X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

চৈত্র সংক্রান্তির পুরনো আমেজ কোথায়

সাদ্দিফ অভি
১৩ এপ্রিল ২০২২, ০৮:০০আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২২, ১৬:০৪

চৈত্র মাস শেষ হতে চললো। দুয়ারে কড়া নাড়ছে বাংলা নববর্ষ। শুরু হবে বৈশাখ। নতুন বছর বরণের প্রস্তুতি সর্বত্র। একসময় চৈত্র মাসের শেষ দিন উৎসব পালন করা হতো। চৈত্রসংক্রান্তির আয়োজনে অনেক ক্ষেত্রেই ভাটা পড়েছে। কালের বিবর্তনে বাংলার ঐতিহ্যটি চাপা পড়েছে বৈশাখের উদ্দীপনায়। 

চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভাবা হয়ে থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল চড়ক পূজা। এটি মূলত বাঙালি হিন্দুদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোক উৎসব। নববর্ষের প্রথম দুই-তিন দিন চড়ক পূজার উৎসব চলে। লিঙ্গপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিবের আরাধনা এবং উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার বিষয়টি পাওয়া যায় না। তবে পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এই উৎসব প্রচলিত ছিল। ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ সরকার আইন বানিয়ে বন্ধ করলেও গ্রামবাংলার যেসব অঞ্চল মূলত কৃষিপ্রধান, সেখানেই চড়ক পূজা উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

চৈত্র সংক্রান্তির গোধূলি লগ্নে বেসমা পূজা করতো উত্তরাঞ্চলের মানুষ। পূজার সময় ঘরের দরজায় বাগাচূড়া (চ্যাপ্টা পাতা ও কাঁটাযুক্ত বনজ লতা), বিষ ঢেঁকিয়া (ফার্ন), বিষ কুণ্ডলী (বিষকাঁটালী), রসুন, পেঁয়াজ একসঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। এগুলো অশুভ শক্তিনাশের প্রতীক বলে বিশ্বাস করে এই অঞ্চলের মানুষ।

চৈত্র সংক্রান্তিতে শাকান্ন উৎসবের প্রচলন ছিল। দিবসটিতে গ্রাম-বাংলার নারীরা ঝোপ-জঙ্গল থেকে প্রথা মেনে ১৪ রকমের শাক তুলে আনতেন। সেই শাক একসঙ্গে রান্না করে এই দিনে খাওয়া হয়। এখনও পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের অনেক স্থানে এভাবে ঝোপ-জঙ্গল থেকে শাক তুলে এনে খাওয়ার রীতি রয়েছে। প্রথাটি শাকান্ন উৎসব নামে পরিচিত। কোথাও কোথাও চৈত্র সংক্রান্তির দিনে নিরামিশ খাওয়ার প্রথা রয়েছে। দিনটিতে ঘরে আমিষ আনা নিষেধ।

পুরনো বিষাদের ছায়াকে বিদায় দিয়ে চৈত্র সংক্রান্তিতে তিতা খাবারের প্রচলন ছিল একসময়। এখনও দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে এর প্রচলন আছে। এছাড়া চৈত্র সংক্রান্তিকে অবলম্বন করেই হালখাতা উৎসবের জন্ম নিয়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। জমিদারির খাজনার হিসাব-নিকাশ হতো চৈত্র সংক্রান্তির দিনে। সারাবছর কে কত খাজনা জমা করেছে এবং কার কত খাজনা বাকি রয়েছে, সেসব চৈত্র সংক্রান্তির মধ্যে চূড়ান্ত হতো। এরপর পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষের দিনে নতুন খাতায় সেই হিসাব তোলা হতো। এটি হালখাতা নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে এই হালখাতার চল দোকানে-দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। দোকান মালিকরাও ক্রেতাদের হিসাব-নিকাশ নতুন খাতায় তুলে রাখতে শুরু করেন নববর্ষের দিনে।

চৈত্র সংক্রান্তিতে তালতলার ফিরনি তৈরি করার চল আছে বহুদিনের। দিনটিতে প্রতিটি বাড়ি থেকে চাল, তালের গুড় ও দুধ সংগ্রহ করা হয়। যে বাড়িতে এগুলো থাকে না তারা অর্থ দিয়ে দেয়। এরপর গ্রামের কোনও তালগাছের নিচে বা বটগাছের নিচে এসব জিনিস দিয়ে তৈরি হয় ফিরনি। এটাই তালতলার ফিরনি নামে পরিচিত। এরপর খাবারটি গ্রামের মানুষের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়।

চৈত্র সংক্রান্তির আরেক আয়োজন নীল উৎসব। গায়ে লাল কাপড় ও গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে মাথায় পাগড়ি বেঁধে এবং হাতে ত্রিশূল নিয়ে শিব সাজে কেউ। দেবী পার্বতীর সাজে থাকে একজন। তাদের সঙ্গে খোল-করতাল, ঢাক-ঢোল নিয়ে কিছু মানুষ মেতে ওঠে নীল উৎসবে। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে তারা দলে দলে বাড়ি বাড়ি ঘোরে এবং শিব-পার্বতীর গান গেয়ে বেড়ায়। সঙ সেজে থাকা এই দলকে বলা হয় নীল। তাদের একজন দলপতি থাকে, যিনি বালা নামে পরিচিত। তিনি নীল ঠাকুরকে হাতে ধরে থাকেন। বাড়ির উঠোন লেপে বা কোনও গৃহস্থ উঠোনে আল্পনা দিয়ে দেয়। সেখানেই নীলকে প্রতিষ্ঠা করে চলে নীলের নাচ বা শিবের গাজন। এটাই নীল উৎসব নামে পরিচিত।

