদ্ধতিতে গণপরিবহন পরিচালিত হচ্ছে— দৈনিক মজুরিভিত্তিক, মাসিক মজুরিভিত্তিক ও ভাড়াভিত্তিক চুক্তি। দৈনিক মজুরিভিত্তিতে পরিবহনের চালকরা কাজে যোগদানের পর দৈনিক নির্দিষ্ট বেতন-ভাতা পান। আর মাসিক মজুরিভিত্তিতে পরিচালিত পরিবহনের চালকরা মাসে নির্দিষ্ট বেতন-ভাতা এবং সপ্তাহে একদিন করে ছুটি পান। এ ছাড়া কিছু সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে তাদের। আর ভাড়াভিত্তিক চুক্তিতে পরিচালিত পরিবহনের চালকরা মালিকের নির্ধারিত দৈনিক ভাড়া পরিশোধ করে অতিরিক্ত যে টাকা থাকে তা দিয়েই তাদের সংসার চালান।

গণপরিহনের ট্রিপ বাড়াতে চান চালকরা, এ কারণে হুমকির মুখে যাত্রী নিরাপত্তা। (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)

সম্প্রতি রাজধানীতে দুই বাসের প্রতিযোগিতায় তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন, কিশোরী রোজিনা আখতার ও ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিভাগের কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিনসহ কয়েকজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা।

২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। আর পঙ্গুত্ববরণ করেন দেড় শতাধিক মানুষ।

চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাভাবিক নিয়মে তারা গাড়ি চালালে মালিকরা অসন্তুষ্ট হন। অনেক সময় চালকদের বেতন আটকে দেওয়া হয়। যে কারণে তাদের অনেকেই অপেক্ষাকৃত একটু বেশি আয়ের আশায় মালিকদের কাছ থেকে দৈনিক ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায় বাস ভাড়া নিয়ে গাড়ি চালান। তাছাড়া যে ডিপো বা স্টেশন থেকে চালক বাস নামান তাকে আগে ‘রুট পারমিট’ বা ‘শ্রমিককল্যাণ ফান্ড’-এর নামে পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলোকে দৈনিক ৭০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। রাজধানীর অন্য কিছু জায়গাতেও চাঁদাবাবদ খরচ হয় আরও  অন্তত ৩০০ টাকা। এর বাইরে চালক ও হেলপারের খাওয়া-দাওয়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ ৫০০ টাকার মতো। সব মিলিয়ে একজন চালকের দৈনিক সাড়ে ৪ হাজার টাকা খরচ রয়েছে। এর বেশি যে টাকা ভাড়া ওঠে সেই টাকা নিয়েই বাসায় ফেরেন চালকরা।

চালকরা জানান,সব খরচ শেষে আয়ের জন্য তাদের প্রত্যেককে দৈনিক কমপক্ষে সাড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা ভাড়া আদায়ের টার্গেট রাখতে হয়। এজন্য ৩ থেকে ৪টি পর্যন্ত ট্রিপ দিতে হয়। তীব্র যানজটের কারণে ২ থেকে ৩টির বেশি ট্রিপ দেওয়া যায় না। তাছাড়া একই রুটের যে বাস আগে শেষ গন্তব্যে পৌঁছায় সেই বাসই ফিরতি ট্রিপের সিরিয়াল পায়। ফলে একই রুটের বাসের মধ্যেই ভয়াবহ প্রতিযোগিতা দেখা যায়।

পরিবহন সংগঠনগুলোর হিসাবে রাজধানীতে ৫০-৬০ ভাগ বাস চলে চালকের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে। বিশেষ করে ২০ বছরের পুরনো বাসগুলোর বড় অংশই চুক্তিতে চলে। পুরনো গাড়ি হওয়ায় চালক বেপরোয়া চালান কিনা তা খেয়াল রাখেন না মালিক। চালকের কাছ থেকে দিনে বা সপ্তাহে পাওনাটা শুধু বুঝে নেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ট্রিপভিত্তিক ব্যবস্থাপনার অন্যতম কারণ চালক। তাদের কারণেই ৫০ শতাংশ রোডে চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চলে। তারা মালিকদের অধিক মুনাফার স্বপ্ন দেখান। তাছাড়া সব রাস্তায় কাউন্টার, টিকেট পদ্ধতির পরিবেশ নেই। যে কারণে মালিকরা একটা নির্দিষ্ট হিসাব ধরে চুক্তিতে চালকদের গাড়ি দেন। মালিকদের চুক্তি ও সড়কে চাঁদার কারণেই চালকরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে সড়কে।’

