X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বন্দিদশায় কেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবার

এমরান হোসাইন শেখ
২৬ মার্চ ২০২২, ১০:০০আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২২, ১৮:২৩

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এর পরপরই তাঁকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেই রাতে তাঁকে আটক করে রাখা হয় তৎকালীন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে (বর্তমানে শহীদ আনোয়ার উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে)। পরদিন তাঁকে নেওয়া হয় ফ্ল্যাগস্টাফ হাউজে। ১ এপ্রিল সেখান থেকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বিমানে করে করাচিতে স্থানান্তর করা হয়। এরপর আরেকটি বিমানে রাওয়ালপিন্ডি এবং শেষ পর্যন্ত তার জায়গা হয় উত্তর পাঞ্জাবের শহর মিয়াওয়ালির কারাগারে। এখানেই তিনি যুদ্ধের পুরো সময়টি কারাবন্দি ছিলেন।

এদিকে ২৫ মার্চের বিভীষিকা শুরু হওয়ার আগেই শেখ কামাল ছাত্রদের সঙ্গে ব্যারিকেড গড়ে তুলতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েন। বাড়িতে ছিলেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় অন্তঃসত্ত্বা থাকায় বোন শেখ রেহানা ও  খালাতো বোন জলিকে সঙ্গে নিয়ে আগেই স্বামী বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ধানমন্ডির ১৫ নম্বর রোডের বাড়িতে চলে যান। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর, বেগম মুজিব দুই সন্তান শেখ রাসেল ও শেখ জামালকে নিয়ে অসহায় অবস্থায় আশ্রয় নেন পাশের বাড়িতে।

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের খবর শুনে পরিবারের সদস্যদের অবস্থা জানতে ওয়াজেদ মিয়া ২৭ মার্চ ৩২ নম্বরের বাড়িতে গেলে পাশের এক বাসা থেকে জানতে পারেন, শাশুড়ি তার (ওয়াজেদের) বাসার উদ্দেশেই রওনা হয়েছেন। তবে সেখানে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে শেখ হাসিনা ও জলিকে মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় বন্ধু ড. মোজাম্মেল হোসেনের বাসায় যান ওয়াজেদ মিয়া। আর বেগম মুজিব, শেখ রেহানা, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলকে নিয়ে চলে যান ওয়ারীর একটি বাসায়।

এরপর ড. ওয়াজেদ মিয়া আণবিক শক্তি কেন্দ্রের কর্মকর্তা পরিচয়ে ১ এপ্রিল থেকে খিলগাঁও চৌধুরী পাড়ায় ফ্ল্যাট ভাড়া করে সবাইকে নিয়ে ওঠেন। কিন্তু ৫-৬ দিন পর বাসার বাড়িওয়ালি এসে বেগম মুজিবকে বাড়ি ভাড়া ফেরত দিয়ে বললেন, ‘আপনাদের পরিচয় জানাজানি হয়ে গেছে। আল্লাহর দোহাই, আপনারা দয়া করে এই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তা না হলে পাকিস্তানি আর্মিরা আমাদের বাড়িটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবে।’

পরে উপায়ন্তর না দেখে বেগম বদরুন্নেসার স্বামী নূর উদ্দিন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি মগবাজার চৌরাস্তার কাছে প্রধান সড়কে অবস্থিত তার বাড়ির নিচতলায় তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু বাড়িটির সামনে অচেনা পশ্চিম পাকিস্তানি লোকের আনাগোনা ও মাঝে মধ্যে পাকিস্তান আর্মির ট্রাক থামার কারণে বেগম মুজিবের পরামর্শে ওই বাসার কাছাকাছি একটি বাড়ির দোতলা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হয়। ওই বাসায় কেটে যায় প্রায় ১৫ দিন।  

মগবাজারের ওই বাসা থেকে ১৯৭১ সালের ১২ মে সন্ধ্যার দিকে বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারকে গ্রেফতার করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের ২৬ নম্বর বাড়িতে নেওয়া হয়। এরপর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে এই বাড়িতেই গৃহবন্দি করে রাখা হয়। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ১৭ ডিসেম্বর সম্মিলিত বাহিনী এসে পাকবাহিনীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং সেই সঙ্গে মুক্তি পান বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল।

ওই সময়কার ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জনক আমার নেতা আমার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘...২৫ মার্চ রাত একটার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি আক্রমণ করে প্রচণ্ড গোলাগুলি চালায় এবং পরদিন ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় আবার আমাদের বাড়ি আক্রমণ করে। শেখ জামাল ও রাসেলকে নিয়ে আমার মা বেগম মুজিব ওই বাড়িতেই ছিলেন। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেখ কামাল ২৫ মার্চ রাতেই ছাত্রদের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চলে যায়। পিতার গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ পেয়ে কামাল কারফিউর ভেতরেই গেরিলা কায়দায় ৫০টি বাড়ির দেয়াল টপকে সন্ধ্যায় মাকে দেখতে আসে। বাড়ি আক্রমণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেয়াল টপকে সন্তানদের নিয়ে আমাদের মা পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। দিনের পর দিন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় লুকিয়ে দিন কাটান। অবশেষে হানাদার বাহিনী মাকে মগবাজারের একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে এনে বন্দি রাখে। বন্দি অবস্থায় ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অনেক মানসিক যন্ত্রণা ও অত্যাচার ভোগ করেন। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্তিলাভ করেন। মুক্তিলাভের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ওপরে হানাদার বাহিনীর টানিয়ে রাখা পাকিস্তানি পতাকা টুকরো টুকরো করে ফেলেন। পা দিয়ে মাড়ান ও আগুন লাগিয়ে দেন। নিজেই জয় বাংলা স্লোগান দিতে শুরু করেন।’

এদিকে গত বছর (২০২১) মায়ের জন্মদিনে স্মৃতিচারণকালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে বাসায় তাদের গ্রেফতার করে রাখা হয়, তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘এ বাসা ও বাসা করে মগবাজারের একটা বাসা থেকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাওয়া হলো। ১৮ নম্বর রোডের একতলা বাসায় রাখা হলো। খোলা বাড়ি। কিছু নাই, পর্দা নাই। রোদের মধ্যে আমাদের পড়ে থাকতে হয়েছে, দিনের পর দিন। মাকে কিন্তু কখনও ভেঙে পড়তে দেখিনি। সবসময় একটা আত্মবিশ্বাস ছিল, সাহস ছিল, সে সাহসটাই দেখেছি। এরপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর সারেন্ডার করে, আমরা কিন্তু সেদিন মুক্তি পাইনি, আমরা মুক্তি পেয়েছি একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর।’

অপর একটি বইয়ে গ্রেফতার হওয়ার আগের ঘটনার বর্ণনা করে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘সেই সময় থেকেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আশ্রয়ের সন্ধানে আমাদের ঘুরতে হয়েছে। আর ৩২ নম্বর বাড়িটা হানাদার বাহিনী দখল করে রাখে। দুই মাসের মধ্যে ১৯ বার আমরা জায়গা বদল করে করে এ বাড়ি সে বাড়ি লুকিয়ে থাকি। খাওয়া-দাওয়ার কোনও ঠিক নেই। আজ  এখানে তো কাল ওখানে। এভাবেই দিনের পর দিন কাটে। রাতে ঘুমাবার জায়গাও নেই।’