চৈত্র সংক্রান্তিতে আরেকটি বড় আচার-অনুষ্ঠান হলো গম্ভীরা নাচ। আজও বরেন্দ্র অঞ্চল এবং রাজশাহীতে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। গম্ভীরা নাচের সঙ্গে হয় গম্ভীরা পূজা এবং শিবের গাজন। এদিন আরেক উৎসব বিজু বা বৈসাবি উৎসব পালন করে পাহাড়ের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা। চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে এই উৎসবের আমেজ এখনও দেখা যায়। বৈসাবি নামের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ত্রিপুরার বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসব। উৎসব তিনটির অদ্যাক্ষর মিলে হয়েছে ‘বৈসাবি’।

তবে বিজু বা বৈসাবী পালিত হয় দুই দিন ধরে। চৈত্র সংক্রান্তি এবং পয়লা বৈশাখ নিয়ে এই উৎসব। এছাড়া চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন হয় ফুল বিজু উৎসব। এদিন চাকমা সম্প্রদায়ের মেয়েরা ফুল সংগ্রহ করতে পাহাড়ে যায়। তাদের সংগ্রহ করা ফুলকে তিন ভাগ করা হয়। এক ভাগ দিয়ে বুদ্ধদেবকে পূজা করা, এক ভাগ জলে ভাসিয়ে দেওয়া এবং বাকি এক ভাগ দিয়ে ঘর সাজানো হয়। 

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে পালিত হয় মূল বিজু। এদিন সকালে বুদ্ধদেবের মূর্তিকে স্নান করানো হয়। ছেলেমেয়েরা নদী বা কাছের জলাশয় থেকে জল বয়ে নিয়ে এসে বৃদ্ধ দাদু-দিদিমাকে স্নান করিয়ে আশীর্বাদ নেয়। 

এছাড়া চৈত্র মাসের শেষ দিনে পাজন নামে অভিনব রান্নার আয়োজন করা হয় চাকমা সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে। পাজন হলো নানা সবজির মিশ্রণে তৈরি একটি তরকারি। এদিন বাড়িতে যেসব বন্ধু বা অতিথিরা আসে তাদের এই পাজন দিয়ে আপ্যায়ন করেন চাকমারা। তাদের ধারণা, বছর শেষের দিনে সব ধরনের সবজি দিয়ে তরকারি খেলে মঙ্গল হয়। এতে নতুন বছরে শুভ সূচনা হয়। তাছাড়া পুরান ঢাকায় দীর্ঘদিন ধরে চৈত্র সংক্রান্তিতে পালিত হয়ে আসছে ঘুড়ি উৎসব। এদিন আকাশ ছেয়ে যায় রঙ-বেরঙের নানান আকারের ঘুড়িতে।

তবে এসব আয়োজনের অনেক কিছুই এখন আর আগের মতো নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি কাজল দেবনাথ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চৈত্র সংক্রান্তির চল কিছুটা কমেছে। তবে গ্রামে এখনও কিছুটা টিকে আছে। শহর এলাকায় চৈত্র সংক্রান্তির আয়োজন কমে গেছে। তবে পুরান ঢাকায় চৈত্র সংক্রান্তির বিশাল আয়োজন দেখা যায়। আমাদের শহুরে জীবনে চৈত্র সংক্রান্তিকে ছাপিয়ে গেছে পহেলা বৈশাখ। পুনো বছর বিদায় দিয়ে নববর্ষ বড় পরিসরে উদযাপন করা হয়।’

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের এই নেতা উল্লেখ করেন, ‘আমাদের হিন্দু সংস্কৃতির অনেক উৎসব চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে। আগে এসব উদযাপন বেশ বড় আকারে হতো। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন পহেলা বৈশাখের চেয়ে আয়োজন বেশি ছিল চৈত্রসংক্রান্তিতে। পিঠা-পায়েস তৈরির মাধ্যমে বছরকে বিদায় দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের লোকজ সংস্কৃতি ছিল। গ্রাম-গঞ্জে প্রত্যেকের ঘরে উৎসবের আমেজ ছিল। এসব লোকজ সংস্কৃতি এলাকা ভিত্তিক একেক রকম। যেমন পুরান ঢাকায় এদিন ঘুড়ি উৎসব হয় ব্যাপক আকারে। আরেকটি হচ্ছে শিবের গাজন। চড়ক পূজা ছিল একসময়, যদিও তা আইনিভাবে নিষিদ্ধ আছে। তবে গ্রামে কিন্তু এখনও এই উৎসব হয়।’

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শেষ করতে হবে
বাংলা নববর্ষ নির্বিঘ্নে উদযাপনে ঢাবির তিন কমিটি
‘আমরা তিমির বিনাশী' প্রতিপাদ্যে হবে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা
সর্বশেষ খবর
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
সর্বাধিক পঠিত
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!