যানজট। (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)

তিনি বলেন, ‘নিয়োগপত্র দিয়ে চালক নিয়োগ করলে চালকরা থাকেন না। বাজারে চালকের সংকট রয়েছে। কিন্তু তাদের চাকরির অভাব নেই। মালিকরা একটু কঠোর হলে তারা চাকরি ছেড়ে দেন। ফলে চালকরা যেভাবে চান মালিকরা সেভাবেই তাদের কথা মেনে নিতে বাধ্য হন।’

এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘সড়কে দুর্ঘটনার অন্য আরও একটি কারণ রয়েছে। এটি হচ্ছে চালকদের প্রায় ৫০ শতাংশই মাদকসেবী। আমরা মাদকাসক্ত চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। অনেক চালককে পুলিশে সোপর্দ করেছি। তাদের সচেতন করতে অনেক সভা-সেমিনার চালিয়ে যাচ্ছি।’

এই পরিবহন নেতা বলেন, ‘বেশি মুনাফার আশায় অদক্ষ চালকরা প্রতিযোগিতা করেন। যেসব চালক এমন কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা মালিকদের সঙ্গে মিটিং করেছি।’

জানতে চাইলে সদরঘাট টু গাজীপুর ও চন্দ্রা রুটে চলাচলকারী সুপ্রভাত পরিবহনের চালক রাকিবুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঢাকায় ট্রিপভিত্তিক মজুরিতেই বেশিরভাগ গাড়ি চলে। স্বাভাবিক নিয়মে গাড়ি চালাতে দিনে ৩টির বেশি ট্রিপ দেওয়া যায় না। তাতে যা আয় হয় তা দিয়ে ভালোভাবে সংসার চলে না। তাই সব চালকরা চান, একটা বাড়তি ট্রিপ দিতে। আর এজন্য বেশি যাত্রী ওঠানো এবং আগের গাড়িকে পেছনে ফেলার (ওভারটেক)ভাবনায় গতি বাড়িয়ে গাড়ি চালান। আর এতেই ঘটছে দুর্ঘটনা।’ তিনি বলেন, ‘বাড়তি ট্রিপ দিতে গেলে পুরো সময় চলে যায়। ফলে রাতে ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পান না চালকরা। যে কারণে তারা ড্রাইভিংয়ের সময় প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়েন। ফলে ঘটে দুর্ঘটনা।’

সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ, চালকরা অতিরিক্ত আয়ের লোভে সড়কে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করান। অনেক সময় ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা করেন। বেখেয়ালি চালক অন্য যানবাহন ও পথচারীদের ওপর বাস উঠিয়ে দেন। তাদের এমন আচরণে রাস্তায় বের হয়ে নিরাপদে বাসায় ফেরার নিশ্চায়তা নেই!

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ট্রিপভিত্তিক মজুরিতে মালিকরা বেশি মুনাফা পান। এ কারণে মালিকরা চুক্তিতে চালকদের গাড়ি ছেড়ে দেন। অন্যদিকে, চালক যদি মালিকের মন জয় করতে না পারেন তাহলে পরের দিন তাদের চাকরি থাকে না। যেহেতু অধিকাংশ চালকের পরিবহনে স্থায়ী চাকরি নেই, সেহেতু মালিক যেভাবে চাইবেন সেভাবে চালাতে বাধ্য থাকেন চালকরা।’

যাত্রী অধিকার আন্দোলনের মুখপাত্র মাহমুদুল হাসান শাকুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো চুক্তিভিত্তিক পরিবহন চালানো। এ কারণে শ্রমিকদের মধ্যে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা কাজ করে।’

 

/এইচআই/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
টিভিতে আজকের খেলা (৩ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৩ মে, ২০২৪)
ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
সর্বাধিক পঠিত
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে