X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন কাদের

রক্তিম দাশ
২৬ মার্চ ২০২২, ১০:০৩আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২২, ১৭:১১

কলকাতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম জীবিত সাক্ষী কাদের মিঞা, ডাক নাম খোকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন কলকাতার পাকিস্তান উপ-দূতাবাসের পিয়ন। বাংলাদেশের বাইরে ওই দূতাবাসেই প্রথম ওড়ানো হয় বাংলাদেশের পতাকা। আর উপ-দূতাবাসটির স্বাধীনতার ঘোষণার যে দলিল, রাতভর তার সাতশ’ কপি প্রস্তুত করেছিলেন কাদের। পৌঁছে দিয়েছিলেন গণমাধ্যমের কার্যালয়গুলোতে। থাকতেন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনিও।

১৯৫৩ সালে কলকাতার পাকিস্তান উপ-দূতাবাসে কর্মরত জনৈক সাত্তার ১৬ বছর বয়সী কাদের মিঞাকে নিয়ে আসেন অস্থায়ী কর্মী হিসেবে। তখন উপ-রাষ্ট্রদূত ছিলেন খাজা নাসুরউল্লা। ১৯৬৮ সালে কাদের মিঞা হয়ে যান উপ-রাষ্ট্রদূতের মেসেঞ্জার।

ভালোই চলছিল। এরই মধ্যে এসে গেলো উত্তাল সত্তর। পাকিস্তান জাতীয় সংসদে ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলো আওয়ামী লীগ। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী করতে টালবাহানা শুরু করলো। তার ছোঁয়া এসে লাগে কলকাতা উপ-দূতাবাসেও। তখন উপ-রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী, প্রেস সচিব মকসুদ আলী। আর ছিলেন আনোয়ার করিম চৌধুরী।

’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর থেকেই কাদের বুঝতে পারছিলেন কিছু একটা হতে যাচ্ছে। উপ-দূতাবাসের ভেতর অবাঙালিরা বাঙালিদের সন্দেহ করছে। খলিল নামের এক পাকিস্তানি সেনা-গোয়েন্দা একদিন তাকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি সাচ্চা মুসলমান। দাড়ি রাখো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ো। ঠিক করে বলো, এই মিশনে কারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে?’

কাদের চোয়াল শক্ত করে ঠান্ডা মাথায় মিথ্যা বলেছিলেন, ‘আমি কিছু জানি না, স্যার। এখানে কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক নাই।’

কাদের ততদিনে জেনে গিয়েছিলেন, পাকিস্তানি সরকারের চাকরি করলেও মিশনের সব বাঙালিই দেশের স্বাধীনতা চাইছেন। আর ভারতের নাগরিক হয়ে তিনিও তাই চান।

মকসুদ আলী খুব ভালোবাসতেন কাদেরকে। সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতেন নিজের চাচাতো ভাই বলে। কাদের তখন তার সঙ্গেই থাকেন। অফিসের কাজের পর বাসায় গিয়ে মকসুদ সাহেবের জন্য রান্না করেন। এই সময় খবর এলো মকসুদ সাহেবকে ১৫ দিনের মধ্যে লাহোর যেতে হবে।

কাদেরকে তিনি বললেন, ‘ভিক্ষা করে খাবো। তা-ও ওই খুনিদের পাকিস্তানে যাবো না। একটা কিছু করতেই হবে।’

এদিকে প্রতিদিনই দূতাবাসের বাইরে মঞ্চ করে পাকিস্তানকে গালিগালাজ শুরু করলো কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশিরা। তারা উপ-রাষ্ট্রদূত হোসেন আলীকে ‘রাজাকার’, ‘পাকিস্তানের দালাল’ বলে মাইকে চিৎকার করতো, স্লোগান দিতো।

একদিন থাকতে না পেরে হোসেন আলীকে কাদের বললেন, ‘স্যার কিছু একটা করেন। এরা আপনাকে গালিগালাজ করছে।’ ‘এখনও সময় হয়নি’, বললেন হোসেন আলী।

কাদের মিঞা

এভাবেই দিনে দিনে উত্তাল হতে থাকল পরিস্থিতি। এল ১৭ এপ্রিল। আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি পড়ছে। মকসুদ সাহেব বিকালে কাদেরকে বললেন, ‘আজ রাতে বাসায় যেও না। কাজ আছে’। কাদের বুঝলেন, সময় হয়েছে।

রাত সাড়ে ১২টা। মিশনে মাত্র চার জন। হোসেন আলী, মকসুদ আলী, আনোয়ার চৌধুরী আর তিনি। হোসেন সাহেবের ঘর থেকে একটা কাগজ নিয়ে এসে মকসুদ সাহেব বললেন, ‘কাদের, এই নাও। এটা ৭০০ কপি সাইক্লোস্টাইল করে ফেলো। কাল সকালেই লাগবে।’

সাইক্লোস্টাইল করতে করতে কাদের পড়ছেন, ‘আমি হোসেন আলী। আমি ২২ বছরের পাকিস্তান সরকারের চাকরি থেকে পদত্যাগ করছি। পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশন থেকে ইস্ট পাকিস্তান বেশি দূরে না। পাকিস্তানিরা যে অত্যাচার করছে আমার দেশবাসীর প্রতি তা আমি সহ্য করতে পারছি না। তাই ছাড়লাম...।’