এদিকে শেখ হাসিনার ‘রচনা সমগ্র’ বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় জটিলতার প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘যে সময়টায় সন্তান পেটে থাকলে খাবারের রুচি চলে যায় এবং অনেক কিছু খেতেও ইচ্ছে হয়, ঠিক সেই সময়টায় এই বিপর্যয়। খাবার ইচ্ছে হলেও পাবো কোথায়? এই অবস্থায় দিন যাচ্ছে। মা আমাকে এ অবস্থায় ফেলে কোথাও যেতে পারছেন না। কামাল ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চলে গেছে। আর আমরা আজ এক জায়গায় তো কাল আরেক  জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছি। ঠিক এমনই অবস্থায় মগবাজারের একটা বাড়ি থেকে আমরা গ্রেফতার হলাম। আমাদের ধানমন্ডি ১৮ নম্বর সড়কের একটা বাড়িতে এনে রাখা হলো। গোটা পরিবারের জন্য একখানা কম্বল ও একখানা চেয়ার দিয়েছিল। রান্না, খাবার, কোনও কিছুই ছিল না। দুপুরে আমাদের গ্রেফতার করেছে। দুপুরের খাবারও খাওয়া হয়নি। এ অবস্থায় সারা দিন ও সারা রাত কাটাতে হয়েছিল।’

প্রসঙ্গ জয়ের জন্ম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর (২০২১) ২৭ জুলাই ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫০তম জন্মবার্ষিকীতে ছেলের জন্মের সময়কার ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই জয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন।

স্মৃতিচারণকলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ দেশের কোথাও কেউ পাকিস্তানের পতাকা ওড়ায়নি। দেশের সবখানে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। ওই সময় ইয়াহিয়া খান ঢাকায়। সেদিন তাকে সবাই অস্বীকার করেছিল। ৩২ নম্বরের বাড়িতেও আমার বাবা সেদিন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন।’

ওই সময় প্রধানমন্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিলেন উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের ১৮ নম্বর রোডের  অনেকটা পরিত্যক্ত একটি একতলা বাসায়  রাখা হয়। যখন আমার সন্তান প্রসবের সময় হয়েছিল পাকিস্তানি মিলিটারিরা আমাকে হাসপাতালে যেতে দিয়েছিল। কিন্তু আমার মাকে তারা যেতে দেয়নি। হাসপাতালে তখন ডাক্তার নূর ইসলাম সাহেব ছিলেন। আমাদের সুফিয়া খাতুন, ডাক্তার ওয়াদুদ সাহেব ছিলেন। আমাদের মুহিত সাহেবের বোন প্রফেসর সাহলাও ছিলেন। জয়ের জন্মটা মেডিক্যাল কলেজই হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমি যখন বন্দি, সেই বন্দি অবস্থায় জয়ের জন্ম। জন্মের পর যখন জয়কে নিয়ে আমি ফিরে আসি বাংলোতে, সেই কারাগারেই। আমি জয়কে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ানো। পাকিস্তানি একজন কর্নেল জিজ্ঞেস করে, ‘ওর নাম কী’? আমি বলি যে, ‘জয়’। তিনি বলেন, ‘জয় মানে’! তো আমি বলি, ‘জয় মানে জয়, জয় মানে ভিক্টরি’। তো খুব ক্ষেপে যায়। শিশু তাকেও তারা গালি দেয়। কাজেই এরকম একটি পরিবেশে জয়ের জন্ম। আমরা সেখানে হলেই (খোলা ঘর) থাকতাম। কোনও প্রাইভেসি ছিল না।’

ওই সময় খাওয়া-দাওয়ার কোনও ঠিক ছিল না উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওকে (জয়কে) নিয়ে যখন একটা বাড়ি থেকে আরেকটা বাড়িতে শেল্টার নেই, জানি না কীভাবে বেঁচে ছিলাম। খাওয়া-দাওয়ার কোনও ঠিক ঠিকানা ছিল না। শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতাম, আমার বাচ্চাটা যেন একটি সুস্থ বাচ্চা হয়। আমার মাও সবসময় সেই দোয়া-ই করতেন।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে ৫টি চুক্তি এবং ৫টি সমঝোতা স্মারক সই
সর্বশেষ খবর
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা