X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নদী প্রকৃতি ও ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা সংক্রমণ প্রতিরোধ করে

উদিসা ইসলাম ও জাকিয়া আহমেদ
০৮ জুন ২০২০, ১২:০৮আপডেট : ০৮ জুন ২০২০, ১২:৫২

দেশের পূর্ব ও পশ্চিম ভূখণ্ডে করোনার চিত্র

উৎপাদন ব্যবস্থা, চারপাশের পরিবেশ, ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক—এগুলো রোগের সংক্রমণ কমাতে বা বাড়াতে পারে। প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশ বিশ্লেষকরা বলছেন, যেকোনও সংক্রমণের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা গুরুত্বপূর্ণ। পানি বা ভূভাগ দ্বারাও এই বিচ্ছিন্নতা হতে পারে। নেপালের মতো দেশকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনে তারা বলছেন, পাহাড়বেষ্টিত ও ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে এসব কারণেই করোনা সংক্রমণ কম।

৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ঢাকায় সাংবাদিকদের জানান, সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার অনুযায়ী বাংলাদেশকে লাল, হলুদ এবং সবুজ জোনে ভাগ করা হবে। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত এক বৈঠকের পর এসব কথা বলেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা বলছে, ভৌগোলিক বা নদীকেন্দ্রিক বিচ্ছিন্নতা নিয়ে তারা এখনও কাজ শুরু করেনি।

সম্প্রতি বাংলাদেশের ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও সংক্রমণের ধরনের ওপর বাংলা ট্রিবিউনের এক স্টাডিতে জানা যায়—ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে ছড়ানোর গতি আর রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে ছড়ানোর গতি এক রকম নয়। এই দুটি অঞ্চলের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে সামনে এসেছে ভূতাত্ত্বিক বিভাজন, অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও টেস্টিং ফ্যাসিলিটির অসাম্য।

বাংলা ট্রিবিউনের স্টাডি বলছে, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে প্রতি লাখ মানুষে আক্রান্তের সংখ্যা ৫ জন এবং এই অঞ্চলে চল্লিশোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা এক কোটি ৬৭ লাখ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে প্রতি লাখ মানুষে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৪ জন। এই অঞ্চলে চল্লিশোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা এক কোটি ৭৭ লাখ।

স্টাডি বলছে, বাংলাদেশে করোনায় যারা মারা যাচ্ছেন তাদের ৮৫.৫ শতাংশ মানুষ চল্লিশোর্ধ্ব। অর্থাৎ, দেশের এই দুই প্রান্তের ঝুঁকিপূর্ণ নাগরিকের সংখ্যা প্রায় সমান হলেও সংক্রমণের তারতম্য ব্যাপক। তাই যদি এই অঞ্চলগুলোতে সংক্রমণের তারতম্যের বিবেচনায় এখনই অঞ্চলভিত্তিক কার্যকর পরিকল্পনা করা যায়, তাহলে অনেক প্রাণ বাঁচানো যেতে পারে।

সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান প্রভাব ফেলে কিনা জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'ভৌগোলিক অবস্থান তো অবশ্যই প্রভাব ফেলে, ম্যাটার করে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, 'এ কারণেই পাহাড়ি এলাকা, সুন্দরবনের মতো জায়গা—যেখানে লোক যেতে পারে  না, সেখানে কম সংক্রমণ হবে। যেখানে ‘হার্ড টু রিচ এরিয়া’সেখানে সংক্রমণ কম হবে, ইনফেকশন হবে না। এটাই নিয়ম।'

বাংলাদেশের কোথাও বেশি কোথাও কম সংক্রমণের কারণ কী জানতে চাইলে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, 'ইতালি থেকে মানুষ যখন দেশে এসেছে, তখন তারা যেখানে বেশি গিয়েছিল সেখানেই সংক্রমণ বেশি। ঢাকাতে আড্ডা দিয়েছে, লকডাউন মানেনি। ঘনবসিতপূর্ণ এলাকা নারায়ণগঞ্জেও একই অবস্থা। আর এ কারণে এসব এলাকায় বেশি সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। সংক্রমিতদের চাল-চলন, আচরণ—এগুলোর ওপর সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি নির্ভর করে। প্রথম থেকেই উত্তরাঞ্চলে সংক্রমণ কম, কারণ সেখানে আক্রান্ত মানুষ কম গিয়েছিল।'

