করোনাভাইরাস মহামারির কারণে জীবন অনেকভাবেই বদলে গেছে। বড় প্রভাব পড়েছে উৎসব পালনে। প্রচলিত রেওয়াজকে থামিয়ে দিয়ে গত ঈদুল ফিরতে দেখা গেছে ঈদগাহে হয়নি নামাজ, কেউ করেননি কোলাকুলি। এবার ঈদুল আজহার সময়ও কোরবানির দীর্ঘদিনের চিত্র বদলে যাচ্ছে। অনেকেই পশু কোরবানি দিচ্ছেন না এবার। কেউ কেউ একা দেওয়ার পরিবর্তে ভাগে দেবেন। অনেকের দেওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছে। যারা শহর ছেড়ে গ্রামে যেতেন, তাদের অনেকেই এবার গ্রামে যাচ্ছেন না।
বেতন-ভাতা নিয়ে কোনও সংকট না থাকলেও সরকারি চাকরিজীবীদের ঈদের আমেজে সবচেয়ে বেশি বাদ সেধেছে করোনা। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, ঈদুল আজহার ছুটির সময় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে থাকতে হবে। কেউ কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবেন না। ফলে ঈদের ছুটিতে যারা গ্রামে যেতেন তাদের এবার গ্রামে যাওয়া হচ্ছে না। গ্রামে যেতে না পারায় অনেকেই কোরবানি দেবেন না এবার। কেউ কেউ এখনও রয়েছেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে। আবার কেউ কেউ নিয়ম রক্ষায় একাধিক মানুষ মিলে একটি পশু কোরবানি দিয়ে সারবেন আনুষ্ঠানিকতা।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ সরকারি নির্দেশনার কারণে এবারই প্রথম ঈদুল আজহায় ঢাকায় থাকছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার আর বাড়িতে যেতে পারছি না। জীবনে এই প্রথম পরিবার-আত্মীয় স্বজনদের ছেড়ে ঢাকায় থাকতে হচ্ছে। যেহেতু কোরবানি দিতে হবে, তাই ঢাকায় কয়েকজন মিলে কোরবানি দেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মনিরুজ্জামন সোহেল। প্রতিবছর নিজেরাই একটি গরু কোরবানি দিতেন। তবে এবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। তিনি বলেন, ‘এবার আর গরু কোরবানি দিচ্ছি না। সংকটময় এ মুহূর্তে আগের মতো সব কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। ছাগল কোরবানি দেবো এবার।’
বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে অনেক বেতন-বোনাস না পাওয়ার কারণে করবেন না কোরবানি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানালেন, ‘গত কয়েক মাস ধরেই বেতন অনিয়মিত, বোনাসও পাইনি। এমন সংকটে কোরবানি দেওয়া মতো পরিস্থিতি নেই। আর ধর্মেও সামর্থ্য থাকলে কোরবানি দিতে বলা হয়েছে। যদিও পরিবারের অন্যদের খারাপ লাগবে, কিন্তু কোনও উপায় তো নেই।’
অন্যদিকে, ছুটিতে আসা যেসব প্রবাসী কাজে ফিরে যেতে পারেননি তারাও রয়েছেন সংকটে। কাতারপ্রবাসী জহিরুল আজিমের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালিতে। গত বছর ১৬ অক্টোবর ছুটিতে দেশে আসেন। ৫ এপ্রিল তার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে করোনার কারণে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় তার আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ সময় আটকে থেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তিনি। জহিরুল আজিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে টাকা পাঠাতাম দেশে, এক সপ্তাহ আগে বাড়িতে গরু কেনা হয়ে যেতো। আর এখন কোনও কিছুই চিন্তা করতে পারছি না। দেশে যত দিন যাচ্ছে ততই আর্থিকভাবে অসহায় হয়ে পড়ছি। জানি না শেষ পর্যন্ত কী করবো। কোরবানি দেওয়া নিয়ে এখনও কোনও কিছু ভাবিনি।’
সামর্থ্য থাকার পরও অনেকে কোরবানি দেওয়া থেকে বিরত থাকছেন মহামারির মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘এতদিন সাবধানে থেকেছি, এই মুহূর্তেও সর্তক থাকতে চাই। হাটে যাওয়া, কোরবানির সময় বাইরে থেকে কসাই আসবে, বিতরণ করতে হবে। এমন নানা দিক বিবেচনা করে কোরবানি দিচ্ছি না।’
তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। করোনার কারণে পরিবারে সদস্যদের নিয়ে ঈদের আমেজে বিঘ্ন ঘটাতে চান না কেউ কেউ। দীর্ঘ সময় গৃহবন্দি থাকার পর ঈদকে কেন্দ্র করে সবার এক সঙ্গে ঈদ উদযাপনের মধ্যে দিয়ে মানসিক পরির্তনের চেষ্টার কথা বলছেন তারা। মিজানুর রহমান সোহেল একটি দৈনিক পত্রিকায় কাজ করেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বাবাসহ পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে দেখা হয় না। এখন ঈদের সময়ও যদি তাদের কাছ থেকে দূরে থাকি, তবে তারা মাসনিকভাবে আঘাত পেতে পারেন। এই দুর্যোগের মধ্যেই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। জীবন তো আর থেমে থাকবে না। তাই প্রতি বছর যেভাবে গরু কোরবানি দিতাম, এবারও তাই করবো।’
জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসার শিক্ষক মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘কোরবানি সামর্থ্যবানদের জন্য ওয়াজিব। কারও যদি সামর্থ্য না থাকে তিনি কোরবানি দিলেও সমস্যা নেই। একইসঙ্গে কোনও কারণে কেউ যদি সমস্যার কারণে সামর্থ্য থাকার পরও কোরবানির পশু কিনতে যেতে না পারেন কিংবা কোরবানি দিতে না পারেন, সেক্ষেত্রে ইসলামে ছাড় রয়েছে।’