X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শুরু থেকে বারবার রণকৌশল বদলের গল্প

উদিসা ইসলাম
০৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:০০আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:০০

এপ্রিলের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের নেতৃত্ব বুঝতে শুরু করেন নিয়মিত পদ্ধতি অবলম্বনে যুদ্ধ দীর্ঘ হবে। ফলে বাংলাদেশের নিজস্ব পদ্ধতি বের করতে তৎপর হন তারা। বেছে নেওয়া হয় গেরিলা পদ্ধতি। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী বিজয় পরবর্তী সময়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানান। আর মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, গ্রাম ও থানায় গঠিত বিভিন্ন বাহিনীর অতর্কিত হামলা ও গেরিলা পদ্ধতি পাকিস্তানি সৈন্যদের টালমাটাল করে দিতে সহায়তা করে।

নিয়মিত বাহিনী আর অন্য কোনও বাহিনীর মধ্যে পার্থক্য জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন বলেন, ‘‘মুক্তিবাহিনীর ‘নিয়মিত বাহিনী’ গঠন করা হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ, অন্যান্য আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে। এই বাহিনী দেশব্যাপী ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল এবং নিয়ন্ত্রণ ছিল সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে। অনিয়মিত বাহিনী, যাকে গণবাহিনী নামেও অভিহিত করা হয়, সেটা গঠন করা হয়েছিল গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের নিয়ে। এই বাহিনীর সদস্যরা ছিল মূলত ছাত্র, কৃষক, শ্রমজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মী। তাদের মূল দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের ভেতরে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে চকিত আক্রমণ চালানো এবং দ্রুত সরে পড়া (হিট অ্যান্ড রান)।’’

হেদায়েত হোসাইন মোরশেদকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জেনারেল ওসমানী ২৬ মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর, অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীর রণরীতি ও রণকৌশল এবং ৩ ডিসেম্বরের পরবর্তী পর্যায়ে সম্মিলিত বাহিনীর রাজনীতি ও রণকৌশল ব্যাখ্যা করেন।

জেনারেল ওসমানী বলেন, ‘সর্বপ্রথম যুদ্ধ হয় নিয়মিত পদ্ধতিতে, আর এই পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালু থাকে মে মাস পর্যন্ত। উদ্দেশ্য ছিল শত্রুকে ছাউনিতে যতটা সম্ভব আবদ্ধ রাখা এবং যোগাযোগের কেন্দ্রগুলো তাদের ব্যবহার করতে না দেওয়ার জন্য নিয়মিত বাহিনীর পদ্ধতিতে যুদ্ধ করা হয়েছিল। যত বেশি বাধা সৃষ্টি করা যায়, সেই সঙ্গে শত্রুর প্রান্ত ভাগে ও যোগাযোগের পথে আঘাত করতে হবে—মূলত এটাই ছিল নিয়মিত বাহিনীর যুদ্ধ পদ্ধতি।’

শুরুতেই নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি গেরিলা যুদ্ধের সামর্থ্য তৈরি করার বিষয়ে সতর্ক ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘থিওরি অনুযায়ী গেরিলা যুদ্ধ করে দেশ মুক্ত করতে হলে অনেক সময় লেগে যাবে। আমাদের সবচে বড় সম্পদ জনসম্পদ ধ্বংস হয়ে যাবে। সময় কমাবার জন্য আমাদের নিজেদের পদ্ধতি বানাতে হবে, সেটা শুরুতেই আন্দাজ করা গেছে। সেই পদ্ধতি হলো—বড় গেরিলা বাহিনী গঠন করে ভেতর থেকে শত্রুর আঁতে ঘা দিতে হবে। সে যেন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সংগঠিত না থাকতে পারে। এজন্য অনেক নিয়মিত বাহিনী দরকার ছিল। মে মাসের শুরুর দিকে সরকারকে লিখিতভাবে এটা জানাই। এই ভিত্তিতে মিত্রদের কাছ থেকে সাহায্য চাই। তাতে আমার উদ্দেশ্য ছিল—কমপক্ষে ৬০ থেকে ৮০ হাজার গেরিলা সমন্বিত বাহিনী এবং ২৫ হাজারের মতো নিয়মিত বাহিনী গড়ে তোলা। এই বাহিনী দ্রুত গড়ে তুলতে হবে। কারণ, একদিকে গেরিলা পদ্ধতি এবং সঙ্গে সঙ্গে শত্রুকে নিয়মিত বাহিনীর কমান্ডো ধরনের কৌশল দিয়ে শক্তিকে বণ্টন করার জন্য বাধ্য করতে হবে। যাতে তার শক্তি হ্রাস পায়।’

