(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ১৯ আগস্টের ঘটনা।)
দেশে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির অপচেষ্টার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এদিন ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধনকালে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, এদেশে আবার সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হতে দেখলে তিনি যারপরনাই মর্মাহত হবেন।
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতার মতো জঘন্য কিছু আর নেই। আমাদের চার মূলনীতির অন্যতম হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। তাছাড়া আমরা সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি।’
সারাজীবন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, এ সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। তিনি অভিযোগ করেন, একশ্রেণির লোক গ্রামে গ্রামে সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করছে। তারা ভারতের সমালোচনাও করে উল্লেখ করে জাতির জনক বলেন, এদের ভারতবিরোধিতার প্রধান উদ্দেশ্য হলো সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি।
তিনি বলেন, ভারতের কাছে আমরা আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের সাহায্য-সহযোগিতা অবিস্মরণীয়। স্বাধীনতার পর তারা খাদ্য সরবরাহ করেছে আড়াই কোটি মণ।
ভারতের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়, সেসবের সমালোচনা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। রাশিয়া-আমেরিকা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। তবে কেউ যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চায়, তাকে কেমন করে বাধা দিতে হয় তা আমি জানি।’
বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘ভারত আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র। বন্ধুত্বের ভিত্তিতে তাদের ও সবার সঙ্গে শান্তিতে থাকতে চাই।’
সমাজের শত্রুদের রুখে দাঁড়ান
সমাজের শত্রুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানান। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দ্বিতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি এখনও অর্জিত হয়নি। যতদিন না দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটবে, যতদিন না তারা খেতে পাবে ততদিন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আমাদের আসবে না।’
গ্রামে গ্রামে ডিফেন্স পার্টি
সমাজবিরোধী, দুষ্কৃতকারী ও চোরাচালানীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করে আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নকে মিলিতভাবে গ্রামে গ্রামে ডিফেন্স পার্টি গঠনের আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আগামী দিনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি মনে করিয়ে দেন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সহজ নয়। ৫০ বছর পর সেভিয়েত এখনও দাবি করতে পারে না যে তারা সমাজতন্ত্রে পৌঁছাতে পেরেছে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এখন এমন সময় এসেছে, যখন আমাকে হয় ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে, নয়তো জনগণের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে সেসব সমাজবিরোধীদের ওপর কঠোর আঘাত হানতে হবে।’ তিনি বলেন, ক্ষমতার প্রতি তার মোহ নেই। পাকিস্তান আমলে বহুবার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ক্ষমতার চেয়ে জনগণের ভালোবাসা তিনি বেশি চান।
নকশালদের কার্যকলাপের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাতের আঁধারে দুয়েকজনকে খুন করে বিপ্লব করা যায় না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়েই ওরা এ ধরনের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। তাদের জানা উচিৎ গণতান্ত্রিক সুবিধা ভোগ করতে হলে গণতন্ত্রের নীতিমালা মেনে চলতে হয়।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও এরা অস্ত্রতন্ত্রে বিশ্বাসী।’
দেশ পুনর্গঠনে ছাত্রদের অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অবসর সময়ে ছাত্ররা যেন মাঠে লাঙল ধরে, গাছগাছালি লাগায় কিংবা হাঁস-মুরগির সংখ্যাবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। প্যান্ট-পরা শিখে লাঙল হাতে নেওয়া যাবে না, এমন মানসিকতা দূর করে শ্রমের মর্যাদা দেওয়ার মনোভাব অর্জন করতে ছাত্রদের বলেন তিনি।
গুপ্তহত্যার নিন্দা
বিভিন্ন স্থানে গুপ্তহত্যারও তীব্র নিন্দা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, তার দলের অসংখ্য কর্মীকে গুপ্তহত্যার শিকার হতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমার ডাকে যারা অস্ত্র সমর্পণ করেছিল এখন তাদের গুপ্তহত্যার শিকার হতে হচ্ছে। এসব দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারতাম। কিন্তু আমি রক্তপাত চাইনি। এক শ্রেণির লোক আমার উদার মনোভাবের সুযোগ নিচ্ছে।’