নদী গবেষক শেখ রোকন বলেন, 'সংক্রমণ ঠেকাতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নটা কাজের। তবে এক্ষেত্রে নগরায়ণ ও ঘনবসতির বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ট্রিবিউনের স্টাডির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, 'তাদের স্টাডিতে বলা হচ্ছে, যমুনার একপাশে সংক্রমণ বেশি, আরেক পাশে কম। বলাই বাহুল্য, যমুনার পূর্বপাশে বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার আগে শিল্পায়ন ছিল না। জনবসতি পাতলা ছিল। কিন্তু শিল্পায়নের কারণে এখন বসতি বাড়ায় সংক্রমণটা এ অঞ্চলে বেশি, কিন্তু যমুনার পশ্চিমাঞ্চলে কম। লক্ষ করবেন, দ্বীপগুলোতে পানি দিয়ে ভূখণ্ড ভাগ করা, দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে সে কারণে কম আক্রান্ত। ফলে নদী ধরে এলাকাগুলো বিভাজন করা গেলে সংক্রমণ ঠেকানো যাবে। কেননা দুই স্থলের মধ্যে যে কোনও ধরনের স্থল সংযুক্তি থাকলে যেকোনোভাবে যাতায়াত অব্যাহত থাকবে। নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ যেখানে, সেখানে ব্রিজটা বন্ধ করে, ফেরি বন্ধ করে দিলেই বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করা যাবে। সেদিক থেকে এটি ভালো পর্যবেক্ষণ।’

প্রাণ প্রকৃতি গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, 'যেকোনও সংক্রমের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিচ্ছিন্নতা পানি বা ভূভাগ দ্বারাও হতে পারে। নেপালের মতো দেশগুলোর দিকে নজর দিলে এর সত্যতা মেলে। ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতেও সংক্রমণ তেমন একটা হয়নি। আমাজন আদিবাসীদের মধ্যে কিছু পাওয়া গেছে, কিন্তু সেটি বাইরে থেকে যাওয়া।' তিনি বলেন, 'সংক্রমণ ঠেকানোর বিষয়টি পুরোপুরি নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত এমন নয়, তবে যেসব অঞ্চল প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ এবং কৃষি নির্ভর, যেসব এলাকার মানুষের মধ্যে সংক্রমণ তুলনামূলক কম। উৎপাদন ব্যবস্থায় যখন উপকরণ হিসেবে প্লাস্টিক, টিনসহ মেটাল থাকছে, তখন সংক্রমণ এক রকম এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে গাছপালা, মাটি যখন প্রধান উপকরণ তখন আরেক রকম।'

আদিবাসীদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, লক্ষণ-ভিত্তিক চিকিৎসা আদিবাসীরা বেশি পালন করছে। ওরাল কালচারের ভেতর দিয়ে যেহেতু তারা বড় হয়, তাদের স্মৃতিতে মহামারি সামাল দেওয়ার চর্চাটা ধরে রাখতে পেরেছে। ফলে প্রকৃতি ও প্রকৃতিকেন্দ্রিক জীবনের সঙ্গে সর্বোপরি ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে সংক্রমণ কম বা বেশি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে।'

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'লোকবসতি ম্যাটার করে। যেমন পাহাড়ি এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ নয়। সেখানে সংক্রমণও কম। ঢাকার মতো সেখানে এত লোকের চলাচল নেই, মিক্সিং নেই। এটাতো মূলত মানুষের সঙ্গে মানুষের মিক্সিংয়ের ফলে সংক্রমিত হয়। সামাজিক দূরত্ব না মানার কারণে ঢাকার মতো শহরগুলোতে সংক্রমণ বেশি। ঈদের মধ্যে মানুষের বাইরে বের হওয়া, পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ঢাকায় আনা-নেওয়া—এসব কারণে করোনা ছড়িয়েছে, যেটা উত্তরাঞ্চলের দিকে হয়নি। তবে সম্প্রতি বগুড়া বা বরিশালের দিকে রোগী কিছুটা হলেও বাড়ছে।'

ভৌগোলিক অবস্থান কোভিড-১৯ এর মতো সংক্রামক রোগগুলোতে কোনও প্রভাব ফেলে কিনা জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'নিশ্চয়ই। পাহাড়ি অঞ্চলে যেসব দেশ যেমন: নেপাল, ভুটান—এসব দেশে সংক্রমণ কম। কারণ তাদের বাসাবাড়ি বিচ্ছিন্ন। আমাদের দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংক্রমণ কম, কারণ মানুষ পাশাপাশি থাকে না। একটা গ্যাপ থাকে। আবার একই কথা গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রেও বলা যায়। সেখানেও বাড়িগুলো আলাদা আলাদা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সংক্রমণ কম। নিশ্চয়ই ভৌগোলিক অবস্থান এসব রোগের সংক্রমণের ওপর প্রভাব ফেলে।'

আরও পড়ুন:

নদীর দু’পাশে করোনা সংক্রমণের এত পার্থক্য কেন?

/আইএ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