বিমান যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে জেনারেল ওসমানী বলেন, ‘আমাদের কাছে বিমান ছিল না। তবে শেষের দিকে কয়েকটি বিমান নিয়ে আমরা ছোটখাটো একটি বিমান বাহিনী গঠন করেছিলাম। যে বিমান পেয়েছিলাম তা ছিল—দুটো হেলিকপ্টার ও একটি আর্টার। হেলিকপ্টারগুলোতে মেশিন গান লাগিয়ে যথেষ্ট সজ্জিত করা হলো। আমাদের যেসব বৈমানিক স্থল যুদ্ধরত ছিলেন, তাদের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক নিয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে একটি ছোট বিমান বাহিনী গঠন করা হলো।’

মাঠে যারা যুদ্ধ করেছেন, তারা বলছেন—গেরিলা যোদ্ধা বাড়ানো দরকার মনে করেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়। যতই দিন যাচ্ছিল ক্রমশ করে উঠলো একটি বিরাট গণবাহিনী- গেরিলা বাহিনী।

যুদ্ধের নানা পর্যায়েও গেরিলা কৌশল খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল উল্লেখ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘গেরিলাদের সবচেয়ে বড় দক্ষতা হলো—তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারা। তারা হিট অ্যান্ড রান কৌশলে আক্রমণ পরিচালনা করতো। তারা আক্রমণ করে দ্রুত প্রস্থানের সময় শত্রুপক্ষের কিছু জিনিস হাতিয়ে নেবে, প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে হাইড আউটে চলে যাবে। আরেকটা প্রক্রিয়া ছিল অ্যাম্বুশ পদ্ধতি। শুরুতে রেকি করবে, শত্রুপক্ষ ওই এলাকায় কতবার আসা-যাওয়া করে, দলে কত জন থাকে—এসব জেনে নিয়ে শেষ রাতে টহলের ওপর আক্রমণ করা হতো।’ অ্যাম্বুশের দল কীভাবে নির্ধারণ হতো প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সামনে ১৫ জন,  একটু পেছনে ১০ থেকে ১৫ জন, বাম দিকে আরও ১০ জন। ডান-বামের সদস্যরা আক্রমণ করে না। সামনের ১৫ জন আক্রমণ করে সরে আসে।’

কৌশল বিষয়ে তিনি আরও তিনি বলেন, ‘প্রথমে আরভি-তে (রিগ্রুপিং ভেন্যু একত্রিত হওয়ার স্থান) বসে পরিকল্পনা করা হতো। কার দায়িত্ব কী হবে, কে কখন কোথায় অবস্থান নেবে। তারপর অ্যাটাক করে আরভিতে ফিরে আসবে, তবে ভিন্ন পথে। এটাই ছিল কৌশল। তবে আমাদের অপারেশনগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই আমরা আরভিতে ফিরতে পারিনি। যে যার মতো ছড়িয়ে পড়ে হতো। ১০-১৫ দিন পরে ভারতে গিয়ে পরস্পরের দেখা হয়েছে।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
আলাপচারিতায় ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম ও মানস ঘোষমুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবাদ সংগ্রহ
একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় সম্ভব মনে করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
‘৩০ লাখ শহীদের বিষয়টি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে লিপিবদ্ধ হলো’
সর্বশেষ খবর
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