X
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কী ঘটতে পারে ঢাকায়?

রিয়াদ তালুকদার
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২০:২০আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৫:৫৭

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পের ভয়াবহতা বাংলাদেশেও তৈরি করেছে শঙ্কা। এরকম শক্তিশালী ভূমিকম্প যদি ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরে অনুভূত হয় তাহলে কী হতে পারে তা নিয়ে চলছে নানা রকম অনুমান-জল্পনাকল্পনা। ভূমিকম্প সহনশীল ভবন কতগুলো আছে, ভূমিকম্পের পর উদ্ধার অভিযান কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা-দক্ষতা কতটুকু এ নিয়ে চলছে আলোচনা।

যদি রিখটার স্কেলে ৭ বা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয় তাহলে রাজধানীর অধিকাংশ ভবন ধসে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া উদ্ধার তৎপরতা চালানোর দক্ষতাও তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি বলে অনেকের অভিমত। তবে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, ভূমিকম্পসহ যেকোনও ধরনের দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধার অভিযানে প্রস্তুত তারা।

পূর্বাভাস কি আছে?

২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ এবং কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ল্যামন্ট-ডোহার্টি আর্থ অবজারভেটরি সেন্টার পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে বাংলাদেশেও। মাটির নিচে ভারতীয়, ইউরেশিয়ান ও মিয়ানমার প্লেটের সংযোগস্থলের ওপর বাংলাদেশের অবস্থান। এ কারণেই এই ঝুঁকি।

উল্লেখ্য, মাটির নিচে পাথর ও অন্যান্য খনিজের বিশাল আকৃতির (শত বা হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ) খণ্ডগুলোকে প্লেট বলে। অনমনীয় এই প্লেটগুলো চলমান অবস্থায় থাকে। চলতে চলতে একটির সঙ্গে অন্যটির ঘর্ষণ বা সংঘর্ষের ফলে অনেক সময় ফাটল তৈরি হয়। মাটির নিচের ওই ঘর্ষণ বা ফাটল থেকে ভূপৃষ্ঠে ভূমিকম্প অনুভূত হয়।  

২০১৬ সালের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও মিয়ানমার টেকটনিক প্লেটের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান। এই প্লেট কয়েকশ’ বছর ধরে শক্তি সঞ্চয় করছে এবং গত একশ’ বছরে  বাংলাদেশে বা আশপাশের অঞ্চলে বড় কোনও ভূমিকম্প হয়নি। তাই যেকোনও সময় হতে পারে ভূমিকম্প। যার মাত্রা হতে পারে রিখটার স্কেলে ৮-এর কাছাকাছি। ভারত-বার্মা প্লেটের ওপরে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের অবস্থান হওয়ায় সেখানে ঝুঁকির মাত্রা বেশি। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে সেসব এলাকা।

এদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) গবেষকরা বলছেন, কোনও এলাকায় সাধারণত একশ বা দেড়শ’ বছর পর পর ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হতে পারে। সেই হিসাবে যেকোনও সময় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশে হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তারা জানান, ৮ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার শঙ্কা সাধারণত থাকে আড়াইশ’ বছর পর পর।

বুয়েটের গবেষকরা জানান, ১৮৭০ থেকে ১৯৩০ সালে পর্যন্ত ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও মিয়ানমার টেকটনিক প্লেটের বিভিন্ন জায়গায় ছয়টি বড় ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটির মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৫। আরেকটি হয়েছে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার।

১৮৬৯ সালে ভারতের কুচবিহারে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, ১৮৮৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে হয় ৭ দশমিক ১ মাত্রার, ১৮৯৭ সালে ভারতের আসামে ৭ দশমিক ৭ মাত্রা, ১৯১৮ সালে বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ও ১৯৩০ সালে আসামের ধুবরি জেলায় ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।

১৭৬২ সালের বার্মা যা বর্তমানে মিয়ানমার, এর আরাকানে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।

ক্ষয়ক্ষতি কী রকম হতে পারে?