ভোর নাগাদ কাজ শেষে হাতের ঘোষণাপত্রটা দেখলেন কাদের। তাতে লেখা, ‘আজ থেকে এই দূতাবাস আর বর্বর পাকিস্তানিদের নয়, বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্রের দূতাবাস।’

ততক্ষণে হোসেন আলী সাহেবের ঘরে চলে এসেছে সবুজের ওপর স্বাধীন বাংলার মানচিত্র আঁকা পতাকা।

বিনিদ্র রজনী কাটানো ক্লান্ত মকসুদ সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘কাদের চা করো এবার। চা নিয়ে হোসেন সাহেবের ঘরে ঢুকে কাদের শুনতে পেলেন, ‘আজ রবিবার। আর্মির লোক পাকিস্তানি ৩৩ জন, আর আমরা ৬৫। ওরা আজ আসবে না। ১১টার দিকে গিয়ে মওলানা সাহেবকে ডেকে আনতে হবে। তারপর...।’

মওলানা সিদ্দিক সাহেব এলেন সকাল সাড়ে ১১টায়। হাইকমিশনের ছাদের ফ্ল্যাগস্টান্ডের নিচে লাগানো হলো বাংলাদেশের পতাকা। স্ট্যান্ডের মাথায় তখনও পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। দূতাবাসের বাইরে তখনও বাংলাদেশিরা জোরে জোরে স্লোগান দিচ্ছে- ‘রাজাকার, রাজাকার।’

ঘড়িতে ১১টা ৫৫ মিনিট।

ধীর পদক্ষেপে ফ্ল্যাগস্টান্ডের দিকে এগিয়ে চললেন উপ-রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী, সঙ্গে মকসুদ আলীসহ অন্যরা। তাদের দেখে স্লোগান আরও তীব্র হলো। কান পাতা দায়—‘রাজাকার-রাজাকার, পাকিস্তানের দালাল।’

হঠাৎ থেমে গেলো স্লোগান। মুখরিত কোলাহল পরিণত হলো পিনপতন নিস্তব্ধতায়। পাকিস্তানের পতাকা নিচে নেমে গেছে। ধীরে ধীরে উঠছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। মুহূর্তের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে চিৎকার করে উঠলেন হোসেন আলী, ‘জয় বাংলা’। গলা মেলালেন মিশনের সব বাঙালি। কান্নাভেজা গলায় কাদেরও চেঁচিয়ে বললেন, ‘জয় বাংলা’।

মিশনের বাইরে নিচের মঞ্চে বাংলাদেশিরা আনন্দে নাচতে নাচতে স্লোগান দিচ্ছেন। বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বাইরে প্রথম উঠল স্বাধীন বাংলার পতাকা। মাইকে তখন বাজছে- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’।

খুলে গেলো মিশনের লোহার দরজা। দলে দলে বাংলাদেশিরা মিশনে ঢুকে জড়িয়ে ধরলেন হোসেন আলীসহ সবাইকে।

ভিড়ের মধ্যে মকসুদ সাহেব বললেন, ‘কাদের, ওই সাইক্লোস্টাইল চিঠিগুলো পিটিআই, ইউএনআই, আকাশবাণী, বসুমতি, যুগান্তর, আনন্দবাজারে দিয়ে এসো। ওদের বলো, আজ আমরা স্বাধীন।’

এরপর স্বাধীন হলো বাংলাদেশ, পেরিয়ে গেলোো আরও তিন যুগ। ২০০৩ সালে চাকরি হারালেন কাদের। তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রদূতের কাছে আবেদন করেছিলেন তার একটি ছেলেকে অন্তত যেন চাকরি দেওয়া হয়। কিন্তু ওই আবেদনের সাড়া পাননি কাদের। এমনকি চাকরির শেষ দিনটিতে পাননি কোনও বিদায় সংবর্ধনা।

আজ কেউ মনে রাখেনি ভিনদেশি কাদেরকে। মনে রাখেনি- প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের কথা রেখে সংগ্রামের ছয় মাস বেতন নেননি। কলকাতা থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে এক গণ্ডগ্রামে নিভৃতেই তিনি আছেন। মৃত্যুর আগে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের কথা স্মরণ করে সজল চোখে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘কলকাতায় বঙ্গবন্ধু এসে বলেছিলেন, কিছুই আনতে পারিনি তোমাদের জন্য, নিয়ে এসেছি ভালোবাসা। ওই ভালোবাসা নিয়ে এখনও বেঁচে আছি।’

/এফএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট
খেলাধুলার মধ্য দিয়ে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি: প্রধানমন্ত্রী
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
সর্বশেষ খবর
প্রস্তুত বলী খেলার মঞ্চ, বসেছে মেলা
প্রস্তুত বলী খেলার মঞ্চ, বসেছে মেলা
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
দুই মাসে ব্র্যাক ব্যাংকে আড়াই হাজার কোটি টাকা নিট ডিপোজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন 
দুই মাসে ব্র্যাক ব্যাংকে আড়াই হাজার কোটি টাকা নিট ডিপোজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন 
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি হয়নি
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি হয়নি
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা