X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অবজ্ঞা উড়িয়ে দেশ আজ উন্নয়নের আদর্শ

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ২৩:১২আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৪৩

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিল পশ্চিমারা। তাদের অনুমান মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশ বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে বিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। বাংলাদেশকে এখন উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে দেখে বিশ্ব। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের সনদ পেয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতিবিদদের মুখে শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশের জয়গান বিজয়ের ৫০ বছর পর পেছন ফিরে তাকালে অনেক স্বস্তির কারণ দেখা যায়। যার করাল থাবা থেকে স্বাধীন হয়েছিলাম আমরা, সেই পাকিস্তানকেও অনেক ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।

 

উন্নয়নের মডেল

সর্বশেষ এক দশকে প্রায় সব সূচকেই অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে বাংলাদেশের। রফতানি, রিজার্ভ, জিডিপি থেকে শুরু করে বাজেটের আকার, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ, রাজস্ব, রেমিট্যান্স, দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো তৈরি ও উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে এসেছে প্রত্যাশিত সফলতা।

উন্নয়নের এ দীর্ঘ পথ মসৃণ ছিল না। হোঁচট খেতে হয়েছে অনেকবার। রাজনৈতিক উত্থান-পতনই ছিল বড় অন্তরায়। মোকাবিলা করতে হয়েছে অনেক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস। তবু পদ্মাসেতুর মতো অনেক বড় বড় প্রকল্প বৈদেশিক সহায়তা ছাড়াই বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বেশ আগেই বলেছেন, যারা এক সময় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিল তারা আজ এ দেশকে ‘উন্নয়নের মডেল’ মনে করছে।

মেট্রোরেল

দারিদ্র্য বিমোচন, নারীশিক্ষা, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমানো, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের অগ্রগতি নজর কেড়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের। করোনা মহামারির কারণে এ বছর বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে যেখানে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখেছে সেখানে বাংলাদেশ ধরে রেখেছে আগের ধারাবাহিকতা।

 

বাজেট ও রিজার্ভ

৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের বাজেট আজ ছয় লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আগের ছোট অর্থনীতির দেশ আজ এশিয়ার ‘টাইগার ইকনোমি’। চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপিতে প্রতিবেশী ভারতকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। অর্থনীতির এ উত্থানকে ‘ছাই থেকে জন্ম নেওয়া ফিনিক্স’ বলে আখ্যায়িত করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক মার্ক টালি। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, পিপিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থান ৩০তম। প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপারসের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০৪০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বে ২৩তম স্থান দখল করবে। এইচবিএসসির প্রক্ষেপণ বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে।

১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থ বছরে তা বেড়ে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। অবশ্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪০ দশমিক৫৩ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড হয়েছিল। করোনা সংক্রমণের কারণে বিদায়ী দুটি অর্থবছরে কিছুটা কমেছে।

স্বাধীনতার পর প্রায় এক দশক বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের কোনও তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নেই। ১৯৮১-৮২ অর্থবছরের রিজার্ভের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সর্বপ্রথম পাওয়া যায়। তখন রিজার্ভ ছিল ১২ কোটি ১০ লাখ ডলার। সেই রিজার্ভ গত ২৪ আগস্ট মাসে বেড়ে ৪৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। অবশ্য সম্প্রতি এই রিজার্ভ কিছুটা কমেছে। বর্তমানে রিজার্ভ (১৭ নভেম্বর) ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। রিজার্ভ কমলেও এর পরিমাণ পাকিস্তানের চেয়ে আড়াইগুণ।

 

জীবনমানের উন্নয়ন

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল সাড়ে ৪৬ বছর। ৫০ বছরে ধাপে ধাপে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭২.৮ বছরে পৌঁছেছে। ৫০ বছরে গড় আয়ু বেড়েছে ২৪ বছর।

১৯৭১ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বছরে গড়ে এক শতাংশের বেশি হারে বেড়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই হার পৌঁছেছে ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশে। গত বছর এ হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ (ছবি: নাসা)

স্বাধীনতার বছর দেশের ৮০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। সর্বশেষ হিসাবে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। করোনা সংক্রন না হলে দারিদ্র সীমায় বসবাসকারী জনসংখ্যা আরো কমতো।

স্বাধীনতার পর পর দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৫০০ মেগাওয়াট। উৎপাদন হতো গড়ে ৩০০ মেগাওয়াট। এখন তা ২৫ হাজার ২৩২ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। দেশের ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষই পেয়েছে বিদ্যুৎ।

ইতোমধ্যে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষপণ করে স্যাটেলাইট জগতেও নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। প্রস্তুতি নিচ্ছে দ্বিতীয় স্যাটেলাইট পাঠানোর।

 

এখনও পিছিয়ে

৫০ বছরে দেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতন কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়তে শুরু করেন স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। দেশ স্বাধীনের চার বছর না পেরোতেই তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শুরু হয় সামরিক শাসন। পঁচাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত এ ধারা চলতে থাকে। এ সময় জাতি কখনও সামরিক শাসনের মোড়কে পেয়েছে গণতন্ত্র। আবার কখনও গণতন্ত্রের মোড়কে সামরিক শাসন।

দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালে দেশে আবার গণতন্ত্রাতিক ধারা শুরু হয়। মাঝের দুই বছর ছাড়া এখন পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত আছে। এমনকি গণতান্ত্রিক ধারা পাশ কাটিয়ে সামরিক শাসন বা ভিন্ন কিছু যাতে আসার সুযোগ না পায় সে জন্য ইতোমধ্যে আইনি কাঠামোতেও আনা হয়েছে পরিবর্তন।

নানা সূচকে উন্নয়নের বিপরীতে দুর্নীতি দমন ও সুশাসনে বাংলাদেশের সুখবর নেই। বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২তম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। আগের বছর ছিল ১৪তম। অবশ্য ২০০১ সাল থেকে টানা পাঁচ বছর বাংলাদেশ দুর্নীতিতে শীর্ষেই ছিল। পরে ধীরে ধীরে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। অবশ্য সেই ধারায় এবার দুই ধাপ অবনতিও হয়েছে।

আইনের শাসন সূচকে ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বাংলাদেশের অবনতি হয়। বিশ্বের ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৪তম। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ। বৈশ্বিক আইনের শাসন সূচকের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ১২৮টি দেশের মধ্যে ১২২তম অবস্থানে ছিল। সেই হিসেবে বাংলাদেশ এ বছর তার আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়েছে।

স্বাধীনতার চার দশকেরও বেশি সময় পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। বিচার করেছে সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনারও। মানিলন্ডারিং বন্ধে কঠোর আইন করেছে। মাদকের বিরুদ্ধে ঘোষণা হয়েছে জিরো টলারেন্স নীতি।

তিন দশক ধরে দেশে টানা গণতন্ত্র থাকলেও এটি এখন অস্থিতিশীল। সংসদে সরকারি ও বিরোধী দল একাট্টা হয়ে গেছে। চলতি একাদশসহ আসন ভাগাভাগি করে সর্বশেষ তিনটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বর্তমান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। যার কারণে সংসদে তারা কার্যকর ভূমিকা পালনে পুরোপুরি সক্ষম হচ্ছে না।

অপরদিকে সংসদের বাইরে থাকা দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি অনেকটা কোণঠাসা। রাজনীতির মাঠে তাদের দৃশ্যত কোনও অবস্থানই নেই। এজন্য তারা ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দাবি করছে, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও জনবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণেই বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন। সংসদেও তাদের প্রতিনিধিত্ব দুর্বল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জন্মলগ্নে বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন ছিল। বঙ্গবন্ধু সেই অস্তিত্বকে প্রশ্নাতীত করেছিলেন। তাঁর সময়ে বাংলাদেশ শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। এই সামগ্রিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্ব কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন অবিশ্বাস্য উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববাসী যা ভাবতে পারেনি, তাই করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ। একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো বাংলাদেশকে। এখন নিন্দুকেরাও আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। আর্থ-সামাজিক সব সূচকেই বাংলাদেশ তার অপ্রতিরোধ্য সক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছে।

/ইএইচএস/এফএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