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাভুক্ত এলাকায় ২০২২ সাল নাগাদ ২১ লাখের মতো পাকা ভবন রয়েছে বলে জানাচ্ছেন বুয়েটের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদরা। এরমধ্য বহুতল ভবন প্রায় সাত লাখ। তাদের হিসাবে, চট্টগ্রামে পাকা ভবন প্রায় চার লাখ, এর মধ্যে বহুতল ভবন প্রায় দেড় লাখ। সিলেটে দুই লাখের মতো পাকা ভবন, যার মধ্যে বহুতল ভবন এক লাখের বেশি। 

ভূতত্ত্ববিদদের শঙ্কা, যদি রিখটার স্কেলে ৭ বা ৮ এর কাছাকাছি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়, তাহলে রাজধানীর অধিকাংশ ভবন ধসে পড়বে।

এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর সৈয়দ হুমায়ূন আখতারের সঙ্গে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, অবস্থানগত দিক থেকে ভূ-অভ্যন্তরের তিন প্লেটের মাঝখানে পড়েছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় মাটির নিচে একই রকম যে কাঠামো রয়েছে, সেই কাঠামো বলছে এই যে বিপুল পরিমাণ শক্তি হাজার বছর ধরে সঞ্চিত হয়ে থাকে, সেই শক্তিটা ৬০ থেকে ৮০ ভাগ একবারে বের হয়ে যায়। তার আগে কিছু মৃদু ভূমিকম্প হয়। এরপর মাঝখানে মেইন শক যেটাকে বলা হয় সেটাই বিপুল পরিমাণ শক্তি নিয়ে নির্গত হয়। পরবর্তীকালে কয়েক মাস বছর ধরে ছোট ছোট ভূমিকম্প হতেই থাকে।

তিনি বলেন, সিলেটে আমরা যেটা জানি সব গ্যাসক্ষেত্র সেখানে। এরপর রয়েছে আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি। পাওয়ারপ্ল্যান্ট রয়েছে। যেগুলো একদম ভূমিকম্পের উৎসের ওপরে অবস্থিত। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে এগুলোর অস্তিত্ব তখন আর থাকবে না।

রাজধানী ঢাকা

ফায়ার সার্ভিস বলছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় মাটির নিচ দিয়ে সেবা সংস্থাগুলোর (গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ) বিভিন্ন লাইন গেছে। ভূমিকম্পের ফলে কোনও ভবন ধসে পড়লে সেসব সেবা লাইন উপড়ে যাবে। সেগুলো তখন জনজীবনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী হাসান আনসারী। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে বিল্ডিং নির্মাণের সময় ভূমিকম্প সহনশীল হিসেবে তা নির্মাণ করতে হবে। সঠিক ডিজাইন অনুযায়ী ভবন নির্মাণ হলেও ২৫ ভাগ ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক খন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, বাংলাদেশে আমরা যেটাকে বলি ভূমিকম্পপ্রবণ জোন, ভূমিকম্প হলে সেখানে মারাত্মক আকার ধারণ করবে। চট্টগ্রাম থেকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার কোথাও যদি ভূমিকম্প হয় তাহলে আমাদের ধারণা সেটি ৮ মাত্রার হতে পারে। ডাউকি ফল্টে যদি ভূমিকম্প হয় সেটাও ৮ মাত্রার হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে যে ধ্বংসস্তূপ তৈরি হবে বলে আমরা মনে করি, তার ২৫ পার্সেন্ট সরানোর সক্ষমতাও আমাদের তৈরি হয়নি।

কী করণীয়?

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীতে অনেক ক্ষেত্রে ভবনগুলোর ফায়ার সেফটি ব্যবস্থাপনা দেখতে গিয়ে ভবনের নকশার ত্রুটির বিষয়গুলো উঠে আসে। সেসব বিষয় দেখভাল করে রাজউক। তারা এ বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।

তারা আরও বলেন, ভূমিকম্প বা ভবন ধসের পর গ্যাস, বিদ্যুৎ বা পানির লাইন থেকে আরও দুর্ঘটনা এড়াতে বিকল্প অবকাঠামো দরকার। মাটির নিচে যেসব লাইন রয়েছে সেগুলোরও আধুনিকায়ন করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবনগুলো বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করা হলে ভূমিকম্প সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। এর জন্য খরচও খুব বেশি না। সেটা নির্ভর করে ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তির মনমানসিকতার ওপর। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে রাজধানীতে ঘনবসতি এলাকা কমিয়ে বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা।

এছাড়া পুরোনো ভবনগুলোতে বসবাসের বিষয়ে জনসচেতনতা ও সতর্কতা বাড়ানো উচিত বলেও তারা পরামর্শ দেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভূমিকম্প ঝুঁকি নিরূপণ করতে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেটসহ দশটি শহরের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ চলছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অনেকেই বলছেন ঢাকা শহরে যেকোনও সময় ভূমিকম্প অনুভূত হতে পারে। সেসব বিষয় মাথায় রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কিনেছি। জনবল প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ আমাদের জন্য ঝুঁকি। পুরান ঢাকার মতো যেসব সরু রাস্তা রয়েছে, কোনও ঘটনা ঘটলে সেসব জায়গায় পৌঁছানো কতটুকু সম্ভব হবে, তা এখনই চিন্তা করা উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও জলবায়ু সহনশীল বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শহর এলাকায় রেসকিউ অপারেশন চালানোর জন্য যে ধরনের দক্ষতা থাকতে হয় সে ধরনের দক্ষতা এখনও আমাদের নেই। তুলনামূলক অনেক কম। এর জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নেই। রিস্কি অপারেশন করতে গিয়ে মানুষের যেন কোনও অঙ্গহানি না হয়, মানুষ যেন আরও বিপদের মুখোমুখি না হয়, সেগুলো খেয়াল রাখতে হয়। বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানলে উদ্ধারকাজ চালানো কঠিন হবে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন।

/এফএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
যে জাদুঘরের পরতে পরতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
কাওরানবাজারে লা ভিঞ্চি হোটেলের জেনারেটর রুমে আগুন
ধোলাইখালে মিউচুয়াল ট্র্যাস্ট ব্যাংকের শাখায় আগুন
সর্বশেষ খবর
পুলিশের পরিশ্রম ও আত্মত্যাগে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে: আইজিপি
পুলিশের পরিশ্রম ও আত্মত্যাগে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে: আইজিপি
সংকট থেকে উত্তরণে তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান মেননের
সংকট থেকে উত্তরণে তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান মেননের
কানে ঝুলছে বাংলাদেশের দুল!
কান উৎসব ২০২৪কানে ঝুলছে বাংলাদেশের দুল!
ধোনি-জাদেজার লড়াই ছাপিয়ে প্লে অফে বেঙ্গালুরু
ধোনি-জাদেজার লড়াই ছাপিয়ে প্লে অফে বেঙ্গালুরু
সর্বাধিক পঠিত
মামুনুল হক ডিবিতে
মামুনুল হক ডিবিতে
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি
নির্মাণের উদ্দেশ্যে ভালো সড়ক কেটে ২ বছর ধরে খাল বানিয়ে রেখেছে
নির্মাণের উদ্দেশ্যে ভালো সড়ক কেটে ২ বছর ধরে খাল বানিয়ে রেখেছে
গরমে সুস্থ থাকতে কোন কোন পানীয় খাবেন? ইলেক্ট্রোলাইট পানীয় কখন জরুরি?
গরমে সুস্থ থাকতে কোন কোন পানীয় খাবেন? ইলেক্ট্রোলাইট পানীয় কখন জরুরি?